বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাঁটছি আমরা—আমি আর আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের আমিন সাহেব। আমরা দুজনেই অবসরভোগী। তাই স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে এবং ডাক্তারের পরামর্শে দুজনে সন্ধ্যাবেলা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে সামান্য কিছু দূরের এই পার্কে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। আমিন সাহেব বিপত্নীক। শিক্ষকতা করতেন মফস্বলের এক শহরে। অবসর নেওয়ার পর দেশের বাড়িতে একাই থাকতেন। সম্প্রতি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর ব্যবসায়ী মেজ ছেলে, আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের মোমিন, একরকম জোর করে সুচিকিৎসা এবং দেখাশোনার জন্য বাবাকে কাছে এনে রেখেছে। আমিন সাহেব বেশ আলাপি এবং নানা বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন। বিশেষ করে তাঁর মধ্যে কোনো কূপমণ্ডূকতা নেই। তাই তিনি আসার কয়েক দিনের মধ্যে ভালো আলাপ জমে উঠল আমাদের মধ্যে। শীর্ণকায় দেহ আর মুখভর্তি লম্বা দাড়ি সত্ত্বেও তাঁকে দেখে মফস্বলের লোক বলে মনেই হয় না। তবে ঠিক মুদ্রাদোষের পর্যায়ে না পড়লেও কথার মধ্যে প্রায়শ তিনি ‘যাচ্চলে’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আমরা দুজনে প্রায় প্রত্যেক দিন মাগরিবের নামাজের পর একসঙ্গে পার্কটায় বেড়াতে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পার্কের এক প্রান্তে লেকের পাড়ে আমাদের প্রিয় বেঞ্চিটার কাছে এসে পৌঁছলাম। হেলান দিয়ে বসার ব্যবস্থাসহ কংক্রিটের বেঞ্চিটা লেকের প্রায় পাড় ঘেঁষে একটা বড় বাদামজাতীয় গাছের তলায়। পার্কের এদিকটা নির্জন বলে বেঞ্চিটা আমরা সব সময় খালিই পাই। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম ঘটল। দেখলাম, বেঞ্চিটার এক প্রান্তে এক ভদ্রলোক বসে আছেন চাদর গায়ে। চাদরটা দিয়ে আঁচলের মতো মাথা ঢাকা। তাই তাঁর মুখ দেখতে পেলাম না। হেলান দিয়ে বসে আছেন চুপচাপ। মাথা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকানো। মনে হয় ঝিমুচ্ছেন। বিচিত্র কোনো দৃশ্য নয়। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিকে পার্কের বেঞ্চিতে বসে এভাবে ঝিমুতে দেখা যায়। পৌষের শেষ এখন। শীত বেশ জাঁকিয়ে না বসলেও সন্ধ্যার পর বেশ শীত করে, বিশেষ করে খোলা জায়গায়। তাই চাদর মুড়ি দিয়ে বসা ভদ্রলোককে দেখে অবাক হলাম না। তবে এমন এক ভঙ্গিতে তিনি বসেছিলেন যে তাঁকে দেখাচ্ছিল অনেকটা ভূতের মতো। আমার নিজের পরনে জগিং স্যুট, যদিও জগিং করার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বেরোইনি। শীত লাগার ভয়ে আমার স্ত্রী জোর করে জগিং স্যুটের ওপর একটা কার্ডিগান চাপিয়ে দিয়েছেন। মাথায় বেসবল ক্যাপ, গলায় একটা স্কার্ফ জড়ানো আর পায়ে স্নিকার। আমিন সাহেবের পরনে সাদা পাজামা। গায়ে হালকা নীল পাঞ্জাবির ওপর মোটা সোয়েটার আর মাথায় একটা মাফলার পাগড়ির মতো করে পরা। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো।
ভদ্রলোককে দেখে আমি একটু ইতস্তত করে গলা খাঁকরি দিয়ে বললাম, মাফ করবেন। আমরা কি আপনার পাশে বসতে পারি?
ভদ্রলোক মুখটা সামান্য উঁচু করলেন, কিন্তু আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন না। হাতটা শুধু পাশের দিকে সামান্য প্রসারিত করে বেঞ্চিটার ওপর মৃদুভাবে দুটি থাবা দিয়ে আমাদের বসতে ইঙ্গিত করলেন। তার পর হাতটা আবার গুটিয়ে নিয়ে ঝিমুতে লাগলেন আগের মতো।
ধন্যবাদ বলে আমরা সামান্য দূরত্ব রেখে বেঞ্চিটার অপর প্রান্তে বসে পড়লাম।
বেঞ্চিটার কাছে একটা লাইটপোস্ট। ফলে বেঞ্চিটা আর তার আশপাশ বেশ উজ্জ্বল। আরাম করে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। এই বেঞ্চিটায় বসে রোজ আমরা নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এবং গল্পগুজব করি। তবে রাজনীতি নিয়ে খুব একটা কথা-টথা হতো না আমাদের মধ্যে। আজ অবশ্যি আলোচনার একটা বিশেষ বিষয় ছিল। আজকের কাগজে চোখে পড়ার মতো একটা খবর ছাপা হয়েছে। মুগদায় একটা পুরোনো দোতলা বাড়িতে নাকি ভূতের উপদ্রব হয়েছে গত রাতে। এই নিয়ে প্রায় সব কাগজে বাড়িটির ছবিসহ বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। সকালে আমরা দুজনেই সেটা পড়েছি।
আমিন সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে করে একটা দৈনিকের কপি এনেছিলেন। আজকের আলোচনার সূত্রপাত তিনিই করলেন। পকেট থেকে কাগজটা বের করে সামনে মেলে ধরতে ধরতে বললেন, যাচ্চলে, এই বিজ্ঞানের যুগে ঢাকার মতো আলো ঝলমল মেগাসিটিতে ভূতের উপদ্রব! পড়েছেন তো খবরটা। আপনার কী মনে হয়?
আরে দূর। বললাম আমি, কাগজওলারা মাঝে মাঝে সামান্য একটা সূত্র ধরে এ ধরনের উদ্ভট খবর ছাপে। আর সাংবাদিকরাও হয়েছে সে রকম। ভালো করে খোঁজখবর না করে যা শোনে ছেপে দেয়। অধিকাংশ পাঠকও তেমনি। হামলে পড়ে একেবারে।
যা বলেছেন। আমিন সাহেব বললেন, কিন্তু যাচ্চলে, ব্যাটারা এমনভাবে লেখে যে অধিকাংশ লোকে তাদের কথা বিশ্বাস না করে পারে না; বিশেষ করে স্বল্পবুদ্ধি, দুর্বলচিত্ত আর কুসংস্কারপরায়ণ যারা। আর যারা বিজ্ঞানমনস্ক বা বাস্তববাদী, তাদেরও অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভাবে, কী জানি হতেও পারে। ঘটতেও পারে এমনটা।
কী ঘটতে পারে? ভ্রু কুঁচকে বললাম আমি, ভূতের আবির্ভাব? আরে সাহেব, ভূত থাকলে তবেই না আবির্ভাবের প্রশ্ন। এটা বিজ্ঞানের যুগ; আর চলতি অর্থে ভূত বলে যা বোঝানো হয়, বিজ্ঞান তা স্বীকার করে না। বিজ্ঞান বলে সবকিছুরই যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে। সে ব্যাখ্যা কারো কাছে আপাতদৃষ্টিতে ধরা না পড়লেই সেটা ভৌতিক বলে ধরে নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
ভূত আছে, তা আমিও বিশ্বাস করি না। আমিন সাহেব বললেন, আমাদের ধর্মও ভূত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ইসলাম ধর্মমতে মৃত্যুর পর রুহ বা মৃত আত্মা ‘আলমে বজরাখ’-এ চলে যায়। সেখানে তার অবস্থান হবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত। সুতরাং তার প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন অবান্তর। অবশ্যি কোরআন শরিফে এমন এক সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে, যাদের আচার-আচরণ অনেকটা ভূতের মতো। এরা হলো জিন। সম্পূর্ণ আলাদা এক জাতি। এদের সঙ্গে মানুষের মৃত আত্মা বা ভূতের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ দেখেন, বলে আমিন সাহেব ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাতের কাগজটা মেলে ধরে বললেন, ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে লিখেছে যেন বাড়িটিতে সত্যি সত্যি ভূত হানা দিয়েছিল কাল রাতে।
ওসব হলো কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে আসল ঘটনার সঙ্গে কাল্পনিক কিছু আবর্জনা মিশিয়ে একটা নির্ঘণ্ট তৈরি করে পরিবেশন করা। যত সব বুজরুকি। বললাম আমি।
তা যা বলেছেন। আমিন সাহেব বললেন, আমি সমস্ত বিবরণ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। কিন্তু ভূতের কারসাজি বলে যতই ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে লিখুক না কেন, আমি কোথাও এমন অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কিছু দেখলাম না, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
থাকলে তো দেখবেন। আমার মনে হয়, কেউ বা কারা বাড়ির বাসিন্দাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ভয় দেখানোর জন্যে এসব ঘটিয়েছে। তবে যারাই ঘটাক, বোঝা যাচ্ছে তারা আনাড়ি নয়। কারণ কাগজের বিবরণ থেকে দেখা যায় তাদের কার্যকলাপ বেশ নিখুঁত। এতই নিখুঁত যে সবাই ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং নিশ্চিতভাবে মনে করছে যে এসবই ভূতের কারসাজি।
ঠিক। আমিন সাহেব বললেন, বাড়িটিতে যা ঘটেছিল বলে বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হলো গভীর রাতে ছাদময় দাপাদাপির শব্দ। বিরক্ত হয়ে একজন টর্চ হাতে খোঁজ নিতে গিয়ে ছাদে কাউকে দেখতে পায়নি। রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে বাইরে বিভিন্ন দিকে টর্চের আলো ফেলেও কোনো আলামত দেখতে পায়নি। এরপর সে সিঁড়িঘরের গেট খোলা কি না পরীক্ষা করতে যেয়ে দেখে কলাপসিবল গেট যথারীতি তালাবন্ধ। অর্থাৎ বাইরে থেকে কারো ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। ভীষণ অবাক হয়ে সে ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই দাপাদাপি। শব্দ আগের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে আরো অনেকের ঘুম ভেঙে যায়। সবাই মিলে আবার খোঁজাখুঁজি। ফল একই। কিছুই পাওয়া গেল না। বাড়ির মধ্যে আর যারা ছিল, তাদের সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল তারা কেউ ছাদে যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দোতলার এক কাজের মেয়ে হঠাৎ ‘ভূত ভূত’ বলে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পর বলে যে সে রান্নাঘরে ঘুমুচ্ছিল। চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দেখে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে থেকে একটা কালো ভয়ংকর মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
খবরের কাগজে প্রকাশিত ঘটনাটির সারমর্ম এভাবে বয়ান করে আমিন সাহেব এবার তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা দিলেন।
বর্তমান যান্ত্রিক যুগে যদিও চৌকস কোনো পেশাদার খেলোয়াড় বা ম্যাজিশিয়ান বা ওই ধরনের কারো পক্ষে মাটি থেকে দশ-বারো হাত উপরে দোতলার জানালার বাইরে বিকট একটা মুখ উপস্থিত করা কঠিন কিছু নয়; তবু আমার ধারণা কাজের মেয়েটা আসলে কিছুই দেখেনি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সে অতি সম্প্রতি কাজে বহাল হয়েছে। অর্থাৎ যারা ভয় দেখানোর জন্যে বাড়িটিতে গত রাতে উৎপাত ঘটিয়েছে, মেয়েটি তাদের কেউ হওয়া বিচিত্র নয়। ভৌতিক নাটকে সে যথাসময় তার ভূমিকাটুকু অভিনয় করে গেছে শুধু।
হ্যাঁ, এমন হতে পারে। বললাম আমি, আমারও মনে হয় ঘটনা তাই।
তা ছাড়া, আমিন সাহেব বললেন, সবার অলক্ষ্যে এবং ধরা পড়ার কোনো চিহ্ন না রেখে নানা কৌশলে ছাদময় দাপাদাপির শব্দ সৃষ্টি করা যায়।
অবশ্যই যায়। আপনি জুয়েল আইচকে জিজ্ঞেস করেন। সে কয়েকটা উপায় বা ট্রিকস আপনাকে বাতলে দেবে। ভূত আসলে দুর্বলচিত্তের কল্পনা। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। ভূতের আবির্ভাব বা উপস্থিতির অকাট্য কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ঠিক বলেছেন। ওই ঘটনাগুলো ছাড়া বাড়িটিতে আরো কিছু কী ঘটেছিল, মনে করতে পারছি না। দাঁড়ান কাগজটা দেখি আর একবার। বলে আমিন সাহেব সবে খবরের কাগজটা আবার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরেছেন, অমনি বিদ্যুৎ চলে গেল।
যাচ্চলে। বিদ্যুতের বারো বাজল। দারুণ বিরক্তির সঙ্গে খেদোক্তি করে আমিন সাহেব কাগজটা পাশে বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রেখে হতাশ ভঙ্গিতে হেলান দেওয়া জায়গাটায় পিঠ এলিয়ে দিলেন।
আকাশে এক ফালি চাঁদ ছিল বলে বিদ্যুৎ চলে গেলেও নিশ্ছিদ্র আঁধার ঘিরে ধরেনি আমাদের। আলো-আঁধারির মতো একরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে শুধু। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না বটে তবে একেবারে অস্পষ্ট নয়। ঠিক এই সময় একটা মৃদু গলা খাঁকারির আওয়াজ পেয়ে চমকে পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তার কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম এতক্ষণ। ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে তাকালেন আমাদের দিকে। তাঁর মাথায় তখন আর চাদরের আঁচল নেই। মুখটা খুব পরিষ্কার দেখা না গেলেও নিখুঁতভাবে কামানো এবং চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আছে, তা বোঝা যায়। হঠাৎ আমার মনে হলো এরকম একটা মুখ কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
আপনারা ভূত নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ভদ্রলোক বললেন, আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আপনাদের কথা ।
ভদ্রলোকের মনে হয় ঠান্ডা লেগে সর্দি হয়েছে। গলাটা সেই রকম ধরা ধরা।
তাই নাকি? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমরা ভেবেছিলাম আপনি ঘুমুচ্ছেন। আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে দুঃখিত।
না না। আমি ঠিক ঘুমুচ্ছিলাম না। ভদ্রলোক বললেন, একটু ঝিমুনির মতো ভাব অবশ্য ছিল। কিন্তু আপনাদের কথাবার্তা শুনে সে ভাবটা কেটে গেল। না না, দুঃখ প্রকাশের কারণ নেই।
আমি ‘সরি’ জাতীয় কিছু বলতে যাচ্ছি দেখে মুখ খুলবার আগেই তিনি বললেন, আমি বেশ উপভোগ করছিলাম আপনাদের কথা। তা ইয়ে, আপনারা মনে হয় ভূত বলে কিছু বিশ্বাস করেন না।
অবশ্যই না। বললাম আমি, কেন আপনি করেন নাকি?
আরে দূর মশাই। জীবনে কোনোদিন ভূত-ফুত বিশ্বাস করিনি। বরং ভূতের কথা কাউকে বলতে শুনলে মেজাজ খিঁচড়ে যেত আমার। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ছাত্র ছিলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছি ওই বিষয়ে। তথ্য-উপাত্তসহ যুক্তিগ্রাহ্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ছাড়া আমরা কোনো কিছু গ্রহণ করতে বা মানতে রাজি নই। তাই ভূত বা অশরীরী কোনো বস্তুর উপস্থিতি বা কার্যকলাপের পক্ষে যারা কথা বলত তাদের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য রীতিমতো পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নানা লাইব্রেরি ঘেঁটে ভূতের ওপর তথ্যসমৃদ্ধ বইপত্র যা পাওয়া গেল, তার সংখ্যা এত কম যে আমার মন ভরল না। শেষে ডক্টরেট করতে যখন আমেরিকা গেলাম, তখন অনেক বইপত্র ছাড়াও নানা সূত্র থেকে অনেক তথ্য আমার নাগালে এলো।
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক থামলেন।
তাহলে তো আপনি একজন ভূত বিশেষজ্ঞ, বললাম আমি।
বিশেষজ্ঞ কি না জানি না। তবে ভূত সম্বন্ধে অনেক কিছু পড়েছি, জেনেছি। ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু ভূত বা অশরীরী বা অতীন্দ্রিয় কোনো বস্তুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো অভ্রান্ত, অকাট্য এবং যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ কোথাও খুঁজে পাইনি। ভূত নিয়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে জানতে পারি যে ১৮১৩ সালে জন ফেরিয়ার নামে জনৈক চিকিৎসক সম্ভবত সর্বপ্রথম ভূতের আবির্ভাব একটি ‘অপটিক্যাল ইলিউশন’ বলে বর্ণনা করেন। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার জ্যাকুই বইমন্ট নামক একজন ফরাসি চিকিৎসক ভূত দর্শন হ্যালুসিনেশনের ফল বলে নানা তথ্য দিয়ে ১৮৪৫ সালে একটা বই লেখেন। পরে কিছু মনস্তত্ত্ববিদ, যারা ‘অ্যানোমালিস্টিক সাইকোলজি’ বা সাধারণভাবে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার অতীত ‘প্যারানরমাল’ পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন, তাঁরা দেখলেন যে ‘হিপ্নাগোজিক হ্যালুসিনেশন’ ভূত দেখার জন্যে অত্যন্ত সহায়ক। এর পর আরো অনেক বিশেষজ্ঞ অনেক প্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপারও যে সময় সময় ভৌতিক বলে মনে হতে পারে, বিশেষ করে কোনো কারণে সাময়িকভাবে মানসিক বিপর্যয় ঘটলে, যেমন ‘প্যারেডোলিয়া’ বলে মানসিক পরিস্থিতির শিকার হলে, উদাহরণসহ তা ব্যাখ্যা করেছেন। তবু ভূত দেখার দাবিসম্বলিত অসংখ্য খবর সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়াতে প্রচারিত হতে থাকে। এসব অবাস্তব এবং অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাগুলো সম্বন্ধে ব্যাপক অনুসন্ধানের জন্যে ১৯৭৬ সালে পল কুর্জ নামে জনৈক ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ‘কমিটি ফর দ্য সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন অব ক্লেইমস অব দ্য প্যারানর্মাল’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যা পরে নাম বদলে হয় ‘কমিটি ফর স্কেপটিক্যাল ইনকোয়ারি’। এই কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে সমস্ত ভূত দর্শন এবং ভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ঘটনাবলি তাদের নজরে এসেছিল বা আনা হয়েছিল, সেগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান এবং গবেষণা শেষে ঘোষণা করেন যে কোনো স্থান ভূত বা মৃত আত্মা অধ্যুষিত বলে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এতটুকু বলে ভদ্রলোক থামলেন আবার।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, ভূত নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আরো চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারলাম। জানলাম যে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনেও আপাতদৃষ্টিতে ব্যাখ্যার অতীত এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যা তাদের কাছে ভৌতিক বলে মনে হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ ভূত নিয়ে গবেষণা পর্যন্ত করেছেন এবং সে সম্বন্ধে তাঁদের অভিজ্ঞতা লিখেও রেখে গেছেন। এঁদের মধ্যে রবিঠাকুরও আছেন। অনেকেই জানেন না যে রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে প্রেতচর্চা করতেন। মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে রীতিমতো প্ল্যানচেট করতেন। এ বিষয়ে তিনি দীর্ঘ প্রবন্ধও লিখেছেন।
হ্যাঁ, বললাম আমি। এ রকম একটা প্রবন্ধ অনেক দিন আগে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু সে প্রবন্ধেও ভূতের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ নেই।
না নেই। ভদ্রলোক বললেন, যা হোক ভূত সম্বন্ধে যতই জ্ঞান আহরণ করতে থাকলাম, ততই ভূত বলে যে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই সে বিষয়ে আমার বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকল। তারপর দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যখন যোগ দিলাম, তখন অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে ভূতের উকিলদের শায়েস্তা করার মহান দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। নানা তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে তাদের কথার এমন দাঁতভাঙা জবাব দিতে লাগলাম যে তারা আর পারতপক্ষে আমার সামনে ভূতের পক্ষে কথা বলার সাহস করত না। একই সঙ্গে অনেক পত্রপত্রিকায়ও এ সম্বন্ধে লেখালেখি করেছি। কিন্তু… বলে ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন আবার।
আমরা বেশ উৎকর্ণ হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনছিলাম। তাই হঠাৎ তিনি এভাবে থেমে যাওয়াতে আমি কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলে উঠলাম, কিন্তু…?
কিন্তু, মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ভদ্রলোক, মাস চারেক আগে এমন একটা ঘটনা আমার জীবনে, মানে একেবারে চোখের সামনে ঘটে গেল যে আমার সমস্ত যুক্তি, বুদ্ধি-বিবেচনা কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। দারুণ সমস্যায় পড়ে গেলাম আমি। সেই থেকে চিন্তা করেই চলেছি।কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছি না। সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। জীবনে বিজ্ঞানের অনেক সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছি; সমাধান বের করেছি; বড় বড় প্রবন্ধ লিখেছি। অথচ নিজের জীবনের এই সামান্য সমস্যাটুকুর হিসাব মিলছে না।
বলে আবার থেমে গেলেন তিনি।
কী এমন ঘটনা? কী এমন সমস্যা? বেশ খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, তা কি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়?
তা যায়, বললেন তিনি। শোনেন তাহলে। চার মাস আগের ঘটনা। সন্ধেবেলা শিল্পকলা একাডেমিতে একটা প্রদর্শনী দেখে বাসায় ফিরছি। বয়স হয়েছে। এখন নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করা দরকার। নানা কারণে হয়ে ওঠে না। তাই ভাবলাম আজ হেঁটেই যাই। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়েছি, হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। বেশ খানিকক্ষণ কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোধহয় জ্ঞান ছিল না। তারপর দেখলাম আমি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি রাস্তার ওপর; জামা-কাপড় রক্তে লাল। অনেক লোকজন ঘিরে আছে আমাকে। তার মধ্যে দু-তিনজন পুলিশের লোকও আছে দেখলাম। পায়ের দিকে রাস্তার পাশে একটা খালি মোটর কার দাঁড়িয়ে; তার সব কয়টা কাচ ভাঙা। বুঝলাম এই গাড়িটাই চাপা দিয়েছে আমাকে। আর পথচারীরা ক্ষেপে গিয়ে গাড়িটার এই হাল করেছে, মানে গাড়িটার মডেল আমূল বদলে দিয়েছে। সচরাচর যা হয় আর কী। এই সময় প্যাঁ-পোঁ করতে করতে একটা গাড়ি এসে থামল আমার পাশে। তাকিয়ে দেখি অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটার পেছনের দরজা খুলে দুজন লোক নেমে এল একটা স্ট্রেচার নিয়ে। আমার দেহের পাশে স্ট্রেচারটা রেখে রক্তমাখা শরীরটা ধরাধরি করে তুলে স্ট্রেচারের ওপর রেখে সেটা নিয়ে ঢুকল অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। ড্রাইভারের ইঞ্জিন স্টার্ট করার শব্দ পেলাম। তারপর গাড়ির দুলুনিতে বুঝতে পারলাম অ্যাম্বুলেন্স চলতে শুরু করেছে। বুঝলাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই। হাসপাতালে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সটা এক জায়গায় থেমে দাঁড়ালে স্ট্রেচারসুদ্ধ আমাকে জরুরি বিভাগ বা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সাদা অ্যাপ্রন পরা ছোকরামতো দুজন ডাক্তার আমার হাতের নাড়ি টিপে, চোখের ওপর টর্চের আলো ফেলে, নিচের পাপড়ি টেনে ধরে, বুকে স্টেথিস্কোপ বসিয়ে পরীক্ষা-টরীক্ষা করল। তারপর দুজনে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করল। একটু পর দেখলাম একটা চাকা লাগানো মোবাইল বেড এনে আমাকে স্ট্রেচার থেকে তার ওপর তোলা হলো। তারপর দুজন ডোম শ্রেণির লোক সেটা ঠেলে নিয়ে চলল। মনে হলো আমার বোধ হয় অপারেশনের প্রয়োজন। তাই অপারেশন থিয়েটার মানে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর আগে হাসপাতালে নিজের চিকিৎসার জন্যে কখনো আসার প্রয়োজন হয়নি। যাও বা এসেছি, তা পরিচিত বা আত্মীয় সম্পর্কিত কোনো রোগী দেখতে। ফলে হাসপাতালের অভ্যন্তরের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে তেমন একটা ধারণা ছিল না। তাই ডোম শ্রেণির লোক দুজন আমার বেডটা নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে যখন স্বল্পালোকিত একটা ঘরে প্রবেশ করল, সেটা ওটি কিনা প্রথমে বুঝতে পারলাম না। লোক দুজন আমাকে ধরাধরি করে মোবাইল বেডটা থেকে তুলে একটা বড় ক্রোমিয়াম প্লেটেড টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে গেল। খানিক পরে তারা আবার ঘরে ঢুকল সাদা অ্যাপ্রন গায়ে মাঝবয়সী একজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। তার গলায় ঝোলানো স্টেথিস্কোপ আর হাতে একটা প্যাড আর বল পেন। ওটিতে কখনো না গেলেও টেলিভিশন এবং মুভিতে যে রকম দেখেছি ডাক্তারের পরনে সে রকম পোশাক এবং ঘরটায় সে রকম আয়োজন না দেখে বুঝলাম এটা ওটি নয়। ভাবলাম এটা বোধ হয় অপারেশনের আগে রোগীকে তৈরি করার ঘর।
ভদ্রলোক থামলেন, সম্ভবত দম নিতে।
একটু পর ভদ্রলোক শুরু করলেন আবার—এর একটু পরেই সমস্যার শুরু; অনেক ভেবেও যার কোনো সুরাহা মিলছে না। আর তাই চিন্তারও অবসান হচ্ছে না।
কী সমস্যা? আর আপনার চিন্তারই বা কারণ কী ঠিক বুঝতে পারছি না। বললাম।
চিন্তায় পড়লাম এ জন্য যে, দুর্ঘটনার পর আমাকে নিয়ে এত সব কাণ্ড, এই যেমন স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এসব আমি দেখলাম বা জানলাম কী করে, তার কোনো হদিস না পেয়ে।
মানে? আমি তার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বললাম, না দেখার কী আছে? দুর্ঘটনায় আপনি হয়তো সাময়িক জ্ঞান হারিয়েছিলেন; তারপর জ্ঞান ফিরে এসেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বললেন, আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এর পরে যা ঘটল, তাতেই চিন্তায় পড়ে গেলাম।
কেন? আপনার অপারেশন তো হলো?
হলো।
এবং সাকসেসফুল, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বহাল তবিয়তে আছেন এখন। তাহলে আপনার চিন্তার কারণটা কী তা এখনও আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
চিন্তার কারণ, ভদ্রলোক বললেন, অপারেশন হলো, কিন্তু ওটিতে নয়। হলো ওই ঘরেই এবং ক্রোমিয়াম প্লেটের পাত বসানো টেবিলটার ওপর। মাঝবয়সী যে ডাক্তারটা ঘরে ছিল; অপারেশনটা সে করেনি, করেছে ডোম দুজন, যারা আমার বেড ঠেলে এ ঘরে এনেছিল। তারা ছুরি দিয়ে আমার দেহ কাটা-ছেঁড়া করতে করতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে ডাক্তারকে কী যেন বলছিল; আর সে তার প্যাডে তা লিখে নিচ্ছিল। তখন বুঝলাম অপারেশন না, ডোম দুটো আমার পোস্টমর্টেম করছে। এই ঘরটা আসলে লাশকাটা ঘর যেখানে শব ব্যবচ্ছেদ হয়। তার মানে দুর্ঘটনাস্থলেই আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। তাই যদি হয়, তাহলে দুর্ঘটনার পর আমাকে নিয়ে যা কিছু করা হলো তা আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হয় কী করে? আর আমাকেই বা কেউ দেখতে পাচ্ছে না কেন? অবশ্যি তখন না জানলেও পরে বুঝতে পেরেছি ইচ্ছা করলে আমি আমার ব্যবহৃত যে কোনো পোশাকে দৃশ্যমানও হতে পারি। এত যে পড়াশুনো আমার, তা কোনো কাজে আসছে না। অনেক ভেবেও এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে পারছি না। আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম যখন মনে হলো, এ সবই সম্ভব শুধু একটি ব্যাপার ঘটলে। আর সেই ব্যাপারটাই যে আমার বেলায় ঘটেছে তা একদিকে যেমন আমার বিদ্যা-বুদ্ধি-লজিক মেনে নিতে পারছে না; অন্যদিকে তেমনি
বাস্তবকেও অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। জীবনে যা কোনো লজিক বা যুক্তিতে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, তা যদি এখন মেনে নিতে হয় তাহলে কেমন লাগে বলেন তো। মহাবিড়ম্বনায় পড়লাম আমি। চিন্তিত মনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে দেখি বারান্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছেলেমেয়ে এসে জড়ো হয়েছে। তাদের অনেককেই দেখলাম চোখে রুমাল চেপে কাঁদছে। দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আহা এরা আমাকে এত ভালোবাসে আগে কখনো বুঝতে পারিনি। ভাগ্যিস আমার পরিবারের কেউ এখানে নেই। স্ত্রী গত হয়েছে বছর দুই আগে; আর ছেলে-মেয়ে দুটি বিদেশে লেখাপড়া করছে।
ভদ্রলোকের কথায় বলা বহুল্য আমি এবং আমিন সাহেব দুজনেই দারুণভাবে চমকে উঠেছি। তিনি থামতেই আঁতকে ওঠা গলায় বলে উঠলাম, তার মানে আপনি- আপনি-
হ্যাঁ, যা ভাবছেন ঠিক তাই। আচ্ছা চলি তাহলে। ভদ্রলোক হঠাৎ বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গি করে বললেন, আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করলাম। কিছু মনে করবেন না।
ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চলে এল। আলোয় ভরে গেল চারদিক। ভদ্রলোকের মুখটা পরিষ্কার দেখার জন্যে দৃষ্টি ফেরালাম তাঁর দিকে। কিন্তু দেখা গেল না। তিনি চাদরটা আঁচলের মতো মাথায় তুলে আবার ঢেকে ফেলেছেন তাঁর মুখ।
ইয়ে, আপনার নাম-পরিচয় তো জানা হলো না। তিনি চলে যেতে উদ্যত দেখে বললাম আমি।
নাম-পরিচয় জেনে আর কী করবেন? খানিকটা নিস্তেজ গলায় বললেন ভদ্রলোক, এখন আমাকে কেউ চেনে না। অথচ এক সময় প্রফেসর পরাশর রুদ্রকে সবাই এক নামে চিনত।
পরাশর রুদ্র? আই মিন আপনিই ডক্টর পি রুদ্র? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফিজিসিস্ট? বিস্মিত হয়ে বললাম আমি, যার অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ বিলাত-আমেরিকার নামকরা বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে?
তা হয়েছে।
তখন পরিষ্কার মনে পড়ল, বিখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানী প্রফেসর পি রুদ্র কয়েক মাস আগে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাঁর মুখ চেনা চেনা লাগছিল কেন এখন বুঝলাম। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার কোনো সুযোগ কখনো হয়নি। সেই সুযোগটা এল, কিন্তু এইভাবে!
চলি। নমস্কার।
বলে ভদ্রলোক বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বলতে গেলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন; একেবারে আমাদের চোখের সামনে। হতবাক হয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া করার আর কিছু ছিল না।
ভাইসাব, বিরাট এক ঢোঁক গিলে আমিন সাহেব বললেন, আমরা কি এতক্ষণ একটা ভূতের পাশে বসেছিলাম?
তাই তো মনে হচ্ছে। আমিও একটা ঢোঁক গিলে জবাব দিলাম। তবে সাধারণ ভূত না; বিজ্ঞানী ভূত।
বেঞ্চিটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমিন সাহেব বললেন, চলেন বাড়ি যাওয়া যাক। শরীরটা কেমন শিরশির করছে।
সেটা শীতে না ভয়ে তা আর জিজ্ঞেস করলাম না। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমিও বললাম, হ্যাঁ, চলেন। আমারও শরীরটা কেমন জানি—
আমিন সাহেব ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করেছেন দেখে আমিও তাঁর পিছু ধরলাম। কিছুদূর নীরবে হাঁটার পর আমিন সাহেব হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরলেন। বেঞ্চিটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই বেঞ্চিটায় আর বোধ হয় বসা হবে না। যাচ্চলে….
বলে ফিরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন।
হুঁ। বলে আমিও তাঁর পিছু পিছু।