নির্বিকার

নির্বিকার

মাটিতে একদলা থুতু ফেলে মনিরের মূখের দিকে তাঁকালো জসিম।
অনেকটা নির্বিকারের মতোই।
মনিরকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো- “পাটিবাড়ীর ভিঁটেয় তো চুন্নি থাহে। ক্যামনে মাছ ধরবার যাবি?”
মনির বললো- “চুন্নি বইলা কিছু আহে নাকি? আইজ রাইতে আমি জাল লইয়া যামু। তুই গিলে যাবি নাইলে থাকিস।”
মাছ ধরা যদিও একটা বড় নেশা। সেটা সামলানো অনেক কঠিন কাজ।
মনিরের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলো জসিম।
রাতের বেলা চুপিচুপি দু’জনে যাবে পাটিবাড়ীর পুরনো দিঘিটাতে মাছ ধরতে।
বহুকাল ধরে এই দিঘির ধারে কেউ আসে না।
চুন্নির ভয়ে সকলে পাটিবাড়ীর দিঘিটাকে যথাসম্ভব এড়িয়েই চলে।
গ্রাম থেকে দুই ক্রোশ দূরে পাটিবাড়ীর আঙিনা।
রাত গভীর হলে সকলে যখন ঘুমিয়ে পড়লো মনির তখন জসিমকে নিয়ে পাটিবাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো।
জসিম আর মনিরের হাতে মাছ রাখার খাড়ী আর কাঁধে ঝোলানো জাল।
দুজন চুপচাপ হেঁটে চলেছে।
পাটিবাড়ী যেতে হলে একটা খাল পার হতে হয়।
খালটা পার হলেই দিনের বেলা পাটিবাড়ীর আঙিনা দেখা যায়।
তবে এখন রাতের বেলা দেখা সম্ভব না।
আজকে রাতটা জোসনায় আলোকিত।
তাই মনির তার ২ ব্যাটারীর জাপানী লাইটটা হাতে করে আনেনি।
গত মাসে গাঁয়ের ভাঙাড়ীর দোকান থেকে ২৫টাকা দিয়ে লাইটটা কিনেছিলো।
পুরাতন হলেও রাতের বেলা মনিরকে অনেক সাহায্য করে লাইটটা।
খালের পাড়ে এসে জসিম এদিক ওদিক তাঁকাতে লাগলো।
জোসনার আলোয় বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে খালের পাড়।
এতক্ষনের মধ্যে এইবার জসিম এইবার মূখ খুললো।
“ডিঙির টিকিখানি পর্যন্ত দেহিনা তো। এই কী কইরা খাল পার হবি রে মনির?”
মনিরও পাল্টা জবাবে জসিমের নিরাশা ভেঙে দিলো।
“চেনতা করিস ক্যা? আমরা কী সাঁতার জানিনা নাকি? চল লুঙি গুটায়ে নেমে পড় দেহি।”
দুজনেই লুঙ্গি গুটিয়ৈ নেমে পড়লো খাল পাড়ি দেওয়ার জন্য।
.
.
সাঁতরিয়ে খাল পার হয়ে দু’জন পাড়ে এসে উঠেছে।
শীতের মধ্যেও হাড় হিম করা পানিতে দুজন সাঁতার দিলো শুধু মাছ ধরার নেশায়।
মনিরের গামছায় দুজন শরীর মুছে আবার হাঁটা দিলো পাটিবাড়ীর দিকে।
পাশের পাটবাগান থেকে হুক্কা-হুয়া সুরে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক।
পাটবাগানের মধ্যখানে বাড়ী বলে বাড়ীটাকে গ্রামের সকলে পাটিবাড়ী বলেই ডাকে।
এখন এই বাড়ীতে আর কেউ থাকে না।
.
.
দুজন অবশেষে এসে পৌঁছালো পাটিবাড়ীর আঙিনায়।
“কিরে জসিম? কেমন একটা পঁচা পঁচা গন্ধ নাকে এসে ঠ্যাকে। তুই ঠ্যাকর করতে পারতাছিস?”
মনির জসিমের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করিলো।
“কই নাতো। আমার নাকে তেমন কিছু ঠ্যাকর পায়না তো।”
জসিমের জবাবে এতটুকুও অবাক হলোনা মনির।
ভাবছে হয়তো কোনো পশু মরে গন্ধ হয়ে গেছে।
দুজনে পাটিবাড়ীর পেছন দিকটাতে যায়।
এখানেই রয়েছে সেই দিঘি।
যেটাতে মাছ ধরার জন্য দুই বন্ধু দুই ক্রোশ পথ হেঁটে এসেছে।
-“তুই মাছের মসল্যাটা বানাইয়া লে। আমি একটু মুইত্যা আসি।” কথাটা বলতে বলতে খাড়ীর ভেতর থেকে একটা পলিব্যাগ এগিয়ে দেয় মনির।
পলিব্যাগের মধ্যে রয়েছে মাছকে আকর্ষণ করার জন্য এক প্রকার খাদ্য।
মনির প্রসাব করার জন্য দিঘির কোণে একটা তাল গাছের নিচে গিয়ে বসে কাজ সারতে লাগলো।
.
.
মসল্যা তৈরী করার জন্য একটু পানি হইলে ভালো হতো।
এজন্য জসীম মসল্যার পাত্রটা নিয়ে দিঘি থেকে একটু পানি তুলতে যায়।
পাত্রটা পানিতে ডুবাতেই কেউ একজন হাত বের করে জসীমকে নিচের দিকে টানতে থাকে।
জসীম যতই চেষ্টা করছে হাত ছাড়ানোর ততই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
জোসনার আলোতে সে দেখতে পেলো একটা কালো হাতে তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে।
অনেক কষ্টে মনিরকে ডাকার চেষ্টা করে সে।
কিন্তু তার গলা থেকে আওয়াজ বের হতে চাচ্ছে না।
অবশেষে ব্যর্থ হয়ে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারায় জসীম।
কালো হাতটা তাকে পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়।
পানিতে হঠাৎ করে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে দ্রুত দৌঁড়ে আসে মনির।
– ওই জসিম? কী হইলো?
– কিছুনা। পানিতে মাছ নড়ার একখান আওয়াজ হইলো।
– তোর গলাডা অমন ফ্যাসফ্যাসে লাগে ক্যান রে?

কোনো কথা বলেনা জসিম। চুপচাপ মাছের মসল্যা মাখাইতে থাকে।
.
.
সামনা সামনি বসে আছে দুজন। তবে আবছা আন্ধকারে কেউ কারো মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেনা।
মনির মাছ ধরার মসল্যাটা নিয়ে দিঘির এককোণে ছিটিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
– ওই ধারডায় তুই মসল্যা দিয়ে জাল মার। আমি এইহানে থাকুম।

কথাটা বলে পাত্রটা জসীমকে দিয়ে জাল আর খাড়ী নিয়ে উঠে যায় মনির।
কিন্তু জসীম যে সেখানেই বসে থাকলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় পেলো না মনির।
.
.
বেশ কিছুক্ষণ জাল ফেলার পর মনিরের খাড়ী মাছে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।
সেগুলো এনে জসীমের সামনে রেখে বললো-
“তোর খাড়ী কী ভইরা গেছে?”

জসিম কোনো কথা বলেনা।
কিন্তু মনিরের এতে কিছুই সন্দেহ না।
কারণ জসিম প্রয়োজন ব্যতীত খুব একটা কথা বলতে চাইনা।
মনির ভাবতে লাগলো হয়তো জসীমের খাড়ীও পুরো হয়ে গেছে।
মনির আবার বললো- “চল এইবার ফিরি। আজকে আর ধরুম না।”
কথাটা জসিমের কানে গেলেও সে চুপটি মেরে সেখানে বসে রইলো।
যেন তার কোনো তাড়া নেই।
মনির এইবার ওর হাত ধরে একটু টান দিলো।
আর তাতেই ঘটলো বিপত্তি।
জসীম রক্তাক্ত চোখে মনিরের দিকে তাঁকালো।
মনির অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ওর চোখ।
জসীম খপ করে ধরে ফেললো মনিরকে।
ওর বুক বরাবর লম্বা নখ বসিয়ে দিয়ে লাল কলিজাটা বের করে আনলো।
ততক্ষণে মনির আৎকে ওঠার মতো একটা আওয়াজ করে মাটিতে পড়ে রইলো।
দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেছে।
জসীম কলিজার এককোণে কামড় দিয়ে আকাশ ফাঁটিয়ে একটা হাসি দিলো।
জসীমের গাল বেয়ে পড়ছে কলিজা নিংড়ানো রক্ত।
আর পাশে পড়ে আছে একখাড়ী মাছ এবং জাল।
কিছুক্ষণ পর গাঁয়ের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজান ভেসে আসলো।
সাথে সাথে জসীমের শরীরটা আবার পুকুরের মধ্যে লাফ দিয়ে বিলীন হয়ে গেলো।
হয়তো অন্য কারো রাতের বেলা মাছ ধরতে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে আছে।

……………………………………….সমাপ্ত………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত