এই কংক্রিট শহরের বুকে ঠিকমতো আকাশেরই দেখা মেলে না, জোছনার দর্শন কী করে মিলবে? তবু আকাশে চোখ রেখে ব্যাপারটা অনুভব করার চেষ্টা করে রাশেদ। ভীষণ উজ্জ্বল রুপালি চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে। ঠিক এখনই যদি নিভে যেত এই সড়কটার সবগুলো স্ট্রিট ল্যাম্প, মার্কেটগুলোর রঙিন আলো আর যানবাহনের হেডলাইট—তা হলে হয়তো জোছনা অবতরণ করতে পারত নগরীর বুকে। দেখতে দেখতে পিচঢালা সড়কটা হয়ে যেত রুপালি ছায়াপথ।
অবশ্য স্বপ্নই দেখা যেতে পারে শুধু। মস্ত বড় এই শহরে লাখো স্বপ্ন যেমন ভাঙে প্রতিদিন, তেমনি পূরণও হয়।
কিন্তু জোছনায় ভেজার স্বপ্নপূরণের ক্ষমতা যে এই নগরীরও নেই।
ক্লান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ণ রাশেদ একা একা হাঁটে বাড়ির পথে। কেন যেন আজকাল মনের শরীরে সরীসৃপের মতো বিষণ্ণতা জড়িয়ে থাকে সবসময়। দিন শেষে বাড়ি না ফেরার আগ পর্যন্ত কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। আজব সব ইচ্ছা জাগে মনে, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারা যায় না। অদ্ভুত সব ব্যাপারে মন অকারণ আগ্রহী হয়ে ওঠে… বাড়ি এসে গেছে। দরোজায় দাঁড়ানো আয়শার মুখটা দেখামাত্র আজেবাজে ভাবনা নিমিষে উড়ে যায় মন থেকে। কী ভীষণ মিষ্টি একটা মুখ। টলটলে চোখ জোড়ার দিকে তাকানো মাত্র বুকের মাঝে বর্ষা নামে, ছড়িয়ে পড়ে স্নিগ্ধ প্রশান্তির কণা।
সত্যি কথা বলতে কী, আয়শার মতো স্বচ্ছ মনের মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না। সোজা-সরল, নির্লোভ, নিরহংকার একজন মানুষ। আশপাশে সবাই যখন যুগের তীব্র গতির সাথে তাল মেলাতে ব্যস্ত, আয়শা তখন ডুবে আছে নিজের ভিন্ন জগতে। কলুষতাবিহীন, অন্যরকম একটা জগৎ। মানুষ প্রাণীটাকে ভীষণ ভালবাসে সে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পাড়া-পড়শী—সকলের জন্যই তার খুব টান।
আলতো করে হাসে আয়শা। হাত থেকে বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে দরোজা বন্ধ করে। ‘তোমার অফিস এত কাজ করায় কেন বলো তো?’
‘হঠাৎ এ কথা?’
‘আজও ফিরতে দেরি হলো তোমার!’ হেসে ফেলল রাশেদ। ‘শুধু অফিসকে দোষ দিচ্ছ কেন? এমনও তো হতে পারে অন্য কোথাও ছিলাম আমি। হয়তো কোনও সুন্দরীর সাথে…’
‘ইস অত সোজা? তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারোই না।’
‘এত বিশ্বাস করা ভাল না, ম্যাডাম!… রোকসানা কই?’
‘ঘুমাচ্ছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।’ আয়শা চলে যায় কিচেনে। বাথরুমে ঢোকার আগে রোকসানার ঘরের দিকে একবার উঁকি দেয় রাশেদ। এ কদিনেই মেয়েটার চেহারা একদম ফিরে গেছে। স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে।
মুখটায় ফিরে এসেছে শিশুসুলভ স্বাভাবিক চাপল্য।
এই আরেকটা ব্যাপার আয়শার। আশ্চর্য সুন্দর। রাস্তা থেকে এতিম ছেলে-মেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে সে। বলে যে কাজের লোক হিসেবে নিয়ে এলাম। কিন্তু আসলে কাজ করানোর চাইতে আদরই করে বেশি। ওসব ছেলে-পিলেরা অবশ্য কেউ-ই বেশি দিন থাকে না। রাস্তায় রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলে-পিলেদের মন কি আর চার দেয়ালের মাঝে টেকে? কিছুদিন ভালমন্দ খেয়ে, নতুন কিছু জামাকাপড় পেলেই পালায় এরা। যাওয়ার আগে চুরি-চামারিও করে বোধ হয়। তবে সেটা নিয়ে আয়শা কখনও উচ্চবাচ্য করে না। এবং হালও ছাড়ে না। আবার একজনকে খুঁজে নিয়ে আসে। এবং আশা করে এইবারের জন হয়তো তাকে ছেড়ে যাবে না। হয়তো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশেদ।
বিধাতা তাদের একটি সন্তান কেন দিচ্ছেন না? বিয়ের পর একে একে পাঁচটা বছর পার হয়ে গেছে। এখন তো আয়শা এ ব্যাপারে কথা পর্যন্ত বলে না। বোঝাই যায়, আশা করাও ছেড়ে দিয়েছে। এবং এ-ও বোঝা যায় যে রাস্তার অনাথ শিশুগুলোকে ভালবেসে মাতৃত্বের অতৃপ্ত সাধটাই পূরণ করার চেষ্টা করে সে।
ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি হয়েছে বিস্তর। দুজনের কারোরই কোন সমস্যা নেই। কিন্তু…
এই একটা কিন্তুই নীরব সমস্যা হয়ে জেপে আছে পাথুরে দ্বীপের মতন, রাশেদ-আয়শার দাম্পত্যের প্রশান্ত নীল সমুদ্রে!
সম্ভবত আজীবনই থাকবে।
খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। আয়শা কোথায়? ও হ্যাঁ, মার্কেটে।
নিজেই এসে ফ্রিজ খোলে রাশেদ। সে রকম কিছু নেই, পাঁউরুটি আর কোল্ড ড্রিংকস ছাড়া। আয়শা ফ্রিজে রাখা খাবার কখনও রাশেদের সামনে আনে না। স্বামীর পছন্দ নয়, জানা আছে তার।
একটা প্লেটে কয়েক স্লাইস ভাজা মাংস দেখা যাচ্ছে। কী করা যায়? স্যান্ডউইচ করা যেতে পারে…হ্যাঁ, সেটাই সহজ। দু স্লাইস রুটিতে পুর করে মেয়োনিজ মাখিয়ে কয়েক স্লাইস মাংস, একটু সিদ্ধ ডিম, একটা লেটুসপাতা আর অল্প গোলমরিচ। ব্যস, রেডি টু ইট! উমমম! দারুণ!
নিজের প্রতিভায় নিজেই বিস্মিত হয় রাশেদ। রান্না করাটা তা হলে খুব বেশি একটা কঠিন কিছু নয়। চাইলেই শেখা যেতে পারে। ইচ্ছা থাকতে হবে।
‘তুমি এটা কী খাচ্ছ?’ স্যান্ডউইচটা হাতে দেখে রীতিমতো চিৎকার করে ওঠে আয়শা। ‘দেখি! আমাকে দেখাও!’
‘আরে, একটা স্যান্ডউইচ তো। ফ্রিজে যে মাংসের স্লাইস ছিল…’
‘সেই মাংস দিয়ে বানিয়েছ? হায়, খোদা! ফেলে দাও। এক্ষুনি ফেলে দাও। এক্ষুনি!’
নিজেই স্যান্ডউইচটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে আয়শা।
‘কী হলো?’ বিস্মিত রাশেদ। ‘সমস্যা কী?’
‘ওই মাংস খাওয়া যাবে না। অনেক দিনের পুরনো। আমি তোমাকে অন্য কিছু করে দিচ্ছি।’ ‘অনেক দিনের পুরনো তো ফেলে দাওনি কেন?’
‘ভুলে গেছি।’ উদ্বিগ্ন দেখায় আয়শাকে। ‘তুমি কতটুকু খেয়েছ ঠিক করে বলো তো!’
‘বেশি না। ৩/৪ কামড় দিয়েছি।’
এবার একটু হাসল আয়শা। ‘ডায়রিয়া হলে কিন্তু আমার দোষ নেই।’
‘নাহ্। এত সামান্যে কারও শরীর খারাপ হয় না।’
‘হতেই পারে। মানুষেরই তো শরীর…’ আয়শার কথাই অবশ্য ঠিক হয়েছে। সত্যিই রাতে শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল। ডায়রিয়া হয়নি, তবে বমি-টমি করে যাচ্ছেতাই অবস্থা। দু’দিন অফিস কামাই হয়েছিল।
ঘটনাটা বেশ আগের। ৬/৭ দিন তো হবেই। রোকসানাকে যেদিন প্রথম বেড়াতে নিয়ে গেল আয়শা, সেদিনকার ঘটনা। শরীর ভাল হয়ে গেলেও বোধহয় মনটা হয়নি। সেদিনের পর থেকে খাবার টেবিলে বসলেই কেমন যেন অনীহা লাগে। কখনও কখনও বমি পায়। অথচ পেটে রাক্ষুসে খিদে। পুরানো, বাসি মাংস ছিল। না জানি কত রকম জীবাণু বাসা বেঁধে ছিল…
‘তুমি আবার ওইসব হাবিজাবি ভাবছ?’ একটু বিব্রতই বোধহয় হলো রাশেদ। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যে বলে, ‘তুমি তো দেখছি কিছুই খাচ্ছ না। এতকিছু আমি একা খাব নাকি?’
‘আমি কোন কালে বেশি খেতাম?’
‘এত অল্প খেয়ে তুমি বেঁচে থাকো কী করে—সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।’ কথাটা অবশ্য সত্যি। আয়শা প্রায় কিছুই খায় না। যেন অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্যেই খাবার টেবিলে বসে। ভাত-ডাল-সবজির মতো স্বাভাবিক সব খাবারে তার ভীষণ অনীহা।
প্রিয় হচ্ছে কোল্ড ড্রিংকস, চকোলেট আর কালো কফি। প্রিয় বললেও ভুল হবে। এই তিনটা আয়শার প্রধান খাদ্য।
‘তুমি এটা একটু ট্রাই করে দেখো তো!’ ফ্রিজ থেকে ছোট্ট একটা বাটি বের করে দেয় আয়শা। ‘একটু খেয়ে দেখো। মনে হয় ভাল লাগবে। কদিন যাবৎ তো একদম না খেয়ে আছ।’ খাবারটা এমন আহামরি কিছু না। ছোট ছোট মাংসের টুকরা। মশলায় কালো রঙ হয়ে গেছে। রঙ আর গন্ধ—দুটোই আচারের মতো।
‘এটা তো আচার মনে হচ্ছে।’
‘আচার-মাংস বলে একে। তুমি একটু খেয়েই দেখো না। ভাল লাগবে।’
সত্যিই তাই। ভীষণ ভাল লাগে রাশেদের। অনেকদিন পর আরাম করে খেতে পারে সে। মন ভরে, পেটপুরে। মাংসটা কাঁচা না রান্না করা, সে নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না।
একটু লক্ষ করলেই রাশেদ দেখতে পেত যে তার স্ত্রীর চোখে ভর করেছে অন্য রকম আলো। কীসের যেন সংকেত দুচোখের সেই আলোয়!
অফিসে আজকাল একদম ভাল লাগে না। একটুও মন বসে না কাজে। শরীর খারাপ লাগলে কারই বা কাজ করতে ইচ্ছা হয়?
‘তোর চেহারার কী হাল হয়েছে দেখেছিস?’ কোমল কণ্ঠে বলে সুমন। বন্ধু, কলিগ। ‘আমার মনে হয় ক’টা দিন ছুটি নে। বাসায় শুয়ে-বসে থাক। অথবা ভাবীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যা।’
‘কী লাভ? এত ডাক্তার দেখালাম, কেউ তো কোনও শারীরিক সমস্যা খুঁজে বের করতে পারে না। বলে—সমস্যা আপনার মনে।’ ‘আমি জানি না। আমার কিছু খেতে ভাল লাগে না। খাবার দেখলেই বমি পায়। কোনরকম চা-কফি খেয়ে বেঁচে আছি।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সুমন। তারপর বলে, ‘মানসিক চিকিৎসক দেখিয়েছিস?’
‘হুঁ। তবে লাভ কী? একগাদা ঘুমের ওষুধ দিল শুধু।’
‘ভাবী কী বলে?’ ‘তোর ভাবী তো সারাদিন কান্নাকাটি করে। নিজেকে দোষ দেয়। বলে, সে বেখেয়ালে বলেই নাকি পঁচা মাংসগুলো ফ্রিজে রয়ে গেছিল।’
‘বেচারী! এমনটা ভাবতেই পারে। তোকে যা ভালবাসে! কপাল নিয়ে এসেছিলি দুনিয়ায়।’
‘আর কপাল! আজকাল মনে হয় আয়েশাকে একা ফেলে মরে-টরে না যাই।’ ‘যা ব্যাটা, আজেবাজে কথা বলিস না। সবকিছুই তো করে দেখলি, এখন আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?’
‘কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবি। সন্ধ্যায় যাব। অফিসের পর।’
ঠিক সন্ধ্যায় নয়, অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে যায়। তবু সুমন নাছোড়বান্দা। ঠিকই রাশেদকে ধরে নিয়ে যায় সে। এমন একটা জায়গা, যেখানে প্রবেশের কথা চিন্তাও করতে পারে না রাশেদ।
সরু, নোংরা গলি। দুপাশে ছাপড়া ঘর। ডাস্টবিনের উৎকট গন্ধ বস্তির সর্বত্র। প্যাঁচপেঁচে কাদা গলিতে। হাঁটতে গেলে জুতো দেবে যায়।
যে ঘরে লোকটার দেখা মেলে, তারও বাইরের অবস্থা একই রকম। আর ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী। মোটা কার্পেট পাতা মেঝেতে। বিবর্ণ, পুরানো। সিলিংয়ে ঝোলানো পুরানো ঝাড়বাতিও ছড়াচ্ছে ম্লান আলো। এছাড়া ঘরটিতে আসবাব বলতে শেলফের পর শেলফ ভরা বই আর ঝাড়বাতির নিচে পাতা সেগুন কাঠের চওড়া টেবিলটা। যার অপর প্রান্তে বসা বৃদ্ধও সাজসজ্জার মতোই প্রাচীন।
‘আসসালামু ওয়ালাইকুম, বাবারা।’ ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলেন তিনি। ইশারায় বসার ইঙ্গিত করেন।
সুমনের সাথে বৃদ্ধের সৌজন্য বিনিময়সূচক কথা হয় কিছু সময়। রাশেদকে নিয়েও কথাবার্তা হয় বিস্তর। কিন্তু কিছুই পৌঁছায় না রাশেদের মস্তিষ্ক পর্যন্ত। নিজেকে কেমন জড় পদার্থের মতো লাগে।
একসময় রাশেদের দুটো হাত ধরেন বৃদ্ধ। আর হাত দুটো ধরে ঝিম মেরে বসে থাকেন দীর্ঘসময়। ঘরের কোথায় যেন ধূপ জ্বেলে দিয়ে গেছে একজন। কী যে জঘন্য লাগছে গন্ধটা!
‘তোমার বাসার মানুষদের মধ্যে একজন আছে…’
কথা শেষ করতে পারেন না বৃদ্ধ। তার আগেই সুমন বলে ওঠে, ‘ওর বাসায় আর মানুষ কই! স্রেফ ও আর ভাবী।’
‘আর কেউ নেই?’ এবারও রাশেদকেই প্রশ্ন করেন তিনি।
‘আছে। একটা মেয়ে আছে এখন। রোকসানা।’ ক্ষীণ সুরে বলে রাশেদ। ‘আমরা নিঃসন্তান। মাঝে মধ্যেই আমার স্ত্রী রাস্তার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে এনে রাখে। ভীষণ ভালবাসে তাদের। ওদের নিয়েই আয়শার দিন কাটে।’
‘তোমার কিছু খেতে ভাল লাগে না, তাই না?’ ‘সেদিন সেই পচা মাংস খাওয়ার পর থেকে… সবসময় মনের ভেতর অস্থির লাগে। কোন কাজে আগ্রহ পাই না। অসম্ভব ক্লান্ত শরীর।’
‘তা হলে সবার আগে তোমার প্রয়োজন খাদ্য এবং বিশ্রাম।’ বলতে বলতে ভেতর বাড়ির দিকে রওনা হন বৃদ্ধ।
সাথে সাথে বাধা দেয় রাশেদ।
‘আপনি কষ্ট করবেন না, চাচা। আমি সত্যি কিছু খেতে পারি না।’
মৃদু হাসেন তিনি, ‘দেখা যাক, আমি পারি কিনা তোমার পছন্দসই কিছু খাওয়াতে।’
টেবিল ভরে সাজানো হয় নানান পদের খাদ্যসমগ্রী। অতিথি আপ্যায়নের চূড়ান্ত আয়োজন। সুমন তো খুশি হয়েই প্লেট টেনে নেয় কাছে, কিন্তু রাশেদের দেখেই অসহ্য লাগতে শুরু করে। কয়েক রকমের কাবাব, নানরুটি নানা রকম মিষ্টি-ফিরনি কিংবা শরবত—সব দেখেই বমি বমি ভাব হয়। ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যেতে।
মৃদু হাসেন বৃদ্ধ। ভেতর বাড়ি থেকে পৃথক একটা প্লেট এনে রাখেন রাশেদের সামনে। মাথায় হাত রাখেন কোমল ভঙ্গিতে। ‘তুমি ক্ষুধার্ত, বাবা। খাও! নিঃসংকোচে খাও। না খেলে মানুষ বাঁচবে কী করে? তুমি খাও।’
সত্যিই তাই করে। খাবারটুকুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশেদ। খাবারটা ভালই। সেদিন রাতে আয়শার দেয়া মাংসের মতো অত ভাল না। তবে ভালই। অন্তত দীর্ঘদিন পর কিছু খেতে তো পারা যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়। রাক্ষুসে খিদেটা মিটে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাশেদ। রাত হয়েছে অনেক, সুতরাং বিদায় নেয় সুমন। সত্যি কথা বলতে কী, বৃদ্ধ তাকে সরাসরিই বলেন চলে যেতে। রাশেদের সাথে একান্তে কথা বলতে চান তিনি। কিছু কথা কারোর সামনেই বলা যায় না। বুদ্ধিমান সুমন অবশ্য এতে কিছু মনে করে না। জানিয়ে যায়, গলির সামনে পান-সিগারেটের দোকানে অপেক্ষা করবে সে।
‘আমাদের কী খাওয়ালেন আপনি, চাচা?’
আবার হাসেন বৃদ্ধ। ‘তোমার ভাল লেগেছে?’
‘হ্যাঁ। অনেকদিন পর কিছু খেতে পেরেছি। জিনিসটা কী ছিল?’
‘গরুর মাংস… কাঁচা গরুর মাংস! মসলায় মাখানো।’
আঁতকে ওঠে রাশেদ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আঁতকে উঠলেও ঘেন্না হয় না একটুও। বমিও করতে ইচ্ছা হয় না। বরং পেট পুরে খাওয়ার পর শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া আরামদায়ক উষ্ণতাটা একরকম উপভোগই করে। ‘এটা কী করে সম্ভব? এতকিছু থাকতে কাঁচা মাংস কেন ভাল লাগবে?’
‘লাগতে পারে, বাবা। লাগতেই পারে। পৃথিবীতে আমাদের জ্ঞানের সীমার বাইরে কত কিছু আছে। সব কি আমরা জানি?’
‘কিন্তু … What’s wrong with me?’
‘উত্তেজিত হয়ো না, বাবা। হয়তো তোমাকে একটুখানি ব্যাখ্যা করতে পারব আমি। কিন্তু বেশি না।’ একটু দম নেন বৃদ্ধ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। ‘অনেক বছর আগে একজন মহিলা এসেছিলেন আমার কাছে। কমবয়সী গৃহবধূ, গর্ভবতী। সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই তার শুধু কাঁচা খাদ্য খেতে ইচ্ছা করত। অন্য কিছু নয়, শুধুমাত্র মাংস।’
‘কিন্তু কেন?’ ‘আমি ঠিক জানি না। চেষ্টা করেছি, জানতে পারিনি। প্রতিটি মানুষের মাঝে কোথাও একটা অন্ধকার জগতের অস্তিত্ব থাকে। আমরা যতই চেষ্টা করি, একে অস্বীকার করা সম্ভব না। আমার মনে হয়, কোনও বিশেষ ঘটনা এই অন্ধকার অংশকে জাগিয়ে তুলতে পারে। সেই মহিলার সাথে সে রকম কিছু ঘটেছিল। তোমার সাথেও ঘটেছে। আমার সে রকমই ধারণা।’
‘সেই পচা-বাসি মাংস খাওয়ার ঘটনা…’
‘হ্যাঁ, হয়তো সেটাই। কিন্তু তা কোন সাধারণ মাংস হয়ে থাকলে তেমনটা হবার কথা নয়।’
‘তা হলে?’
‘অনেক প্রেত সাধকেরা কাঁচা মাংস খেয়ে থাকে। সেটাই তাদের প্রধান খাদ্য… আমার মনে হয় তোমার বাসায় এমন কেউ আছে, যে প্রেত সাধনা করে থাকে।’
‘কিন্তু আমার বাসায় তো…’
‘আমি জানি। তুমি আর তোমার স্ত্রী আছে শুধু।’
‘তা হলে…তা হলে কি, আয়শা?’ ‘হতে পারে, অসম্ভব কিছু না। এটা একটা মানসিক অসুবিধা। ঠিকমতো চিকিৎসা করালে ভাল হয়ে যাবে।’
‘তোমার সমস্যাটার সমাধান তোমার নিজের হাতে। তুমি ইচ্ছা করো, নিজের অন্ধকার জগতের পথ রোধ করে দাঁড়াও…’
আরও অনেক অনেক কথাবার্তা হয়। কিছু বুঝতে পারে রাশেদ; কিছু পারে না। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পদক্ষেপে বেরিয়ে আসে, খুঁজে বের করে সুমনকে।
‘উনি কী করেন, সুমন? ওনার পেশা কী?’
হাসে সুমন। ‘কার কথা বলছিস?’
‘ওই যে…ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক!’
‘তার আগে বল, তোর সমস্যাটা মিটেছে? শরীর খারাপ ভাবটা কমেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মাথা ঘোরা কমেছে? আর ক্লান্ত লাগছে না তো?’
‘একদম না।’
‘বমি বমি ভাবটা গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘উনি কী বলেছেন তোকে?’
‘বলেছেন, পুরো ব্যাপারটা আমার হাতে। আমার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভরশীল।’
‘খুব ভাল কথা। দেখ তো, এটা খেতে পারিস নাকি।’ বলে একটা ক্যান্ডিবার রাশেদের দিকে বাড়িয়ে দেয় সুমন। রাশেদের প্রিয় ক্যান্ডিবার।
খাওয়া যায় সহজেই। খেতে ভালও লাগে। রিকশা করে যেতে যেতে বেনসনও সাবাড় করা হয়। মনটা ভীষণ ফুরফুরে লাগে রাশেদের। যাক্ বাবা, সমস্যা তো মিটেছে!
‘থ্যাংকস, দোস্ত!’ ভীষণ আন্তরিক কণ্ঠে বলে রাশেদ। ‘তোর জন্যে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেলাম আমি। তুই যদি ভদ্রলোকের কাছে না নিয়ে…’
মিটিমিটি হাসে সুমন। ‘ওনার পেশা কী জানিস?’
‘কী?’
‘ঝাড়-ফুঁক। মানে ভূত-প্রেতে ধরা মানুষের ‘‘চিকিৎসা’’ করেন আর কী।’
ভীষণ বিস্মিত হয় রাশেদ। ‘How silly! তুই আমাকে ভূতের ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলি? একবিংশ শতাব্দীতে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করে?’
‘করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু তোকে একটা ঝাঁকি মারতে চেয়েছিলাম। মেডিকেল সায়েন্সের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলি। তাই ভাবলাম উদ্ভট একটা জায়গায় রহস্যময় পরিবেশ আর অন্যরকম একটা মানুষ হয়তো নিজের প্রতি তোর বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিতে পারবে। এই বৃদ্ধের কথা বলার ভঙ্গিটা সাংঘাতিক। যাই বলে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।’
সুমন লক্ষ করে না, কিন্তু খুব সাবধানে বুকে জমে থাকা দূষিত ভাবনগুলো বের করে দেয় রাশেদ। সত্যিই তো, একটা লোক বলল আর আয়শাকে নিয়ে আজেবাজে ভাবনা ভাবতে শুরু করে দিল সে? এর চাইতে আহাম্মকি আর হতে পারে না! ভূতের ওঝা!!!
ভাবতে গিয়ে নিজেরই হাসি পায় রাশেদের। সুমনের নিশ্চয়ই নাটকটার পিছনে বেশ কিছু টাকা-পয়সা খরচ হয়েছে। এমনিতেও দিলে নেবে না।পায়ে ধরে সাধলেও না। সুতরাং ভাল দেখে একটা উপহার কিনে দিতে হবে…
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে যায় রাশেদ। রোকসানার জ্বর এসেছে। মাথার কাছে বসে কপালে পানি দিচ্ছে আয়শা। একটু পরপর চোখ মুছছে। সেবা করবে কী, নিজেই কাঁদতে কাঁদতে অস্থির বেচারী।
গভীর ভালবাসা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে রাশেদ। পৃথিবীতে এত মমতাময়ী বোধহয় অন্য কোন নারী নেই!
খুব সন্তর্পণে ঘটে ব্যাপারটা। বুঝি বাতাসও কিছু আঁচ করতে পারে না।
শরীরের নিবিড় সান্নিধ্যে ছিল আয়শা, নিঃশ্বাসের একান্তে। গভীর রাতের বুকে ভালবাসার গল্প বুনে যাচ্ছিল দুটো শরীর। সরব নীরবতায়…
যেন হঠাৎই বদলে যায় আয়শার অপরূপ মুখটা। হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়… যেন… যেন মানুষের মুখটা বদলে হয়ে যায় কোনও জানোয়ারের মুখ। কোন পিশাচের মুখ। কোনও… কোনও প্রেতের চেহারা!
প্রাণীটা উঠে বসে বুকের ওপরে… দম বন্ধ হয়ে আসে… একটুখানি অক্সিজেনের আকাঙ্ক্ষায় আঁকুপাঁকু করে জোড়া ফুসফুস… লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে রাশেদ।
উফ!!!
কী ছিল ওটা? স্বপ্ন? স্বপ্ন এত ভয়াবহ রকমের বাস্তব হতে পারে?
এখনও আফ্রিকান ড্রাম বাজিয়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। ঘামে ভিজে উঠেছে পুরো শরীর, কাঁপছে একটু একটু। এত ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এ জীবনে অন্তত আর দেখা হয়নি।
আয়শা? আয়শা কোথায়? বোধ হয় রোকসানাকে দেখতে গেছে…
‘আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও না প্লিজ!’ গলা উঁচিয়ে স্ত্রীকে অনুরোধ করে রাশেদ। আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। মনটা ভীষণ দুর্বল লাগছে।
ভূতের ওঝার প্রভাব ভালই হয়েছে দেখা যাচ্ছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে মন…
আয়শা এল না কেন?… বোধহয় টয়লেটে।
অগত্যা পানির আকাঙ্ক্ষায় নিজেকেই উঠতে হয়। ইচ্ছে করে না, পা দুটো চলতে চায় না। তবু উঠতে হয়।
বেডরুমের পর ড্রইংরুম। মাঝে সরু প্যাসেজ পার হয়ে খাবার ঘর। যাবার পথে রোকসানার ঘরে একবার উঁকি দেয় রাশেদ। নাহ্, আয়শা নেই। রোকসানাও না। কোথায় গেল মেয়েটা। কী একটা দেখে ভয় পেয়েছিল। ভয়ের কারণেই জ্বরটা এসেছে। অন্তত জ্বরের ঘোরে মেয়েটার প্রলাপ শুনে সেটাই মনে হয়েছে। ছোট মানুষ। ভয় পেতেই পারে।
কিন্তু এখন কোথায় গেল?
ডাইনিং হলেও কেউ নেই। গ্লাসে পানি ঢালে রাশেদ। ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছে। বরফ কোথায়? কোথায় আবার, অবশ্যই ডিপফ্রিজে। নিজের আহাম্মকিতে নিজেরই হাসি পায়। আসলে আয়শা তার এত খেয়াল রাখে যে, এক গ্লাস পানিও কখনও নিজে ঢেলে খেতে হয় না।
প্রথমে ব্যাপারটা লক্ষই করে না। বরফ বের করে পরক্ষণেই আবার খোলে…
হায় খোদা!!! হায় খোদা!!!
হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে এসে আটকে যায় পলিথিনে জড়ানো বস্তুটা দেখে। বস্তু নয়, একটা মাথা। মানুষের ছিন্ন মস্তক! মুখটাকেও চিনতে পারে রাশেদ। রোকসানার আগে যে ছেলেটা ছিল। সোহাগ নাম।
কিন্তু…কিন্তু আয়শা যে বলেছিল চুরি করে পালিয়ে গেছে সোহাগ…
উফ!!! মাথাটা এলোমেলো লাগছে। মেঝের উপরই বসে পড়ে রাশেদ। সোহাগের মাথাটা থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না। ছেলেটার লম্বা চুলে জমাট বেঁধে আছে শুভ্র বরফ কণা…
কী করে আয়শা এদের? খেয়ে ফেলে? সেটাই হবে, না হলে বাকি শরীরটা কোথায়?
তা হলে… তা হলে ভুল করে সেদিন মানুষের মাংস খেয়ে ফেলেছিল সে? আর তারপর থেকে… তার মানে সেদিনকার সেই আচার-মাংস নামের বস্তুটা ছিল আসলে মানুষের মাংস? এই…এই সোহাগের মাংস?
কেঁদে ফেলে রাশেদ।
কল্পনা-সীমার অনেক ঊর্ধ্বের কোন আতঙ্কে মানুষ এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে।
আয়শা নামের পিশাচটার সামনে সে তো ভীষণ তুচ্ছ এক মানুষ! স্রেফ একজন রক্ত-মাংসের মানুষ।
ছাদের দরোজাটা বন্ধ। তবু রাশেদ নিশ্চিত, আয়শা ছাদেই আছে। অন্য কোথাও নয়।
ওদের ফ্ল্যাটটা পাঁচ তলায়, তারপরেই ছাদ। ছোট্ট একটা কামরা আছে ছাদে, বাড়িওয়ালাকে এটার জন্য আলাদা করে এক হাজার টাকা দিতে হয়। বাচ্চাদের খেলার ঘর বানাবে বলে আয়শা অনেক জোড়াজুড়ি করে ঘরটা ভাড়া নেবার ব্যবস্থা করেছিল। আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে যায় ছাদের দরোজাটা। পায়ে পায়ে সামনে এগোয় রাশেদ। খেলার ঘরে আলো জ্বলছে। আর মন বলছে ভীষণ অশুভ কিছু অপেক্ষায় আছে চার দেয়ালের ওই ইটের খাঁচায়।
ভয় হচ্ছে?
হ্যাঁ, হচ্ছে। কিন্তু তার চাইতেও অনেক বেশি তীব্র রোকসানাকে রক্ষা করার ব্যাকুল ইচ্ছাটা। ছ-সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা কিছুতেই কোন পিশাচের খাদ্য হতে পারে না। কিছুতেই না!
রাশেদ জানত তাকে ভীষণ কুৎসিত কিছু দেখতে হবে। তবু হাট করে খোলা দরোজার ওপাশে যে দৃশ্য দেখতে পায়, সেটা হার মানাতে বাধ্য কল্পনাকে…
হ্যাঁ, খেলার ঘরই। রঙিন দেয়াল, কার্পেটময় ছড়ানো খেলনা, ছবি আঁকার খাতা, রঙ পেন্সিল… আর সবকিছুর মাঝে সস্তা প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলে রাখা রোকসানার শরীরটা। মরে গেছে?
না, এখনও নয়। তবে আর বেশি দেরিও বুঝি নেই। পা জোড়া বাঁধা জানালার সাথে, মুখে আটকানো চওড়া স্কচটেপ। ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে দুচোখ বেয়ে। আর হাত… ডান হাতটা কেটে নেয়া হয়েছে কনুই বরাবর। ঠিক কেটে নয়, যেন ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো শরীর মোচড়াচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা।
আর আয়শা?
কার্পেটের উপরই বসে আছে পিশাচটা। কী শান্ত, স্থির ভঙ্গি! হাতে একটা প্লেট, পাশে রাখা পেপসির ক্যান। ভীষণ আয়েশী ভঙ্গিতে রোকসানার ছিঁড়ে নেয়া হাতটা চিবুচ্ছে সে, যেন কোন মুরগির রান। হ্যাঁ, রোকসানার হাতটাই খাচ্ছে সে। রক্ত যাতে শাড়িতে না লাগে সেজন্য কোলের উপর বিছানো ন্যাপকিন। একটু পরপর পেপসির ক্যানে চুমুক দিচ্ছে আর মিষ্টি করে হাসছে রোকসানার দিকে তাকিয়ে।
‘…ভয় পেয়ো না, সোনামণি! আর একটু কষ্ট করো। প্লিজ!… কী করব বলো। তোমার যেমন খিদে পায়, আমারও তো পায়। তুমি খাও ভাত মাংস, আর আমি খাই তোমাকে। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম, তাই না?… একদম চিন্তা করো না তুমি। আমি খুব সুন্দরভাবে পিস পিস করে কাটব তোমাকে। রানের মাংসগুলো রাখব বিরিয়ানি রান্নার জন্য, আঙুলগুলো নিয়ে হবে ফিঙ্গার ফ্রাই। মগজটা দিয়ে যে কত ভাল ভুনা তৈরি করতে পারি আমি, তুমি ভাবতেও পারবে না…’ রাশেদকে দেখে মোটেও ব্যস্ত হয় না আয়শা। মোহনীয় হেসে কাছে ডাকে, ‘খুব ভাল হয়েছে, তুমি এসেছ। একবার খেয়ে দেখো, তোমার সমস্ত অসুখ ভাল হয়ে যাবে। বমি পাবে না, মাথা ঘুরবে না…’
সেই হাসির সম্মোহনে সত্যিই কাছে যায় রাশেদ, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আর গভীর চুম্বনে তাকে আরও বেশি সম্মোহন করে আয়শা। রাশেদের জিভ পায় আয়শার ঠোঁটে লেগে থাকা রক্তের আস্বাদ। যেন ঝনঝন করে ওঠে শরীরের সমস্ত রক্তকণিকারা… তীব্র সেই স্বাদে!
খাওয়া ভুলে রাশেদের আরও ঘনিষ্ঠ হয় আয়শা। প্রচণ্ড শারীরিক আবেগে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়। সম্মোহিত রাশেদও ভুলে যায় পারিপার্শ্বিকের কথা, রোকসানার কথা। কামনায় অস্থির নগ্ন দুটো শরীর মিলিত হয় রোকসানার পড়ে থাকা দেহটার পাশেই। শুধু এক মুহূর্তের জন্য…
এক মুহূর্তের জন্য শুধু রাশেদের দৃষ্টি আটকায় বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে, অবহেলায় পড়ে থাকা মাংস কাটার চাপাতির দিকে। সেদিকেই ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় সে… ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে আয়শার দুভাগ হয়ে যাওয়া গলা থেকে, রাশেদের মুখটা মাখামাখি হয়ে যায়। তার শরীরের নিচে আয়শার নগ্ন শরীরটা তখনও উত্তপ্ত, দৃষ্টিতে ফুটে আছে তখনও উগ্র কামনা।
সেদিকে আর দ্বিতীয়বার তাকায় না রাশেদ। দ্রুত পোশাক পরে রোকাসানার
দেহটাকে কোলে তুলে নেয়। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে একে। এই মেয়েটাই তাকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র হাতিয়ার।
এখনও জ্ঞান হারায়নি রোকসানা। আশা হয় রাশেদের, হয়তো বেঁচে যাবে!
খোদা করুন, যেন তাই হয়!
কয়েক মাস পর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায় সবকিছুই।
রোকসানার সাক্ষ্য আইনের যন্ত্রণা থেকে খুব সহজভাবেই রক্ষা করে রাশেদকে। আয়শার ক্ষতও আস্তে আস্তে মন থেকে মুছে যেতে শুরু করে। ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি হৈচৈ হয় না বলে মানুষের কৌতূহলের বিষয়বস্তু হতে হয় না। এদেশে আজকাল বোধ হয় আজব আজব সংবাদের কোনও অভাব নেই।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রাশেদ।
প্রাণপণ চেষ্টা করে জীবনকে আবার স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনতে। রোকসানা মেয়েটার যাবার কোন জায়গা নেই বলে সে-ও রয়ে যায় রাশেদের সাথেই। অভিশপ্ত বাড়িটাও বদল করা হয়। একটা ছুটা কাজের বুয়া রাখা হয়। রোকসানাকে দেয়া হয় স্কুলে। মেয়েটা তাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাকে। তবু জীবন যে আর কিছুতেই ফিরে আসে না আগের পথে!
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে
থাকে রাশেদ। পেটে প্রচণ্ড খিদে। মনটা ভয়াবহ পিপাসার্ত। শরীর-মন ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো হয়ে ওঠে এক টুকরো সজীব মাংসের জন্য। বারবার মনে পড়ে পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা রোকসানার কথা…
… কচি কচি আঙুলগুলো চিবাতে কী মজাটাই না লাগবে। মড়মড় করে শব্দ হবে…তারপর ঘাড়ের কাছে মাংসের স্তর…
মুখ বেয়ে লালা গড়াচ্ছে রাশেদের।
অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতে থাকে চোখজোড়া। আদিম শ্বাপদের মতো।
………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………….