সিংগাড়ায় বড় একটা কামড় বসিয়েই চমকে যায় জাফর আলী। আলুর পাশাপাশি মাংস জাতীয় কিছুর উপস্থিতি তাকে অবাক করে তোলে। এই পাড়াগাঁয়েও এখন তাহলে কলিজার সিংগাড়া পাওয়া যায়!! যেতেই পারে। প্রযুক্তির কল্যানে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে যেকোন কিছুই হতে পারে। তাছাড়া স্মার্টফোনতো এখন ঘরে ঘরে। জাফর আলী আরেকটা কামড় বসায়। বেশ সুস্বাদু। বেশি ক্ষুধা লাগার কারনে কিনা কে জানে! তাই সিংগাড়াটা শেষ হতেই আরেক পিস চেয়ে বসে দোকানির কাছে,
– মামা আরেকটা সিংগাড়া দাও।
– আর সিংগাড়া নাই। পানি খান। আমি চা দিতাছি।
দোকানির উত্তরে খানিকটা হতাশ হতে হলো জাফর আলীকে। যদিও এককোনায় রাখা বাটিতে দুটো সিংগাড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলে জাফর আলী। দোকানির বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের গ্লাস হাতে নিয়েই চুমুক দিলো সে। কি বিচ্ছিরি চা রে বাবা! মনে মনে দোকানিকে গালি দিয়ে ওঠে। যে দোকানের সিংগাড়া এতো চমৎকার সেই একই দোকানের চা এরকম হয় কিভাবে! চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বিল জানতে চায় জাফর আলী,
– তোমার বিল কতো হলো?
– তিনটাকা।
– তিনটাকা!!!
– হ। সিংগাড়া দুই টাকা আর চা একটাকা।
কলিজার সিংগাড়ার দাম দুইটাকা শুনে জাফর আলী ভয়ানক বিরক্ত হয়! এই রাত বিরাতে দোকানি কি তার সাথে মস্করা করছে নাকি! এবার একটু চড়া গলায় বলে ওঠে,
– ঠিক করে বলো বিল কতো হলো?
– তিনটাকা।
– কলিজার সিংগাড়ার দাম দুইটাকা কিভাবে হয়!!!
– কলিজার সিংগাড়া কই পাইলেন? এইটাতো শুধু আলুর সিংগাড়া।
– আমার মুখে পড়লো দুই পিস আর তুমি বলছো শুধু আলু!
– আপনার ভুল হচ্ছে। অনেক্ষন গাড়ি চালাইলে এরকম হইতে পারে! যান আর দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট করেন। তাড়াতাড়ি বাড়িত গিয়া ঘুম দেন। দেখবেন সকালে সব ঠিক হয়ে গ্যাছে।
অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে পড়লো জাফর আলী। আরো এক দেড় ঘন্টা গাড়ি চালাতে হবে তাকে। তারপর ঢাকায় পৌছাবে সে। টিপটা জাফর আলী হঠাতই পেয়েছে। জাফর আলীর মালিক খোরশেদ সাহেব সপরিবারে চিটাগাং গিয়েছেন আজ সকালে। গাড়িটা রঙ করার জন্য শরাফতের গ্যারেজে ছিলো। জাফর আলীকে বলা হয়েছিলো গাড়ির কাজ শেষ হলে গাড়িটা বাসায় এনে রাখতে। আজ দুপুরে গাড়ি আনতে গেলে শরাফতই তাকে প্রস্তাবটা দিলো। এক দুবাই প্রবাসী আজ বিকালে দেশে ফিরবে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। জাফর আলী চাইলে এই ফাঁকে গাড়িটাকে কাজে লাগিয়ে কিছু বাড়তি ইনকাম করে নিতে পারে। প্রস্তাব দিতে যতক্ষন। জাফর আলী একবাক্যেই রাজি। বাড়তি ইনকামের লোভ সামলানো দেবতারই কম্য নয়। আর জাফর আলী তো সামান্য মানুষ। সেই টিপের ফিরতি পথেই আছে সে। জাফর আলীর ভাগ্য মন্দ। কুমিল্লা থেকে আরো বারো কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে। ওদের নামিয়ে দিয়ে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষন পরেই গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেলো। আশপাশে তেমন কোন দোকানপাট নেই যে টায়ারটা সেরে নেবে। রাজ্যের ঝামেলা পার করে সবকিছু ঠিকঠাক করে আবার যখন যাত্রা শুরু করলো তখন ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর পেরিয়েছে। ঘুমে জাফর আলীর দু’চোখ লাল হয়ে গিয়েছিলো। সেই ঘুম কাটাতেই এই চায়ের দোকানে বসা। এতোরাতে চায়ের দোকান খোলা পাবে এমনটা সে আশা করেনি। একটু অবাকও হয়েছিলো। তবে সিংগাড়ার স্বাদ সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিলো তাকে। এখন উঠে আবার গাড়ি চালাতে হবে ভাবতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো জাফর আলীর।
ঢাকার কাছাকাছি পৌছাতেই কেমন জানি শীত শীত অনুভূতি হলো জাফর আলীর। ঢাকায় আবার বৃষ্টি হলো নাকি আজ! হতে পারে। এখন তো আর বৃষ্টি নামার কোন নিয়ম কানুন নেই। ফাঁকা রাস্তায় আরো জোরে টেনে চললো জাফর আলী। গাড়ি মালিকের বাড়িতে পৌছে মেসে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা বাজলো। রুমে ঢোকার পরেই জ্বরের ব্যাপারটা প্রথম বুঝতে পারলো জাফর আলী। তার জ্বর এসেছে। কাঁপুনি দেওয়া জ্বর। দেরি না করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
রাসেলের দোকানে প্রতিদিন সকালে নাস্তা করতে ঢোকে জাফর আলী। আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। দুটো পরোটা আর ডালভাজি। এই হলো তার নিয়মিত মেন্যু। পকেটে পয়সা থাকলে ডিম পোচও চলে। ডিম জাফর আলীর অত্যন্ত প্রিয়। জাফর আলীর যখন অনেক টাকা পয়সা হবে তখন সে একসাথে চার পাঁচটা ডিম খাবে। এই আশায় সে আজ অনেকগুলো দিন বুক বেধে আছে। আজ অবশ্য একটা ডিম খাওয়াই যায়। কাল অনেকগুলো টাকা বাড়তি ইনকাম হলো। বেশ জোরের সাথেই তাই ডিম পোচের অর্ডারটা দিয়ে দিলো। বেশ আয়েশ করে পরোটাটা মুখে পুরতেই ওয়াক ওয়াক শব্দ বের হয়ে এলো মুখ থেকে। বেশ কষে একটা ঝাড়ি দিলো। এতো বাজে খাবার আগে কখনো মুখে তুলেছে বলে মনে পড়েনা জাফর আলীর। এমনকি ডিম পোচটাও জঘন্য। এদের দোকানে আর আসা যাবেনা, মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
দুইদিন পেরিয়ে গিয়েছে সেদিনের পর থেকে। জাফর আলী মুখে কিছুই দিতে পারেনি। অনেক কিছু ট্রাই করেছে। সব কিছুই অখাদ্য মনে হয়। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এমনিতেই এই দু’দিনে অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছে। জাফর আলী আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবে। কোন দিশা পায়না। পাশের ফার্মেসীর মনোয়ার ডাক্তারকেও দেখিয়েছে। ডাক্তার কিছু খুঁজে না পেয়ে বলেছে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। জ্বরের কারনেই নাকি এমনটা হয়েছে। জাফর আলীর কেন জানি সেরকমটা মনে হয়না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে অনেক কিছুই ভাবে। নাকি দেশের বাড়ি চলে যাবে কয়েকদিনের জন্য। জাফর আলীর দেশের বাড়ি খেপুপাড়া। এই শরীর নিয়ে এতোটা পথ পেরিয়ে বরিশাল যাওয়াটা আসলেই সম্ভব কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। জাফর আলী যখন চিন্তার জগতে এপার ওপার ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। সবুজের ফোন। সবুজ জাফর আলীর এলাকার ছেলে। সেও গাড়ি চালায়। জাফর আলীই বছর তিনেক আগে নিয়ে এসে ড্রাইভিং শিখিয়ে দিয়েছিলো। ওরা একসাথেই থাকতো। কিছুদিন হয়েছে সবুজ নতুন এক মালিকের চাকরি পাওয়ায় কাছাকাছি মেসে যেয়ে উঠেছে। ফোনটা ধরতেই অন্য কারো গলা। পঞ্চাশ সেকেন্ডের কলটা শেষ হতেই জাফর আলী যা জানলো তা হলো, একটু আগেই এক্সিডেন্ট করেছে সবুজ। অবস্থা বেশি ভালো না। জাফর আলী আর দেরি না করে দুর্বল শরীর নিয়েই ছুটে যায়।
সবুজের লাশটা নিয়ে জাফর আলী যখন তার মেসে ফেরে তখন বেশ রাত। জাফর আলী পৌছে দেখে সবুজ অলরেডি মারা গিয়েছে। অগত্যা তাই লাশ নিয়েই ফেরা। এখন কিভাবে লাশটা নিয়ে এলাকায় পৌছে দেবে সেটাই এখন জাফর আলীর মূল চ্যালেঞ্জ। আপাতত রাতটা পার হতে দিতে হবে। কিন্তু নিজের ঘরে জলজ্যান্ত লাশ নিয়ে সে রাত কাটাবে কিভাবে! তাছাড়া লাশটা তো পচে যাওয়া শুরু করবে। বেশ ভালো ঝামেলায় পড়লো জাফর আলী। একেতো নিজে নড়তে পারছেনা তার উপর আবার নতুন সমস্যা। নাহ ঐ দিনের পর থেকে দেখা যায় প্রবলেম তার পিছুই ছাড়ছে না। কাপড়টা সরিয়ে সবুজের লাশটা আরেকবার দেখতে যায় জাফর আলী। লাশ তো নয় যেন থেঁতলে যাওয়া একটা মাংশপিন্ড।
ঘন্টা তিনেক পরের কথা,
জাফর আলীর সব প্রবলেম সলভ হয়ে গিয়েছে। শরীরের শক্তিটা যে কোন সময়ের চাইতে বেশি অনুভব করছে সে। সবুজের লাশটাও তার বাড়িতে পৌছে দেওয়ার কোন দরকার আর নেই। কারন সেটা এখন নতুন ঠিকানা পেয়েছে। জাফর আলী এখন জানে কেন সব খাদ্য তার কাছে অখাদ্য হয়ে উঠেছিলো। কুমিল্লার সেই অঁজ পাড়াগাঁ থেকে যে খাদ্যের নেশা তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই নেশাই এখন তাকে পরিচালিত করবে। সবুজের লাশের বাকি অংশটা হয়তো দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর কি করতে হবে তা জাফর আলীর ভালোই জানা আছে। কিন্তু আফসোস এই যে জাফর আলীর এই গল্পটা নিরীহ নগরবাসীর জানা নেই।
………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………..
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক