স্বপ্নে তো কত রকম বিদকুটে জিনিস দেখা যায়, এ বোধহয় সেই রকম একটা কিছু হবে। কিন্তু সবটা স্বপ্ন নয়। সে বেশ বুঝতে পারল কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে যা স্বাভাবিক নয়।
এরপরে চারদিকে কচমচ খচমচ আওয়াজ হতে লাগল। সর্বনাশ! মনে হল যেন কড়াপাকের সন্দেশগুলো কেউ কচর-মচর করে খাচ্ছে। এদিকে তার টর্চটা যেটা এতক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরছিল সেটাও স্থির হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। সে আলোতে কতই বা দেখা যায় কিন্তু তবু ঐটুকু আলোতেই সে দেখল তার সুটকেস খোলা, আর তার সব জিনিস কোথায় যে সব হাওয়া হয়ে গেছে!
তার কান্না পেতে লাগল। সে ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে উঠল, ডাকাত ডাকাত! কিন্তু তার চিৎকার করাই সার হল। কে আসবে তাকে সাহায্য করতে? রতনদিয়া গ্রাম তখন চ্যাংড়া ভূতেদের কজ্জায়। ভূতেদের তখন সন্দেশ খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। তারা বলল—
ওরে বাবা! এ যে সত্যি তাকে কারা যেন ধরে শূন্যে লোফালুফি খেলতে লাগল। সে একবার কাদের ঠান্ডা হাতে পড়ে যায়, আবার অন্য কারা ঠান্ডা হাতে লুফে নেয়। এ তো সাংঘাতিক খেলা এদের। ভূত তা হলে সত্যি আছে—সত্যি আছে! সে ভয়ে চিৎকার করতে লাগল আর বলতে লাগল, বাঁচাও বাঁচাও! ওরে বাবারে মরে গেলাম রে, মেরে ফেলল রে, বাঁচাও বাঁচাও !
এইরকম কতক্ষণ চলল সে শ্ৰীকাস্তের খেয়াল নেই। হঠাৎ একসময় তার মনে হল ভূতেদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। তারা তাকে প্রায় আকাশসমান উঁচু থেকে ছেড়ে দিল, আর শ্রীকান্ত মাটিতে পড়তে লাগল। এবার আর রক্ষা নেই। শ্রীকান্ত এত বিপদেও রামনাম করেনি। করলেও কী হত কে জানে, আজকালকার ছোকরা ভূতেরা রামনামের তোয়াক্কা করে না।
শ্ৰীকান্ত পড়তে লাগল—এর মধ্যে সে শুনতে পেল ইংরিজিতে কারা সব কথা বলছে। তাদেরও নাকি-সুর! বুঝতে না বুঝতে সে মাটির উপর আছড়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল তার হাড়টাড় সব ভেঙে গেল। পরে তার আর জ্ঞানই রইল না।
একটু একটু জ্ঞান হলে সে দেখতে পেল সে একটা চমৎকার ঘরে শুয়ে আছে। আশেপাশে অনেকগুলো খাট। প্রত্যেক খাটের উপর গদির বিছানা। শ্রীকান্ত বুঝল সে কোনো হাসপাতালে শুয়ে আছে। ভালো হাসপাতাল। শ্রীকান্ত এ-রকম হাসপাতাল দেখেছে। সে দেখতে পেল সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরা নার্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা আবার মেমসাহেব! শ্ৰীকান্ত একটুখানি নড়াচড়া করতেই একটি নার্স এসে বলল, গুড মনিং সার! শ্রীকান্ত ইংরেজি জানত মোটামুটি। সে বলল, গুড মনিং মিস। এমন সময় একজন মোটাসোটা লম্বা চেহারার সাহেব ডাক্তার এসে তার কাছে একটা ছোট টুল নিয়ে বসলেন। বললেন, কেমন বোধ করছ? শ্রীকান্ত বলল, ভালোই তো মনে হচ্ছে তবে গায়ে বেশ ব্যথা, মাথাতেও ব্যথা খুব। ডাক্তার বললেন, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। তুমি কোন দেশের লোক, তোমাকে কারা মেরেছিল? শ্রীকান্ত বলল, কোন দেশের লোক মানে? আমি এদেশেরই লোক! ডাক্তার বললেন, এদেশের কোথায় তোমার বাড়ি? শ্রীকান্ত বলল, কলকাতা আমার বাসস্থান। ডাক্তার বললেন, এই দেশটা হচ্ছে ইংল্যান্ড। তুমি লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে রয়েছ। তাছাড়া অনেকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। কেউ তোমার নাম জানে না কিছু না, তোমাকে কেউ ভর্তি করায়নি এই হাসপাতালে! একদিন রাত্রে হঠাৎ তোমাকে এই বিছানায় দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। সেও আজ প্রায় দশ দিন হয়ে গেল। তোমার জ্ঞান ছিল না। তোমার হাড়টাড় সব ভাঙা ছিল, কিন্তু কারা সব জোড়া দিয়েছিল, তারপর তারা এখানে এনে ফেলে গিয়েছিল। এই কাজ কারা করেছিল তুমি জান?
শ্ৰীকান্তর এবার মাথাটা ঘুরে উঠল। এ কি কথা—সে এখন লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে? অসম্ভব! অসম্ভব! সে আর ভাবতে পারল না, কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইল। সাহেব ডাক্তার বললেন, না, এর সঙ্গে অত কথা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি, পরে ভালো করে ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হবে। কলকাতার লোক বলছে এ। নামটাও তো জানা যাচ্ছে না, তাহলে কলকাতায় একটা খবর পাঠিয়ে দেওয়া যেত। যাই হোক, এরপর ওর জ্ঞান হলে ওর নাম আর ঠিকানাটা জোগাড় করতে হবে। ডাক্তার নার্সকে কথাগুলো বলে ভ্রু কুঁচকে কি ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন।
শ্ৰীকান্তকে চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা খালি একটা খাটে পড়ে থাকতে দেখেন নাইট ডিউটির একজন সিনিয়র নার্স রোগীর না ছিল পরিচয়, না ছিল কোনও রিপোর্ট। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় কোনও ইন্ডিয়ান উটকো লোক, থাকবার জায়গার অভাবে লুকিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছে। পরে পরীক্ষা করে দেখেন লোকটির সারা গায়ে নানারকম আঘাতের চিহ্ন। লোকটি সম্পূর্ণ অজ্ঞান। তারপর নানা কৌশলে তার এক্স-রে করে দেখা যায় তার অসংখ্য হাড় ভাঙা, তবে সেগুলো সেট করা হয়েছে ঠিক ভাবেই। এটা ভারী আশ্চর্যজনক ব্যাপার বলে তাদের মনে হয়। চামড়া না কেটে, বাইরে থেকে এমন ভাবে হাড় জোড়া দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিশেষ করে যে-সব হাড় ভেঙে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে সেগুলোকে বাইরে থেকে সেট করা যায় না। এই নিয়ে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়।
শ্রীকান্তকে বিশেষ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তার জন্য একটা মেডিক্যাল টিমও গঠন করা হয়। অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শের পর যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাতে সে দ্রুত সেরে উঠতে থাকে। দুদিন আগে তাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই দাঁড় করানোও হয়। খবরের কাগজের লোকেরাও এই বিস্ময়কর রোগীকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতুহল দেখায়। কিন্তু লোকটির পরিচয় কেউই বার করতে পারে না। কলকাতায় বাড়ি এটা শুনে কলকাতায় খোঁজও করেছিল পুলিশ, কিন্তু পুলিশ ওপর ওপর খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছিল তারা ঠিক ধরতে পারছে না। লোকটির নাম জানলেও একটা চেষ্টা করা যেত। কলকাতা থেকে রোজ কম লোক তো নিরুদ্দেশ হয় না।
এরপর চলতে লাগল অপেক্ষা আর চিকিৎসা। আস্তে আস্তে শ্ৰীকান্ত প্রায় সম্পূর্ণই সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু অসুবিধে তারও ছিল। সে তার নিজের নামটাই আর মনে আনতে পারল না! সে কেবল বলত আমার বাড়ি কলকাতা, বাস! এইভাবে চলল আরও দু’মাস। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ। এক্সরে করে দেখা হয়েছে তার হাড়গুলো সবই বেমালুম জুড়ে গেছে! চামড়ায় যে সব কাটাছেড়ার দাগ ছিল সেগুলো মেলাল না তবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল।
এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সমস্যা হল একজন সুস্থ-সবল লোককে কোথায় পাঠানো হবে। হাসপাতালে রাখা চলবে না একেবারেই। সুস্থ লোককে হাসপাতালে রাখা যায় না। মানসিক রোগের হাসপাতালে পাঠানো হয়তো যায়, তার স্মৃতিশক্তি ফেরানোর চেষ্টা করা যায়। শ্ৰীকান্ত নিজেও কেমন যেন হয়ে পড়ল। তার নাম কি সে নিজেই জানে না! সে কেবল জানে তার বাড়ি কলকাতা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশেষে স্থির করলেন ওকে জাহাজে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে ওকে নিয়ে গাড়িতে করে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়ে আনলে তার হয়তো স্মৃতি ফিরে আসতেও পারে। অনেক টাকারও দরকার। সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে—সব ব্যবস্থা পাকা ।
যে দিন সকালের ট্রেনে টিলবেরি ডকে যাওয়ার কথা, সঙ্গে একজন যাবে তার সঙ্গে, তার আগের রাত্রে হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। হঠাৎ রাত দুটাে নাগাদ কর্তব্যরত নার্স শ্ৰীকান্তর বেডে এসে দেখল রোগী উধাও! খোঁজ খোঁজ! রোগী কোথাও নেই। ভারী আশ্চর্য ব্যাপার। হাসপাতালের দরজা বন্ধ, মেইন গেট বন্ধ, রোগী গেল কোথায়? চাঞ্চল্য পড়ে গেল চারদিকে। পুলিশ নানা সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য অনেক জায়গা খুঁজেও তার চিহ্ন পেল না!
রতনদিয়ায় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল এরপরেই। শ্রীকান্তকে পাওয়া গেল তার শ্বশুরবাড়ির একটা ঘরের মধ্যে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায়। শ্রীকান্তকে ওখানে ঐ ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ফের চাঞ্চল্য! সমস্ত গ্রাম দেখতে এল শ্রীকান্তকে। কালুখালি স্টেশন থেকে তাকে নামতে দেখেছে কয়েকজন সেই তিন মাস আগের বিচ্ছিরি ঐ রাত্রে! তারপর পাওয়া গেছে তার ভাঙা সুটকেস, আর ছড়ানো সব জিনিসপত্র। রক্তের ছাপ। ধস্তাধস্তির চিহ্ন। কেবল মানুষটাই হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। সর্বত্র নেমে এসেছিল শোকের কুয়াশা! তারপর দিনের পর দিন গেল অথচ শ্ৰীকান্তর হদিস পাওয়া গেল না তখন সকলে ধরেই নিল শ্ৰীকান্তকে ভূতে খেয়েছে! কেননা সে রাত্রে ভূতেদের নানা চিৎকার আর হল্লা শোনা গিয়েছিল, ভূতদের বিচ্ছিরি সব ছড়াও শুনেছিলেন বহু মানুষ। গুণিনরা ফিরে এসে গ্রামের সব ভূতদের জেরা করেও কোনো সদুত্তর পাননি। সকলে একবাক্যে বলেছে, জানি না—
একটা সত্যি কথা ছোট ভূতেরা সকলে বলেছে, তারা শ্ৰীকান্তকে দেখেছে কিন্তু তাকে কেউ মারেনি। এটা হতেই পারে তারা কেবল তাকে নিয়ে একটু লোফালুফি করেছিল, মারেনি। কিল না ঘুষি না লাঠির আঘাত না, কেবল উঁচু থেকে একবার ধপ করে ফেলে দিয়েছিল। সেটাকে মারা বলা যায় কি? তাছাড়া একটা ব্যাপার তারাও বুঝতে পারেনি, হঠাৎ কোত্থেকে একদল সাদা ধরনের ভূত (সঙ্গে একটু যেন নীল নীল ভাব) এসে মস্তানি করে তাদের হঠিয়ে দিয়েছিল আর মানুষটাকে কোথায় হাওয়া করে দিয়েছিল কেমন করে। ছোকরা ভূতদের ধারণ ঐ অদ্ভুত ভূতেরা লোকটিকে পুরোপুরি খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে-কথা তারা কাউকে বলেনি।
বড় ভূতেরা ছোকরা ভূতদের আর বেশি ঘাটাননি। বড় বড় ভূতরাও সেদিন গ্রামে ছিলেন না। সে জন্য ছোকরা ভূতদের জঘন্য সব কীর্তিকলাপ দেখতে পাননি। পরে আন্দাজ করেছিলেন কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু ঘাটাননি।
এদিকে আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল—শ্ৰীকান্ত চাটুজ্জের সব ঘটনা প্রকাশ হবার পর তাকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। ওর শ্বশুরবাড়িতে একটা বড় উৎসব হয় গ্রামের প্রথম বিলাতফেরত জামাই বলে। তার আগে ঐ গ্রামের কোনো জামাই বিলেত যায়নি। আর ঐ বিলাতফেরত হবার জন্যই তাকে বেশ বড় রকমের একটা কাজও দেওয়া হয়। শ্রীকান্ত ছিল একজন সামান্য কেরানি। মাসে মাইনে ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা। বড় পদে প্রতিষ্ঠিত করার পর তার মাইনে বেড়ে হল দুশো দশ টাকা! হবে না? বিলাতফেরত যে! তা ঐ সময়ে বিলাতফেরতদের ঐ রকমই সম্মান ছিল।
এখন সে গ্রামই বা কোথায়, আর ভূতেরাই বা কোথায়!
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
গুড মনিং মিস। এমন সময় একজন মোটাসোটা লম্বা চেহারার সাহেব ডাক্তার এসে তার কাছে একটা ছোট টুল নিয়ে বসলেন। বললেন, কেমন বোধ করছ? শ্রীকান্ত বলল, ভালোই তো মনে হচ্ছে তবে গায়ে বেশ ব্যথা, মাথাতেও ব্যথা খুব। ডাক্তার বললেন, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। তুমি কোন দেশের লোক, তোমাকে কারা মেরেছিল? শ্রীকান্ত বলল, কোন দেশের লোক মানে? আমি এদেশেরই লোক! ডাক্তার বললেন, এদেশের কোথায় তোমার বাড়ি? শ্রীকান্ত বলল, কলকাতা আমার বাসস্থান। ডাক্তার বললেন, এই দেশটা হচ্ছে ইংল্যান্ড। তুমি লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে রয়েছ। তাছাড়া অনেকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। কেউ তোমার নাম জানে না কিছু না, তোমাকে কেউ ভর্তি করায়নি এই হাসপাতালে! একদিন রাত্রে হঠাৎ তোমাকে এই বিছানায় দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। সেও আজ প্রায় দশ দিন হয়ে গেল। তোমার জ্ঞান ছিল না। তোমার হাড়টাড় সব ভাঙা ছিল, কিন্তু কারা সব জোড়া দিয়েছিল, তারপর তারা এখানে এনে ফেলে গিয়েছিল। এই কাজ কারা করেছিল তুমি জান?
শ্ৰীকান্তর এবার মাথাটা ঘুরে উঠল। এ কি কথা—সে এখন লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে? অসম্ভব! অসম্ভব! সে আর ভাবতে পারল না, কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইল। সাহেব ডাক্তার বললেন, না, এর সঙ্গে অত কথা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি, পরে ভালো করে ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হবে। কলকাতার লোক বলছে এ। নামটাও তো জানা যাচ্ছে না, তাহলে কলকাতায় একটা খবর পাঠিয়ে দেওয়া যেত। যাই হোক, এরপর ওর জ্ঞান হলে ওর নাম
আর ঠিকানাটা জোগাড় করতে হবে। ডাক্তার নার্সকে কথাগুলো বলে ভ্রু কুঁচকে কি ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন।
শ্ৰীকান্তকে চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা খালি একটা খাটে পড়ে থাকতে দেখেন নাইট ডিউটির একজন সিনিয়র নার্স রোগীর না ছিল পরিচয়, না ছিল কোনও রিপোর্ট। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় কোনও ইন্ডিয়ান উটকো লোক, থাকবার জায়গার অভাবে লুকিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছে। পরে পরীক্ষা করে দেখেন লোকটির সারা গায়ে নানারকম আঘাতের চিহ্ন। লোকটি সম্পূর্ণ অজ্ঞান। তারপর নানা কৌশলে তার এক্স-রে করে দেখা যায় তার অসংখ্য হাড় ভাঙা, তবে সেগুলো সেট করা হয়েছে ঠিক ভাবেই। এটা ভারী আশ্চর্যজনক ব্যাপার বলে তাদের মনে হয়। চামড়া না কেটে, বাইরে থেকে এমন ভাবে হাড় জোড়া দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিশেষ করে যে-সব হাড় ভেঙে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে সেগুলোকে বাইরে থেকে সেট করা যায় না। এই নিয়ে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়।
শ্রীকান্তকে বিশেষ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তার জন্য একটা মেডিক্যাল টিমও গঠন করা হয়। অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শের পর যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাতে সে দ্রুত সেরে উঠতে থাকে। দুদিন আগে তাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই দাঁড় করানোও হয়। খবরের কাগজের লোকেরাও এই বিস্ময়কর রোগীকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতুহল দেখায়। কিন্তু লোকটির পরিচয় কেউই বার করতে পারে না। কলকাতায় বাড়ি এটা শুনে কলকাতায় খোঁজও করেছিল পুলিশ, কিন্তু পুলিশ ওপর ওপর খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছিল তারা ঠিক ধরতে পারছে না।
লোকটির নাম জানলেও একটা চেষ্টা করা যেত। কলকাতা থেকে রোজ কম লোক তো নিরুদ্দেশ হয় না।
এরপর চলতে লাগল অপেক্ষা আর চিকিৎসা। আস্তে আস্তে শ্ৰীকান্ত প্রায় সম্পূর্ণই সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু অসুবিধে তারও ছিল। সে তার নিজের নামটাই আর মনে আনতে পারল না! সে কেবল বলত আমার বাড়ি কলকাতা, বাস! এইভাবে চলল আরও দু’মাস। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ। এক্সরে করে দেখা হয়েছে তার হাড়গুলো সবই বেমালুম জুড়ে গেছে! চামড়ায় যে সব কাটাছেড়ার দাগ ছিল সেগুলো মেলাল না তবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল।
এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সমস্যা হল একজন সুস্থ-সবল লোককে কোথায় পাঠানো হবে। হাসপাতালে রাখা চলবে না একেবারেই। সুস্থ লোককে হাসপাতালে রাখা যায় না। মানসিক রোগের হাসপাতালে পাঠানো হয়তো যায়, তার স্মৃতিশক্তি ফেরানোর চেষ্টা করা যায়। শ্ৰীকান্ত নিজেও কেমন যেন হয়ে পড়ল। তার নাম কি সে নিজেই জানে না! সে কেবল জানে তার বাড়ি কলকাতা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশেষে স্থির করলেন ওকে জাহাজে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে ওকে নিয়ে গাড়িতে করে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়ে আনলে তার হয়তো স্মৃতি ফিরে আসতেও পারে। অনেক টাকারও দরকার। সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে—সব ব্যবস্থা পাকা ।
যে দিন সকালের ট্রেনে টিলবেরি ডকে যাওয়ার কথা, সঙ্গে একজন যাবে তার সঙ্গে, তার আগের রাত্রে হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। হঠাৎ রাত দুটাে নাগাদ কর্তব্যরত নার্স শ্ৰীকান্তর বেডে এসে
দেখল রোগী উধাও! খোঁজ খোঁজ! রোগী কোথাও নেই। ভারী আশ্চর্য ব্যাপার। হাসপাতালের দরজা বন্ধ, মেইন গেট বন্ধ, রোগী গেল কোথায়? চাঞ্চল্য পড়ে গেল চারদিকে। পুলিশ নানা সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য অনেক জায়গা খুঁজেও তার চিহ্ন পেল না!
রতনদিয়ায় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল এরপরেই। শ্রীকান্তকে পাওয়া গেল তার শ্বশুরবাড়ির একটা ঘরের মধ্যে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায়। শ্রীকান্তকে ওখানে ঐ ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ফের চাঞ্চল্য! সমস্ত গ্রাম দেখতে এল শ্রীকান্তকে। কালুখালি স্টেশন থেকে তাকে নামতে দেখেছে কয়েকজন সেই তিন মাস আগের বিচ্ছিরি ঐ রাত্রে! তারপর পাওয়া গেছে তার ভাঙা সুটকেস, আর ছড়ানো সব জিনিসপত্র। রক্তের ছাপ। ধস্তাধস্তির চিহ্ন। কেবল মানুষটাই হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। সর্বত্র নেমে এসেছিল শোকের কুয়াশা! তারপর দিনের পর দিন গেল অথচ শ্ৰীকান্তর হদিস পাওয়া গেল না তখন সকলে ধরেই নিল শ্ৰীকান্তকে ভূতে খেয়েছে! কেননা সে রাত্রে ভূতেদের নানা চিৎকার আর হল্লা শোনা গিয়েছিল, ভূতদের বিচ্ছিরি সব ছড়াও শুনেছিলেন বহু মানুষ। গুণিনরা ফিরে এসে গ্রামের সব ভূতদের জেরা করেও কোনো সদুত্তর পাননি। সকলে একবাক্যে বলেছে, জানি না—
একটা সত্যি কথা ছোট ভূতেরা সকলে বলেছে, তারা শ্ৰীকান্তকে দেখেছে কিন্তু তাকে কেউ মারেনি। এটা হতেই পারে তারা কেবল তাকে নিয়ে একটু লোফালুফি করেছিল, মারেনি। কিল না ঘুষি না লাঠির আঘাত না, কেবল উঁচু থেকে একবার ধপ করে ফেলে দিয়েছিল। সেটাকে মারা বলা যায় কি? তাছাড়া একটা ব্যাপার তারাও বুঝতে পারেনি, হঠাৎ কোত্থেকে একদল সাদা
ধরনের ভূত (সঙ্গে একটু যেন নীল নীল ভাব) এসে মস্তানি করে তাদের হঠিয়ে দিয়েছিল আর মানুষটাকে কোথায় হাওয়া করে দিয়েছিল কেমন করে। ছোকরা ভূতদের ধারণ ঐ অদ্ভুত ভূতেরা লোকটিকে পুরোপুরি খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে-কথা তারা কাউকে বলেনি।
বড় ভূতেরা ছোকরা ভূতদের আর বেশি ঘাটাননি। বড় বড় ভূতরাও সেদিন গ্রামে ছিলেন না। সে জন্য ছোকরা ভূতদের জঘন্য সব কীর্তিকলাপ দেখতে পাননি। পরে আন্দাজ করেছিলেন কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু ঘাটাননি।
এদিকে আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল—শ্ৰীকান্ত চাটুজ্জের সব ঘটনা প্রকাশ হবার পর তাকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। ওর শ্বশুরবাড়িতে একটা বড় উৎসব হয় গ্রামের প্রথম বিলাতফেরত জামাই বলে। তার আগে ঐ গ্রামের কোনো জামাই বিলেত যায়নি। আর ঐ বিলাতফেরত হবার জন্যই তাকে বেশ বড় রকমের একটা কাজও দেওয়া হয়। শ্রীকান্ত ছিল একজন সামান্য কেরানি। মাসে মাইনে ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা। বড় পদে প্রতিষ্ঠিত করার পর তার মাইনে বেড়ে হল দুশো দশ টাকা! হবে না? বিলাতফেরত যে! তা ঐ সময়ে বিলাতফেরতদের ঐ রকমই সম্মান ছিল।
এখন সে গ্রামই বা কোথায়, আর ভূতেরাই বা কোথায়!