নয় মাসের শিশুকন্যাকে বারান্দায় মাদুর পেতে শুইয়ে দিয়ে মোমেনা বেগম পাশেই তরকারি কাটতে বসলেন। মেয়েটির দিকে তাকাতেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ভালোভাবে খেলতেও পারছেনা মেয়েটি। শুয়ে শুধু চারহাত পা আস্তে আস্তে নাড়াচাড়া করছে। আজ তবুও হাত পা নাড়াচাড়া করতে পারছে, গত পাঁচ দিন তাও পারেনি।
পাঁচ দিন আগে মেয়েকে কোলে নিয়েই তিনি ভাতের মাড় ঝরাচ্ছিলেন । অনেক বার কোল থেকে নামাতে চেয়েছিলেন কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা, সে কিছুতেই নামবেনা। তাই বাধ্য হয়েই কোলে নিয়েই কাজটি করছিলেন আর তখনই কোল থেকে গরম ভাতের মাড়ের মধ্যে পড়ে গেলো, মেয়েটির মাথা বাদে সমস্ত শরীর পুড়ে যায়। সমস্ত শরীরে ফোসকা পড়ে যায়। বুকের কাছটা একটু বেশিই পুড়ে গিয়েছিলো তাই অন্য জায়গার পোড়া ঘা শুকিয়ে এলেও বুকের ঘা কেমন লাল হয়ে আছে। যতবার তিনি মেয়েটিকে দেখেন ততবার নিজের প্রতি ঘৃণা হয়, কেমন মা, নিজের কলিজার টুকরোকেই নিরাপদ রাখতে পারলেন না। নিজেকে হাজারোবার গালমন্দ করেও যেনো শান্তি পাননা। ডুকরে কেদে ওঠেন। আজ মেয়েটির মুখে হাসি দেখে মোমেনা বেগমের ঠোটেও কিঞ্চিৎ হাসির রেখা হাসি ফুটে উঠেছে। আশেপাশের সবাই বলেছিলো মেয়েটি বাঁচবে না কিন্তু সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেয়েটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। ক্ষত শুকিয়ে আসছে। হাত পা ছুড়তেই ক্ষতে হয়তো টান লাগছে তাই মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছে। কাছে এসে কথা বলছেন আর কাজ করছেন। এখন খুব একটা কোলে তোলেননা। বেশিরভাগ সময়েই হয়তো বিছানায় নয়তো বারান্দায় মাদুর পেতে তার উপর কাথা পেতে শুইয়ে রাখেন। কোলে নিতে গেলে যদি ব্যথা লাগে সে ভয়ে একটু কমই কোলে তুলেন।
মেয়েটি মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে, মোমেনা বেগমও হাসছেন আর মেয়ের সাথে কথা বলছেন। বাড়ির সব পুরুষ মানুষ নানান কাজে বাহিরে গেছে। বাড়িতে শুধু মা আর মেয়ে একা। এমন সময় এক বুড়ি এসে উঠানে দাঁড়ালো। সাহায্য চাইছে। বুড়িটির সমস্ত চুল পেকে সাদা হয়ে আছে তবে নিচের দিকে সমস্ত চুলেই জট। সাদা ধবধবে শাড়ি পড়ে আছে। মুখ ভর্তি পানের পিক। সাদা চামড়া কিছুটা কুঁচকে গেছে, পানের পিকে ঠোট লাল হয়ে আছে। আর চোখ দুটিও গভীর কালো। বুড়িটিকে দেখে মোমেনা বেগমের মনটা কেমন জানি করে উঠলো। বুড়িটির মুখের প্রশস্ত হাসি তাকে কেমন ভয় পাইয়ে দিলো। তবুও জিজ্ঞাসা করলো, কি চাই মা?
বুড়িটি হেসে উত্তর দিলো, দু’মুঠো চাল দে মা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোমেনা বেগম উঠে ঘরে গেলেন চাল আনতে। ঘরে ঢুকেই কেন জানি মনে হলো মেয়েটিকে একা ওভাবে রেখে আসা ঠিক হয়নি। কথাটি মনে আসতেই দ্রুত চাল নিয়ে তিনি ছুটে চলে এলেন বারান্দায়। এসে দেখেন বুড়িটি বারান্দার খুব কাছে এসে মেয়েটির দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে ঠোট চাটছে। তার চোখ দুটিও চকচক করছে। তাই দেখে মোমেনা বেগমের বুক ধ্বক করে উঠলো। তিনি দ্রুত গিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতেই বুড়িটি হেসে উঠে বলল, তোর মেয়ের কচি কলিজাটি লকলক করছে রে মা কেমন লকলক করছে, দেখেই জ্বীভে জল চলে এলো। কথাটি বলা মাত্রই মোমেনা বেগম মেয়ে কোলে নিয়েই ছুটে ঘরে গিয়ে খিল এটে দিলেন। ঠিক তখনি বাহির থেকে বুড়ির বিদঘুটে হাসি ভেসে এলো সাথে কিছু কথা, তোর মেয়ের কলিজাটি বেশ কচি রে মা বেশ কচি, কেমন লকলক করছে!!
মোমেনা বেগম মেয়েটিকে বিছানায় শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন মেয়েটি কেমন ছটফট করছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যাচ্ছে যেন, ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় মেয়েটি মারা গেলো।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো, এক ডাইনি বুড়ি এসে মেয়েটির কলিজা খেয়ে গেছে। সবাই সমস্ত গ্রাম খুঁজেও আর সেই বুড়ির হদিস পেলোনা।
…..
( জানিনা সেদিন আসলে কি ঘটেছিলো, মেয়েটি কেনই বা মারা গিয়েছিলো। ডাইনি বুড়ি কি আসলেই পৃথিবীতে আছে? নাকি সবই কল্পনায় বিরাজমান। বুড়িটাই বা কেন ওসব বলেছিলো আর প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা মেয়েটিই বা কেন আচমকা মৃত্যুবরণ করলো। এ সবই হয়তো প্রশ্ন যার সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই তবে ঘটনাটি সত্য)
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক