দিন চারেক হল খুন হয়েছে ও পাড়ার কালাম মিয়ার ছেলে সজিব মিয়া । প্রকাশ্য দিনে দুপুরে কে বা কারা জবাই করে খুন করেছে তাকে । এ নিয়ে মামলা হলেও এখনো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি পুলিশ । এদিকে ছেলে খুন হওয়ার পর থেকে কালাম মিয়ার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন । দানা পানি ছেড়ে দিয়েছে লোকটি । কিইবা করবে সে ? ভবে যে আপন বলতে আর কেউ রইলনা তার ! সজিব ছেলে হিসেবে খুব ভাল এবং নম্র-ভদ্র ছিল । কারো সাথে কোনদিনও ঝগড়া করতে দেখা যায়নি তাকে । তবে অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দেয়নি সে । এইতো সেদিন , খুন হওয়ার আগমুহূর্তে কয়েকজন সন্ডা-পান্ডা ছেলের লালসার হাত থেকে প্রাণ বাঁচাল যতীন চন্দ্রের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটার । হয়তো সে জের ধরেই খুন হয়ে থাকতে পারে সে ! যাকগে বাবা , ওসব ভেবে আমার কাজ নেই ! কোনদিন দেখা যাবে আমাকেও খুন করে ফেলে রাখা হয়েছে ঐ বড় রাস্তার মোড়ে ! – তাই বলে কি আমরা চুপ করে বসে থাকব ? অবাক হয়ে সুরেষের কাছে জানতে চাইল ফারুক । – তো কি করব ? আগাছা উপড়াতে গিয়ে নিজে উপড়ে যাব ! না বাবা ! মরণকে আমি ভীষণ ভয় পাই ! তার চেয়ে বরং কুলি মানুষ , দুবেলা খেটে এক বেলার খাবার যোগাড় করব । ওসব ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই আমাদের । ফারুক কিছু বললনা । তবে চেহারা দেখে মনে হল সুরেষের কথাগুলো ঠিক মেনে নিতে পারছেনা সে ।
রাতের বেলা সুরেষ আর ফারুক স্টেশন থেকে বাড়ির পথে হাঁটছে । এসময় চৌধুরীদের কলা বাগানের পথ ধরে যাওয়ার সময় হঠাত্ থমকে দাঁড়াল তারা । বাগানের মাঝখানটায় কেমন যেন খচ খচ শব্দ হচ্ছে । গাছের পাতাগুলোও কেমন যেন নড়ে উঠছে । অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে যেতে চাইল ফারুক । কিন্তু হাত ধরে আটকে দিল সুরেষ । মাথায় ইশারা করে বুঝাল ওখানে যাওয়া ঠিক হবেনা । কারণ রাত এখন অনেক । কমচে কম ১২ টা হবে । তাছাড়া অমাবস্যার রাত । ঘুটঘুটে অন্ধকার । যদি মন্দ কিছু হয়ে যায় ! তখন ? সুরেষের কথায় যুক্তি আছে । তাই আর ওদিকে না গিয়ে বাড়ির পথেই পুনরায় চলতে লাগল তারা । কিছুদূর যাওয়ার পর দুজনেরই মনে হল কেউ যেন তাদের পিছু নিয়েছে । ফারুক সাহস করে এগিয়ে চললেও সুরেষের কিন্তু প্রচন্ড ভয় হচ্ছে । মনে মনে রাম রাম জপ করা শুরু করে দিয়েছে সে । শরীরটা যেন ক্রমেই অবশ হয়ে যাচ্ছে তার । হাঁটতে গিয়ে পায়ে পায়ে বাড়ি খেয়েও খাচ্ছেনা ও । অবস্থা বুঝতে পেরে তাই সুরেষের কাঁধে হাত চেপে তাকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ফারুক । কিন্তু কিছুদূর যেতেই হঠাত্ মট মট শব্দ করে তাদের একেবারে পায়ের সামনে এসে পড়ল একটা ঝোপড়াল জামের ডাল । তাই থমকে দাঁড়াল তারা । কলিজাটা কেমন যেন কুঁচকে যেতে চাইল তাদের । শ্বাস-প্রশ্বাসওযেন থেমে গেছে ঠেকল । অনেক কষ্ট করে ভিতর থেকে একটা গরম হাওয়া যেন ঠেলে বের হয়ে আসল দুজনের । এসময় ধুপ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি । সাথে বয়ে চলল ভীষণ ঝড় । একেবারে গাছ পালা ভেঙে পড়ার মত দশা । অবস্থা বেগতিক দেখে তাই দৌড় লাগাল তারা ।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উঠল চেয়ারম্যান বাড়িতে । কিন্তু রাত বেশি হওয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই । এখন কি করবে তারা ? সুরেষ জিজ্ঞেস করল । ফারুক কিছু না বলে তড়ি গড়ি করে এগিয়ে চলল কামলা বাচ্চুর ঘরের দিকে । চেয়ারম্যানের খাস চাকর সে । তবে ফারুকের সাথে বেশ খাতির রয়েছে তার । দরজার সামনে এসে এলোপাথারি থাপড়াতে থাকল কাঠের তৈরি দরজাটায় । কিন্তু বাইরের ঝড় বৃষ্টির কারণে কোন শব্দই পৌঁছুল না বাচ্চুর কানে । তার উপর কাচা ঘুম । এ ঘুম কি এত সহজে ভাঙে ! এভাবে কিছুক্ষণ ডাকার পর কোন সাঁড়া শব্দ না পেয়ে জানলাটার কাছে গেল তারা । ধাক্কা দিতেই খট করে খুলে গেল সেটি ।
এবার বিদ্যুত চমকানির আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল বাচ্চুর মুখখানি । এদিকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শরীর যেন একেবারে জমে গেছে । সুরেষটা ক্ষাণিক কাঁপতেও শুরু করে দিয়েছে । তাই আর দেরি না করে হাতের মুঠিতে কিছুটা পানি নিয়ে ফারুক ছুড়ে মারল বাচ্চুর দিকে । পানির স্যাঁতস্যাঁতে পরশ পেতেই আচমকা জেগে উঠল সে । উঠেই বিছানার দিকে তাকাল ও । কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । তাই হাতরে হাতরে অবস্থা বুঝতে চাইল ও । একি ! আবারো বিছানায় পেশাব করে দিয়েছে সে ? মনে মনে ভাবল হারান কবরেজটাকে ভাল করে টাইট দিতে হবে । বেটা , আমার সাথে বিটলামি ! ভেজাল অষুধ দেওয়া , না ! দুইদিনেই একশন শেষ ! হঠাত্ বিদ্যুত্ চমকে উঠল আকাশে । জানলাটার দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠল বাচ্চু ! ওমা ! এ যে দুজোড়া চোখ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে । ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে দোয়া দুরুদ পড়তে লাগল সে । এসময় ফারুকের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আলগোছে উঠে বসল ও । কোনরকমে তাকাল জানলাটার দিকে । আকাশে অনবরত বিদ্যুত্ চমাকাচ্ছে বলে ফারুককে চিনতে বেশি সময় লাগলনা তার । তাড়াতাড়ি করে বন্ধ দরজাটা খুলে দিলে ফারুক আর সুরেষ ঘরে ঢুকল । এরপর দুজনকে দুটো শুকনো কাপড় আর একটা গামছা দিলে তা দিয়ে শরীরটা মুছে ভিজা কাপড়গুলো পাল্টে ফেলল তারা । ইতিমধ্যে বাচ্চু তার হারিকেনটাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে । – এবার বল , এতরাতে তোমরা কোথ্থেকে ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল বাচ্চু ! – আর বলোনা ভাই ! কাজ সেরে স্টেশন থেকে ফিরছিলাম । কিন্তু চৌধুরীদের কলা বাগানটায় আসতেই কিসব কান্ড কারখানা ঘটতে লাগল ! সুরেষতো ভয়ে কাঠ ! আমিও কম ভয় পাইনি ! এরমধ্যে বৃষ্টি আর ঝড় শুরু হলে কোনরকমে দৌড়ে তোমার কাছে এলাম । বেশ করেছ , এখন শুয়ে পড়তো দেখি । সকাল হলে বাড়ি যেওক্ষণ । হারিকেনের প্রদীপটা নিভু নিভু করে শুয়ে পড়ল তারা । বাইরে তখনো ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে । বিদ্যুত্ চমকানির পাশাপাশি ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে গুড়ুম গুড়ুম মেঘেদের চিত্কার ।
যাইহোক , ভোরের আলো ফুটতেই ফারুক আর সুরেষ বাচ্চুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিল বাড়ির দিকে । চৌধুরীদের বাগানটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাত্ মনে পড়ল গত রাতের কথা । তাই কৌতূহল বশত বাগানে ঢুকল তারা । ঢুকে দেখল চৌধুরীর ক্ষত বিক্ষত লাস, পিলে চমকে গেল তাদের ! সুরেষতো দেখেই বিকট চিত্কার মেরে বসল । ফারুক কোন রকমে তার মুখ চেপে ধরে সেখান থেকে কেটে পড়ল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । বাড়ি ফিরে দুজনেই নিম পাতা মেশানো গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে নিল । কিন্তু আসল ঘটনা চেপে গেল সবার কাছে ।
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক