পেত্নীর মাছ খাওয়া

পেত্নীর মাছ খাওয়া

প্রসিদ্ধ জিনিস বাংলাদেশের সব জেলায় পাওয়া যায় না। মুষ্টিমেয় কয়েকটি জেলায় বা এলাকায় এই সকল জিনিস গুলো পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ-আমের জন্য চাপাই নবাবগঞ্জ, লিচুর জন্য দিনাজপুর, দই এর জন্য বগুড়া, এবং চমচমের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা টাংগাইলের পোড়াবাড়ী। এসকল জিনিসের পাশাপাশি আরও একটি অদৃশ্যমান কিন্তু ভয়ংকরভাবে পিলে চমকানোর বিষয়টির নাম হলো-ভূত, পেত্নী ও জ্বিন নামক    নায়ক-নায়িকারা। এদের আবার বাংলাদেশের সকল জায়গায় দেখা মিলে না। অবশ্য সকল স্থানের মানুষেরা ভূত পেত্নীর অস্তিত্ব মনে- প্রাণে বিশ্বাস বা ধারণ করে না বলেই সব জায়গাতে ভূত-পেত্নীর দেখা মিলে না।
তবে সে সকল এলাকার মানুষ তাদের মনের ভিতর এই সকল অস্তিত্ব বিহীন নামগুলো ইরি মৌসুমের মত চাষাবাদ করে, সে সকল মানুষের মাঝে হয়তো ভূতের দেখা মিলে। এদিক দিয়ে ভূত- পেত্নীর আবাসস্থল হল- পাহার পর্বত, বন জঙ্গল, নদ-নদী, খাল-বিল অধ্যুষিত এলাকা। তেমনি জামালপুর জেলা ভূত পেত্নী প্রসিদ্ধ এলাকা। গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলার মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে যমুনা নদী। যদিও মাদারগঞ্জ থানার দিকের যুমনা নদী শুকিয়ে চিকন রাজ্যের রাজার মত চিকন হয়ে গিয়েছে।
নদী শুকিয়ে চিকন হলেও অন্য কিছু পাওয়া না গেলেও মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যাদের অন্য কিছু নেশা না থাকলেও মাছ ধরার প্রতি প্রচুর নেশা আছে। বয়স অনুপাতে অল্প-মাঝারী- বয়স্ক সকল বয়সী লোকের মাঝেই মাছ শিকারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আরও এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা দিনের চাইতে গভীর রাতে মাছ  শিকার করতে বেশী পছন্দ করে। কাদের আর জামাল মামা- ভাগ্নে। এরা দু’জন মামা- ভাগ্নে হলেও চলাফেরা করে বন্ধুর মত। তাই দুজনের মাঝে খুব মানিক জোর। দু’জনের বয়সের ব্যবধান ও খুব একটা বেশি না। ৫-৬ বছরের ছোট-বড়।
এদের দু’জনেরই মাছ ধরার প্রচন্ড রকমের নেশা। মাছ শিকার করার সব ধরনের উপকরণই এদের আছে। জাল, কুচ, কারেন্ট জাল, খড়াজাল কোন উপকরণই বাদ নাই।
বৈশাখ শেষ হয়ে আষাঢ় এসেছে। নদীতে ধীরে ধীরে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। নদীর আদা আদি পানিতে মাছ শিকার করা একটু সহজ বৈকি। রাত দুইটার পর কাদের আর জামাল নদীতে মাছ শিকার করতে যাবে। তাই ওরা দু’জন দুপুরে পেট ভরে খেয়ে মনের খায়েশ মত ঘুমিয়ে নিয়েছে। রাত প্রায় বারটার মত বাজে। মামা- ভাগ্নে দু’জনার মাছ ধরার প্রস্তুতি চলছে। জামাল হাতে চার ব্যাটারির টর্চ লাইট, কাদের কুচ, আর খড়াজাল নিয়েছে। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটা একটার ঘরে এসে পড়েছে। ওরা দু’জনই সমস্ত মুখ জুড়েই পান চিবুচ্ছে। পান চিবানো ব্যক্তিকে দেখে মনে হয়, সে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি। কাদের-জামালকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে।
দুজনই জমির মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে মনের সুখে গান গেয়ে গেয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে নদীর নিকটে চলে গিয়েছে। নদীর পাড়ে গিয়ে কাদের ও জামাল দুজনই হঠাৎ দাড়িয়ে যায়। ডানে ও বামে দুই দিক থেকেই মাছের আঁশটে বিকট গন্ধ বাতাসে ভেসে আসতেছে। মাছের গন্ধটা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জামাল চার ব্যাটারির টর্চ লাইটটা চারদিকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কাদের জামালের মত অতটা সাহসী নয়, কিন্তু জামাল প্রচন্ড সাহসী। সে সহজে ধমে যাওয়ার পাত্র নয় । জীবনের বিনিময়ে হলেও শেষ চেষ্টাটুকু করতে পিছ পা হয় না জামাল।
কাদের কিছুটা ভয় পেয়ে জামালকে বলে, আজ আর মাছ ধরে কাজ নেই। লক্ষণটা ভাল মনে হচ্ছে না। চল বাড়ি যাইগা । কাদেরের কথা শুনে জামাল বলে মামা শুধু শুধু ভয় পেও নাতো! কেন আমি তো তোমার সাথেই আছি। ভূত পেত্নী বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। এগুলো সব আমাদের মনের ভুল।
ভাগিনা, এত সাহস দেখাইস না। এই রাতের বেলায় কিছু একটা হয়ে গেলে, আমাদের বাঁচাতে কেউ আসবে না। মামা, তুমি সত্যি সত্যিই ভয় পাইতাছো!
আমার তোর মত এত সাহস নাই। আমার কলিজার ভেতর একটু ভয়-ডর আছে বৈকি। ঠিক আছে মামা, তুমি এখন টর্চ লাইটটা পানির দিকে ধর। টর্চ লাইটটা পানির দিকে ধরলে, মাছ পানিতে যাওয়া আসা করলে তা স্পষ্ট দেখা যায় । যখনই টর্চের আলোতে মাছ দেখা যায় তখনই কুচ মাছের উপর মারা হয়। এতে কুচের লোহার শলাগুলো মাছের উপর বিঁধে যায়। যখনই জামাল মাছের উপর কুচ নিক্ষেপ করে, তখনই উত্তর দিক দিয়ে প্রচন্ড রকমের বাতাস বইতে শুরু করে। প্রচন্ড বাতাসের কারনে কাদের ও জামাল পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পাচ্ছে না। এই বুঝি দুজনই শূণ্যে উড়ে যাবে। বাতাসের গতির চাপে কাদেরের হাত থেকে টর্চ লাইটটা পানিতে পড়ে যায় । গুটগুটে অন্ধকারের কারনে কাদের হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। জোরে জোরে আল­াহর নাম ও সূরা পড়া শুরু করে দেয়। কাদের অনেক কষ্টে পানিতে ডুব দিয়ে টর্চ লাইটা খুঁজে পায়। ডুব দিয়ে উঠে যেই না টর্চ লাইটা জ্বালায়, তখনই পেছনে ফিরে দেখে- বটগাছের মত বিশাল দেহী পেত্নী হাঙ্গরের মত বড় বড় দাঁত দিয়ে কুটুস কুটুস করে মাছ খাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে কাদের ও বাবা গো বলে জোরে চিৎকার দেয়। এদিকে জামালও হতবাক। কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। জামাল ও কাদের থেকে পেত্নী মাত্র ৩০০ গজ দূরে অবস্থিত। পেত্নীকে দেখে মনে হচ্ছে এতক্ষণ কাদের ও জামালকে পেত্নী দেখেনি। কিন্তু  এখন মনে হচ্ছে, পেত্নী তার লম্বা লম্বা ঠ্যাং দিয়ে কাদের ও জামালের দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। এদিকে কাদের ও জামাল কুচ, জাল ফেলে পানি থেকে উঠে সোজা পশ্চিম দিকে জোরে দৌড় দেয়। টানা ত্রিশ মিনিট দৌড় দিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় চলে আসে। বাড়িতে এসে দুজনই বেশ হাফাতে শুরু করে। কাদের আগে থেকেই জানে, জামাল ভূত-পেত্নীতে বিশ্বাস করে না। তাই খোচা মারার ছলে বলে, কিরে ভাগিনা, তুই না ভূত পেত্নীতে বিশ্বাস করিস না। তাহলে এইভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আসলি কেন।
কেন যে আসলাম মামা, সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি এখনও বলছি, ভূত পেত্নী বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। তাই যদি হবে ভাগিনা, তাহলে বটগাছের মত বড় জিনিসটা কুট কুট করে মাছ খাচ্ছিল কেন? মামা এটা হয়তো আমাদের চোখের ভুল কিছু দেখা। আমরা হয়তো ভয়ে মনে মনে এমন কিছু কল্পনা করেছিলাম। তাই এ রকম বিশাল আকৃতির কিছু একটাকে মাছ খেতে দেখেছি।
পরের দিন সকালে মামা ভাগ্নে দু’জনই ভয়ে শরীরে জ্বর চলে আসে। দু’জনই জ্বরের শরীরে গোসল করে বিকালে কিছুটা সুস্থবোধ করে। লোক মারফত জানতে পারে, নদীর ঘাটে বিশাল একটা মহিষ মরে পড়ে আছে। গ্রামে আজ অবধি এই ভাবে নদীর ঘাটে কেউ মহিষ মরে থাকতে দেখেনি। এই ঘটনাটা গ্রামের সবাইকে খুব অবাক করেছে। গ্রামের সবাই ভাবছে, এটা আবার কোন আলামত ! গ্রামের লোকেরা যা ইচ্ছা ভাবুক, তাতে কাদের ও জামালের কোন মাথা-ব্যথা নেই। ওরা তো জানে আসল ঘটনাটা কি ঘটেছিল?

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত