অন্ধকারের অবতার

অন্ধকারের অবতার

(গল্পটি লাভ, ডেথ অ্যান্ড রোবটস থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে লেখা সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প।)

রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে। ক্রমাগত ঝিকঝিক শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই নিশুতি রাতের বেলাতে। রেলগাড়ি দুলে উঠছে মাঝেমাঝে। স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া উঠছে উপরের দিকে। কিন্তু এই ধোঁয়া ঠিক কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। জন বার্কেটের হাতে একটা সংবাদপত্র। মন দিয়ে পড়ছেন কিছু একটা। লন্ডন শহরে নাকি নতুন এক উপদ্রব শুরু হয়েছে। মানুষ রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে। তাও আবার অ্যানিমিয়া রোগে কিংবা সহজ ভাষায় যাকে রক্তশূন্যতা বলা হয়। অথচ অনেকের মুখে গুঞ্জন উঠেছে এটা অ্যানিমিয়া নয়। বরং কোনো এক রক্ত পিপাসু পিশাচ মানুষের রক্ত পান করছে। অনেকের মৃতদেহ রাস্তায়, অলিগলির মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশ এসব বিষয়ে কিছু করতে পারছে না। কারণ মৃতদের শরীরে একবিন্দু রক্তের চিহ্ন নেই। মানুষ অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে পুলিশ তাতে কি করতে পারবে !? বার্কেট নিজে ডাক্তার মানুষ। রক্ত পিপাসু বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে বলে সে মনে করে না। ১৯ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসেও তাকে কিনা রক্ত পিপাসুর গল্পে বিশ্বাস করতে হবে !? বার্কেট নিউক্যাসল থেকে লন্ডনে ফিরছে ডাক্তারির কাজ শেষ করে। ডাক্তারি কাজ চর্চার বিষয়। নতুন একধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে অগ্রগতি করতে চলেছে মানবসমাজ। বার্কেট ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়টা নিয়েই বেশ কয়েকদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে। আজকে লন্ডন রওনা দিয়েছে তার গবেষণার রিপোর্ট লিনিয়ান সোসাইটির সামনে তুলে ধরতে। সেইসাথে বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা তার স্ত্রী মার্গট আর তাদের চার বছরের মেয়ে ন্যান্সি। ন্যান্সির জন্য পুতুল আর বেশ কয়েকটি খেলনা কিনেছে।

 

বার্কেটের কামড়াতে সে পুরোপুরি একা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো বার্কেট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। উদ্দাম গতিতে ছুটছে রেলগাড়ি। জানালা খোলা রয়েছে। রেলের গতিবেগের ফলে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকে পড়ছে কামড়ার মধ্যে। ভীষণ ভালো লাগছে বার্কেটের। বাইরে তাকিয়ে দেখল রেলগাড়ি এখন ঘন জঙ্গলের মতো একটা জায়গা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তবে আশেপাশে গাছপালা নেই। বরং লম্বা লম্বা ঘাস। উচ্চতায় নয় দশ ফুট তো হবেই। বার্কেটের মনে হলো রেলের গতি কমে যাচ্ছে। হঠাৎই একটা বেদম ঝাঁকুনি খেয়ে রেলগাড়ি থেমে গেল। বার্কেট কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। রেল কি কোনো স্টেশনে থামলো নাকি !? এমন জায়গায় স্টেশন থাকবার কথা নয় ! কৌতুহল হলো বার্কেটের। নিজ কামড়া হতে বেরিয়ে এলো। এতো রাতে অন্য কোনো যাত্রী সজাগ আছে কিনা তা দেখার জন্য বার্কেট তার পাশের কামড়ার দরজা খুলল। দেখল কয়েকজন লোক ঘুমিয়ে আছে। নাক ডাকার শব্দে বোঝা যাচ্ছে ডাক দিলে সহজে উঠবে বলে মনে হয় না। দরজা লাগিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। রেলগাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো দেখবার জন্য যে রেল কোনো স্টেশনে থেমেছে কিনা। না এটা কোনো স্টেশন নয়। বরং আশেপাশে যতদূর চোখ যায় লম্বা লম্বা ঘাস ব্যতীত অন্য কিছু চোখে পড়ছে না।

 

রেল থেমেছে মাঝপথে। এমন জায়গায় রেল থামতে যাবে কেন ? তবে কি রেলের কোনো সমস্যা ? বার্কেট রেল থেকে নেমে পড়লো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো চারপাশে সম্পূর্ণ জনমানবহীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এমন অন্ধকার রাতে ঠিক করে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে দূরে কোথাও। বার্কেট একটু এগিয়ে গেল। তখনই আচমকা একটা কিছু সামনে এসে পড়লো তার। লোকটার মুখ ভর্তি সাদা দাড়িতে চেহারা দেখা মুশকিল। হাতে একটা লণ্ঠন। বার্কেটের মুখের উপর লণ্ঠনের আলো ফেলে বার্কেটকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল লোকটি। লণ্ঠনের আলোয় বার্কেট লোকটার পোশাক দেখতে পেল। লোকটা বোধহয় টিকিট কালেক্টর। লোকটা তার দিকে ভুরু কুঁচকে বলল,

: এতো রাতে রেলগাড়ি থেকে নামতে গেলেন কেন ?

বার্কেট নিজের চশমা ঠিক করে নিয়ে বলল,

: আসলে দেখতে চেয়েছিলাম যে রেল কিসের জন্য থেমেছে। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি রেলের ইঞ্জিনে ?

লোকটা বার্কেটের মুখের সামনে থেকে লণ্ঠন সরিয়ে বলল,

: তেমন কিছু না। ছোটখাটো সমস্যা। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।

: আচ্ছা যতক্ষণ না রেল ঠিক হচ্ছে ততক্ষণ কি একটা সিগারেট খেতে পারি এখানে দাঁড়িয়ে ?

: পারবেন তবে রেল চলতে শুরু হওয়ার আগেই উঠে পড়বেন কিন্তু। তবুও রেল ছাড়ার আগে আমি দুবার ডাক দিবো… ঠিক দুবার। না উঠতে পারলে আপনাকে ছেড়েই রেলগাড়ি চলতে শুরু করবে। বুঝতে পেরেছেন ?

লোকটি আঙুল দিয়ে দুই ইশারা করলো। তারপর সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। রেলের চালকের বগির দিকে। বার্কেট রেলের সাথে হেলান দিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। সেখান থেকে একটা সিগারেট মুখে নিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া খানিকটা ভিতরে নিল। তারপর মুখ দিয়ে বলয়ের মতো করে উপরে ছাড়লো। সিগারেট খেতে খেতে বার্কেট আশেপাশে তাকালো। কিন্তু দেখার মতো কিছুই নেই। এদিকে আকাশে চাঁদ যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। লম্বা লম্বা ঘাস বাতাসে দুলছে। ঠিক যেন কোনো রমণী তার সামনে নৃত্য পরিবেশন করছে। বার্কেটের মনে হলো তার চোখে কিছু একটার আলো পড়ছে। আলোটা আসছে তার সামনে থেকে। লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপের মধ্যে থেকে। ভীষণ হালকা সেই আলো। এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় চলাচল করছে। বার্কেটের কৌতুহল হলো। কোটের পকেট থেকে টর্চ লাইট বের করলো। কিন্তু টর্চ লাইট জ্বালালো না। আলো অনুসরণ করে এগিয়ে চলতে শুরু করলো।

 

সেই আলো এক জায়গায় স্থির নেই। এঁকেবেঁকে কোথাও চলেছে। বার্কেট আলোর পিছনে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা দূরে। একটু পরে আলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। চারপাশে এখন শুধুই অন্ধকার। বার্কেট বিরক্তের শ্বাস ফেলল। আলো অনুসরণ করতে করতে অনেক দূরে চলে এসেছে। পিছন ফিরে এগিয়ে চলল‌। একটা সময় বুঝতে পারলো সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে একই জায়গায় বারবার হাঁটছে। এ যেন এক গোলক ধাঁধা। বার্কেটের ভয় পেতে শুরু করলো। সে এই লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে পথ চিনতে পারছে না। ঘাসগুলোর উচ্চতা এতোটাই বেশি যে বার্কেট লাফ দিয়েও দেখতে পারছে না সে কোথায় অবস্থান করছে। টর্চ লাইট জ্বালালো। তারপর একটা পথে সোজা এগোতে থাকবে বলে মন স্থির করলো। কিন্তু পরক্ষণেই বাঁধলো বিপত্তি। যতটাই এগিয়ে চলেছে মনে হচ্ছে সে আরো গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই একটা শব্দ শুনতে পেল। ভীষণ অদ্ভুত সেই শব্দ। যেন কোনো প্রাণী শব্দ করছে। বার্কেট বুঝতে পারলো না কিসের শব্দ। কিছুটা এগোতেই মনে হলো শব্দটা আরো জোরালো হচ্ছে। ঘাসের আড়ালে দেখতে পেল একটা সাদা প্রাণীকে।

 

অনেকটা মানুষের মতোই নুইয়ে আছে। এই অন্ধকারের মধ্যে টর্চ লাইটের আলোতে প্রাণীটিকে বেশ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। বার্কেট আর এগোবার সাহস পেল না। টর্চ লাইট বন্ধ হয়ে গেল আপনা আপনি। প্রাণীটা কোনোকিছু খাচ্ছে। হঠাৎই প্রাণীটা তার দিকে ঘুরে তাকালো। তাকে দেখতে পেয়েছে কিনা বার্কেট জানে না। তবে সে প্রাণীটিকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। এমন একটা কিছু না দেখতে পারলেই বোধহয় ভালো হতো। বার্কেটের হাত থেকে টর্চ লাইট পড়ে গেল। প্রাণীটির বর্ণনা দেওয়ার মতো কিছু নেই। প্রাণীটির কোনো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে মুখের অংশে লেগে আছে রক্ত। টাটকা রক্ত। যেন সদ্য কোনো কিছু খেয়েছে। বার্কেট ভয়ে পিছিয়ে গেল। হোঁচট খেল কিছু একটার সাথে। পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো একইরকম দেখতে আরেকটি প্রাণী। মুখে কোনো চেহারা নেই। তবুও গর্জে উঠছে। এমন তীব্র সেই শব্দ যে বার্কেটের কান ব্যাথা করে উঠলো। কানে হাত দিয়ে কান চেপে ধরলো। তরল কিছু একটা তার কান দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বার্কেট বুঝতে পারছে তার কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

 

প্রাণীটি তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। বার্কেট দিকবিদিক না দেখে দৌড় লাগালো। পিছনে খসখস শব্দ। ঘাস ভেদ করে পিছু নিয়েছে প্রাণীটি। তবে বার্কেটের অনুভূতি হচ্ছে আরো কয়েকটা প্রাণী হাতে পায়ে ভর দিয়ে তাকে তাড়া করছে। ডানদিকে কিছু একটা তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কিন্তু তার আগেই বার্কেট মাথা নিচু করে ফেলল। অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পারছে লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে থেকে তার পিছু নিয়েছে সাদা কতগুলো প্রাণী। যাদের কোনো চেহারা নেই। পুরোটাই মসৃণ। প্রাণীগুলোর একসাথে গর্জে ওঠার ফলে বার্কেটের মাথা ব্যাথা করতে শুরু করে দিয়েছে। তার মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে সে ঘাসগুলোর মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। প্রাণীগুলো তাকে ছাড়বে না। এই জঙ্গলের মধ্যেই সে মারা পড়বে। যখনি মনে করেছিল এই জঙ্গলে থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই তখনই বার্কেট পা ফসকে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। তার চশমাটা পড়ে গেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে কোনোকিছু দেখার উপায় নেই। মাটির উপর হাতড়াতে লাগলো চশমাটা পাবার আশায়। মাটি কেমন যেন ভেজা মনে হলো। সেইসাথে পঁচা গন্ধ। অবশেষে চশমাটা পেয়ে গেল হাতের কাছে। চশমাটা পড়ে দেখলো সে একটা স্তূপের মধ্যে পড়ে গেছে। মাটি ভেজা হওয়ার কারণ মাটি রক্তে ভেসে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখলো মরা কতগুলো দেহ দিয়ে ঢিবির মতো বানানো হয়েছে। পঁচা গন্ধ সেখান থেকেই আসছে। রক্তাক্ত নাড়ি ভুরি, যকৃত, হৃৎপিণ্ড সহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সেখানে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো বার্কেট। উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করল তার পায়ের নিচে কিছু একটা থেঁতলে গেছে। পা সরিয়ে নিল সেখান থেকে। পায়ের কাছে থাকা অর্ধ খাওয়া মানব খুলির থেকে বেরিয়ে আসা চোখের উপর সে পা দিয়েছে।

 

বার্কেট একজন সার্জেন। নিজের ডাক্তারি জীবনে সেও বহু মৃতদেহ কেটেছে। তা নিয়ে পরীক্ষা করেছে। সেসব মানুষের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এমন একটা মূহুর্তে এমন সব জিনিস চোখের সামনে দেখে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত উঠানামা করতে লাগলো। এ কোথায় এসে পড়েছে সে ? হঠাৎই পায়ের নিচে হেঁচকা টান অনুভব করলো। টাল সামলাতে না পেরে আবারো বসে পড়লো মাটিতে। অর্ধ খাওয়া মানব খুলির অংশ তার পশ্চাৎ দেশে ভীষণ জোরালোভাবে আঘাত করলো। মাটি ফেরে বেরিয়ে এলো একইরকম দেখতে প্রাণী। কিন্তু এইবার প্রাণীটির মুখ দেখা যাচ্ছে। বলতে গেলে মসৃণ মুখে গোলাকার ভাবে কতগুলো ধারালো দাঁত বেরিয়ে এসেছে। সেই ধারালো দাঁতগুলো এগিয়ে আসছে তার পা লক্ষ্য করে। একটা অর্ধ খাওয়া হাতের একটা অংশ পড়ে আছে তার পাশে। সেইটা তুলেই প্রাণীটির মুখে আঘাত করলো। তবে প্রাণীটি তার পা ছাড়লো না। আরো কয়েকবার আঘাত করলো ক্রমাগত। প্রাণীটির হাত থেকে তার পা একটু আলগা হতেই বার্কেট নিজেকে কোনরকম ছাড়িয়ে উঠতে লাগলো স্তূপের উপরের দিকে। কাঁদা মাটি আর রক্তে ভেসে যাওয়া স্তূপ থেকে উপরে উঠে এসেই শুনতে পেল রেলগাড়ির হুইসেলের শব্দ। রেলগাড়ি বোধহয় চলতে শুরু করবে।

 

বার্কেট তাড়াতাড়ি ছুট লাগালো সেদিকে। ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করল সে। তবে এবার সে নিশ্চিত যে সে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। হুইসেলের শব্দ ভীষণ জোরালো। সামনের দিক থেকে আসছে সেই শব্দ। পিছনে এখনো তাড়া করছে সাদা সাদা সেই প্রাণীগুলো। একটা সময় সে লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে রেল চলতে শুরু করেছে। বার্কেট রেলের দিকে দৌড়াতে গিয়ে রেললাইনের সাথে পা বেঁধে পড়ে গেল। তখনই একটা প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। বার্কেট চোখ বুজে ফেলল। ঠিক তখনই প্রাণীটি দ্রুত তার উপর থেকে সরে পড়লো। বার্কেট দেখতে পেল সেই কালেক্টর লোকটিকে। লোকটির একহাতে একটা মশাল। মশাল দিয়ে লোকটি প্রাণীগুলোকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। আর তাতে কাজও হচ্ছে। প্রাণীগুলো যেন ভয় পেয়ে আর সামনে এগোচ্ছে না। লোকটা বলল,

: দ্রুত রেলগাড়ির দিকে দৌড় দাও।

লোকটা প্রাণীগুলোর দিকে মশাল ছুঁড়ে মারলো। তারপর বার্কেট আর লোকটা দ্রুত দৌড় দিল রেলগাড়ির দিকে। রেল ততক্ষনে বেশ খানিকটা দূরেই এগিয়ে গেছে। সেদিকে দৌড়ে কোনোরকম উঠে পড়লো তাতে। দুজনেই তাকিয়ে আছে সাদা সাদা প্রাণীগুলোর দিকে। মসৃণ তাদের মুখ। যাতে কোনো চেহারা নেই। কিন্তু যেকোনো সময় গোলাকার ভাবে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর ধারালো দাঁত। লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

: ভয় নেই। ওরা আর আমাদের পিছু নিবে না। ওরা আগুন ভয় পায়। ভীষণভাবে ভয় পায়।

বার্কেট ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

: আচ্ছা ওগুলো কি ছিল ?

লোকটা বার্কেটের দিকে তাকিয়ে বলল,

: ওগুলো কি তা সঠিক বলতে পারব না। তবে এটুকু জানি ওরা একটা সময় তোমার আমার মতোই মানুষ ছিল।

তারপর সামনের দিকে বেশ দূরে প্রায় নিভে যাওয়া মশালের আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

: এমনটা কেন হয় তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। তবে প্রতিবার ঠিক এই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় রেলের ইঞ্জিন হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। আর রেলগাড়ি ঠিক একই যায়গায় গিয়ে থেমে পড়ে।

দূরে পড়ে থাকা মশাল পুরোপুরি নিভে গেছে। বার্কেট আর লোকটা দেখতে পেল লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে কেমন যেন আলোকিত হয়ে উঠছে। তারা যেন অন্ধকারের অবতার। অন্যসময় হলে হয়তো এমন একটা দৃশ্য দেখতে সত্যি ভীষণ সুন্দর লাগতো।

 

রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে। ক্রমাগত ঝিকঝিক শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই নিশুতি রাতের বেলাতে। রেলগাড়ি দুলে উঠছে মাঝেমাঝে। স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া উঠছে উপরের দিকে। কিন্তু এই ধোঁয়া ঠিক কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হাতে একটা দৈনিক পত্রিকা। মন দিয়ে পড়ছেন কিছু একটা। একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সম্পর্কে বেশ লেখালেখি করা হয়েছে। একইভাবে কয়েকবছর আগে তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর ছাপা হয়েছিল এমনই কোনো পত্রিকায়। তিনি বার্লিন যাচ্ছেন সেই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সাথে দেখা করতে। তাও আবার এই রাতের বেলা। রবীন্দ্রনাথের কামড়াতে তিনি পুরোপুরি একা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন রবীন্দ্রনাথ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। উদ্দাম গতিতে ছুটছে রেলগাড়ি। জানালা খোলা রয়েছে। রেলের গতিবেগের ফলে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকে পড়ছে কামড়ার মধ্যে। ভীষণ ভালো লাগছে রবীন্দ্রনাথের। বাইরে তাকিয়ে দেখল রেলগাড়ি এখন ঘন জঙ্গলের মতো একটা জায়গা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তবে আশেপাশে গাছপালা নেই। বরং লম্বা লম্বা ঘাস। উচ্চতায় নয় দশ ফুট তো হবেই। রবীন্দ্রনাথের মনে হলো রেলের গতি কমে যাচ্ছে। হঠাৎই একটা বেদম ঝাঁকুনি খেয়ে রেলগাড়ি থেমে গেল।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত