ছোট বেলা থেকেই আর্থিক অসচ্ছলতায় বড় হয়েছে টুম্পা। ওর বাবার এক্সিডেন্ট এর পর থেকে অভাব যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে ওদের। মা এলাকার চেয়ারম্যান কে ধরে একটা সরকারি অফিসে আয়ার কাজ পায়। মার আয়েই অনেক কষ্টেসৃষ্টে কোনরকম সংসার চলে, ওতে আর বাবার চিকিৎসা খুব ভালো ভাবে হয়ে ওঠে না। কোন ভাই নেই, তিন বোন ওরা। টাকার অভাবে বড় দুই বোনের লেখাপড়া তেমন আর এগোয় না, অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হন মা।
বড় ও মেজ জামাই টুকটাক সংসারে অবদান রাখায় এখন সংসার টা সচ্ছল না হলেও আগের মতো তেমন অভাব নেই তাই টুম্পার লেখাপড়া কোনরকমভাবে চলছিল। এস.এস.সি এর ফরম ফ্লাপের সময় স্কুলে আবেদন করতে হয়েছিল। কারন ওত টাকা যোগার করা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
এস. এস. সি তে খুব ভালো ফলাফল হওয়ায় শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজে চান্স পেয়ে যায় টুম্পা। কিন্তু সেই কলেজের খরচ বহন করা ওর পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই ওর মা ওকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু ওর একটাই কথা মা আমি ডাক্তার হব। ডাক্তার হয়ে আমি বাবার চিকিৎসা করবো। ওর মা নিরবে শুধু আঁচলে চোখ মোছেন।
কলেজে বিনা বেতনে পড়ার আবেদন করে। ছাত্রী ভালো হওয়ায় ওর আবেদন মঞ্জুর হয়।
দিনে কলেজ শেষে তিন চারটা স্টুডেন্ট পড়িয়ে বই, খাতা, কলম ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজন ও নিজেই পূরণ করে।
এভাবে অনেক কষ্টে বেশ সাফল্যের সাথেই এইচ. এস. সি তে উত্তীর্ণ হয়।
দিন রাত প্ররিশ্রম করে মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় টুম্পা।
এলাকার চেয়ারম্যান আর্থিক ভাবে বেশ সহায়তা করে টুম্পার মেডিকেল এ ভর্তির ব্যাপারে।
ও যখন হোস্টেল এ উঠল তখন ওর রুমমেট দুজনের সাথে তেমন মিশতো না বা মিশতে পারতো না, সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো । কারন ওর রুমমেট দুজন ছিল বেশ অবস্থা সম্পূর্ণ । একজনের নাম ছিল তমা আর একজন দিয়া।
কিছুদিন যেতে না যেতেই ওদের সাথে বেশ সহজ হয়ে ওঠে।
একদিন দিয়া বলল, আজ সন্ধ্যায় নিলয় স্যারের প্রাক্টিক্যাল ক্লাস আছে মর্গে জানিস তো নাকি?
তমা বলল, জানি কিন্তু একটা বিষয় বুঝিনা মর্গের মতো ভয়ংকর জায়গায় কেন সন্ধ্যায় প্রাক্টিক্যাল ক্লাস হয়, দিনে কেন হয় না।
এবার টুম্পা হেসে বলে উঠল এতো ভিতু কেনরে তুই তমা, ওখানে কি তুই একা থাকবি? ওখানে আমাদের ব্যাচের সবাই থাকবে।
দিয়া মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল, জানিস আজ জোস একটা খবর পাইলাম।
— কি কি? সমস্বরে দুজনেই জানতে চাইলো ।
— আজ এক বড় আপুর কাছে শুনলাম নিলয় স্যার নাকি দেখতে হেভি হ্যান্ডসাম। যে কোন মেয়ে তার চোখের দিকে তাকালেই নাকি টাশকি খায়, প্রেমে পড়ে যায়।
তমা যোগ করলো, আরেকটা অদ্ভুত কথাও শুনেছি নিলয় স্যার নাকি শুধু রাতেই মর্গে প্রাক্টিক্যাল করান দিনে কখনওই ক্লাস নেন না। অনেকেই নাকি দিনে তার কেবিনে নক করে দেখতে চেয়েছিল যে তিনি কি করেন বা কেন ক্লাস নেন না কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। হসপিটাল কর্তৃপক্ষও নাকি বলেছে যে তার মত দক্ষ প্রাক্টিক্যাল ক্লাস আর কেউ নিতে পারে না আর তাই তার দিনে ক্লাস না নেওয়ার শর্ত হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছেন।
টুম্পা ও দিয়া অবাক হয়ে শুনলো আর ভাবলো, আরে তাইত নিলয় স্যার কে কখনওই ওরা কোন ক্লাস নিতে দেখেনি।
দিয়া বলে উঠল আরে বাদ দে ওসব ফালতু কথা, আমি খুবি এক্সাইটেড স্যার কে দেখার জন্য। দিয়ার কথা শুনে টুম্পা ও তমা দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
সন্ধ্যায় ওরা যখন মর্গে পৌঁছালো তখন দেখতে পেল ওদের ব্যাচের ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ওদের মাঝখানে প্রায় ছয় ফিট উচ্চতার একজন সুপুরুষ দাঁড়িয়ে যার গায়ের রং ফ্যাকাসে সাদা আর চোখ দুটি গাড় নীল। অপূর্ব লাগছে সাদার মাঝে নীল চোখের সংমিশ্রণ । ওরা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতেই স্যার ওদের দিকে চাইতেই কেন জানি টুম্পার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। মনে হল কোন নিশ্বঃপ্রাণ মানুষের চোখ দেখতে পাচ্ছে। গাড়ো নীল যেন থমকে গেছে ওদুটি চোখে।
নিলয় স্যার ইশারায় অনুমতি দেওয়ায় তমা আর দিয়া ঢুকে গেলো কিন্তু টুম্পা কোন এক অজানা ভয়ে পা বাড়াতে পারছে না, মনে হচ্ছে ওর পায়ের ওজন যেন দশ মন বেড়ে গেছে। তমা ফিরে এসে ওর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।
সবাই খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে নিলয় স্যার একটা লাশ খুব যত্নের সাথে কাটছে কিন্তু টুম্পা কেন জানি লাশ কাটায় মনোযোগ দিতে পারছেনা। ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ যেন ঐ নীল দুটি চোখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । কি করে একজন মানুষের চোখ এত নির্জীব হতে পারে! দেখলেই মনে হয় থমকে যাওয়া নীলের পেছনে বিশাল এক অন্ধকার গহ্বর রয়েছে যার কোন তলদেশ নেই শুধুই অসীম।
হুট করেই নিলয় স্যার টুম্পার দিকে তাকিয়ে একটি রহস্যময় হাসি দিলেন। টুম্পা আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না ওর সারা দেহ ভয়ে কাঁপতে লাগলো ।
চোখ নামাতেই একটা জিনিস দেখতে পেয়ে মনে কেমন খটকা লাগলো । লাশ কাটা শেষ এবং সেলাইও ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে কিন্তু নিলয় স্যারের বাঁ সাইডে যে ছোট একটি টেবিল আছে তার ঠিক উপরে একটি পরিষ্কার পাত্রে কলিজাটা পড়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে খুব যত্নে রাখা হয়েছে কলিজাটা।
কেউ ওদিকে তাকাচ্ছে না কিন্তু কলিজাটার উপর টুম্পার চোখ আটকে গেল।
সবাই চলে যাচ্ছে, তুমি যাবে না?
একটা ভরাট কন্ঠস্বরে টুম্পার সম্বিৎ ফিরে এলো। ও আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে মর্গ থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।
ওর জীবনে ভয় নামে কোন অধ্যায় ছিলো না, অনেক সাহসি ছিল টুম্পা কিন্তু আজ কি হলো! এমন কেন লাগলো যে একটা মৃত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আজ।
রুমে এসে তমা আর দিয়াকে কলিজাটার কথা বলতেই ওরা হেসে গড়াগড়ি খেল আর বললো হয় তো ওটা কে ঢুকাতে ভুলে গেছেন আর তুই ঔটা নিয়ে এতো কেন ভয় পাচ্ছিস? টুম্পা আর কথা বাড়ায় না।
এরপর নিলয় স্যারের তিনটি প্রাক্টিক্যাল ক্লাস পার হলো কিন্তু টুম্পা একটা ক্লাসেও মন দিতে পারলো না, শুধুই ভয় পেত আর লক্ষ করতো প্রতিবারই কলিজাটা সযত্নে তুলে রাখা।
চতুর্থ দিন ওদের মর্গে প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা ছিল আজ ওরা কাটবে আর স্যার দেখবেন। একেক জন একেক পার্ট কাটছে আর স্যার ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু একবারো টুম্পা কে কিছুই কাটতে দিলেন না যেন ওর উপস্থিতি স্যারের নজরেই আসেনি। মনে মনে খানিকটা খুশিই হয়েছিল কারন ওকে কাটতে দিলে ও কিছুই পারতো না।
সেদিন সবাই চলে গেলে টুম্পা চুপিসারে মর্গের জানালায় এসে দাঁড়ালো। কৌতুহল ওকে এতটাই পেয়ে বসেছিল যে ভয় তার কাছে হার মেনেছিল। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে উঁকি দিল আর যা দেখলো তাতে ওর চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল।
দেখলো স্যার লাশের ড্রয়ার টা টেনে বের করলেন, তার ভেতরে দু হাত পুরে দিয়ে সেই কলিজা সহ পাত্রটা বের করলেন তারপর খুব যত্ন সহকারে কচ্ কচ্ করে কলিজাটা চিবিয়ে খেলেন । তারপর একটা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঠোটের রক্ত মুছতে মুছতে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা টুম্পার দিকে তাকালেন।
তার তাকানো দেখে টুম্পা আর সহ্য করতে পারলো না সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করলো। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। সবার উৎসুক চেহারার মাঝে আরেকটি চেহারা দেখতে পেল, দেখেই ভয়ে ওর হাত পা জমে গেল। এই প্রথম নিলয় স্যার কে দিনের বেলায় দেখলো তবে ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ও ছাড়া তাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আর তাকাতে পারলো না ভয়ে চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পেল সেই ভরাট কন্ঠ। যেন ওর কানের মধ্যে ঢুকে কথা বলছে।
বলছে, আমি জানি টুম্পা সেই প্রথম দিন থেকেই তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে, আমিও অবাক হয়েছিলাম। এত বছরেও কেউ আমাকে চেনেনি শুধু তুমি চিনলে। আর কেউ আমার চোখের ভাষা পড়তে পারেনি শুধু তুমি পেরেছিলে। আমি জানতান তুমি জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে তবুও আমি আমার আসল রুপ তোমাকে দেখিয়ে ছিলাম। কারন তোমাকে লুকানো সম্ভব ছিলো না। তোমার মধ্যে হয়ত বিধাতা এমন দৃষ্টি দিয়েছেন যা সাধারণ কোন মানুষের মধ্যে নেই। তাইত সবার চোখ ফাকি দিতে পারলেও কলিজাটা তোমার চোখে ঠিকি ধরা পড়েছিল। আমি ইচ্ছা করলেই তোমাকে সরিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু তোমার জীবনের লক্ষ্য টা আমার এখানে থাকার থেকেও অনেক বড়। আমি অন্য জায়গা খুঁজে নেবো তুমি ভালো থেকো , আর মনোযোগ দিয়ে পরবর্তী প্রাক্টিক্যাল ক্লাস গুলি করো কারন আমি জানি তুমি একটা ক্লাসেও মনযোগী ছিলে না। জীবনে অনেক বড় হও আর যা কিছু দেখেছো ভুলে যেও।
টুম্পা চোখ খুলতেই আর স্যার কে দেখতে পেলো না।
ঐ দিনের পর থেকে আর নিলয় স্যার কে কেউ খুঁজে পায়নি তবে সপ্তাহ খানেক পর হসপিটাল কর্তৃপক্ষ একটা মাফিনামা পেলো , যাতে লেখা ছিল — আমি নিলয় কোন একটা কারনে না জানিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি, আশা করি কর্তৃপক্ষ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমার পদে অন্য কাউকে নিয়োগ করবেন।