বটগাছের ভূত

বটগাছের ভূত

এক.
পাড়াগাঁয় একটা কথা সব-সময় সবার মুখে লেগেই থাকে কারোর কিছু হলেই— ‘এই ওকে ভূতে ধরেছে, না হয় জিনে ধরেছে’। আমাদের গ্রামেও ওই একই কথা আছে। আমাদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণ দিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের পাশেই একটা পোড়োবাড়ি। এটা এক-সময় ছিল এক অত্যাচারী জমিদারের বাড়ি। এখানে এক-সময় গরীব চাষীদের ধরে এনে আটকে রাখা হতো। যেসব চাষী তাদের জমিতে নীলচাষ করতে রাজি হতো না তাদের নির্যাতন করে করে মেরে ফেলা হতো। এখন আর ওসব নেই; কিন্তু কেউ ওই বাড়ির দিকে ভুল করেও যায় না। সবাই বলে ওখানে নাকি গরীব কৃষকদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তারা কাউকে পেলে মেরে ফেলে।

একবার শহর থেকে এক সাংবাদিক এসেছিলেন, গিয়েছিলেন ওই জঙ্গলে। সারাদিনেও ফেরেননি তিনি। পরদিন সকালে জঙ্গলে ঢোকার মুখে মহাশ্মশানের পাশেই পড়ে থাকতে দেখা গেছে তার মৃতদেহ। নাকে মুখে রক্ত জমে ছিল তার লাশের। সবাই বলে, শ্মশান ঘাটের বটগাছেও নাকি মধ্যরাতে ভূত দেখা যায়। ওই জঙ্গল থেকে আসে। দুলাল কিন্তু এই ভূত-টুতের কোনো ধার ধারে না। তার কাছে ভূত বলে কিছু নেই। সে শহরে বাবা-মায়ের সাথে থাকে। স্কুলে পড়ে আর ছুটির সুযোগে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে সময় কাটায়। তবে এর ফাঁকে সে আর একটা কাজ করে তা হল গোয়েন্দা কাহিনী পেলে তার আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। যতক্ষণ না ওটা শেষ করবে ততক্ষণে তার যেন দম ফেলার ফুরসৎ টুকুও নেই। বাবা-মা কত বকাবকি করেন গোয়েন্দা বই পড়ার জন্য তাতে কোনো লাভ হয়নি। দুলাল গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে আর নিজেই গোয়েন্দা হবার স্বপ্ন দেখে। সেই সাহসী গোয়েন্দা এবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে এল বেড়াতে। এই-ই প্রথমবার। আর আমি রাজু।

দুলাল আমার চাচার ছেলে। বয়সে আমার ছোট তবুও ওকে ছোট মনে হয় না। বরং ওর কথাবার্তা চাল-চলনে ওকেই আমার চেয়ে বড় মনে হয়। আমি বরাবরই একটা ভীতুর ডিম। দুলালের বেশ সাহস। মৌচাকে মধু দেখলে কীভাবে মৌমাছি তাড়িয়ে মধু পাড়তে হয় তা ও বেশ জানে। একেবারে সড়সড় করে নারিকেল গাছে উঠে যেতে পারে ও— আমি পারি না। সবাই ওর প্রশংসা করে, ‘কত বুদ্ধি এ বয়সে’! গ্রামে ও আসার পর ওর কদর অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয় তখন শহরের স্কুলে ও কেমন জনপ্রিয় তা বলে। একবার ওদের ক্লাসে প্রায়ই কারো না কারো টিফিন চুরি হতো সেই চোরটাকে ওই-ই গোয়েন্দাগিরি করে ধরেছিল। আরও কত গল্প যে আছে ওর থলিতে তার হিসেব নেই। সেই দুলাল বলল আমাকে, ‘হ্যাঁ রে রাজু আমি কিন্তু ওই জঙ্গলে যাব। ওটা পোড়োবাড়ি না ভূতের বাড়ি তা দেখতে। তুই যাবি আমার সাথে?’ এক নিমিষে গড়গড় করে বলে গেল কথাগুলো। আমি বললাম, ‘না রে ভাই, আমার ভীষণ ভয় করে, তুই দ্যাখ অন্য কেউ যায় কি-না। তা ছাড়া ওখানে যাবার দরকারটা কী তোর?’

দুলাল বলল, ‘না, তোদের ভূতের আড্ডাটা ভেঙ্গে দিয়ে আসতে হবে। যত সব ফালতু ভয় নিয়ে থাকিস তোরা।’ যেমন কথা তেমন কাজ। দুপুরে খেয়েই সে ছোট্ট একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আমি ওকে বাধা দিলেও লাভ হল না।

দুই.
দুলাল বাড়ি থেকে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটছে তো হাঁটছে। জঙ্গল যেন আর শেষ হয় না। কোথাও কোনো পায়ের চিহ্ন নেই যেন কেউ কখনও আসেনি এ পথে। যত সামনে হাঁটে ততই যেন ঝোপঝাড় আরও ঘন হয়ে আসে। দুলাল ঠিক বুঝতে পারে না কোথায় শেষ এই জঙ্গলের। মাথার উপর বড় বড় শাল গাছ, শিরীষ গাছ, কখনও বড় বড় ঝোপ আর কাঁটাওয়ালা অচেনা সব গাছ। হঠাৎ একটা চিল উড়ে যায়, একটা কালো কাক ডেকে ওঠে। দুলালের তবু ভয় করে না। একটা বেজী পালিয়ে গেল, একটা খেকশিয়াল লেজ উঁচিয়ে ছুটল দুলালের তা দেখতে ভালই লাগল। কিন্তু হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে তিন চারবার ডাক দিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। দুলাল সামনের একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াতে চাইল। সে তাই পা দুটো একটু জোরে চালাতে গিয়ে বেখেয়ালে নিজের পায়ে লেগে পড়ে কাদামাটি লেগে নিজেই একেবারে ভূত বনে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে পেছনে তাকাল, কোনো রকমে মনে মনে বলল, ‘কই পেছনে তো কেউ নেই, তাহলে কীভাবে পড়লাম?’ হালকা ভয় পেয়ে গেল সে। পকেট থেকে টর্চটা নিয়ে জ্বালাতে সামনের ঝোপে বসা একটা বানর লাফ দিয়ে পালাল, দুলাল যেন আবার কেঁপে উঠল ভেতরে ভেতরে। সে তখন সামনে দৌড়াতে লাগল।‘তবে কী কোনো বাড়ি নেই এখানে— কথিত সব’ এই ভাবনার মধ্যে শন শন বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটায় মনে হল যেন পেছনে কেউ তাকে তাড়া করে আসছে। তখন সে আরও জোরে দৌড়াতে লাগল, আর দৌড়ের চোটে খেয়াল করেনি সামনেই একটা বাড়ির ভাঙ্গা দরজা। সোজা দরজায় ধাক্কা খেয়ে সে হুড়মুড় করে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার পড়ার শব্দে অনেকগুলো পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। সেই শব্দে হিস-হিস সাঁ-সাঁ করে উঠল চারপাশ। স্থানটা যেন কোনো দৈত্যপুরী। দুলাল চিৎকার করে উঠল, ‘কেউ আছ কোথাও?’ তা আরও প্রতিধ্বনিত হয়ে ভয়ানক শব্দে ফিরে এল। তখনই শোনা গেল একটা নাঁকি-সুরে কান্নার আওয়াজ। টর্চের আলোয় দুলাল দেখল, কেউ কোথাও নেই। দুলাল মনে মনে বলল, ‘তবে কান্নার সুর আসছে কোথা থেকে?’ দুলাল ভাবল, তাহলে ভূত-পেত্নী! সে ওখান থেকে বেরুবে কীভাবে চিন্তা করতে লাগল। তখনও থেমে থেমে কান্নার সুর ভেসে আসছে। দুলালের বুদ্ধিতে কাজ করে না।বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়। এখানে সে কিছুই চেনে না, কী করবে সে। ঘর থেকে বের হয়ে আসে ভয়ে ভয়ে। এবার আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে দুলাল, ‘কেউ আছ এখানে?’ এরমধ্যে কান্না থেমে গেছে। দুলাল এবার দৌড়ে বাড়িটার অন্যপাশে যায়, সেখানে একটা বারান্দা দেখা যায়। বারান্দায় উঠে ঘরের জানালায় টর্চ জ্বালিয়ে দেখে ভেতরে একটা বাচ্চা মেয়ে। দুলাল তখন দ্রুত দরজায় যায়। দেখে দরজায় তালা ঝুলছে চকচকে নতুন তালা। খোলা ইট দিয়ে ঘা মেরে দুলাল তালাটা অনেক চেষ্টার পরে ভেঙ্গে ফেলে। ভেতরে যায়। টর্চের আলো ধরে মেয়েটার ওপর। মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। দুলাল বলে— ‘কে তুমি?’ মেয়েটা জানায়, তার নাম তুলি। পাশের গ্রামে তাদের বাড়ি। সে বিকালে খেলতে বেরিয়ে পথ হারিয়ে নদীর পাড়ে এসেছিল। তখন পেছন থেকে কেউ তার মুখ আটকে ধরে। তারপর সে আর কিছু বলতে পারে না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে কেবল এই অন্ধকারে পড়ে আছে।

পরের ঘটনা আরও বড় করে একদিন পর পেপারে বেরিয়েছিল— দুলাল নামের এক কিশোরের গোয়েন্দাগিরিতে তথাকথিত বটগাছের ভূতেরা ধরা পড়েছে। আসলে ভূতের ভয় দেখিয়ে একদল আদম পাচারকারী এখানে তাদের ঘাঁটি বানিয়েছিল ।

অবশেষে গ্রামে একেবারে পাকাপোক্ত হিরো হয়ে গেল আমার ভাই দুলাল।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত