বাবলুকে একা বাসায় রেখে তার মা-বাবা ভৈরবে বেড়াতে গেছেন। সকালের ট্রেনে গেছেন, ফিরবেন রাত৯টায়। এই এত সময় বাবলু একা থাকবে। না, ঠিক একা না, বাসায় কাজের বুয়া আছে। বাবলুর খুব ইচ্ছা ছিল সেওভৈরব যাবে। অনেক দিন সে ট্রেনে চড়ে না। তার খুব ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করছিল। তা ছাড়া ভৈরবে ছোটখালার বাড়িতেও অনেক মজা হবে। ছোটখালার বাড়িটা নদীর উপরে। নিশ্চয়ই নৌকায় চড়া হবে। বাবলু অনে দিন নৌকাতেও চড়ে না। তাকে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যাওয়াযেত। কিন্তু বাবলুর বাবা মনসুর সাহেব তাকে নেবেন না। তিনি চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, নো নো নো। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বেড়ানো আমিপছন্দ করি না। তুমি বাসায় থাক। হোমওয়ার্ক শেষ করো। বাবলু ক্ষীণ গলায় বলল, হোমওয়ার্ক শেষ করে রেখেছি। ‘শেষ করলে অন্য কাজ করো। দেখি, অঙ্ক বই নিয়ে আস, দাগিয়ে দিই। অঙ্ক করে রাখ_ভৈরব থেকে ফিরে এসে দেখব।’ বাবলু অঙ্ক বই নিয়ে এলো।মনসুর সাহেব ২০টা অঙ্ক দাগিয়ে দিলেন। ‘সব করবে। একটা বাদ থাকলে কানে ধরে চড়কিপাক খাওয়াব। সারা দিন আছেই শুধু খেলার ধান্ধায়।’ বাবলুর চোখে পানি এসে গেল। সারা দিন সে তো খেলার ধান্ধায় থাকে না। খেলাধূলা যা করার স্কুলেইকরে। বাসায় ফিরে বাবার ভয়ে চুপচাপ বই নিয়ে বসেথাকে। বাবলু তার বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। বাবাদেরকোনো ছেলেই এত ভয় পায় না_বাবলু পায়, কারণ মনসুর সাহেব বাবলুর আসল বাবা না, নকল বাবা। বাবলুর আসল বাবার মৃত্যুরপর তার মা তাঁকে বিয়ে করেন। তবে লোকটা যে খুব খারাপ তা-ও বলা যাবে না। বাবলুকে তিনি প্রায়ই খেলনা, গল্পের বই_এসব কিনে দেন। কিছুদিন আগে দামি একটা লেগোর সেট কিনেদিয়েছেন। তবে বাবলুর সব সময় মনে হয় তার আসল বাবা বেঁচে থাকলে লাখো গুণ বেশি মজা হতো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে ভৈরব যেতেন না।
বাবলু কোথাও যেতে পারে না। বেশির ভাগ সময় সোবাহানবাগ ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলায়ইতাকে বন্দি থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে তার এমন কান্নাপায়।! তার কান্না দেখলে মা কষ্ট পাবেন বলে সে কাঁদে না। তার যখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে, তখন সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। বের হয়ে আসার সময় চোখ মুছে এমনভাবে বের হয় যে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। বাবলু বসার ঘরে অঙ্ক বই নিয়ে বসেছে। মনসুর সাহেব২০টা অঙ্ক দাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সে মাত্রএকটা অঙ্ক করেছে। অঙ্কগুলো এমন কঠিন! বুয়াগ্লাসভর্তি দুধ রেখে গেছে। দুধ খেতে হবে_না খেলে সে নালিশ করবে। গ্লাসটার দিকে তাকালেই বাবলুর বমি আসছে। সে অঙ্ককরছে গ্লাসটার দিকে না তাকিয়ে। এ সময় দরজায় খটখট শব্দ হলো। বাবলু দরজা খুলে দিল। সাত-আট বছর বয়েসী দুষ্ট দুষ্ট চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খালি পা। পরনে সাইজের বড় একটা প্যান্ট। প্যান্ট খুলে খুলে পড়ার মতো হচ্ছে আর সে টেনে টেনে তুলছে। তার গায়ে রঙিন শাট। শার্টের একটা বোতাম নেই।
বোতামের জায়গাটা সেফটি পিন দিয়েআটকানো। ছেলেটা বাবলুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল_এই, তুই আমার সঙ্গে খেলবি? বাবলু কথা বলল না। ছেলেটাকে সে চিনতে পারছে না। ফ্ল্যাটেরই কারো ছেলেহবে। তবে বাবলু আগে দেখেনি। অপরিচিত একটা ছেলে তাকে তুই তুই করছে, এটাও বাবলুর ভালো লাগছে না। ‘কথা বলছিস না কেন? খেলবি?’ ‘না।’ ‘আমি অনেক মজার মজার খেলা জানি।’ ‘আমি খেলব না। অঙ্ক করছি।’ ‘সকাল বেলা কেউ অঙ্ক করে? আয় কিছুক্ষণ খেলি-তারপর অঙ্ক করিস।’ ‘আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন?’ ‘বন্ধুকে তুই তুই করে বলব না? বন্ধুকে বুঝি আপনি আপনি করে বলব?’ ‘আমি তোমার বন্ধু না।’ ‘বন্ধু না। এখন হবি। ওই গ্লাসটায় কি দুধ নাকি?’ ‘হুঁ।’ ‘তোকে খেতে দিয়েছে?’ ‘হুঁ।’ ‘খেতে ইচ্ছা করছে না?’ ‘না।’ ‘দুধটাকে পেপসি বানিয়ে তারপর খা।’ ‘পেপসি কিভাবে বানাব?’ ‘মন্ত্র পড়লেই হয়। এর মন্ত্র আছে।
মন্ত্র জানিসনা?’ রাগে বাবলুর গা জ্বলে যাচ্ছে। কী রকম চালবাজের মতো কথা। মন্ত্র পড়লেই দুধ না-কি পেপসি হয়ে যাবে। মন্ত্র এতই সস্তা? ‘আমি মন্ত্র জানি। মন্ত্রপড়ে পেপসি বানিয়ে দেব?’ ‘দাও।’ ‘যদি দিই, তাহলে কি তুই খেলবি আমার সঙ্গে?’ ‘হুঁ।’ ছেলেটা ঘরে ঢুকল। চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে কী যেন বলে গ্লাসে ফুঁ দিল_বাবলু দেখল, দুধ দুধের মতোই আছে। আগের মতোই কুৎসিত সব ভাসছে। ছেলেটা বলল, দেখলি দুধ কেমন পেপসি বানিয়ে দিলাম, কঠিন মন্ত্র_তোকে শিখিয়ে দেব। এই মন্ত্র দিয়ে খাবার জিনিস বদলে ফেলা যায়। মনে কর, তোকে ছোট মাছ দিয়ে ভাত দিয়েছে, ছোট মাছ খেতে ইচ্ছা করছে না। মন্ত্র পড়ে ফু দিবি, ছোট মাছ হয়ে যাবে মুরগির রান। তুই মুরগির রান খাস, না বুকের মাংস? বাবলু বলল, দুধ তো আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি। ‘দেখাচ্ছে দুধের মতো কিন্তু এর স্বাদ এখন পেপসির মতো। খুব ঝাঁঝ।
একচুমুক খেলেই টের পাবি। একটা চুমুক দিয়ে দেখ।’ ছেলেটা কি তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে? বাবলুর রাগ লাগছে। কেউ তাকে বোকা বানানোর চেষ্টাকরলে তার রাগ লাগে। ছেলেটা বলল, আমার দিকে এমন রাগি চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? একটা চুমুক দিয়ে দেখ। বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুক খেয়ে দেখাযাক। ক্ষতি তো কিছু নেই। ছেলেটা যেভাবে বলছে, তাতেদুধ বদলে গিয়ে পেপসি হয়েও তো যেতে পারে। বাবলু চুমুক দিল। চুমুক দিয়েই থু করে ফেলে দিল। দুধ দুধের মতোই আছে_তার বুকের ভেতর দুধের সঙ্গে এক গাদা সরও ঢুকে গেছে। এই ছেলে দেখি মহা তেঁদড়।তাকে খুব বোকা বানাল। ‘ছেলেটা বলল, পেপসি হয়নি?’ ‘না।’ ‘সময় লাগবে। দিনের বেলা মন্ত্র চট করে লাগে না। দুধের গ্লাসটা এক কোনায় রেখে দে, কিছুক্ষণ পর দেখবি দুধ বদলে পেপসি হবে। এখন আয় আমরা খেলি। বেশিক্ষণ খেলব না। অল্প কিছুক্ষণ খেলে আমি চলে যাব।’ ‘আমি খেলব না। আমাকে অঙ্ক করতে হবে। তা ছাড়া তুমি মিথ্যাবাদী। মিথ্যাবাদীরসঙ্গে আমি খেলি না।’
‘আমি মিথ্যাবাদী তোকে কে বলল? দুধটা বদলাতে সময় লাগছে_বললাম না, গরমের সময় মন্ত্র সহজে ধরে না।’ ‘তুমি চলে যাও। আমার অঙ্ক শেষ করতে হবে।’ ‘কঠিন অঙ্ক?’ ‘হুঁ কঠিন।’ ‘খুব কঠিন?’ ‘হুঁ। খুব কঠিন।’ ‘কঠিন অঙ্ক সহজ করার একটা মন্ত্র আছে। ছে। সেটা শিখিয়েদেব? যেকোনো কঠিন অঙ্কের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রটা পড়ে দুই বার ফুঁ দিলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যাবে, চট করে করতে পারবি। দেব শিখিয়ে? ‘তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামিকরছ কেন? তুমি কি ভেবেছ? আমি বোকা? আমি মোটেই বোকানই।’ ‘মন্ত্র শিখবি না?’ ‘না শিখব না। আর শোন, আমাকে তুই তুই করবে না।’ ছেলেটা ফিস ফিস করে বলল_তুই এমন রেগে আছিস কেন? রাগ করা তো ভালো না।
আচ্ছা শোন, রাগ কমাবার মন্ত্র আমার কাছ থেকে শিখবি? এই মন্ত্রটা খুব সহজ। হাত মুঠো করে এই মন্ত্র একবার পড়লেই রাগ কমে যায়। নিজের রাগ তো কমেই, আশেপাশে যারা আছে তাদের রাগও কমে। মনে কর, তোর বাবা খুব রাগ করেছেন_তুই হাত মুঠো করে একবার মন্ত্রটা পড়বি। দেখবি মজা। তোর বাবার সব রাগ পানি হয়ে যাবে। তোকেহাসি মুখে কোলে তুলে নেবে। বাবলু বলল, তুমি যাও তো। ‘চলে যাব?’ ‘হ্যাঁ চলে যাবে এবং আর কোনোদিন আসবে না।’ ‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি। একটা খাতা আর কলম আন_চট চট করে মন্ত্রগুলো লিখে ফেল। আমিএকবার চলে গেলে আর আমাকে পাবি না।’ ‘তোমাকে আমার দরকারও নেই।’ ‘সত্যি চলে যাব?’ ‘হ্যাঁ, চলে যাবে।’ ‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি। তুই মন খারাপ করে বসেছিলি দেখে এসেছিলাম_আমি কে জানিস?’ ‘জানতে চাই না।’ ‘আমি হচ্ছি ভূত রাজার ছেলে। ভূতদের সব মন্ত্র আমি জানি। খাতাটা দে না। _অদৃশ্য হবার মন্ত্রটা লিখে রেখে যাই। চোখ বন্ধ করে তিনবার এই মন্ত্রটা পড়লেই অদৃশ্য হয়ে যাবি।
আর কেউ তোকে দেখতে পাবে না।’ ‘তুমি যাও তো।’ ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল। বাবলু দরজা বন্ধ করেআবার অঙ্ক নিয়ে বসল। কী যে কঠিন সব অঙ্ক। বাবলু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অঙ্ক সহজ করার কোনো মন্ত্র থাকলে ভালোই হতো। রান্নাঘর থেকে বুয়া চেঁচিয়ে বলল, দুধ খাইছ? বাবলু বলল, না। ‘তাড়াতাড়ি খাও। না খাইলে তোমার আব্বার কাছে নালিশ দিমু।’ ‘নালিশ দিতে হবে না, খাচ্ছি।’ বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। দুধ কোথায়? গ্লাসভর্তি পেপসি। বরফের দুটো টুকরাওভাসছে। বাবলু ভয়ে ভয়ে একটা চুমুক দিল। হ্যাঁ, সত্যি সত্যি পেপসি। কী ঝাঁঝ। মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে? বাবলু ছুটে ঘর থেকে বের হলো। ছেলেটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। ফ্ল্যাটেরদারোয়ান বলল, লাল সার্ট পরা একটা ছেলেকে সে শীষ দিতে দিতে রাস্তার ফুটপাতধরে এগিয়ে যেতে দেখেছে। এর বেশি সে আর কিছু জানে না।