কাঁঠ ফাঁটা রোদের মাঝেও নৌকায় পাল তুললো মজিদ মিয়া।
উদ্দ্যেশ্য ৩ জন যাত্রীকে নিয়ে পূবের দিকে যাওয়া।
ভাঁড়া ঠিক করার পর মজিদ মিয়ার নৌকায় চড়ে বসলো ৩ জন পান্জাবীওয়ালা পুরুষ।
নৌকা ছাড়ার আগে ঘাটের দিকা আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো মজিদ মিয়া।
তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে পাল তুলে ডিঙি ছাড়লো।
পূবের কোণে বাতাস থাকায় তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা তার।
তবে এত গরমের মধ্যে পূব পাড়ায় যেতে তার একটু বেশীই অসহ্য লাগছে।
যাত্রী ৩জন টঙের মধ্যে গিয়ে বসে পড়লো।
,,
,,
ছোট্ট একটা সংসার মজিদ মিয়ার।
২ ছেলে আর বৌ নিয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে তার দিন।
দুপুরের ভাঁড়াটা না গেলেও তার সমস্যা ছিলো না। তবে যাত্রীরা একটু বেশীই তাড়া দিলো।
মনে হয় কোনো জরুরী দরকার পড়েছে পূব পাড়ায়।
নাহলে এই গরম তার উপর রোদের ফোড়নে কেনই বা অযথা যাবে অতদূর?
ঘাট থেকে একটু দূরে পূর্বপাড়া। নৌকায় পাল তুলে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যাবে।
,,
,,
দুপুরের খাওয়াটা এখনো সারা হয়ে ওঠেনি মজিদ মিয়ার।
তাই সকালে সাথে করে আনা ভাত-তরকারি নৌকায় বসেই খুলতে লাগলো সে।
পেটের মধ্যে মনে হয় ছুঁচোর টান পড়েছে।
দ্রুত গামলায় ভাত আর আলু ভাজার তরকারি নেয় সে।
নাকে মুখে দ্রুত খেয়ে ঘটি-বাটি আবার যথাস্থানে রেখে দেয় আবার। দ্রুত খাওয়া শেষ করার কারণ হলো সামনে একটা বাঁক এসেছে।
সেটাকে সামলে নেয় মজিদ মিয়া।
টঙের ভেতর থেকে একজন জোরে চেঁচিয়ে বললো,,,
আর কতক্ষণ লাগবে মাঝি….
– এইতো এলাম বলে….
পাল্টা জবাব দেয় সে।
,,
,,
ওইতো দূরের শ্বশানটা দেখা যাইতেছে।
শ্বশানটা পেরুলেই আর কিছুক্ষণের মধ্যে পূব পাড়ার ঘাটে পৌঁছে যাবে মজিদ মিয়া।
.
.
শ্বশান বরাবর আসতেই মজিদ মিয়ার নৌকাটা একটু কেঁপে উঠলো।
সে ভাবলো হয়তো জোয়ারের কারণে এমনটি হয়েছে।
তাই দ্রুত নৌকায় হাল টানতে লাগলো।
,,
,,
পূব পাড়ার ঘাটে মজিদের নৌকা ভিঁড়েছে।
ঘাটে সবে অন্য মাঝিরা আসতে শুরু করেছে।
অনেক নৌকায় মাঝি বিহীন খালি পড়ে আছে।
মজিদের নৌকা থেকে ৩জন যাত্রী ঘাটে নেমে গেলো।
একজন বেঁটে মতো লোক এগিয়ে এসে পান্জাবীর পকেট থেকে একশ টাকার একখানা পুরনো নোট বের করে মজিদ মিয়ার হাতে ধরিয়ে দিলো।
টাকাখানা হাতে পাওয়ার পরই খুশিতে চকচক করে উঠলো মজিদ মিয়ার চোখ দু’খানি।
তবে টাকার উপর লাল বর্ণের ছাপ পড়ে আছে।
মনে হয় কোথা থেকে রক্তের দাগ লাগিয়েছে।
তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না মজিদ মিয়া।
একশ টাকা তার কাছে অনেক বড় পাওয়া।
,,
,,
অন্য সময় হলে হয়তো ২৫ টাকার উপরে কেউ ভাঁড়া দিতো না। অসময়ে এসেছে বলেই এতো টাকা।
টাকাটা হাতে নিয়ে মজিদ মিয়ার ছোট ছেলের কথা মনে পড়ে যায়।
গত কয়েকদিন ধরে সে একটা নতুন জামার আবদার করেছে তার কাছে।
মজিদ মিয়াও তার কাছে প্রতিশ্রুতি করেছে যে,,,
ছোট ছেলেকে একটা নতুন জামা কিনে দেবে।
টাকাটা লুঙ্গিতে শক্ত গিঁট বেঁধে তার মধ্যে পুরে নেয়।
,,
,,
এবার নৌকা থেকে পাল নামিয়ে ফেলে মজিদ মিয়া।
কারণ বাতাস এখনো পূবের দিকেই যাচ্ছে।
তাই পাল খাটিয়ে রাখলে কষ্ট বরং বেড়েই যাবে।
বাতাসের উল্টো দিকে আবার হাল ধরলো সে।
নৌকা গতি ফিরে পেলে সে বে-সুরা গলায় আনন্দে গান ধরলো,,,
ওরে…… মনো মাঝি রে…….
দে….রে……বৈঠা ছেড়ে দে…….
তবে এই সুর সে বেশীক্ষণ গলায় টিকিয়ে রাখতে পারলো না।
আকাশের দিকে তাঁকাতেই তার পিলে চমকে উঠলো।
ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।
এই বুঝি বৃষ্টি চলে আসবে।
প্রকৃতির এত বড় পরিবর্তন হঠাৎ করে হয়ে গেলো। যেটা মজিদ মিয়া ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি।
সাঁ সাঁ গতিতে ঝড় উঠে গেলো।
মজিদ মিয়া তার হালে আর গতি পেলো না।
বাধ্য হয়ে নৌকা কিনারে ভিঁড়ালো।
অন্ধকারে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
সামনের দিকে তাঁকিয়ে সে আঁচ করতে পারলো যে বনের মধ্যে এসে উঠেছে।
,,
,,
নৌকাটা ভিঁড়ে সে টঙের মধ্যে বসে রইলো।
ঝিমঝিম করে বৃষ্টি নামলো।
বৃষ্টির ফোঁটা নদীর পানিতে পড়ে একটা অদ্ভূদ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে।
কাঠের টঙটা পানির ঝাপটা বেশীক্ষণ সইতে পারলো না।
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো রমিজ মিয়ার মাথার উপর।
টঙের আঘাতে নৌকার উপরেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো সে।
,,
,,
আকাশটা অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে।
বৃষ্টিও পড়ছে না।
আস্তে আস্তে চোখ খুললো রমিজ মিয়া।
চোখের উপর দেখতে পেলো খোলা বিস্তৃত আকাশ।
একটু নড়া ওঠার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সে নিজেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলো।
আশে-পাশে চোখ মেলে দেখতে পালো সে ৪টি খুঁটি দিয়ে ঘোরা আঙিনার উপর শুয়ে আছে।
পিঠের নিচে কাঠ সাজানো।
মনে হচ্ছে কোনো মরা লাশকে পোড়ানোর পরিবর্তে তাকে চিতায় শোয়ানো হয়েছে।
কিন্তু কেন?
সে তো নিজের নৌকার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো।
,,
,,
তিনজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে।
গায়ে লম্বা সাদা পান্জাবী জড়ানো। মুখ গুলো খুব চেনা চেনা লাগছে।
হুম….
মজিদ চিনতে পেরেছে তাদের। এরাই তার নৌকাই করে সওয়ার হয়েছিলো। লোকগুলোর হাতে আগুনের মশাল।
মজিদ মিয়া চোখ তুলে তাদের মুখের দিকে তাঁকালেন।
মুখের মধ্যে কালো কালো অনেক লোম গজিয়েছে।
মুখের মাংস গুলো সেই লোমের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছে।
চোখ দুটো বিশ্রীভাবে গলানো।
মজিদ মিয়া আর সহ্য করতে পারলো না।
আবারো জ্ঞান হারালো।
শেষ বারের জন্য তার মনে হতে লাগলো,,,
তার ছোট ছেলেকে জামা কিনে দেওয়ার সেই প্রতিশ্রুতির কথা।
হয়তো একটু পরেই ওই তিনজনের হাতে থাকা আগুনের কারণে মজিদ মিয়া চিতায় জ্বলে মারা যাবে।
আর অসমাপ্ত থেকে যাবে তার প্রতিশ্রুতি।
………………………………………………..সমাপ্ত…………………………………………