ভয়ানক বাড়ি !

ভয়ানক বাড়ি !

ঘটনাটা আজকের নয়। প্রায় তেত্রিশ কি চৌত্রশ বছর আগের কথা। আমার দিদির বিয়ে হয় সদ্য সদ্য। বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দিদির শ্বশুরবাড়ির আদিবাড়ি। জমিদার না হলেও আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন তারা সেইসময়। বিয়ের পর নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের বাড়ির কুলদেবীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে ওদের। আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে। যাওয়ার আগে দেখেছিলাম ওর শাশুড়ি ও শ্বশুরের চোখে মুখে উদ্বেগ। সামনেই পূর্ণিমা। তার আগেই নববধূকে নিয়ে যেভাবেই হোক ফিরে আসতেই হবে আবার। দেখলাম জামাইবাবু বলল, সেরকম হলে অন্তত বাইরে হোটেলে থেকে যেতে হবে। বুঝলাম না কিসের এত ভয় ওদের। দিদিকেও বললাম না কিছু। এত যখন লুকোচুরি চলছে, নিশ্চই ভয়ের কিছু আছে। দিদিও ভয় পেতে পারে। এমনিতেই ও বড্ড ভীতু। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম আমি ওকে আলাদা ভাবে চোখে চোখে রাখব। অগত্যা,পরদিন ভোরেই রওনা হয়ে গেলাম। দিদি, জামাইবাবু, মাসীমা, মেসোমশাই আর আমি দিদিদের গাড়ি করে রওনা দিলাম। জামাইবাবু খুব মজার মানুষ সারারাস্তা হইচই করে কাটলো। যদিও মাসীমার ভিতর এক লুকানো ভয় যেন দেখতে পেলাম। চা খেতে নেমে ওদের বাড়ি সম্পর্কে এটা ওটা জানতে চাইছিলাম। জামাইবাবুও টুকটাক বলছিল। জানালো সাধারণত নতুন বউকে আর বাচ্চা হলেই কুলদেবতার কাছে যাওয়া হয়। আর নয়ত সবাই ব্যাস্ত। কারুর এত সময় হয়না যাওয়ার। কিন্তু পূর্ণিমার আগেই কেন আসতে হবে তা কিছুতেই বুঝলাম না। জিজ্ঞেসও করা যাচ্ছেনা। কারণ আমি ঘরের বাইরে থেকে শুনে ফেলেছি ওদের ব্যাক্তিগত আলোচনা। কিছু যদি ভাবে আবার, তাই আর সরাসরি জানতে চাইলামনা।
অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে ধূ ধূ মাঠের একপ্রান্তে বাড়িটা। অবাক হয়ে দেখলাম আশেপাশে বিশেষ বাড়িও নেই। তবে বাড়িটা যেন ছোটখাটো একটা জমিদার বাড়ি। বিশাল ফটক পেরিয়ে ভেতরে এলাম। কেমন যেন ভারী বাতাস বাড়িটার মধ্যে। বেশ পরিচ্ছন্ন বাড়ি। পুরোনো কেয়ারটেকার পঞ্চাদা, তার বউ, ছেলে এগিয়ে এল আমাদের লাগেজ নেওয়ার জন্য। মাত্র একরাতের জন্য এসেছি আমরা। পরদিন সকাল সকাল পুজো দিয়েই দুপুর নাগাদ ভোকাট্টা হব। কারণ তারপরদিনই পূর্ণিমা। একতলায় বিশাল বসার ঘরে একটা বড় মেহগনি কাঠের সোফা ছাড়া কিছুই নেই। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। দোতলায় চওড়া টানা বারান্দা, যার একদিকে সার দিয়ে অনেক ঘর। দুটো আমাদের জন্য খোলা, বাকী সব তালা বন্ধ। আমি ঘুরেঘুরে দেখছি আর ভাবিছি মাসীমা তো বটেই, দিদিও যেন একটু অন্যমনস্ক আর ঘাবড়ানো আছে। রাস্তায় যদিও এমন ছিলনা। বাড়িটা বড্ড বেশী শুনশান। হঠাৎ মনে হল, আশেপাশে তেমন কাকপক্ষীও চোখে পড়ছেনা। আবার ভাবলাম বেশ গরম বাইরে। রোদের তেজ বড় কড়া। তাই হয়ত..। পায়ে পায়ে দিদির কাছে এলাম। ও শাড়ি ছেড়ে নিয়ে পাখার তলায় এসে বসেছে। আমি ওর পাশে বসামাত্র মাসীমা বললেন, ‘ওইতো তুমি এসেছ। তবে বস দিদির পাশে। আমি একটু আসছি। আর হ্যা, দিদিকে একা ছেড়ে যেওনা এক্কেবারেই।’ কথাটা বলামাত্রি আমি আর দিদি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। উনি সামলে নিয়ে বললেন, আসলে এটা নিয়ম। এবাড়িতে নতুন বউ আসার পর পূজো না দেওয়া অব্দি নতুন বউকে একা কোথাও ছাড়তে নেই। বুঝলে বউমা? তাই তোমায় বাথরুমের দরজা ভেজিয়ে রেখেই বাথরুম যেতে বলেছি।’ মাসীমা বেরিয়ে যেতেই আমি ওর দিকে তাকালাম। ও ফিসফিস করে আমায় বলল, ‘এই বাড়িটা বোধহয় ভালো না। আমার ভয় করছে এখানে।’ আমি বললাম, ‘তা তোকে দেখেই বুঝেছি। কেন? কি হয়েছে রে?’
– ‘বাড়িতে পা রাখতেই না কেউ যেন ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বলল, ফিরে যা। পালিয়ে যা। যেন হাওয়া খেলে গেল।’
– ‘ধুস, বাজে কথা। টায়ার্ড বলে ওরম মনে হয়েছে।’ মুখে বললেও আমি উড়িয়ে দিইনি ওর কথা। দিদিও কেমন থম মেরে শুয়ে পড়ল।
সন্ধ্যের পর বাইরেটা বড় বেশী ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। এরমধ্যে কারেন্টটাও চলে গেল। কুলদেবীর মন্দিরে কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ সবেমাত্র শেষ হওয়াতে আরও নিশঃব্দতা যেন ঘিরে ধরল। কেমন যেন অদ্ভুত ভুতুড়ে পরিবেশ বাড়ির। মাসীমা আর মেসোমশাই দিদির একদম দুইপাশে যেন লেগে রয়েছে। সামনে পঞ্চাদা আর জামাইবাবু দুটো এই বড় বড় হারিকেন নিয়ে চলেছে। আর দিদিদের পিছনে আমি, আর আমার পিছনে পঞ্চাদার বউ মালতি মাসি আর ছেলে পল্টু। ওদের হাতেও মোমদানিতে বড় বড় মোম। পুরোনো বাড়ির মোটা দেওয়ালে আগুনের শিখায় আমাদের ছায়াগুলো অদ্ভুত ভাবে কাঁপতে লাগলো, যেন আমাদের ছাড়াও এই ছায়া জগতের একটা আলাদা উপস্থিতি রয়েছে। এরমধ্যেই আমি বলি, ‘আচ্ছা মাসীমা, আমরা এতদূর এলাম আজ, আবার কাল সকালে পূজো দিয়েই চলে যাব? কাল বরং আশপাশটা ঘুরে পরশু গেলে হত না? দেখলাম দিদি বাদে, সব্বাই প্রায় লাফ দিয়ে ‘না না, সেকি কথা, কাল রাতেই পূর্ণিমা লেগে যাবে..’ নানা কথা বলতে লাগল। ব্যাস এটাই তো চাই। দিদিই ভয় পেয়ে বলে উঠল, ‘কেন? কি হবে পূর্ণিমাতে থাকলে?’ মাসীমা বলল, ‘আসলে পুরোনো বাড়ি তো। দেখ মা মিথ্যে বলবনা তোমায়। এবাড়ির বউ তুমি, সব জানবে। তবে এই রাতে আর কিছু জানতে চেয়োনা।’ আমি বললাম, ‘ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি?’ পিছন থেকে মালতি মাসি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠল, ‘এবাড়িোতে তেনাদের নাম নিবেননা দিদিমণি।’ আর ঠিক তখনি, আকাশ চিঁড়ে মেঘ কড়কড় করে উঠলো।
মাঝরাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এইরকম পাণ্ডববর্জিত ফাঁকা জায়গায় এইহারে বৃষ্টি আর ভয়ানক মেঘেরডাক আরও যেন ভয়ের করে তুলেছে পরিবেশ। আমি, দিদি আর মাসীমা একঘরে শুয়েছি। জামাইবাবু আর মেসোমশাই পাশের ঘরে শুয়ে। মাসীমা দেখলাম চিন্তায় প্রায় সারারাতই জেগে। মাঝেমধ্যে নিজের মনে কি সব বিড়বিড় করছে। পঞ্চাদা আর তার পরিবার কিছুদূরের গ্রামে থাকে, পুরোহিতও তাই থাকে। এবাড়ির আশেপাশে বেশ কিছুদূর ফাঁকা মাঠ ছাড়া কিছুই নেই। বারান্দায় গিয়ে মাসীমা দাঁড়ালেন। তখন মোবাইল না থাকায়, পঞ্চাদা বা পুরোহিত কখন আসবেন কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। এদিকে সকাল আটটা বেজে গেছে। পুরোহিতের সাতটা থেকে পুজো শুরু করার কথা। প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ পুরোহিত আর পঞ্চাদারা সব এলো। তুমুল এই বৃষ্টি এদিকে থামার কোনো লক্ষণ নেই। ভালোভাবে পূজো মিটে গেলে, মাসীমা বললেন ব্রেকফাস্ট সেরেই এবার বেরিয়ে যাব। কিন্তু বিধিবাম। মালতি মাসি চাতালে গেছিল, বাগান থেকে লংকা তুলতে। বিশাল জোড়ে পিছলে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে বিচ্ছিরি ভাবে। জামাইবাবু, আমি আর পল্টু ছুটলাম গাড়ি নিয়ে। এই বৃষ্টিতে গ্রামের স্বাস্থকেন্দ্রের শোচনীয় অবস্থা। সেলাই দিয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হল। দুপুর গড়িয়ে যায় প্রায়। কিন্তু বৃষ্টি থামার বা কমার কোনো লক্ষণই নেই। এসে দুমুঠো খেয়েই আমাদের রওনা দিতে হবে। কিছুতেই থাকা যাবেনা। কিন্তু বেরোনোর পর দেখা গেল গাড়িটার ইঞ্জিন পুরো বিগড়ে গেছে। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মাসীমা আর মেসোমশাই বেশ ভয় পেয়ে যায়। যেন সব ইচ্ছে করেই হচ্ছে। জামাইবাবু বলল, ‘মা তুমি মিতা আর মনা (আমার নাম) মালতি মাসিকে নিয়ে মালতিমাসিদের বাড়িই চলে যাও। আমরা ছেলেরা এখানে থাকলে তো ভয় নেই।’
পঞ্চাদা হিসহিস করে বলে উঠল, ‘না ভয় আছে দাদাবাবু। অনেকদিন আপনারা আসেননা। আর এলেন তো ঠিক পূর্ণিমার মুখেই। পরশুও যদি পূর্ণিমা কাটার পর আসতেন ভয়ের ছিলনা।’ সবাই দেখলাম চিন্তায় পড়ল, তবে উপায়? পঞ্চাদার বাড়ি বড় ছোট। এতজন হবেনা, তায় তার বউ ব্যাথায় কাতর।
দেখতে দেখতে মেঘলা আকাশে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। বৃষ্টি থামেও না কমেও না। এরসাথে দোসর লোডশেডিং। আমরা একতলার বসার ঘরেই সবাই ছিলাম। হঠাৎ আমি বললাম, ‘দিদি কই?’ একেই অজানা ভয়ে বুক কাঁপছে, কিসের যে এত আতঙ্ক এই পূর্ণিমায় তাইই বুঝছিনা। তার পরে, যার উপর বিপদের আশংকা বেশি, সেই আমার দিদিও হঠাৎ গায়েব। জামাইবাবু চিৎকার করে দিদির নাম নিতে নিতে দোতলায় এলো। অন্ধকারে ঘরে ঢুকে দেখে দিদি ঘুমিয়ে কাদা।গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দিদিকে নিয়ে এই বর্ষায় মালতি মাসির বাড়ি যাওয়া হবে কি ভাবে কে জানে। ঠিক হল পরদিন সকালেই যাওয়া হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে সব শুয়ে পড়া হল আগের দিনের মতই। পঞ্চাদা আর তার ছেলেও একরকম পালিয়ে গেল। মাসীমা ভয়ে পাচ্ছিল রাত থেকেই পূর্ণিমা লাগবে। তাই সবাইকেই সজাগ থাকতে হবে। তারউপর যা সব চলছে। মাঝরাতে ঝটপটানি একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। চোখ খুলে অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছিনা। একটা গোঙানির আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘কে কে?’ কিছুই বুঝতে পারছিনা সেই তীব্র অন্ধকারে। আচমকা কে যেন আমায় সজোরে ধাক্কা মেরে পালংক থেকে নীচে ফেলে দিয়ে পালালো। কি বলব, যে ফেললো তার হাত যেন বরফের মত ঠান্ডা। দরজা খুলে সে বারান্দায় গিয়ে মিলিয়ে গেল। বাইরেটাও অত অন্ধকার, কিন্তু কেন যেন মনে হল আমার দিদি ছিল ওটা। চমকে উঠে দাঁড়ালাম চোখ সয়ে এলেও বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছেনা। ঘরের মোমটা নিভে গেছে যেন কখন। হঠাৎ শুনলাম মাসীমা গোঙাচ্ছেন। আমার চিৎকারেও পাশের ঘর থেকে জামাইবাবু আর মেসোমমশাই বেরোলেন না দেখে আমি এগিয়ে এসে বলি, ‘মাসীমা, কেমন আছেন? কি হয়েছে?’ কোনো উত্তর সে না দিয়ে তখনো গোঙাচ্ছেন। আমি দৌড়ে বারান্দায় আসি। কোথাও দিদিকে দেখছিনা। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে। জামাইবাবুদের ঘরের দরজায় কিলঘুষি মেরেই চলেছি। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি দৌড়ে গেলাম দিদিকে যেদিক যেতে দেখেছি দরজা দিয়ে। আকাশে মেঘ থাকলেও বৃষ্টি ধরেছে। দিদি এত অল্প সময়ের মধ্যে এই টানা বারান্দা দিয়ে কোথায় গেল ভাবছি। কি যে রহস্য এই বাড়ির তাও মাথায় আদতে আসছেনা। হঠাৎ একটা দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। ভিতরে চাপা অথচ স্পষ্ট একটা গোংনির শব্দ। যেন বুকচাপা কান্না। আমি ভয়ে কাটা হয়ে গেলাম। বাইরে থেকে অবশ্য মরচেধরা তালা মারা। আচমকাই আমার পিছনে ‘কে?’ শব্দটা শুনে চমকে তাকাই। জামাইবাবু আর মেসোমশাই এসে দাঁড়িয়েছে কখন। তারাও শুনেছে সেই শব্দ। জামাইবাবু বলে, ‘কি হয়েছে? তুমি এখানে এত রাতে?’ আমি ভয়ে ভয়ে সব বলতেই মেসোমশাই দৌড়ে মাসীমার ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘তোমরা ওদিকে বউমাকে খোঁজো। ‘ জামাইবাবু চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, ‘মিতা, এই মিতা।’ হঠাৎ ই ভিতরে কান্নার শব্দটা থেমে গেলো। দরজার ওদিক দিয়ে ধাক্কা মারতে লাগলো কেউ। এরপরেই দিদির প্রাণফাটা চিৎকার, ‘বাঁচাও আমায়। আমায় মেরে ফেলবে, বাঁচাও।’ দিদির গলার আওয়াজ পেয়ে আমি নিজের সব ভয়ে জলাঞ্জলি দিয়ে দরজায় দুমাদ্দুম লাথি মারতে লাগলাম আমার শাড়ি গুটিয়ে। আমার দেখাদেখি জামাইবাবুও লাথি মারতে লাগলো। ওই মোটা দরজার গাঁয়ে আঁচড় ও কাটা গেলোনা। হঠাৎ সব আওয়াজ থেমে গেলো। দেখি আরো দূরে আরেকটি ঘর থেকে অনেক মহিলার খিলখিলিয়ে হাসি। এঘর ওঘর প্রায় সব ঘর থেকেই চরম হাসির রোল আসতে লাগলো। আমি কেঁদে উঠলাম, ‘দিদি, এই দিদি’ বলে। চীৎকার করে বললাম, ‘কেন জানাওনি জামাইবাবু, যে এটা ভুতের বাড়ি? আমার দিদির প্রাণ সংশয় আছে এই বাড়িতে।’ দেখলাম জামাইবাবু দৌড়ে গেল আমাদের শোয়ার ঘরের দিকে। আর মেসোমশাই দরজা ধরে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল। ‘কি হল বাবা? মা কেমন আছে?’
-‘ নেই কোনো হুশ নেই। জানিনা হুশ নেই না প্রাণ। কিচ্ছু জানিনা।’ বলেই কেঁদে ফেলেন মেসোমশাই। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘মানে কি এইসবের?’
এদিকে বন্ধ ঘরের মধ্যে নানা বয়েসী মহিলাদের খিলখিলিয়ে হাসি, ফিসফাস চলেছে। যেন ভরদুপুরে মা মাসিদের আড্ডা
চলছে। আবার কখনো প্রাণফাঁটা কান্নার আওয়াজ। আমি বললাম, ‘চাবি কই এই ঘরগুলোর?’ ক্লান্ত মেসোমশাই বললেন, ‘জানিনা। পঞ্চার কাছে থাকবে হয়ত।’ অত সময় নেই হাতে।আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। এক দৌড়ে নেমে গেলাম নীচে। দালানের একদিকে কিছু নুড়ি পাথর পড়েছিল। দু একটা বেশ বড়ও ছিল। সেই একটা তুলে নিয়ে এলাম। জামাইবাবু ক্রমাগত তখনো লাথি মেরে যাচ্ছে একএকটা দরজায়, আর বাচ্চাদের মত কাঁদছে। আমি মরচে ধরা একটা তালায় সজোরে আঘাত করলাম। কয়েকটা ঘা খেয়েই ভেঙে গেল সেটা। আর সারা বাড়ি জুড়ে সেই হাসি-কান্নার কলরব মুহুর্তে থেমে গেলো।
ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা, বোঝাও যাচ্ছেনা। আমি এই ঘরেই কেন এলাম নিজেও জানিনা। কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকলাম, ‘দিদি, এই দিদি। যেন, অনেক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে মনে হল। দরজাটা সশব্দে বন্দ হয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। শুনতে পাচ্ছি, বাইরে জামাইবাবু আর মেসোমশাই চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন আমার নাম ধরে। ভয়ে আমার হাত পা কাঠ হয়ে গেলো। মায়ের মুখটা ভেসে আসল। সে বেচারি কিচ্ছু বুঝতেই পারছেনা যে এখানে কি ঘটে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে হঠাৎই সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে হাল্কা এক বেগুনি আলো ছড়িয়ে পড়ল। কি তার উৎস আমি জানিনা। তাতেই দেখলাম, নির্জীব, নৃশংস কিছু নারীর শরীর এদিকওদিক ছড়িয়ে আছে। বিভৎসভাবে খুন করা হয়েছে তাদের। নানা বয়েসের মহিলা তারা। একটা তুমুল ভয়ে পিঠ ঠেকে গেলে বোধহয় আর নতুন করে ভয় লাগেনা। তাই আচমকাই আমি ওই দেহগুলোর মধ্যে দিদিকে খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ সেই মৃতশরীরগুলো যেন নড়েচড়ে উঠতে লাগলো। ভয়ে আমি চুপ করে দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারা ধীরে ধীরে উঠে বসল। কি ভয়ানক সে দৃশ্য। রক্তাক্ত অঅঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো গুটিয়ে উঠে বসল। সবাই আমার দিকে ফিরে বসল। তাদের সারা শরীর থেকে, মাথা, চুল থেকে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরেধীরে উঠে দাড়াচ্ছে তারা। ভয়ে আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। জ্ঞান হারাতে হারাতেও দেখলাম, মাসীমা যেন কোথা থেকে দৌড়ে এলো আর আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ মনা শিজ্ঞিরি ওঠো। ওরা উঠে দাড়ানোর আগে এসো। দিদিকে নিয়ে পালাও। এবাড়ি ছেড়ে পারলে রাস্তায়, ওই মাঠে রাত কাটাও। এসো এসো তাড়াতাড়ি।’ আমিও দিদির নাম শুনে তড়াক করে উঠে দাড়ালাম। মাসীমা আমার হাত ধরে নিয়ে এলো ঘরের এক কোণে। দিদি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দেওয়াল ঘেঁষে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে। অবাক হয়ে দেখলাম মাসীমা দিদিকে পাঁজাকোলে তুলে নিল অবলীলায়। আমি বলতে গেলাম, ‘আমায় দিন..’, তার আগেই আমায় বলল, ‘আমার শাড়ি চেপে ধর তুমি শক্ত করে। ছাড়বেনা।’ ওই মৃত, খণ্ডবিখণ্ড নারীশরীরগুলো কেমন অবর্ণনীয়ভাবে গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে আসছে। ভয়ে আমি ‘মাসীমা’ বলে কঁকিয়ে উঠলাম। সেদিকে নজর দিতে বারণ করে ঘরের ধার ঘেঁষে দরজার কাছে পালিয়ে এলাম আমরা। দরজা অল্প ফাঁক হতেই দেখলাম মাসীমা দিদিকে ছুঁড়ে ফেলল বাইরে, আর তার সাথে আমাকেও অসম্ভব জোড়ে এক ধাক্কা মারল। দুজনে বেরিয়ে যেতেই সশব্দে দরজা বন্দ হয়ে গেলো। বাইরে দেখি মেসোমশাই মেঝেতে পড়ে আছে অচেতন হয়ে। জামাইবাবু কাঁদছে আর চোখে মুখে জল ছেঁটাচ্ছে। আমাদের দেখে রীতিমতো চমকে উঠেছে। এরমধ্যেই মেসোমশাইও যেন আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে বসার মত উঠে বসল, আর তারপরেই চটপট উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘বউমা? মনা? এসেছো? শিজ্ঞিরি পালা বাবু। ওই ওই মাঠে দাঁড়িয়ে থাকব পারলে।’ বলে ছুটে যেতে লাগলো। জামাইবাবু অবাক হয়ে যায় পুরো ঘটনায়, বলে, ‘আর মা?’ থমকে দাঁড়ায় মেসোমশাই, বলল, ‘মা ই বলেছে তোর। বউমাকে তোল আর যত তাড়াতাড়ি পারিস পালা।’ জামাইবাবু আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ দিদিকে নিয়ে নিল পাঁজাকোলে।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় বাকি রাতটা কিভাবে ওই ভয়ংকর বাড়িটার সামনে কাটালাম, তা সেদিনও মনে ছিলোনা, আজও মনে নেই। ভোরবেলাতেই পঞ্চাদা হাজির হয়েছিল পাড়ার লোকেদের নিয়ে। এরপর পুলিশ আসে, মাসীমার ডেডবডি আমাদের শোয়ার ঘর থেকেই পুলিশ বের করে আনে। খুব আতঙ্কে হার্টফেল করে গেছিলো। কি করে যে সবাই কোলকাতা ফিরেছিলাম সত্যিই মনে নেই। মেসোমশাই বেশিদিন আর বাঁচেননি এরপর। আত্মীয় দের থেকেই শুনেছিলাম ও বাড়ির ভয়ঙ্কর ইতিহাস। বাঁকুড়ার ওই বাড়ি ছিল একসময় লোকজনে ভরা। জামাইবাবুর দাদুর বাবারা ছিলেন পাঁচভাই। তাদের বাবার ছোট্ট ব্যাবসা এই পাঁচভাই মিলে বাড়িয়েছিল, বানিয়েছিল ওই বড় বাড়িটা। শোনা যায়, বাড়ির সেজোভাই এর মনের ভিতর নাকি একটা অসন্তোষ কাজ করছিল। সে নাকি মনে করত, বাকি ভাইদের চেয়ে এই ব্যাবসার উন্নতি, বৃদ্ধি সবকিছুতে তার বুদ্ধি ও পরিশ্রমই বেশী। তাই ব্যাবসার লাভ চার ভাই সমান নিক, কিন্তু তার পাওয়া উচিত বেশী। এক রাতে নাকি বাড়ির ছেলেরা নানাকাজে নানা দিকে আটকে ছিল। আর চাকররা গেছিল দূরের গাঁয়ে যাত্রাপালা দেখতে। বাড়ির বউঝিয়েরা বসে গল্পগাছা করছিল ওই একতলায়। বাড়ির দারোয়ান আসে এই সময় রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করতে। চরম শারীরিক অত্যাচার আর তারপর হত্যালীলা চলে। লুটপাট ও হয়েছিল কিছু। সেরাত ছিল নাকি ঝলমলে পূর্ণিমারাত। পরে শোনা যায়, সেইদিন সেজোভাইয়ের পরিবারও ছিলনা সেখানে। সেজোগিন্নি তার তিন ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান, দুদিন আগেই। মনে করা হয়, এসব সেজোভাইয়েরই কান্ড। জামাইবাবুরা এই সেজোছেলেরই বংশধর। তবে বাড়িটায় নাকি পূর্ণিমা রাতে আজও কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে বাড়িটার বদনাম রটে অল্পস্বল্প। তবে আগেও নাকি মেসোমশাইয়ের বড়দা বিয়ের পর কুলদেবতার মন্দিরে গেছিলেন। আর অদ্ভুত ভাবে পূর্ণিমার আগের রাতেই গেছিলেন। সেই নতুন বউ ভীষণ ভয়ে মাঝ রাতে হার্টফেল করে মারা যান। এ ঘটনার পর বিশেষ কেউ আর বাঁকুড়ার বাড়ি আসেনা, এলেও পূর্ণিমা পার করে আসে। তাতেও মৃত্যু না ঘটলেও ভয় পেয়েছেন অনেকে। কিন্তু দিদি জামাইবাবুর বিয়ের কদিন পরেই দিল্লী ফিরে যাওয়ার কথা। তাই অন্তত নতুন সংসার শুরু করার আগে একবার কুলদেবতার কাছে যাওয়া হোক মনে করেই আসা। আর সেই আসা হল মহাকাল। খোঁজ করে দেখেছিলাম, সেই সেজো ভাইয়ের বংশধরদের যতটুকু জানতে পেরেছি, কেউ বিশেষ সুখে নেই, বিশেষ করে, বাড়ির বউরা। যেমন, আমার দিদি পুরো পাগল হয়ে গেছে, ওর শাশুড়ি মারা গেলেও নিজে যখন বিয়ের পর ওবাড়ি গেছিলো, বড় ভয়ে পেয়েছিল, যার ফলে অনেকদিন অসুস্থ হয়েছিলেন। আর ছেলেরা? অসুস্থ স্ত্রী, মৃত স্ত্রীর স্মৃতি, নয়ত কেউ কেউ চরম দারিদ্রতা নিয়ে বাকী জীবন কাটায়। আর আমি? এরপর থেকে অন্ধকার আমার ভালোলাগে। শ্মশান, পোড়োবাড়ি আমায় টানে বেশি। মা বাবার মৃত্যুর পর এখন বাড়িটাকে ভুতের মত পোড়ো বাড়ি বানিয়ে পড়ে আছি আজ।
.

স্বপ্নময় পৃথিবী…. ……

……………………………………..সমাপ্ত……………………………………

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত