ঘটনাটা লিখতে গিয়ে এখনও বুক কেঁপে উঠছে। লেখার গতি থেমে থেমে যাচ্ছে।
বলব কিনা সেটাই ঠিক করতে পারছিনা। কারন একটাই – যারা পড়বেন, তাদের কাছে এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু হবে সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছি।
নিজে যখন ভুতের গল্প শুনি অথবা পড়ি, তখন ভয় পাই ঠিকই। কিন্তু কখনও কি বিশ্বাস করেছি? উঁহু। সেটা হয়নি। তাই আজ আমি যখন কথকের জায়গায়
আর আপনারা আমার মত সেই অবিশ্বাসী পাঠক, তখন বারবার ভাবতে হচ্ছে – এই একান্ত নিজস্ব গা শিউরানো অভিজ্ঞতাটা কি আমি আপনাদের দিতে
পারব?
যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তারা হয়ত ভ্রু কুঁচকে ভাববেনঃ নির্ঘাৎ কোথাও থেকে টুকলিফাই করে ঝেড়ে দিয়েছে ব্যাটা। আর বন্ধু বা
পরিচিতজনরা সামনে পেলে নিশ্চয়ই পিঠে থাবড়া দিয়ে বলে উঠবেঃ ভাল গল্প ফেঁদেছিস রে বাপ! চালিয়ে যা গুরু। তোর হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এখন যে
ঘটনাটা আমি বলব, সেটা ঘটেছিল। আমার এখনও ধন্দ লাগে যদিও। কিন্তু কিছু একটা আমি দেখেছিলাম ঠিকই।
গল্পের, আসলে ঘটনাটার নামধাম উহ্য থাকুক। যারা চেনেন আমাকে, তাদের তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। অচেনাদের জন্য বলছিঃ আমার সংসার
চারজনের। ছেলেদুটো দশ আর বারো বছরের। স্ত্রী আমারই ব্যাচমেট। সরকারী চাকুরে আর আমি ব্যাংকে দিন গুজরান করি। পুরো ডমেস্টিক টেরিটরি
তারই এক্তিয়ারে। তাই দিন শেষে আক্ষরিক অর্থেই বেদম ক্লান্ত থাকে। আমিও থাকি। তাই আমাদের দু’জনেরই দিনের সবচে আরাধ্য সময়টা হলো যখন
বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে নিজ বিছানায় পাশাপাশি গা’টা এলিয়ে দেই। এটাই আমাদের নিজস্ব সময়। ও ফেসবুকের জঙ্গলে নাইট সাফারি করে আর আমি
কিছুক্ষন নোটপ্যাডে ডিজিটাল আঁচড় কাটবার চেষ্টা করি। এরপর স্লিপিং পিল একশনে এলেই চুপটি করে ঘুমিয়ে যাই। ও অবশ্য আরও একটু জাগে। বলে,
ঘুম নাকি আসেনা। তাই কখনও কখনও আমি জেগে গেলে দেখি ওর বুকের ওপর মোবাইল পড়ে আছে আর ও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলটা একপাশে
সরিয়ে রেখে আমি আবার ঘুমিয়ে যাই।
গত জুলাইয়ের বাইশ তারিখে এরকমই আমরা শুয়েছিলাম। তারিখটা মনে আছে কারন সেদিন আমার ভাইয়ের জন্মদিন ছিল। আমি সেদিন কেন যেন বেশি
টায়ার্ড ছিলাম। তাই আর মোবাইল চালাইনি। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম দশটা নাগাদ। পাশে ও, চ্যাটিং করছে। জানি আধ ঘন্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিটটাক ইন্টারনেট
সার্ফিং করে ও-ও ক্ষান্ত দেবে। তাও একবার জিজ্ঞেস করলামঃ ঘুমাবে না? ও উত্তর দিলঃ এইতো, আরেকটু পর। আমি আর কিছু না বলে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে
গেলাম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই।
দাঁড়ান…। একটু ভেবে নেই সেই সময়টার কথা। উফ…! কি ভয়ংকর একটা স্মৃতি! আমার পিঠের মাঝখানটা এখনই শিরশির করছে।
আমার আবার রাতে কয়েকবার ঘুম ভাঙ্গে। এমনিই ভাঙ্গে। স্পন্ডিলাইটিসের ব্যাথা আছে। তো, সেই রাতে আন্দাজ ঘন্টা দেড়েক পর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে
গেল। শোয়ার আগে দু’গ্লাস পানি খেয়েছিলাম। সেটাই এখন তলপেটে চাপ দিচ্ছে। আমি উঠে টয়লেটে গেলাম। এখানে বলে রাখি, রাতে আমি টয়লেটের
দরজা সাধারণত বন্ধ করিনা। এমনিই। আর ভয়ও লাগে কিছুটা। তো পেশাব করতে করতেই আমি ঘুরে তাকালাম আয়নার দিকে। আয়নাটা এমন জায়গায়
লাগানো যে দরজা খোলা থাকলে বিছানার পায়ের দিককার জায়গাটুকু দেখা যায়। অন্ধকার বেডরুমে টয়লেটের আলো তেরছা করে পড়েছে। আর আমি
সেই আলোতে দেখলাম….দেখলাম যেন একটা নারীমুর্তি ওই অন্ধকার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আয়নার মধ্যে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গাঢ়
একটা কাপড়, অনেকটা ম্যাক্সিটাইপ পরা। চুলগুলো মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা। আর সবচে আশ্চর্য – চোখদুটো যেন দুটো সাদা আলোর বিন্দু। এক
মুহূর্তে এই পুরো ছবিটা আমার ব্রেনে গেঁথে গেল। অস্বীকার করব না – বুকটা প্রচন্ড ধড়াশ করে উঠেছিল। তারপরই মনে হলো, হয়তো আমার স্ত্রীই উঠেছে
টয়লেটে যাবে বলে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কারন ততক্ষনে ভয়টা কেটে গেছে। টয়লেটের কাজ শেষ করে বের হয়েই আমি অবাক! কোথায় কি? ও তো
মশারির ভেতরে। আবার শুয়ে পড়ল নাকি? হয়ত পানি খেতে উঠেছিল। আমি শব্দ শুনতে পাইনি। আমি বেশ হতবাক হয়ে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে
মশারির মধ্যে ঢুকে ওর গায়ে হাত রাখলাম। অদ্ভুত ব্যাপার! এতো গাঢ় ঘুমে নিমগ্ন একজন মানুষ। এত অল্প সময়ে কি কেউ ঘুমিয়ে যেতে পারে? আমি ওর
গা ধরে একবার নাড়া দিলাম। উঁহু…। জাগল না। এবার আমি ধন্দে পড়ে গেলাম। কি দেখলাম? স্পষ্ট দেখেছি তা বলব না। তবে দেখলাম তো। তবে কি ঘুম
চোখে আলো আঁধারির ইল্যুশন? আমি আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বউএর গা ঘেঁসে শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুম আসতে সময় লাগল না।
কতক্ষন কেটে গিয়েছে টের পাইনি। অসম্ভব একটা পচা গন্ধে ঘুম আবার ভেঙ্গে গেল। কোত্থেকে আসছে এরকম গন্ধ? যেন পচে যাওয়া রক্ত মাংস। এবার
খেয়াল হলো পাশে তো বউ নেই। কোথায় গেল? তাকিয়ে দেখি বেডরুমের দরজাটা খোলা। আমাদের বেডরুমের পরেই ডাইনিং, তারসাথে দূরে ড্রয়িংরুম।
আর পাশের রুমে আমার দুই ছেলে ঘুমায়। ওদের রুমে ডিমলাইট জ্বলে। দরজাটা খোলা বলে ডাইনিং রুমটা অতি আবছা আলোকিত হয়ে আছে। আমি
খোলা দরজাটা দিয়ে দেখলাম, আমার স্ত্রী যেন ড্রয়িংরুমের অন্ধকারে হেঁটে গেল। আমি খুব অবাক হইনি কারন ও মাঝে মাঝে ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে
শুয়ে নেট চালায় ঘুম না আসলে। আজ আমার ভয় লেগেছে একবার। তাই একা থাকতে সাহস হলো না।
আরেকটা কথা বলে নেই। আমাদের ফ্ল্যাটে আশপাশ থেকে আলো আসেই না। তাই মোটামুটি ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে থাকে। আমি ঘুমচোখে ড্রয়িংরুমে
গেলাম। দেখি কোনার সোফাটায় ও বসে আছে। অন্ধকারে অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে। আমি ডাকলামঃ এই, এত রাতে বসে আছ কেন? আসো। আমার একা
ভয় লাগছে। ও উত্তর দিল না। শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল মনে হলো। কিছু নিয়ে মন খারাপ? মাঝে মাঝে হঠাৎ ওর ডিপ্রেশনের মত হয়। কতকিছু যে
ভাবে। সেইজন্যই কি উঠে এসেছে? হয়তো। আমি ওর পাশে বসলাম। পচা গন্ধটা আবার নাকে লাগল। আমি আবার বললামঃ এই, গন্ধটা কিসের বলতো?
ফ্রিজ থেকে আসছে না কি? এবারও ও নিশ্চুপ। ধুত্তোর। আমি ওর হাত ধরলাম। উফ…! এত ঠান্ডা হয়ে আছে। এসি থেকে বেরিয়েছে বলে এই অবস্থা। আমি
ওকে হাত ধরে টেনে উঠালাম। তারপর বেডরুমের দিকে রওনা দিলাম। ডাইনিংরুমে এসে লাইটটা জ্বালালাম পানি খাব বলে। হাত ততক্ষনে ছেড়ে দিয়েছি।
লাইটটা জ্বালিয়ে আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলাম ও পানি খাবে কি না। আর তখনই…..
আমার ঠিক পাশে যে মূর্তিটা দাঁড়ানো সেটা এক অনেক বয়স্ক মহিলার। ফ্যাকাশে গায়ের রঙ। আসলে দেখে আমার মনে হলো বহুদিন মাটির তলায় আবদ্ধ
থাকলে এরকম রঙ হতে পারে চামড়ার। চোখদুটো প্রচন্ড রকমের ঠেলে বেরিয়ে আছে। মড়ার মত সাদাটে। আমি চোখের মণি বলে কিছু দেখলাম না। যেটা
আমি ম্যাক্সি ভাবছিলাম সেটা আসলে ময়লা হয়ে যাওয়া ধুসর একটা কাপড়। পেটের কাছটা উন্মুক্ত। শাড়ি না। মনে হলো কাফন। আর সবচে বিভৎস হলো
গাল থেকে গলা হয়ে পেট পর্যন্ত একটা চওড়া কাটা দাগ। তার ভেতরে কালো হয়ে যাওয়া মাংস দগদগ করছে। আর পেটের কাছ থেকে মনে হলো সুতোর
মত কিছু ঝুলছে। আমি তীব্র আতংকিত? না…আমি সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে গেছি। পুরো শরীর প্যারালাইসড। গলা দিয়ে সামান্য শব্দও বের করার ক্ষমতা নেই।
কবরের অভিশপ্ত প্রানীটা এবার মুখটা হাঁ করলো। একসারি তীক্ষ্ণ ফলার মত দাঁত আর ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছে সেই রক্ত পচা গন্ধটা। তারপর
আমার গলার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
আমি এই পর্যন্তই মনে করতে পারি। পরে স্ত্রী আর ছেলেদের কাছ থেকে বাকিটুকু শুনি।
আমার অসহনীয় তীব্র চিৎকারে টয়লেট থেকে আমার স্ত্রী ছিটকে বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষন পরেই ছেলেরাও এসে হাজির হয় ঘুম ভেঙ্গে। দাঁতে দাঁত লেগে
আমি গোঁ গোঁ করতে করতে ওদের সামনেই অজ্ঞান হয়ে যাই। অনেকক্ষন পর ওদের সেবাশুশ্রুষায় আমার জ্ঞান ফেরে। এবং আমি না কি আমার স্ত্রীকে
দেখে বিকট চিৎকার করে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার স্ত্রী তখন পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ডেকে আনে। বহুকষ্টে যখন আবার আমার জ্ঞান ফেরে
তখন সবাই মিলে আমাকে চেপে ধরে নরম্যাল করে। এরমধ্যেই ভোর হয়ে আলো ফুটে উঠেছে। আমি ধাতস্থ হয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বলি সবাইকে। তখন
আমার স্ত্রী জানায় যে সে একবারই উঠেছিল টয়লেটে যাওয়ার জন্য যখন আমি গভীর ঘুমে। চিৎকার শুনেই ও বের হয়ে আসে এবং আমাকে আবিষ্কার করে
ডাইনিং রুমের মেঝেতে।
পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অসম্ভব ভীতিকর আর আমার স্ত্রীর কাছে অতীব রহস্যময় হয়ে আছে আজও। আমরা এই বাসাটায় আছি দশ বছর। সেই
ঘটনার আগে বা পরে আর কখনই এরকম কিছু ঘটেনি। আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি। ফ্ল্যাটটারও কোন বদনাম নেই। তাহলে আমি কিসের পাল্লায় পড়তে
যাচ্ছিলাম? কি ছিল সেটা? এলোই বা কোত্থেকে? এইসব প্রশ্ন আমাকে আতংকিত করে রাখে সবসময়। সন্ধ্যার পর আমি কোনকিছুর বিনিময়েই একা থাকি
না। রাতে টয়লেটে যেতে হলে লাইট জ্বালিয়ে বউকে উঠিয়ে তারপর যাই। কিন্তু সেই অসম্ভব আতংক আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে।
অনেক ভেবে একটা আবছা সম্ভাবনার কথা আমার মনে হয়েছে। কিন্তু সেটা এতই অদ্ভুতুড়ে যে বললে আপনারা আমাকে পাগল ঠাওরাবেন। হয়ত
এরমধ্যে তাই ভেবে বসে আছেন। তাই থাক।
‘ভয়ের জিনিস’ যেকোন সময় যেকোন জায়গায় যেকোন রূপে আসতে পারে। আর হ্যাঁ….আপনাদের যে কারও কাছেই আসতে পারে। প্লিজ…মনে রাখবেন
কথাটা।