গ্রামের জ্ঞাতি কবরেজ-ঠাকুর্দা, শহরের নাতি নিমাইচরণের বাড়িতে এসে দাঁড়ানো মাত্রই প্রায় ধিক্কারের গলায় বলে উঠলেন, ‘‘কী রে নিমে, সংসারের মালপত্তর শুধু নিজের পেটেই চালান করিস? ছেলেমেয়েগুলোকে স্রেফ হাওয়া খাইয়ে রাখিয়?’’ এই অভাবিত আক্রমণে নিমাইচরণ থতমত খেয়ে বলেন, ‘‘তার মানে?’’
‘‘মানে? মানে জিজ্ঞেস করছিস?’’ কবরেজ-ঠাকুর্দা জোর গলায় বলেন, ‘‘বাড়িতে বড় আয়না নেই? একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এসে ছেলেপুলেগুলোর দিকে তাকা। মানে বুঝতে পারবি। অ্যাঁ! কী কাণ্ড! নিজের ভুঁড়ির ওপর থাক-থাক বাড়তি তিন থাক ভুঁড়ি, আর ওগুলো একেবারে শ্বেত-চামচিকে। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। চামচিকেরও অধম। কাঠঠোকরা, পাটকাঠি, ফড়িং।’’
এমন অপমানে কার না রাগ হয়? তার ওপর আবার ওই শ্বেত-চামচিকে কাঠঠোকরা, পাটকাঠি আর ফড়িংরা কবরেজ-ঠাকুর্দার সামনেই বাবার সেই ‘তিন থাকের’ দিকে দৃষ্টিপাত করে একযোগে হাসি চালিয়ে যাচ্ছে। হি হি হি হি! খি খি খি খি।
পিত্তি জ্বলে গেল। ক্রুদ্ধ নিমাইচরণ উত্তেজিত হলেন। এই ছেলেমেয়েদের জন্যেই প্রাণপাত করছেন তিনি, আর কিনা এমন অপবাদ! রেগে গেলেন, ‘‘আমায় বোলো না ওসব, ওদেরই বলো। না-খেলে কখনো কারুর শরীর সারে? ওদের মা তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাওয়া-খাওয়া করে ওদের পিছু-পিছু ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে, তা খাচ্ছে কে? খেতে বললেই তো তেড়ে মারতে আসে—’’
শুনে কবরেজ-ঠাকুর্দা চমকে উঠে বলেন, ‘‘অ্যাঁ! বলিস কী? খেতে বললে তেড়ে মারতে আসে? এ যে একটা দারুণ ব্যাধি। আযুর্বেদ শাস্ত্রে একে বলে ‘‘প্রাকোন্মাদ রোগ’’। সব কটার একসঙ্গে! ইস! নিমেরে, তোর কপালে—’’ কথার মাঝখানে নিমাইচরণ তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ‘‘আহা, সত্যি কি আর মারতে আসে? মানে খিদে নেই, তাই খেতে চায় না।’’
‘‘তা খিদেই বা নেই কেন?’’ কবরেজ-ঠাকুর্দা ভুরু কুঁচকে নাকে নস্যি ঠুশতে-ঠুশতে বলেন, ‘‘এ বয়সে তো ‘ঘর খাই বাড়ি খাই ইঞ্জিন খাই রেল গাড়ি খাই’ খিদে হবার কথ। নাঃ বাপু, এও এক প্রকার ব্যাধি। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে একে বলে—’’ এখন নিমাই-গিন্নী এক গেলাস মিছরির শরবত এনে কবরেজ-ঠাকুর্দার সামনে ধরে দিয়ে বলেন, ‘‘তা আপনার আয়ুর্বেদ শাস্তর থেকে একটা কিছু ওষুধ দিন না ঠাকুর্দা, যাতে খুব খিদে হয়। নেই তেমন ওষুধ?’’
কবরেজ-ঠাকুর্দা চড়া গলায় বলেন, ‘‘পৃথিবীতে এমন ব্যাধি নেই, আয়ুর্বেদে যার ওষুধ নেই। নেহাত নাকি দাঁত গেলে দাঁত বাঁধাবার ব্যবস্থাটা নেই, তাই তোমাদের ওই এলোমেলোপ্যাথির শরণাপন্ন হতে কলকাতায় আসা। খাক না এক্ষুনি বৃহদারণ্যক বটিকা, ‘খিদে খিদে’ করে পাগল করে দেবে তোমায় ছেলেমেয়েরা।’’
নিমাই-গিন্নী ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘‘তবে তাই চারটি দিন বাপু! আছে সঙ্গে?’’ ‘‘এই দ্যাখো পাগলের কথা! ওষুধ কি আমি সঙ্গে নিয়ে বেড়াই? তবে হ্যাঁ, উপকরণগুলো জোগাড় করে দিলে বানিয়ে দিতে পারি।’’ ‘‘তবে বলুন তাই, কী কী লাগবে।’’
নিমাই-গিন্নী আশা-ভরসা-মাখা মুখে তাকান কবরেজ দাদাশ্বশুরের মুখের পানে। ঠাকুর্দা গড়গড় করে বলে যান, ‘‘বুড়ো বটগাছের ছাল এক তোলা, প্রাচীন ছাতিম গাছের বাকল দেড় তোলা, দেবদারু কাণ্ডের মূল পৌনে এক তোলা, গোধূম ও কৃষ্ণতিলচূর্ণ সওয়া তোলা, অর্জুনছাল আধ তোলা, অনন্তমূল শুষ্ক সওয়া তোলা, জম্বুবৃক্ষের বাকল চার তোলা, নিম্বফল ভস্ম সওয়া তিন তোলা আর মধু পাঁচ তোলা একত্রে নিয়ে—’’
নিমাই-গিন্নী কাতর মুখে বলেন, ‘‘শহরে বসে এত সব জোগাড় করা কি সম্ভব ঠাকুর্দা?’’ ঠাকুর্দা উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘‘এত সব কী গো নাতবৌ? তবু তো ঝাঁটি-করবীর কথা বলতে ভুলেছি। ‘বৃহদারণ্য বটিকা’ মানে হচ্ছে একটি বৃহৎ অরণ্যের মধ্যে যত প্রকার ওষধিবৃক্ষ আছে তার নির্যাস বার করে নিয়ে—’’
‘‘বুঝলাম তো,’’ নিমাই-গিন্নী আরও কাতর মুখে বলেন, ‘‘মানছিও। কিন্তু অতসব চিনবে কে? আনবেই বা কে? ওর চেয়ে সহজ কিছু নেই?’’
‘‘ওর থেকে সহজ?’’ কবরেজ ঠাকুর্দা বলে ওঠেন ‘‘হুঁ! রাংতায় মোড়া ট্যাবলেটগুলোকে ওষুধ বলে গিলে-গিলে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে তো, তাই এই কটা জিনিস জোগাড় করাটা শক্ত কাজ মনে হচ্ছে। তা বেশ, সহজ চাও তো হাওয়া বদলাতে যাও। ওই অরণ্যঘেঁষা কোনও জায়গায়। ওর চাইতে সহজ ওষুধ আর নেই।’’
সহজ! সেরেছে! এখন নিমাইচরণ চমকে ওঠেন, ‘‘হাওয়া বদলটা তোমার সহজ মনে হল ঠাকুর্দা?’’ ‘‘তা হবে না? ওতে তো আর এত সব জোগাড়ের দরকার নেই। একটাই মাত্র জোগাড়-ট্রেনের টিকিট! তা মাসখানেক আগে থাকতে চেষ্টা কর্। ব্যস পেলেই চলে যা!’’ নিমাইচরণ রেগে বলেন, ‘‘চলে যা বললেই চলে যাওয়া হবে?’’
কবরেজ-ঠাকুর্দা পাকা ভুরু নাচিয়ে বলেন, ‘‘তা কি আর হয় রে নিমে? হওয়ালে তবে হয়। তবে পয়সা খরচের ভয়ে যদি তুই ছেলেমেয়েগুলোকে প্যাকাটি করে রেখে দিস, টাকা নিয়ে করবি কী?’’ পয়সা খরচের ভয়ে! নিমাইচরণ পয়সা খরচের ভয় পান? রাগে দুঃখে বেচারী মুখটা পেঁচা করে বলেন, ‘‘সময় কোথা? ছুটি কোথা?’’ কবরেজ ঠাকুর্দা চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘‘ছুটি নেই? সরকারি অফিসে তো শুনেছি ছুটি জমে যায়।’’
নিমাইচরণ মুখটাকে পেঁচার পেঁচা তস্য পেঁচা করে বলেন, ‘‘শুধু জমে যায় কেন, পচেও যায়। কিন্তু শুধু আমি ছুটি পেলেই হবে? ছেলেমেয়েদের ছুটি চাই না? তাদের সারা বছরে সাতান্ন দফা পরীক্ষা নেই? স্পোর্টস নেই? গানের ক্লাস নেই? নাচের প্রোগ্রাম নেই? সাইকেল রেস নেই? ক্যারম কম্পিটিশান নেই? খেলা দেখতে যাওয়া নেই? দাদামণির আসরে গল্প বলা নেই? পাড়ার ফাংশানে যোগ দেওয়ার দায়িত্ব নেই? পাড়ার পুজোর চাঁদা তোলা নেই? ‘সামনে বসে আঁকো’ নেই? হ্যানো নেই? ত্যানো নেই? এটা নেই? ওটা নেই? এর মাঝখানে কোন ফাঁকে নাক গলাব আমি বলো?’’
কিন্তু শুনতে-শুনতে কপাল টিপে সোফায় বসে পড়েছেন ঠাকুর্দা, এখন আস্তে নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘এ যে বৃহদারণ্যকের জ্যাঠামশাই! কটা ছেলেমেয়ে তোর নিমে?’’ নিমাইচরণ রেগে বলেন, ‘‘কটা আবার কী? জানো না তুমি? এখুনি প্রণাম করে গেল তোমায়! নিলু, ভোম্বল, মিমি, টুসকি, এই তো।’’
‘‘আমিও তো তাই জানতাম।’’ কবরেজ-ঠাকুর্দা বলেন, ‘‘কিন্তু তোর এই ফিরিস্তি শুনে মনে হচ্ছে বোধহয় আরও ডজনখানেক আছে ভেতরে। চারটেতেই এত?’’ নিমাইচরণ গম্ভীর হন।
বলেন, ‘‘ওই চারেই চারশো ঠাকুর্দা! এ তোমার-আমার যুগ নয়, এ হচ্ছে রকেটের যুগ! এত সব না-করতে পারলে সমাজে মুখ থাকে না।’’ ঠাকুর্দা মিছরির শরবত শেষ করে গেলাস নামিয়ে রেখে বলেন, ‘‘তা মুখটা রাখছে কিসের জোরে? এদিকে তো ধুঁকছে!’’
নিমাইচরণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘‘ওই ধুঁকে-ধুঁকেই খেলছে, ছুটছে, নাচছে, গাইছে, আঁকছে, লিখছে, বলছে, কইছে আর দু’দিন ছাড়া পরীক্ষা দিচ্ছে।’’
কবরেজ-ঠাকুর্দা দু’হাত কপালে জোড় করে বলেন, ‘‘ধন্য ধন্য! তবু বলি বাপু, এতটা ঠিক নয়। কাপড়-জামাকে সময়-সময় যেমন ধোবাবাড়ি ঘুরিয়ে ফর্সা করে আনতে হয়, শরীরটাকেও তেমনি মাঝেমধ্যে হাওয়া বদলে ফ্রেশ করে আনতে হয়। আমি বলি একবার বদ্যিনাথ ঘুরে আয়। আহা আমি একবার গিয়েছিলাম। জল-হাওয়ার তুলনা নেই। সে কী খিদে পাওয়া! চব্বিশ ঘণ্টা খিদে পাচ্ছে। মাঝ-রাত্তিরে ঘুম ভেঙে উঠে মনে হচ্ছে, কী খাই কী খাই। একটা রাতে সে এক কাণ্ড! ঘরে কিছু নেই, অথচ দারুণ খিদে। ঝুড়িতে ছিল কপি আর আলু, তোদের ঠাকুমা আর আমি তাই খেতে লেগে গেলাম নুন দিয়ে-দিয়ে! মনে হল অমৃত খাচ্ছি।’’
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে চার-চারটে ছেলেমেয়ের গলা থেকে একসঙ্গে হি হি হি হি হাসির শব্দ ভেসে আসে।
কবরেজ-ঠাকুর্দা বলেন, ‘‘হাসলে কী হবে? গিয়ে দ্যাখ না! আমি বলছি নিমে, তুই একবার বদ্যিনাথ চলে যা। তোর ছেলেমেয়েদের অখিদে অগ্নিমান্দ্য দুদ্দাড়িয়ে পালাতে পথ পাবে না। যে করে হোক, ছুটিফুটি নিয়ে চলে যা একবার।’’ তা শেষ পর্যন্ত হাওয়া-বদলই ঠিক হল।
নিমাইচরণ অবশ্য প্রথমটায় ভেবে আকুল হচ্ছিলেন। চেনা-জানা নেই কোথায় গিয়ে উঠব ঠিক নেই, কিন্তু হয়ে গেল ম্যানেজ।
নিমাইচরণের এক বন্ধুর জামাইয়ের পিসেমশাইয়ের দেওঘরে একটা বাড়ি আছে, বলা-কওয়া করে তার চাবিটা পাওয়া গেল। অতএব একদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে রওনা দিলেন নিমাইচরণ তাঁদের বাষট্টি দফা কর্মসূচী থেকে ফাঁক বার করে। শেষ মুহূর্তে এক দুঃখের ঘটনা ঘটায় নিমাই-গিন্নীর যাওয়া হল না। ঠিক এই দিনেই কিনা তাঁর দিদিমার কানের ফোঁড়া পেকে উঠল সেই ‘অপারেশন কালে’ দিদিমার নাতনি কাছে থাকবে না?
তা ছেলেমেয়েরা এতে খুশি বৈ অখুশি হয়নি। ওরা মায়ের কান বাঁচিয়ে চুপি চুপি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ‘‘একরকম ভালই হল বাবা! মা তো সেই সদা-সর্বদা ‘খাওয়া খাওয়া’ করে পিছু-পিছু ধাওয়া করত। এ বেশ নির্ভয়ে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে।’’ বেশ নিশ্চিন্তেই এসে হাজির হল ওরা। যদিও সঙ্গে মোটঘাট বিস্তর।
শুধুই তো জামা-কাপড় বাসন-পত্র খাবারদাবারই নয়, চার ভাইবোনের পড়ার বইয়ের পাহাড়, গল্পের বইয়ের হিমালয়, দশ-বিশ দফা ইনডোর গেম-এর সরঞ্জাম, তানপুরা, হারমোনিয়াম, রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যামেরা, সাজবার বাক্স নিমাইচরণের জানা-অজানা কত কী তার ঠিক নেই। ছখানা রিকশা বোঝাই করে এগোলেন নিমাইচরণ সেই বাড়িখানার উদ্দেশে, যে বাড়ির চাবি আর ঠিকানা সঙ্গে এনেছেন।
কিন্তু রাস্তা আর ফুরোতেই চায় না। কোথায় বাড়ি করে রেখেছেন বন্ধুর জামাইয়ের পিসেমশাই? যাক, শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। একেবারে নন্দন পাহাড়ের কোলে। বাড়ি প্রকাণ্ড! কত যে ঘর দালান বারান্দা গেট! দেখে শুনে যেন দিশেহারা। এতবড় জগদ্দল বাড়ি কী উদ্দেশ্যে বানায় লোকে? যা বানিয়ে তারপর ফেলে রাখতে হয়? দেখা গেল চাবিটা কষ্ট করে না আনলেও চলত। অনেকগুলো জানলাই দরজা হয়ে গেছে। খোলা দরজা।
তালাটায় দারুণ মরচে ধরার দরুন চাবি ঢুকল না। তবে তাতে কিছু এসে গেল না, ওই একটা জানলা-কাম দরজা দিয়েই ঢুকে পড়া গেল। কিন্তু ভিতরের অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন নিমাইচরণ। তবে ছেলেমেয়েদের তাতে উৎসাহ-উল্লাসে ঘাটতি পড়ে না। তারা কেউ ভাঙা নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাতে উঠে যায়, কেউ বাগান দেখতে বেরোয়, কেউ বা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। নিমাইচরণ তাকিয়ে দেখেন না। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ খেয়াল হল নিমাইচরণের, বড্ড যেন চুপচাপ! কেউ কোথাও নেই। রিকশাওলাগুলোকেই বা মেটাল কে?
উঠে পড়ে হাঁক দিলেন, ‘‘নিলু, ভোম্বল, মিমি, টুসকি!’’ শেষের দু’জন দুদ্দাড়িয়ে ছাত থেকে নেমে এল। নিমাইচরণ বললেন, ‘‘রিকশাওলাদের ভাড়া মেটাল কে?’’ ওরা দুজনেই বলে উঠল, ‘‘এ মা, আমরা কী জানি? তুমি দাওনি ভাড়া?’’ কিন্তু দিলে কি আর জিজ্ঞেস করতে আসতেন নিমাইচরণ? সে দুটো কোথায় গেছে? নিলু আর ভোম্বল?
‘‘দাদা, ছোড়দা? কে জানে? বোধহয় অরণ্যের হাওয়া লাগাতে বেরিয়েছি।’’ নিমাইচরণ কড়া গলায় বলেন, ‘‘সন্ধে হয়ে আসছে, আর এই নতুন জায়গায়! যত সব-’’ ‘‘ছোড়দার পকেটে টর্চ আছে বাপি।’’ নিমাইচরণ থমকে বলেন, ‘‘টর্চ আবার কোথায় পেল?’’ ‘‘আসার আগে চোদ্দ টাকা দিয়ে কিনে এনেছে।’’ নিমাইচরণ গুম হয়ে বলেন, ‘‘তা কিনবে বইকি! পয়সা খোলামকুচি।’’ সঙ্গে সঙ্গেই ভোম্বলের গলা। ‘‘খোলামকুচির কথা কী হচ্ছে বাপি?’’ ভোম্বলের পিছনে নিলু। ‘‘কিছু না। বলছি, রিকশাওলাগুলো যে হৈচৈ করল না, ভাড়া মিটিয়ে দিল কে? তোরা?’’ ‘‘ভাড়া? আমরা? আমরা টাকা কোথায় পাব?’’ আকাশ থেকে প়ড়ে ওরা, ‘‘তুমি আমাদের কাছ থেকে সকলের সব টাকা তোমার অ্যাটাচিকেসে পুরে নিয়ে নিজের কোলে চাপিয়ে বসলে না? পাছে আমাদের পকেটমার বলে? কথাটা সত্যি।
তা-ই করেছিলেন নিমাইচরণ, নিজের কোলটা সব থেকে সেফ জায়গা ভেবে। কিন্তু জিনিস কোলে নিয়ে তো আর রিকশা থেকে নামা যায় না? চাবি খোলার সময়ও (মানে খোলবার চেষ্টার সময় কিছু আর হাতে জিনিস থাকলে চলে না? অতএব মনে হচ্ছে, অ্যাটাচিকেসটি সেই বিরাট মাল-পত্তর পাহাড়ের মধ্যেই পড়ে আছে, আর বেচারী রিকশাওলারা বাবুদের ডেকে-ডেকে আর চেয়ে-চেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে।
টুসকি বলে, ‘‘আহা! কত কষ্ট করে এত দূর আনল বেচারারা! তুমি কিন্তু বাপি বড্ড নিষ্ঠুর। তক্ষুনি দিয়ে দেবে তো? চা খেতেও পয়সা দাওনি?’’ কিন্তু দেবেন কখন? তারা তো কোনো সাড়াই করেনি। নিলু বলে, ‘‘ঘাবড়াতে হবে না, ঠিকই আসবে। আজ না হোক কাল সকালে। পাওনা ফেলে যাবে কোথায়? এখন একটা আলোটালো জ্বালানো হোক। হারিকেন-ফারিকেনগুলো কই?’’
নিমাই ক্লান্ত গলায় বলেন, ‘‘সবই একসঙ্গে আছে বাবা, নিয়ে এসে জ্বাল। আর অ্যাটাচিটা আমায় দিয়ে যা।’’ দেবে তো কিন্তু কোথা থেকে? জিনিসের সেই হিমালয় পর্বতটি কোথায় নামানো হয়েছে। কোন গেটের ধারে? কোন দালানে? টর্চ নিয়ে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে আসে নিলু-ভোম্বল। নেই। কোনো দালানে নয়, কোনো গেটের ধারে নয়। তার মানে তারা রিকশা থেকে নামেইনি।
তিনখানা রিকশায় মানুষ ছিল, তিনখানায় মাল। মানুষেরা নিজেরা লাফিয়ে-লাফিয়ে নেমে পড়েছে। মালপত্রের তো আর সে-ক্ষমতা নেই, তাই তারা বসেই থেকেছে। রিকশাওলারাও আর কষ্ট করে না নামিয়ে আবার তাদের বয়ে-বয়েই উল্টোমুখো ফিরে গেছে। তার মানে-দ্বিতীয়বার পরবার মত জামাটামা কিছু নেই। খাবারটাবার কিছু নেই, শোবার কিছু নেই, খেলবার, পড়বার, শোনবার, লিখবার, আঁকবার, সাজবার, বাজাবার কিছু না কিছু না। টুথব্রাশ? সাবান? বালিত? মগ? না না! সব ফর্সা।
সব অভাব মিটোতে পারার মন্ত্রটি যার মধ্যে, সেই অ্যাটাচিকেলসটিও তাই! ফর্সা। হয়তো সে এখন কোনো এক রিকশাওলার কোলে চেপে বসে আছে। নেহাত নাকি চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কাঁদা যায় না, তাই সবাই গুম হয়ে বসে থাকে। বসেই থাকতে হয়, শোবার তো উপায় নেই। হঠাৎ এক সময় নিমাইচরণ কাঁদো-কাঁদো হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘‘তোদের মায়ের সেই অতো যত্ন করে দেওয়া খাবারটা পর্যন্ত-’’ ভোম্বল আর নিলুও চেঁচিয়ে ওঠে রেগে। ‘‘আমাদের যথাসর্বস্ব গেল বাপি, আর তুমি সেই লুচি-তরকারির শোকে কেঁদে ফেলছ?’’ ‘‘তা কী খাবি তোরা? একটা পয়সা পর্যন্ত নেই যে দোকান থেকে কিছু-’’ ‘‘খাওয়াটাই বড় কথা নয় বাপি। ওটা একটা তুচ্ছ ব্যাপার যা সব চলে গেল! উঃ! ভাবা যায় না!’’
মিমি-টুসকি ভাঙা গলায় বলে, ‘‘মায়ের সঙ্গে মিশে-মিশে বাপিরও মায়ের মতন স্বভাব হয়ে গেছে। সব ছাপিয়ে শুধু খাবার চিন্তা! আমার সেই বইগুলো! না খেয়ে বরং সাতদিন সাতরাত থাকা যায় কিন্তু গল্পের বই না পড়ে? অসম্ভব! বাপি, আমি মরে যাব, ঠিক মরে যাব।’’ আলো নেই, তাই কেউ কারুর মুখ দেখতে পায় না, শুধু মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে দেখা হচ্ছে সবাই আছে কিনা। কী না থাকতে পারে এ-বাড়িতে? ভুত, চোর, বাঘ, সাপ! এ রাত কি কাটবে?
টুসকি বলে ওঠে, ‘‘কাল ভোরের গাড়িতেই ফিরে চলো বাপি।’’ নিমাইচরণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘কী দিয়ে? বিনা টিকিটে?’’ নিলু বলে ওঠে, ‘‘মাকে টেলিগ্রাম করে দাও টি-এমও করে টাকা পাঠিয়ে দিতে।’’ নিমাইচরণ আরো গম্ভীর গলায় বলেন, ‘‘টেলিগ্রামও অমনি করা যায় না।’’ ‘‘তাহলে? কার হাতে কী আছে?’’ কিছু না। ছিনতাইয়ের ভয়ে নিমাইচরণ ছেলেমেয়েদের ঘড়ি আংটি কানফুল হার বালা সব কলকাতায় রাখিয়ে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত থাকার মধ্যে এই টর্চটি।
নিমাইচরণ পাথর-পাথর গলায় বলেন, ‘‘ওটাকেই পোস্ট অফিসে জমা রেখে অবস্থা জানিয়ে বিনা পয়সায় টেলিগ্রাম করতে হবে।…তার মানে ওটাই এখন বিপদতারণ।’’ টুসকি কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, ‘‘কাল রাত্তিরের আগে টাকা এসে যাবে?’’ ‘‘পাগল?’’ ‘‘তাহলে কাল রাত্তিরে কী হবে বাপি? টর্চটাও থাকবে না?’’ নিমাইচরণ নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘একটা দেশলাই চেয়ে আনব কারো কাছ থেকে।’’
সকালবেলা উঠে বেরিয়ে যান টর্চটা নিয়ে। পোস্ট অফিসের উদ্দেশে। কিন্তু নিমাইচরণের তাড়া আছে বলে তো আর পোস্ট মাস্টার ভোরবেলা অফিস খুলে বসে নেই? টর্চ জমা রেখে টেলিগ্রাম করে দিয়ে চেয়েচিন্তে একটি দেশলাই জোগাড় করে হাঁটতে-হাঁটতে ফিরে এলেন অনেক বেলায়। হাঁটা ছাড়া উপায় কী? রিকশ? অমনি চড়াবে? হায় কালকের সেই ছ’আনার একখানাও যদি চোখে পড়ত? কিন্তু চোখে পড়লেই কি চিনতে পারতেন? কে ওদের মুখ মনে করে রাখে? রোদ চড়চড় করছে। যে-কোনও একটা খোঁদল দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। সারা বাড়ি সুনসান, চুপচাপ। ছেলেমেয়েগুলো গেল কোথায়?
নিমাইচরণ ভাঙা-ভাঙা ভয়-ভয় গলায় ডাক দিলেন, ‘‘মিমি, টুসকি!’’ কোন্ একটা ঘর থেকে টুসকি বেরিয়ে এল, উৎফুল্ল হাসি-হাসি মুখে। নিমাইচরণ ভাবলেন, আহা, আমার যদি ওদের মত ধাত হত! কাল থেকে উপোস চলছে। আমার তো পেটের মধ্যে রেলগাড়ির হুইসল বাজছে, কাকচিল ডানা ঝাপটাচ্ছে, ছুঁচোয় ডন্বৈঠক করছে, অথচ এরা? এখনো হাসি মুখ! বোধহয় ক্যারমে জিতেছে। পকেট থেকে দেশলাইটা বার করে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘এই নাও তোমার দেশলাই।’’ টুসকি কাছে এসে বলে ওঠে, ‘‘ইস বাপি, এটার বদলে যদি একটু নুন আনতে গো!’’ ‘‘নুন!’’
‘‘হ্যাঁ বাপি! আমরা না এই বাড়ির বাগানে একটা অদ্ভুত খাবার জিনিস পেয়ে গেছি, ইয়া বড়। সব্বাইয়ের পেট ভরে যাচ্ছে, শুধু যদি একটু নুন থাকত। আরও ভাল লাগত।’’ নিমাইচরণ ভয় পেয়ে বলেন, ‘‘বাগান থেকে কী আবার খেতে গেলি? বিষাক্ত নাকি? দেখি-’’ দেখেন গিয়ে। চার ভাই বোনে বৃহৎ কী একটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কামড়ে-কামড়ে খাচ্ছে। কী করবে? ছুরি তো নেই। বঁটি-কাটারি কিছুই না। কিন্তু কী ওটা?
নিমাইচরণ অবলোকন করেন, একটি হৃষ্টপুষ্ট বৃহৎ লাউ। নিমাইচরণ চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ‘‘কোথায় পেলি এটা?’’ ‘‘জঙ্গলের ধারে-শশা কি পেয়েরা-টেয়ারা খুঁজতে গিয়ে হিজিবিজির মধ্যে আবিষ্কার করলাম বাপি।’’ নিমাইচরণ কেঁদে ফেলে বলেন, ‘‘কাঁচা লাউ খাচ্ছিস তোরা?’’ ওরা এক মুখ লাউসমেত একমুখ হেসে বলে, ‘‘ফার্স্ট ক্লাস খেতে বাপি! ঠিক কচি শশার মতনই। একটু যদি নুন থাকত। আঃ! মার্ভেলাস ! বাপি, তুমি একটু খেয়ে দেখলে বুঝতে।’’ নিমাই-গিন্নী আকাশ থেকে পড়ে বলেন, ‘‘তোমরা চলে এলে যে?’’ নিমাইচরণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘চলে আসার জন্যেই তো টাকা পাঠাতে বলা হয়েছিল।’’ শুনে ভদ্রমহিলা ‘নেই’। তিনি ভাবছিলেন, ওখানে বোধহয় কোনো কিছু মজার জিনিস পাওয়া যাচ্ছে শস্তা-শস্তা। তাই টাকার দরকার। ‘‘তা অত টাকা যে সঙ্গে নিয়ে গেলে?’’ ‘‘ফুরিয়ে গেছে। বৃহদারণ্যক হাওয়ার গুণ।’’ নিমাই-গিন্নীর ইচ্ছে ছিল দিদিমা একটু সেরে উঠলেই তিনিও চলে যাবেন। তা নয়, এরাই চলে এল। ধ্যাৎ! বেজার গলায় বললেন, ‘‘তা এই তিনদিনের মধ্যে চলে আসা হল কেন?’’
নিমাইচরণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘তিনদিনেই যখন উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেল, ফর নাথিং বসে থেকে লাভ? তোমার ছেলেমেয়েদের অখিদে অরুচি অগ্নিমান্দ্য সব সেরে গেছে। ‘ঘর খাই বাড়ি খাই’ খিদে! দেখগে যাও এতক্ষণে বোধহয় রান্নাঘরে গিয়ে বামুন ঠাকুরের মাথাটা খাচ্ছে।’’ ‘‘বলো কী গো? হাওয়ার এমন গুণ? যাই, কবরেজ-ঠাকুরদাকে লিখে দিই গে। তা তোমাদের মালপত্র?’’ ‘‘মালপত্র?’’ নিমাইচরণ আরও গম্ভীর গলায় বলেন, ‘‘সে সব আর আনতে পারলাম কই? ঘরবাড়ি, রেলগাড়ি, ইঞ্জিন এ সব কিছু না পেয়ে ওইগুলোই শেষ করতে হয়েছে। এটাও লিখে দিতে পারো কবরেজ-ঠাকুর্দাকে।’’ আসল কথাটি ফাঁস করবেন নাকি নিমাইচরণ? করলেই গিন্নী বলে বসবেন যে, তিনি যাননি বলেই এমন অঘটন। যাক্ গে যাক জিনিস! কিনলে আবার হবে। ছেলেমেয়েদের শক্ত ব্যাধির ওষুধটা তো আবিষ্কার করে ফেলা গেছে!