আমার গেছো ভূত–স্বপ্না লাহিড়ী

আমার গেছো ভূত–স্বপ্না লাহিড়ী

শহরের  বাইরে গ্রামে আমার একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। বাড়িটার পেছন দিকে স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা আম,কাঁঠাল,জা্‌ম,লেবু বেলের গাছ। সামনের দিকেও কিছু ফুলের গাছ রঙ ও গন্ধ ছড়ায় বাতাসে। এ জায়গাটা বড়ো সুন্দর। আমি সুযোগ পেলেই এখানে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যাই। এবার আসতে আসতে গরম প্রায় শেষের দিকে। মাঝে মাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টি পড়াতে লু বন্ধ হয়ে গেছে,কিন্তু  পচা ঘেমো গরমে প্রাণ বেরোবার জোগাড়।

 

দুপুর শেষের দিকে,পেছনের বাগান থেকে হালকা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, কালো চশমাটা চোখে লাগিয়ে নেমে গেলাম বাগানে। হাতের কাছে থোকা থোকা আম,বোঁটার কাছে রঙ ধরেছে সবে। জাম, কাঁঠাল,লেবু গাছগুলোর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে এসে দাঁড়ালাম বেল গাছটার নিচে। কী জানি এবার বেল হয়েছে কিনা দেখার জন্যে ওপর দিকে তাকাতেই মাঝখানের একটা ডালের খানিকটা কেমন যেন কালো কালো লাগল। বয়েস হয়েছে,তাই হয়ত ঠিক দেখছি না,নাকি কালো চশমার জন্যে এ রকম দেখছি? চোখটা ভাল করে মুছে আবার দেখলাম,না! খানিকটা জায়গা বেশ অন্ধকার আর সেখানে দুটো সরু সরু ঠ্যাঙ ঝুলছে। হয়ত কেউ আম জাম কিছু চুরি করতে এসেছিল। আমার আসার আওয়াজ পেয়ে হাতের কাছে যে গাছ পেয়েছে  সেখানেই চড়ে বসেছে।

 

একটু গলা চড়িয়ে বললাম, “অ্যাই, কে রে ওখানে? নেমে আয় বলছি!”

 

অমনি ঝুপ করে একটা আওয়াজ করে সামনে যে এসে দাঁড়াল তাকে রাত্তিরে দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। নিজের অজান্তে একটু পিছিয়ে এলাম। লোকটার হাড়ের ওপরে চামড়া জড়ানো,মাথায় কয়েকটা খাড়া খাড়া চুল দাঁড়িয়ে,চোখ দুটো কোটরের মধ্যে ঢোকানো। জ্বলজ্বল করছে। সাহস দেখিয়ে বললাম, “তুমি গাছের ওপরে কী করছিলে?”

 

লোকটা বলল, “আমি তো ওখানেই থাকি।”

 

আমি বললাম, “তুমি কি ভূত নাকি, যে বেল গাছে থাকো?”

 

দুহাত জোড় করে সে বলল, “সত্যি মা ঠাকরুন, আমি ভূত ই। কিন্তু দোহাই আপনার ওই রাজার ব্যাটার নাম নেবেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “রাজার ব্যাটা আবার কে?”

 

ভূত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ওই ভূত দেখলে সবাই যার নাম করে।”

 

“ও। রা—”

 

বলার সঙ্গে সঙ্গে ভূত বলে উঠল, “আর না,আর না। ওই নাম নিলে আমার এ বাসাটাও যাবে। এখানেই এতদিন একটু নিশ্চিন্তে ছিলাম,এর আগে যেখানেই গেছি লোকেরা ঐ নাম নিয়েছে। এ গাছ ও গাছ করে আর কত দৌড়োব মা ঠাকরুন?”

 

“বেশ। থাকো তুমি এখানে।কিন্তু কারুকে ভয় দেখাবে না।”

 

বলে ঘরে এসে চা নিয়ে টিভির সামনে বসলাম। সন্ধে হয়ে আসছিলো তখন।

 

তারপর তো ভুলেই গিয়েছিলাম ভূতের কথা। রাত থেকে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল,সকালেও থামার নাম নেই। চরাচর ভেসে যাচ্ছে। সকালে চা খেয়ে ভাবলাম যাই রান্নাঘরে গিয়ে দেখি কী আছে। কাজের মেয়ে তো এই বৃষ্টিতে আসতে পারবে না। খিচুড়িই করা যাক না হয়। মনে মনে ভাবছি,আহা আজ যদি খিচুড়ির সাথে ইলিশ মাছ ভাজা হত! ফ্রিজ খুলে দেখলাম মাছের আঁশটাও  নেই। কী আর করি? মনের দুঃখ মনে রেখে চাল ডাল ধুচ্ছি,হঠাৎ দেখি প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছ পড়ে আছে। কোত্থেকে এল তাই ভাবছি,এমন সময় আওয়াজ এল,”আমি আপনার বেল গাছের ভূত মা জননী। আপনার খেতে ইছে হল ,আমি নিয়ে এলাম।”

 

“সেকী? কোথা থেকে আনলে?” আমি  বললাম, “আমার জন্যে চুরি করে এনেছ? যাও এখুনি ফেরত দিয়ে এসো।”

ভূত একটু চুপ করে থেকে মিন মিন করে বলল, “তা কী করব মা? আমার কাছে কি আর টাকা আছে যে দেব!”

 

“একটু দাঁড়াও,” বলে ঘর থেকে টাকা এনে বললাম,”যাও, দিয়ে এস আর আজ আমার সাথে মাছ খেয়ো, কেমন?”

 

ভূত হাপুশ নয়নে কেঁদে উঠে বলল,”সে দিন কি আর আছে মা জননী? হাওয়ার শরীর এখন,কিছুই খেতে পারি না।”

 

আমি বললাম, “সে কী? আমি ত শুনেছি ভূতেরা মাছ খেতে খুব ভালবাসে।”

 

“সব বাজে কথা, সব বাজে কথা,” বলতে বলতে ভূত চলে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহা রে! হাতে করে নিয়ে এল মাছটা! সে দিন দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে মাছ ভাজাটা কিন্তু দারুণ জমেছিল ভূতের কল্যাণে।

 

এরপর বেশ কিছুদিন আমার ভূতের কোন পাত্তা নেই, হয়তো তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। সেদিন কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে সবে একটা বই নিয়ে বসেছি,দরজার কাছ থেকে গেছো ভূতের গলা,”মা ঠাকরুন আসব?”

 

“আরে এসো এসো,” সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললাম, “বোসো।কোথায় ছিলে এতদিন?”

 

সে মাথা নিচু করে বলল,”আপনি ব্যস্ত মানুষ তাই বিরক্ত করি নি।”

 

বেশ গুছিয়ে বসে বললাম, “আজ তোমার গল্প শুনব।”

 

ভূত খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে দু হাত পেতে বলল, “আগে কটা টাকা দিন।”

 

মনে মনে ভাবলাম গল্প বলার জন্যে পারিশ্রমিক চাইছে নাকি? মনের কথা বোঝে ভূত। বলে উঠল, “না না, একটু দরকার আছে।”

 

আমি দশটা টাকা এনে ওর হাতে দিলাম। ভূত নিমেষে উধাও। মিনিট পনেরো পরে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ট্রে। তাতে এক গ্লাস গরম চা ও দুটো আলুর চপ । আমি কিছু বলার আগেই বলল,”এর সাথে মুড়ি যা জমত! কিন্তু আপনার কাছে তো মুড়িও নেই। আগে জানলে নিয়ে আসতাম।”

 

আমি তো অবাক। জিজ্ঞেস করলাম,”চা আনলে কোথা থেকে?”

 

তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ওই আপনার চা বানাবার বাক্সটা থেকে বানিয়ে আনলাম।আমি তো দেখেছি আপনি কেমন করে বানান।”

 

মনে মনে ভাবলাম, সর্বনাশ! ভূত কি আমার সঙ্গে সব সময় থাকে নাকি! রাগ দেখিয়ে বললাম, “আমাকে না বলে আমার ঘরে আসো কেন? জানো না এটা অসভ্যতা?”

 

ভূতের চোখ ছলছল করে উঠল। ভেজা গলায় বলল, “না মা। আমি সকালবেলায় গাছ থেকে ঐ বাক্সটায় আপনাকে চা বানাতে দেখলাম,(বাক্স মানে মাইক্রোওয়েভ)তাই।

 

বুঝলাম, আমার গেছো ভূতের বুদ্ধি যুগের সঙ্গে ভালই খুলেছে। আমাকে না জিজ্ঞেস করে আমার কোন কাজ করতে তাকে বারণ করে দিলাম। কী জানি বাবা, এরপর দেখব ভূত বাড়ির ভেতরে আর আমি বাইরের গাছে!

 

সেদিনের পর থেকে বেশ কিছু দিন ভূত চুপচাপ ছিল।আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিছুদিন পরের কথা,দুপুরে রাজির ফোন এলো, বিকেলে সে আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে। রাজি আমার বন্ধুর মেয়ে। আমেরিকায় পড়াশোনা করে। মাসখানেকের জন্যে দেশে এসেছে। মনটা আনন্দে ভরে ঊঠল। অনেকদিন দেখিনি ওকে। ঘরে ঢুকেই রাজি আগের মতো হইহই হুটোপুটি করতে শুরু করল। একরাশ চকোলেট টেবিলের ওপর রেখে বলল, “মাসী তোমার জন্যে। আর একটু মোটা হও।”

 

আমি বললাম, “তোর জন্যেও তোর সাধের রসগোল্লা রাখা আছে,দাঁড়া আনছি।”

 

মুখ থেকে কথা বেরোল কী বেরোল না ,টেবিলের চকলেট খাটে আর টেবিলে এসে পড়ল ট্রেতে করে বাটি ভর্তি রসগোল্লা,দুটো চামচ আর দু গ্লাস জল। সর্বনাশ,আমি তো ভূতের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! রাজির আবার ছোটো থেকে ভীষণ ভূতের ভয়। ও এ পাড়া ও পাড়ার মত এদেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ভূত… ওরে বাবা!

 

রাজি তো লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে তখন ঠকঠক করে কাঁপছে,আর ঠিক তখনই তার কানের কাছে আওয়াজ, “খুকি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি ভূত, কিন্তু কারো কোন ক্ষতি করি না। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?”

 

তারপর দাঁত বের করে খাড়া চুল মূর্তি একেবারে ঘাড়ের কাছে উঁকি মারল। আমি তেড়েমেড়ে বললাম, “বেরো বলছি এখান থেকে!”

 

রাজি চিৎকার করে ততক্ষণে রামনাম জপতে আরম্ভ করেছে। ওদিকে আমার ভূতও ‘রাজার ব্যাটা রাজার ব্যাটা’ বলতে বলতে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 

মেয়েটা এত বেশি ভয় পেয়েছে যে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমি আমার রামায়ণখানা ওর হাতে দিয়ে বললাম, “এটা ধরে থাক,ভূত তোর কিচ্ছু করতে পারবে না।”

 

সে শুধু পাংশু মুখে বলল, “আমাকে বাড়ি নিয়ে চল মাসী।”

 

বাইরে গিয়ে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বললাম, “দিনু, তাড়াতাড়ি চল।”

 

কিন্তু গাড়ি এত আস্তে চলছে কেন? বেশ কয়েকবার বললাম, “দিনু গাড়ি তাড়াতাড়ি চালাও,” তাও শুনছে না দেখে বকে উঠলাম। এবার দিনু মুখ ফিরে তাকাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। ড্রাইভারের টুপির নিচে গেছো ভূতের মুখ ! কিন্তু তার কোটরাগত চোখ জ্বলছে,বড়ো বড়ো দাঁত বেরিয়ে এসেছে। আমিও চিৎকার করে উঠলাম। আর কিছু জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম গাড়িটা রাজিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে,ভূত কোথাও নেই,আমাদের অরিজিনাল দিনু পাশের সিটে পড়ে আছে,চোখ তখনো বন্ধ।

 

রাজির দিকে ফিরতেই হাতটা পড়ল আমার রামায়ণে ,মলাটে বড়ো বড়ো করে লেখা, “আমরা ভূতেরা রাজার ব্যাটার নামে রেজিস্ট্যান্স গ্রো করে ফেলেছি ! ! ”

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত