তারানাথ তান্ত্রিক ও মহাকালি

তারানাথ তান্ত্রিক ও মহা কালি ৷
        লেখকঃ সিগমা সানিম
★★
সবে মাত্র এলাম অফিস থেকে, ঘামে পুরো শরীর ভিজে
গেছে। জামাকাপড় খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম৷ ক্যানেন্ডারে চোখ যেতেই দেখি আজকে  মার্চ মাসের পাঁচ তারিখ, হঠাৎ মনে পরলো আজকে গিন্নিকে একটা শাড়ি কিনে দেওয়ার কথা। গিন্নি যদি জানে শাড়ি কিনি নি৷ তাহলে আমার কপালে যে  কি আছে ভগবানই জানেন৷ তাই  আর দেরি না করে বাইরে বেরিয়ে পরি৷  অনেক খোঁজার পরেও মনের মতো কোন শাড়ি পেলাম না৷ অবশেষে একটা দোকানে গিন্নির জন্য  মনের মতো একটা  শাড়ি পেয়েছি৷ শাড়িটা বাংলাদেশের ঢাকাইকা শাড়ি। দাম কম হওয়ায় আর হাত ছাড়া করলাম না৷ কিনে নিলাম শাড়িটা।  শাড়ি পেয়ে গিন্নি অনেক খুশি হলো।  যেনো গুপ্তধন পেয়ে গেছে। আমাকে বললো
– বিভুতি আজকে তুমি কি খাবে বলো
আমি বানিয়ে দিবো৷
আমি বললাম
– তোমার যা ইচ্চা করে তাই রান্না করো৷   দেখলাম গিন্নির মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে৷ যাক গিন্নিকে খুশি করতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।মেয়েটা আমার কাছে তেমন  কিছু চায় না৷ মার্চ মাসের পাঁচ তারিখে আমার গিন্নির জন্মদিন৷ জন্ম দিনে আমার কাছে একটা শাড়ি চেয়েছিলো  গিন্নি৷ আর আমি ভুলেই গিয়েছিলাম  আজকে গিন্নির জন্মদিন। আসলে অফিসে এতো কাজের চাপ যে  কোন কিছু মনে রাখাইতো কস্টের৷ বাসায় অনেক গরম পরেছে  তাই ছাদে একটু হাঁটাচলা করছি৷ যা গরম পরেছে ঘরে
আর থাকা যায় না৷ এদিকে বিকেল হয়ে এসেছে৷
আকাশের অবস্থা ভালো না। কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো আকাশটা।  দেখে তো মনে হচ্ছে যেকোন সময় বৃষ্টি হতে পারে। এরকম মেঘলা পরিবেশে ঘরে বসে থাকা আর চলে না৷ মঠলেনে
তারানাথের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছা করে৷
চারির হাতের মুরি মাখানো আর গরম গরম তেলে ভাজার সাথে তারানাথের আধি ভৌতিক গল্প শুনতে ভালোই লাগে আমাদের। এতো দিনে তারানাথের উপর একটা মায়া পরে গেছে৷ একটা সময় লোকটার অনেক নাম ছিলো৷অনেক টাকা উপার্জনও করে ছিলো কিন্তু শক্তির অপব্যবহার করে  নাম, টাকা সব হারিয়েছে৷ তারানাথের কথা মনে পরতেই ছাদ থেকে নেমে
বাসায় গিয়ে একটা ছাতা বের করে কিশোরীর বাড়ির দিকে রওনা দিলুম।  একা একা গল্প শুনতে
ভালো লাগে না, কিশোরীকে সাথে নিয়ে গেলে ভালোই হবে। রাস্তায় বের হতেই আকাশ ভেংগে বৃষ্টি  নামলো।পাঁচ মিনিট পর থেমেও গেলো৷  কলকাতার বাস্তায় সামান্য বৃষ্টি নামলে জলে চারদিক ভরে যায়। তখন রাস্তা দিয়ে হাঁটাটা কস্টকর হয়ে যায়৷  আমি  কোন রকম কস্ট করে কিশোরীর বাসায় আসলাম৷ কিশেরীর রুমে ঢুকে  আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিশোরীর রুমে গিয়ে দেখি কিশোরী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে৷ আমি কিশোরীকে ঘুম থেকে জাগালাম, কিশোরী চোখ লাল করে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। আমার খুব খারাপ লাগছে কিশোরীর জন্য৷ বেচারার কাচা ঘুমটা ভেংগে দিয়েছি । আমি কিশোরীর পাশে বসলাম। তার পর  কিশোরীকে বললাম
–  কিরে কিশোরী এমন অবেলা সময় কেউ ঘুমায়।
কিশোরী বিরক্ত হয়ে বললো
–  দেখতে পারছো না  বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, একটা ঠান্ডা
আবহাওয়া বিরাজ করছে। এই সময়টাই  তো ঘুমের
জন্য উপযুক্ত সময়, তা আমার কাছে কি মনে করে।
–  ভাবছি তারানাথের বাড়ি যাবো, তুমি কি যাবে আমার সাথে? না কি  নাক ডেকে ঘুমাবে৷
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি যাবো তুমি বসো এখানে, আমি ফ্রেশ
হয়ে  জামা কাপড় পরে আসছি৷ কিশোরী ফ্রেশ হয়ে   জামা কাপড়  পরে আসলো। তার পর আমি
কিশোরীকে সাথে  নিয়ে বেরিয়ে পরি তারানাথের বাড়ির  উদ্দেশ্য। পথে কিশোরী তারানাথের জন্য পাসিংশো এর প্যাকেট ও গরম গরম তেলে ভাজা কিনে নিলো। তার পর আমরা  আবার হাঁটতে শুরু করলাম। তারানাথের বাড়ি যেতে আমাদের বেশি সময় লাগে না৷ কিন্তু আজকে একটু
বেশি সময় লাগছে৷ ঔযে বললাম কলকাতার রাস্তায় সামান্য বৃষ্টি হলে চারদিক জলে ভরে যায়।
তখন হাঁটাটা একটু কস্ট কর হয়ে যায়। 
তারানাথের বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় কড়া দিতেই চারি দরজা খুলে
দিলো।  কিশেরী  গরম গরম তেলে ভাজার প্যাকেটটা চারির হাতে দিয়ে বললো
–  চারি মা শশুরবাড়ি থেকে  কবে এলে তুমি।
চারি  কিশোরীকে  বললো
– এই তো কাকাবাবু সকালেই এলাম। আপনারা ভিতরে গিয়ে
তোক্তপোষের উপর বসুন  আমি বাবা কে ডেকে দিচ্ছি।

আমরা ভিতরে গিয়ে তক্তোপোষের উপর বসলাম৷
একটা বই দেখতে পেয়ে কিশোরী বইটা পড়তে লাগলো।  তন্ত্রমন্ত্রের বই।  প্রাচীন কিছু মন্ত্র লিখা
আছে বইটাতে। কিশোরী বইটা আদো বুঝতে পারছে কিনা আমার সন্দেহ আছে৷ 
কিছুক্ষন পর তারানাথ চলে এলেন  তক্তপোষের উপর বসলেন  আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন
– অনেকদিন পর আজকে আমার ইংকামটা
ভালোই হয়েছে  সকাল থেকে এখন পযন্ত
দশ জন আমার কাছে হাত দেখাতে এসেছে।
এমনেতো দুই তিন জন ছাড়া কেউ আসেই না আমার কাছে৷ আজকে দশ জন এসেছে৷ 
তোমরা বসো আমি একটু ভিতর থেকে আসছি। 

তারানাথ কিছু সময় পর ভিতর থেকে  আসলো 
তারানাথ বললো
– টাকা পয়সা নিয়ে আমি তেমন একটা ভাবি না। কোন রকমের দিন চলে গেলেই
হলো।  মধু সুন্দরী দেবী  বলেছিলেন আমার
কোন সময় খাবারের অভাব হবে না৷
তাই ওই চিন্তাটা আমার নেই। 
এক সময় আমার কাছে নামি দামি লোকেরা আসতো।  আমি তাদের সাহাস্য
করতাম।
এরপর  তারানাথ কিছু সময় থামলো
তার পর আবার বললো
–  আসোলে প্রকৃত সাধক চর্চা ছেড়ে দিয়ে
শক্তির অপব্যবহার  করা শুরু করেছিলাম।
তাই এখন অনেকটাই শক্তি কমে এসেছে।
তাই আগের মতো মানুষের  উপকার করতে
পারি না। কোথাও যেতে পারি না আমি৷ আসলে আগের তারানাথ আর এখনকার তারানাথের মধ্যে
অনেকটাই পাথর্ক। এখন তো  আমি বাসায় একাই 
থাকি৷ চারি মা মাঝে মাঝে আছে দুই তিন দিন থাকে
তার পর আবার চলে যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়
আগের মতো এদিক সেদিক ঘুরেবেড়াই ৷ এই বলে
তারানাথ মন খারাপ করে জানালার দিকে চেয়ে রইলো৷ সাথে আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেলো।
কিশোরী তারানাথকে বললো 
–  ঠাকুর মশাই আপনি তো আমাদের আপনার শক্তি দেখাতে চান না৷ আজকে আপনার কিছু শক্তি দেখান আমদের,  দোয়া করে না বলবেন না৷।
তারানাথ কিশোরীর কথা শুনে হাসলো তার পর বললো।
– আচ্ছা দেখাচ্ছি৷
তারানাথ কি একটা মন্ত্র
পড়তে লাগলো ,  তার পর কিশোরীকে  বললো
–  পকেটে একবার হাত দিয়ে দেখতো কিশোরী পাসিং শোয়ের  প্যাকেট টা পাও
কি না। 
কিশোরী তারানাথের কথা মতো   পকেটে হাত দিলো। কিন্তু পাসিং
শোয়ের প্যাকেটা পেলো না। 
আমি একটু অবাকই হলাম  আমার সামনে
বসেই তো কিশোরী  পেন্টের  পকেটে পাসিং শোয়ের প্যাকেটা ঢুকিয়ে ছিলো। তাহলে  প্যাকেটা কোনরকম ভাবে পরেগেলো কি। 
আমাদের   অবাক করে দিয়ে তারানাথ নিজের পকেট থেকে  পাসিং শোয়ের প্যাকেটি বের করলো।
তারানাথ বললো
–  আমি যা করলাম এটা অতি নিচু শ্রেণির
তন্ত্রর  সাহায্যে সম্ভব হয়েছে। এটা একপ্রকার যাদু।বলতে পারো৷ এরকমের যাদু আজকাল অনেকেই
দেখায়৷
এ থেকেও উচ্চ মানের তন্ত্র  সাধনা করেছিলাম এক কালে। 
আমি এক সময় অনেক প্রকৃত গুরুদের সন্ধান পেয়েছিলাম তা তো তোমাদের বসেছি৷
তাদের কাছ থেকে অনেক শক্তি পেয়েছিলাম আমি। সেটুকু শিখেছি সবই তাদের দান। তাদের কথা মতো আমি চেস্টা করেছি। অসহায় মানুষ গুলেকে সাহাস্য করতে।
তা আজকে  তোমাদের আসতে এতো দেরি  হলো কেনো?  এতো দেরিতো তোমরা করো না৷
আমি তারানাথ কে বললাম
– ঠাকুর মশাই  দেখতেই তো পাচ্ছেন রাস্তার অবস্থা।
কলকাতার রাস্তায় সামান্য বৃষ্টি হলে চারপাশ জলে
ভরে যায়৷ তখন হাঁটাটা একটু কস্টকর হয়ে যায়৷ তাই আমাদের আসতে  একটু দেরি হয়ে গেলো।
– তা তোমরা বসো চারি তোমাদের জন্য গরম গরম
তেলে ভাজা আর চা নিয়ে আসছে৷ খাওয়াধাওয়ার
পর বাকি কথা হবে।

চারি আমাদের জন্য গরম গরম তেলে ভাজা আর চা নিয়ে এলো। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে তাই আমি কচমচ শব্দ করে একটার পর একটা বেগুনি খেতে লাগলাম৷ তার পর পাশে থাকা চায়ের
কাপটা তুলে নিয়ে সুরুত সুরুত শব্দ করে  চুমুক দিলাম। আমি খেয়ালই করলাম না তারানাথ
আর কিশোরী আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে৷ 
পথে কিছু খাওয়া হয় নি তাই বড্ড  খিদে পেয়েছে আমার৷

আমার এভাবে খাওয়াটা ঠিক হয় নি তা আমি ভালোই বুঝতে পারছি৷

আমাকে এভাবে খেতে দেখে তারানাথ বললো
– লজ্জা করো  না, খাও খাও  খিদে পেয়েছে  বুঝি৷  তারানাথ ভিতর ঘরের দিকে  তাঁকিয়ে চারিকে উদ্দেশ্য করে বললো
–  চারি মা আমাদের জন্য মুরি মাখিয়ে নিয়ে এসো
তো । চারি আমাদের জন্য মুরি মাখিয়ে নিয়ে আসলো। তোক্তপোষের উপর রেখে ভিতর ঘরে
চলে গেলো৷ 

তারানাথ পাসিং শোয়ের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে,  সিগারেটটা  জ্বালিয়ে একটা লম্বা সুখ টান দিয়ে বললো
–  মানুষ অন্যসব নিয়ন্ত্রন করতে পারলেও খিদেকে
নিয়ন্ত্রন করতে পারে না৷ খিদের আগমতে মানুষের বা অন্যসব প্রাণীর মধ্যে জমে  থাকা লজ্জা সরম  কবেই পালিয়ে যায়৷ তবে হ্যাঁ খিদে বিভিন্ন ধরনের
হতে পারে। এই টুকুই বলে তারানাথ আমাদের দিকে
তাঁকালো। তারানাথ বুঝতে পেরেছে আমরা তারানাথের কথা কিছুই বুঝি নাই৷ কিশোরীকে দেখলাম তারানাথের দিকে ফেল ফেল করে তাঁকিয়ে
আছে৷
কিশোরী বলে উঠলো
–  ঠাকুর মশাই খিদে আবার বিভিন্ন ধরনের হয় কিভাবে? আমরা খিদে পেলে খাবার খাই৷ খিদে
আবার বিভিন্নধরনের হয় এটা ঠিক বুঝলাম না৷ একটু বুঝিয়ে বলুন তো।
কিশেরীর কথা শুনে তারানাথ একটু হাসলো তার পর বললো
–  পেটের খিদাটা তুমি গরম গরম তেলে ভাজা আর
মুরি মাখা দিয়ে শান্ত করলে৷ কিন্তু মনের খিদাটা কি
দিয়ে শান্ত করবে কিশোরী৷ কিশোরীর মুখ দিয়ে
এখন কোন কথা বের হচ্ছে না৷ আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে৷

তারানাথ অলৌকিক ঘটনার পাশাপাশি এসব অদ্ভুদ
কথা প্রায়ই  বলে থাকেন তা  আমরা জানি৷

আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তারানাথের দিকে তাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– ঠাকুর মশাই আপনি কি বলতে চান আমাদের পরিষ্কার  করে বলুন তো৷

তারানাথ জানালার বাইরে আকাশের  দিকে তাঁকিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে  একটা
লম্বা সুখ টান দিয়ে বলতে লাগলো।
–  মনের মধ্যে  জমে থাকা কামনা আর প্রতিহিংসার ঘন কালো জল যখন আগুনের   উত্তাপে বাষ্পীভুত হয়ে মনের গহন জঙ্গলে ছড়িয়ে পরে৷ তখন সেই জঙ্গলথেকে বেরিয়ে আছে এক দানব। শুরু হয় এক ধ্বংসের অধ্যায়৷ আজকে তোমাদের আমার জীবনে
ঘটে যাওয়া এক ধ্বংসের কাহিনী তোমাদের বলবো।

আমি মনে মনে ভাবলাম আজকে একটা ভয়াঙ্কর
গল্প হতে চলেছে। তা স্বচ্ছ জলের মতো বুঝা যাচ্ছে
তারানাথের চোখ মুখ দেখে। আমি তক্তোপোষের
উপর পা দুটো তুলে নিয়ে ভালোভাবে বসলাম।
তারানাথ গল্প বলা শুরু করলো

–  দিনটা ছিলো শুক্রবার, কালি  পুজো। আমার বাসায় আসেন মহিনাথ  বানুজ্জ্যে আমাকে তার  গ্রামের বাড়িতে যেতে বলেন।মহিনাথ খুবই প্রভাবশালী একজন জমিদার।  বড়ই নরম মনের মানুষ৷ মহিনাথ বানুজ্জ্যে তার প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন৷ মহিনাথ বানুজ্জ্যে প্রতিবছর ধুমধাম করে কালি মায়ের পুজো করতেন।
পুজোর দিন  মহিনাথ গ্রামের সকল মানুষকে পেট ভরে খাওয়াইতেন৷
প্রজারাও জমিদারকে খুব ভালো বাসতেন৷ তো সেবার আমি গিয়েছিলাম মহিনাথ বানুজ্জ্যের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই আমাকে সাদরে আমন্ত্রন
জানালেন মহিনাথ বানুজ্জ্যে৷ আমাকে হাত পা ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। মহিনাথ বানুজ্জ্যে আমাকে অতিথি শালায় নিয়ে গেলেন৷  আমাকে
বিছানার উপর বসতে বললেন, আমি বিছানার উপর বসলাম। ইতি মধ্যেই দেখলাম মহিনাথ বানুজ্জ্যের স্ত্রী এসে উপস্থিত হলেন আমার সামনে৷ হাতে একটি বিশাল শাল পাতার থালা। আর সেই থালায় রয়েছে গোটা দশের রুচি,আলু তরকারি, গরম গরম বেগুনি, পায়েস জিলাপি  দশ রকমের মিষ্টি আরও কত কি৷
মহিনাথ বানুজ্জ্যে বললেন
– ও আমার স্ত্রী মধুমিতা, আপনার জন্য সামান্য কিছু খাবারের আয়জন করেছে আপনি খেয়ে নিন।  এসব দেখে আমি বললাম
–  আরে মহিনাথ কি করছো তুমি। এসব খাবার আমি  একা কি করে খাবো। এ যে রাজকিয় আয়জন করেছো। এতো খাবার আমি খেতে পারবো
না।
– কিছু হবে না  ঠাকুরমশাই খেয়ে নিন আপনি, এতো দুর থেকে হেঁটে  এসেছেন, ক্লান্ত হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই  খেয়ে নিন৷
আমি বললাম
– এতো খাবার তো আমি একা খেতে পারবো না, তুমি বসো,  মা মধুমিতা তুমিও বসো আমাদের সাথে, এক সাথে খাবো। 

আমি খেতে লাগলাম সাক্ষাৎ যেনো অমৃত খাচ্ছি। মাও এভাবে আমার জন্য রান্না করতো৷ মায়ের কথা
মনে পরতেই চোখ দিয়ে দু ফোটা জল মাটিতে পরে
যায়৷ আমরা জল খাবার শেষ করে কালি মায়ের
মন্দিরের দিকে যেতে লাগলাম। মহিনাথ বানুজ্জ্যের
বাড়ির ঠিক পিছন দিকে কালি মায়ের মন্দির৷ মন্দিরে যেতে আমাদের  ত্রিশ মিনিটের মতো সময়
লাগলো৷
মন্দিরের দিকে আসতেই একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো আমার৷   ফুল আর ধুপ মিশানো কমল মিষ্টি গন্ধে চারিদিক মহো মহো করছে৷ আমি  মায়ের মন্দিরে ঢুকলাম। কি সুন্দর মায়ের মুখ খানা।  মায়ের মায়া ভরা  মুখ দেখলে মন আনন্দে ভরে যায়। আর চোখ দুটো দেখলে মনে হয়  মনের সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে শরীর থেকে৷ একটা পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আমার চার দিকে খুব ভালো লাগছে আমার।  এ রকম পবিত্র পরিবেশ ফেলে যেতে ইচ্ছা করছে না৷
আমি মহিনাথ বানুজ্জ্যেকে বললাম
– মহিনাথ  আমি এখানে একটু একা থাকতে চাই৷
কিছুটা সময় মায়ের সাথে থাকতে চাই আমি। তুমি এখন আসতে পারো।
– আচ্ছা ঠাকুরমশাই আপনি থাকেন আমি কিছু সময় পর আসবো কেমন। এই বলে মহিনাথ চলে
গেলো৷ আমি মায়ের সামনে বসে আপন মনে কিছু
মন্ত্র পড়তে লাগলাম৷ হঠাৎ আমার মনটা কেমন যেনো কু গাইতে লাগলো। কে যেনো আমার কানের
কাছে এসে ফিস ফিস করে বলতে লাগলো -তারানাথ মহিনাথ আর মধুমিতার সামনে অনেক বিপদ অপেক্ষা করে আছে। তুমি ওদের বাঁচাও৷খুবই
পরিচিত একটা কন্ঠসর।  মনে হলো এই কন্ঠসর আমি আগেও শুনেছি।  আমি শুনতে পেলাম কে যেনো  খুব জোরে নারি আর পুরুষের মিলিত কন্ঠে হেঁসে যাচ্ছে৷ আমার শরীর কেপে উঠলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কে হাঁসছে এমন করে। তোমরা তো জানো মধুসুন্দরি দেবী আমাকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম এখানে  এমন কিছু ঘটনা  ঘটবে যেটা আমার কল্পনারও বাইরে৷

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জমিদারবাড়ির
উঠানে পাইচারি করছি। এমন সময় মহিনাথ আমার
সামনে এলো আর বললো
– ঠাকুরমশাই আপনি এখানে কি করছেন। আমার
সাথে ভিতরে চলুন। সকালের খাবার খাবেন না৷ মধুমিতা আপনার জন্য সকালের খাবারের আয়জন
করেছে,  আসুন  আমার সাথে৷

আমি কোন কথা বললাম না৷ মহিনাথকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভিতর  ঢুকে গেলাম৷ সকালের খাবার খেয়ে আমি আমার রুমে শুয়েছিলাম এমন সময় দেখলাম
কেউ আমার রুমের দরজায় কড়া দিচ্ছে৷
আমি বললাম কে?
ঠাকুর  মশাই আমি মহিনাথ আপনার সাথে কিছু কথা  বলার ছিলো দরজাটা খুলুন৷  আমি দরজা খুলে দিলাম৷
মহিনাথ আমার রুমের ভিতর আসলো আর বললো
– ঠাকুর মশাই আমি আপনাকে কিছু  কথা বলতে চাই৷
– হ্যাঁ  মহিনাথ বলো কি বলবে আমায়৷
–  জানেন ঠাকুরমশাই কয়েকদিন আগে এক কাপালিক  আমাদের গ্রামে এসেছিলো। এই বাড়ির পুর্ব দিকে একটা শ্মশান আছে৷ ঔখানেই থাকতো
ও। একদিন কাপালিকটা এই বাড়িতে আছে আর বলতে থাকে
– আমার খুব খিদে পেয়েছে বাড়িতে কেউ কি আছে, অনেক দিন হলো কিছু খাই না ।  আমি
আমার রুমে শুয়ে  ছিলাম, কাপালিকের  ডাকে বাইরে বের হলাম৷ কাপালিককে দেখে আমি শিউরে উঠলাম। কি ভয়াঙ্কর চেহারা কাপালিকের৷ চোখ দুটো টকটকে লাল, কপালে সিদুরের তিলক আঁকা
আছে৷ পরনে কালো একটা ধুতি। সেই টকটকে লাল চোখের দিকে তাঁকানো যায় না৷ চোখ দুটো
দেখে মনে হয়,  জমে থাকা কোন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে ঔ দুচোখে। আমি কাপালিককে ভিতরে নিয়ে আসলাম তাকে খেতে দিলাম। খাওয়াধাওয়ার পর কাপালিক উঠে দাঁড়ালো। আমি
কাপালিককে প্রনাম করলাম৷ তার নাম জিজ্ঞেস করলাম৷ কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না৷ বরং
আমার দিকে কিছু সময় চেয়ে হন হন করে চলে গেলেন। কাপালিক চলে যাওয়ার পর আমার শরীরটা কেমন যেনো করে উঠলো।

★★
আমি মনযোগ দিয়ে মহিনাথের কথাগুলো শুনছিলাম। আমি বললাম
– চিন্তা করো না মহিনাথ, আমি থাকতে কোন অশুভ শক্তি তোমার বা মধুমিতার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। মায়ের অপর ভরসা রাখো। মাকে ডাকো।  মা তোমাদের পরিবারকে রক্ষা করবেন।

★★
দুপুরে আমি আর মহিনাথ রুমে বসে কথা বলছি।
এমন সময় মধুমিতা আমার কাছে এসে বললো
–  বাবা আপনার কি কিছু লাগবে৷
আমি বললাম – না মা আমার কিছু লাগবে না৷

মধুমিতা চলে গেলো রুম থেকে৷  আমি মধুমিতার চোখের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে পারছিলাম না আমার বুকটা অজানা একটা আতঙ্কে কেঁপে উঠতে লাগলো।
আমি মধুমিতার কপালের দিকে তাঁকয়ে ছিলাম।
স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম কিছু একটা বিপদের চিহ্ন
ফুটে উঠেছে মধুমিতার কপালে।

দুপুরে আমরা খেতে বসলাম, আমার জন্য মধুমিতা
বাস্মতি চালের ভাত, পালং পনির,মচার ঘন্ট,  ইত্যাদি বানিয়েছে। এসব আয়জন দেখে নিজেকে রাজা মনে হচ্ছিলো।
মহিনাথ আমাকে বললো
– আচ্ছা ঠাকুরমশাই আমি আপনাকে একটা কথা
বলতে ভুলে গেছি৷
আমি বললাম
–  হ্যাঁ মহিনাথ বলো,
–  আজ থেকে কয়েক মাস আগে একজন ভরঘুরে লোক এসেছিলো আমাদের বাড়িতে৷  বাড়ির উঠানে
দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকছিলো। আমি আমার
কাজের লোক রমেশকে বলি
– বাইরে গিয়ে দেখতো কে আমাকে ডাকে।

রমেশ আমাকে জানায়
– হুজুর একজন লোক এসেছে আপনার সাথে দেখা
করতে চায়৷
– নিয়ে আয়  লোকটাকে আমার কাছে৷

রমেশ লোকটাকে সাথে নিয়ে আসে আমার কাছে।
লোকটা বেশ সুন্দর দেখতে৷ চোখে মুখে উজ্জল দীপ্তি৷ মুখে একটা সরল হাসি ফুটে রয়েছে৷ তবে লোকটা একটু পাগলাটে। আমার কাছে এসেই বলে
– আজ রাতটা আমি এখানে কাটাবো৷ এই বাড়ির বারান্দায় আমি শোবো। মহিনাথ আমাকে একটু শুতে দেবেন৷
আমি বললাম
– আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন,? আমি তো আপনাকে চিনি না। আর এই গ্রামে  তো আপনাকে
দেখি নি। কোথা থেকে এসেছেন আপনি?
–  আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই৷ আমি জানতে পেরেছি আপনার আর আপনার স্ত্রীর অনেক বিপদ৷
তাই আপনাকে বলতে এলাম।  কি বিপদ আমি জানি না, জানতে গেলে আমাকে সপ্ন দেখতে হবে৷
আর আমার মনে হলো আপনার নাম মহিনাথ৷ তাই
আপনাকে মহিনাথ বলে ডাকলাম৷ আমি কি আপনার বাড়ির বারান্দায় শুতে পারি৷
–  হ্যাঁ হ্যাঁ  তুমি শুতে পারো। রাতে তুমি কি খাবে বলো আমার কাজের লোক রমেশকে বলে দিবো ও বানিয়ে দিবে তোমায়৷
– না না আমি রাতে কিছু খাই না। খেলে সপ্ন দেখা যায় না৷
  আমি লোকটার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম।  রাতে  সপ্ন দেখে  এটা আবার কেমন কথা৷ যাইহোক আমি লোকটাকে শুতে  দিলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকটাকে বললাম
– তা  রাতে কি সপ্ন দেখলে তুমি৷
তার পর লোকটা আমাকে যা বললো তাতে আমর
চোখ মাথায় উঠে গেলো। 
লোকটা আমায় বললো 
– আজ থেকে ঠিক কয়েক মাস পর এক কাপালিক
আসবে আপনার  বাড়ি।  আপনার স্ত্রী মধুমিতাকে বেতালের মাধ্যমে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবে৷ তার পর মধুমিতাকে বসিবত করে  মনের অপুর্ন চাহিদা মিটাবে। আপনি মধুমিতার স্বামী হওয়ায় আপনাকেও শেষ করে দিবে কাপালিকটা৷ বিপদ নেমে আসবে আপনাদের উপর, শুধু একজনই পারবে আপনাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।
আর সেদিন আপনি বুঝতে পারবেন আমি কে। আমি গেলাম তাহলে
নিজের খেয়াল রাখবেন। ওঁম ওইং  ওম হ্রিম ক্লিম   ফট মহাকালি নমঃ। এই বলেই লোকটি বেড়িয়ে গেলো।
– অমর জীবন!
– কিছু বললেন ঠাকুর মশাই৷
– না না মহিনাথ লোকটি পাগলাটে নয়৷ ওর নাম অমরজীবন। ওকে আমি ভালোকরেই চিনি৷ অমর
জীবন আমার কাছেও এসে ছিলো। আমার কানের
কাছে এসে বলেছিলো
-তারানাথ মহিনাথ আর মধুমিতার সামনে অনেক বিপদ অপেক্ষা করে আছে। তুমি ওদের বাঁচাও৷
কিন্তু আমি অমর জীবনকে সামনা সামনি দেখতে
পারি নি৷ ওর কন্ঠসরও চিনতে পারি নি। আমার জীবেনের বিশেষ কিছু মুহুর্তে অমর জীবনের আগমন হয়৷ ওর আগমনের নিদিষ্ট কিছু কারন
নিশ্চই থাকে৷
– ঠাকুর মশাই আপনি  এসব কি বলছেন? কি বিপদ অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য৷  আর লোকটার নাম অমরজীবন।
– হ্যাঁ মহিনাথ লোকটার নাম অমরজীবন। তোমার
আর মধুমিতার মাথার উপর ভয়ঙ্কর কিছুর ঘনঘটার অস্তিত্য আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।
শুধু তুমি ভয় পারে বলে আমি কিছুই বলি নি৷
আচ্ছা মহিনাথ একটু মনে করে বলতো সেই ভয়াঙ্কর কাপালিক কবে নাগাদ আছে তোমার বাড়িতে।
–  অমর জীবন আসার কয়েক মাস  পরই কাপালিকটা আসে আমার বাড়িতে।
– মহিনাথ তুমি নিশ্চিত।
– হ্যাঁ আমি নিশ্চিত।
– মহিনাথ আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে কাপালিকটা খুব তাড়াতাড়ি তোমার আর মধুমিতার
ক্ষতি করবে৷
– ঠাকুর মশাই এতো বড় সমস্যার কথা৷ কিন্তু আপনি কিছু ভাববেন না। কাপালিক যদি কিছু করতে আছে তাহলে  আমার লোক ওকে মেরে ফেলবে৷

আমি একটু হাসলাম আর বললাম
– তোমার লোক কাপালিককে কিছুই করতে পারবে
না৷ যা করার আমাকেই করতে হবে বুঝলে৷  হঠাৎ কেউ আবার আমার কানে কানে বললো
–  ওঁম ওইং  ওম হ্রিম ক্লিম   ফট মহাকালি নমঃ।
আমি বুঝতে পারলাম এই কন্ঠসর অমরজীবনের৷
কিন্তু এই মন্ত্র অমরজীবন কেনো বললো। আর কিসের মন্ত্র এটা। অযথা অমর জীবন কিছু বলে না৷
এই মন্ত্র বলার পিছনে কি কোন কারন আছে৷ কি
কারন থাকতে পারে। আমাকে যেভাবেই হোক অমর
জীবনের মন্ত্র বলার কারন আমাকে বের করতেই
হবে।

মহিনাথের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে বিকেল হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। বাইরে শুনতে
পেলাম শাঁখ আর কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ।

মহিনাথ বললো
– চলুন ঠাকুর মশাই  পুহরী মশাই চলে এসেছেন৷
মায়ের পুজো ভালোভাবে হোক তার পর না হয় অমর জীবনকে নিয়ে ভাবা যাবে৷

মহিনাথকে সাথে নিয়ে পুজো মন্দিরের সামনে আসলাম। পুরোহিদ পুজো করছে। গ্রামের বউ মেয়েরা নতুন জামা কাপড় পরে মাকে দেখছে৷
জমিদার বাড়ির পুজো বলে কথা সবার মনে একটা
আনন্দ বিরাজ করছে৷ সোনার গয়নায় ভরিয়ে তোলা হয়েছে মাকে৷

আমি আর মহিনাথ মন্দিরের সামনে বসে পুজোর
আয়জন দেখছি৷ ঢাকিরা ঢাক বাজাচ্ছে৷ মেয়ে বউরা হুলু দিচ্ছে। এরকম করেই চললো বেশ কিছুক্ষন। মহিনাথের বাড়িতে বলির নিয়ম নেই।
মহিনাথের বাবা বলেছিলেন
– আমার বাড়িতে   নিরীহ পশু বলি দেওয়া চলবে না৷ পৃথিবীর সকল পশুপাখি তো তারই সন্তান।

আমি কিন্তু মহিনাথের বাবার পক্ষে। সত্যিই পুজোর
নামে আমরা নিরীহ প্রাণী গুলোকে বলি দিচ্ছি৷ 
মা কি  সত্যিই  পশু বলি তে খুশি হোন আমার জানা
নেই৷ 

★★
সুর্য অনবরত আলো বিকরন করে  করে ক্লান্ত৷ এবার সে বিশ্রাম নিতে চায়৷ শীতের একটা আমেজ
সরিয়ে পরেছে তার দিকে৷ ঝুপ করে সন্ধ্যে হয়ে গেলো যেনো। কিন্তু মন্দিরের চার পাশ দিনের মতো
আলোকিত হয়ে রয়েছে৷ আর কিছুক্ষনের মধ্যেই
ঘট তুলতে যাওয়া হবে৷ জমিদারের পুকুর থেকে জল তোলা হয়। হঠাৎ শুনলাম কেউ জোরে
জোরে চিৎকার করছে৷ সকলে যেনো কিছু একটা
দেখে বড্ড ভয় পেয়ে গেছে৷

জোরে জোরে কেউ বলছে – আমার সামনে দিয়ে সবাই সরে যা। মধুমিতা শুধু আমার আর কারো না।
ওকে আমার চাই আজকেই ওকে নিয়ে যাবো৷ 
আমাকে আটকাতে সে আসবে তাকে আমি মেরে ফেলবো। আমার হাতের এই কত্তান তার মনিবের
কথা শুনে।  কত্তান মধুমিধাকে তুই  ডেকে আন আমার সামনে৷  মধুমিতাকে আমি বসিবত করে আমার সাথে করে নিয়ে যাবো।

★★
ব্যাপার খানা বুঝতে পেরে আমি কাপালিকটার কাছে এগিয়ে  গেলাম৷ মহিনাথের  বলা সেই কাপালিক৷ চোখ দুটো টক টকে লাল৷ মাথায় সিদুরের তিলক৷  হাতে একটা বড় কত্তান। মহিনাথ
কত্তালের কথা আমাকে বলে নি৷ মহিনাথএতক্ষন মায়ের  পুজো করছিলো কাপালিকের চিৎকার শুনে
বাইরে বের হয়ে আসলো। 

মহিনাথ কাপালিককে দেখে বললো
– একি আপনি এখানে আর কত্তান হাতে নিয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন কেনো? ওটা নিচে রাখুন এক্ষুনি।
– আগে মধুমিতাকে নিয়ে আয়৷ আমি ওকে বসিবত
করে আমার সঙ্গি করে নিবো। যদি আমাকে বাধা দিস তাহলে এই কত্তানের এক কোপে তোর গলা আলাদা করে দিবো। মহিনাথ তোর উপর রাগ জমে
আছে আগে থেকেই।  আমাকে যদি আটকাস তাহলে তুই আমার হাতেই মরবি৷

ইতিমধ্যে পুজো থেমে গেছে৷ চারপাশের সব লোক
এই কর্মকান্ড দেখে চলেছে৷ ছোট বাচ্চা গুলো মায়ের আচলে মুখ লুকিয়েছে৷

মহিনাথ বলে উঠলো
–  তোর এতো বড় ক্ষমতা তুই আমার ভিটেতে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রী  মধুমিতাকে নিয়ে যেতে চাস৷
কে আছিস এই কাপালিককে মার।

মহিনাথের লোক কাপালিককে মারতে লাগলো৷

মহিনাথ একটা মজবুত লাঠি তুলে নিয়ে কাপালিকের ডান  হাত লক্ষ্য করে চালিয়ে দেয়৷
জমিদারি রক্ত তার গায়ে৷ রাগে তার শরীরের শক্তি
দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে৷ লাঠির আঘাতে কাপালিকের
হাতে থাকা কাত্তানটা মাঠিতে পরে গেলো।
যন্ত্রনায় কুকড়ে উঠলো কাপালিক৷

কাপালিক বলে উঠলো
– এতো বড় ক্ষমতা তোর তুই আমার গায়ে হাত তুললি। ভেবেছিলাম তোকে মারবো না৷ ছেড়ে দিবো
তোকে। কিন্তু না আজকে রাতটাই হবে তোর শেষ রাত৷ মধুমিতার সাথে তোকেও নিয়ে যাবো।  তোকে
নিয়ে গিয়ে আমি যজ্ঞে  বলি দিবো৷ সেই বলির রক্ত
খেয়ে আমি আরও শক্তিশালী হবো। তার পর এই
গ্রামকে আমি ধ্বংস করে দিবো।

মহিনাথ ওর লোকদের বললো
–  এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো তোরা। এই কাপালিককে মেরে ফেল।

লাঠি দিয়ে ওরা কাপালিককে মারতে লাগলো৷
ইতি মধ্যে  দেখলাম লোকগুলো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কোন নোড়াচোড়া করছে না৷

বুঝতে দেরী হলো না কি হচ্ছে এখানে৷ হস্তপদ বন্ধন।

কিশেরী বলে উঠলো
– এই হস্তপদ আবার কি ঠাকুরমশাই৷ 
– এটা মন্ত্রের একটা ফসল। তুমি যে বইটা পড়ছিলে
বইটাতে এই মন্ত্রটা পেয়ে যাবে৷
এই মন্ত্রটা পড়লে সামনে থাকা কেউ নড়াচড়া করতে পারে না৷
কাপালিক বলে উঠলো
–  আমাকে এই সামান্য লাঠিয়াল কিছুই করতে পারবে না। আমি ফিরে আসবো তোকে বিনাশ করতে৷

মহিনাথ আমার কাছে আসলো আর বললো
– ঠাকুর মশাই এখন কি হবে  অমরজীবনের  কথা
গুলোতো মিলে যাচ্ছে এখন আপনি শুধু পারেন এই
বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে৷ এই বলেই
মহিনাথ কাদতে লাগলো। সবাই যেনো একটা ঘোরের  মধ্যে রয়েছে৷ মধুমিতা ফেল ফেল করে
তাঁকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে মধুমিতা
আমাকে কি যেনো একটা বলতে চায়৷ কিন্তু ভয়ে
বলতে পারছে  না। আমি মধুমিতার কাছে গিয়ে
বললাম 
– মা তুমি কি আমায় কিছু বলতে চাও আমাকে বলতে পারো,
– হ্যাঁ বাবা আমি আপনাকে আমার কিছু কথা বলতে চাই৷
– হ্যাঁ মা বলো কি বলবে৷

বাবা, আমার বাবা ছিলেন এই গ্রামের মাস্টার মশাই৷ 
তার একজন ছাত্র ছিলো নাম পার্থ মুখার্জি।  আমার বয়স তখন কতো হবে আঠারো বা উনিশ ৷ পার্থ
প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতো। বাবা ওকে পড়া
বুঝিয়ে দিতো।  আমি ওকে নিজের দাদার জায়গায়
বসিয়ে ছিলাম৷ ওকে আমি পার্থদা বলে ডাকতাম।
কিন্তু পার্থদা আমাকে কু চোখে দেখতো। আমার ক্ষতি করতে চাইতো। প্রথমে আমি বুঝতে না পারলেও পরে আমি ঠিকি বুঝতে পারি৷ একদিন বাবা তার কাজে কোথায় যেনো গিয়েছিলেন। বাসায়
আমি সম্পুর্ন একা ছিলাম। হঠাৎ কে যেনো দরজায়
কড়া দিলো। আমি মনে করছিলাম বাবা এসেছেন।
কিন্তু না, দরজা খুলে দেখি আমার সামনে পার্থদা দাড়িয়ে আছে ৷
পার্থদা আমায় বলতে লাগলো 
–  তোকে আমি যখন প্রথম দেখি ভালো বেসে ফেলি
তোকে। তোকে আমি আমার করে পেতে চাই, সুযোগ খুঁজছিলাম আমি, আজকে সেই সুযোগটা পেয়ে গেছি৷ আমার  হাত  থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না৷ এই বলে শয়তানটা আমার উপর
ঝাপিয়ে পরলো। এমন সময় বাবা চলে এলেন৷  
বাবা পার্থদাকে থাপ্পড় মারলেন৷ বাসা থেকে চলে
যেতে বললেন৷ পার্থ দা চলে গেলো।
যাওয়ার সময় বলে গেলো
– মধুমিধা শুধু আমার আর কারো না। ওকে যদি বিবাহ দেওয়ার চেস্টা করিস তাহলে ফল ভালোপ হবে না৷ এই বলে দিলুম ।

বাবা পার্থদার কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে পরে মহিনাথের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেন৷ বিয়ের
ছয় মাস পর বাবা মারা যান।  আমার বিশ্বাস বাবার
মৃত্যুর পেছনে পার্থদার হাত আছে। আর এই কাপালিক আর কেউ নয় সয়ং পার্থদা৷

বাবা আমাদের বাঁচান এই শয়তানটার হাত থেকে।

–  শুধু মাত্র নিজের কামনা আর প্রতিশোধ নেওয়ার
জন্য পার্থ কাপালিক হয়েছে৷ ওর চোখে আমি প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখেছি৷ ও সাধারণ কোন কাপালিক নয় মা। ও যে কি ভয়ানক কাজ করবে আজ রাতে তা আমার ধারনারও অতীত৷ মা মধুমিতা শোন মহিনাথ তুমিও শোন এই বিপদ থেকে
একমাত্র মা কালিই বাঁচাতে পারবেন৷

মহিনাথ মায়ের থেমে যাওয়া পুজো আবার চালু করার ব্যাবস্থা করো।  তার পর আমার  কিছু সমগ্রি
লাগবে সেগুলো এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে৷
বেশি দেরি করা যাবে না। আর মধুমিতাকে সব সময় চোখে চোখে রেখো। আমি একটা রুদ্রাক্ষ
দিচ্ছি ওকে  পরিয়ে দেও। এতে ওকে কোন অশুভ শক্তি কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

মহিনাথ আমার কথা মতো পুজো সম্পুর্ন করলো।
ভয়ে তখন সবাই জরো  হয়ে আছে। সবাই মহিনাথের দিকে তাঁকিয়ে আছে৷

আমি মহিনাথকে বললাম
– তুমি হচ্ছো এই গ্রামের জমিদার, তুমি ভেংগে পরলে গ্রামের সবার কি হবে।  নিজের মনে সাহস
আনো। দেখবে মা সব ঠিক করে দেবে৷
আমি যা বলছি বলছি তা আমায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনিয়ে দেও। আমি একটা যজ্ঞ করবো।

গ্রামের সকলকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাও৷ আমি একটা গন্ডি একে দিবো। ভুলেও যেনো
কেউ গন্ডির বাইরে পা না দেয়৷
মহিনাথ বলে উঠলো
– আর আপনি ঠাকুর মশাই, আপনি তো একা হয়ে যাবেন।
–  চিন্তা করো না মহিনাথ আমি মায়ের মন্দিরে বসে
যজ্ঞ করবো।
মা কালিকে ডাকো ভক্তি ভরে তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন।

মহিনাথ গ্রামের সকলকে একটা নিরাপদ জায়গায়
নিয়ে গেলো৷  তারপর মন্ত্র পড়া জল  মন্দিরের চারপাশে ছিটিয়ে দিলাম যাতে যজ্ঞে কোন অশুভ
শক্তি আমাকে বিরক্ত না করতে পারে৷ গাত্র বন্ধন মন্ত্র পরে নিজেকে বেধে ফেললাম। যদিও আমি জানি এতে কিছু হবার নয়৷

মধ্যরাতে আমি যজ্ঞে বসলাম হঠাৎ মহিনাথ আমার
কাছে এসে বলতে  লাগলো
– ঠাকুর মশাই সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মধুমিতাকে কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷

আমি বললাম
–  আমি বলেছিলাম মধুমিতাকে চোখে চোখে রাখতে। চলো আমার সাথে মধুমিতাকে এখনি খুঁজতে হবে  দেরি হয়ে গেলে মধুমিতাকে বাঁচাতে
পারবো না।

আমি আর মহিনাথ মধুমিতাকে খুঁজতে বের হলাম
কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি  মুধুমিতা শ্মশানের দিকে
হেঁটে যাচ্ছে। মহিনাথ মধুমিতাকে অনেক বার ডাকলো কিন্তু মধুমিতা ছাড়া দিচ্ছে না৷

আমি বললাম
– কোন লাভ নেই ওকে  ডেকো না৷ ও তোমার কথা
শুনতে পারবে না৷  হঠাৎই শুনতে পেলাম কেউ হাসছে আর বলছে
–  তারানাথ মধুমিতাকে যদি বাঁচাতে চাস তাহলে
মহিনাথ কে শ্মশানে নিয়ে আয়। আমি ওকে বলি
দিবো। ওকে বলি দিয়ে ওর রক্ত পান করবো৷ আমি হবো অমর হাহা হা নিয়ে আয় ওকে৷
আমি বললাম
–  চিন্তা করো না আমি আছি চলো আমার সাথে
শ্মশানে৷  তোমার আর মধুমিতার কিছু বলে না৷

আমি মহিনাথ কে শশ্মানের দিকে হাঁটটে লাগলাম৷
কেউ  আমার কানে কানে বলতে লাগলো
– তারানাথ এক মাত্র মহাকালিই পারে মহিনাথ আর
মধুমিতাকে বাঁচাতে।  তুমি মহাকালিকে জাগাও।
– কিন্তু আমি কিভাবে মহাকালিকে জাগাবো।
– ওঁম ওইং  ওম হ্রিম ক্লিম   ফট মহাকালি নমঃএই
মন্ত্রটা তুমি পুর্ব আকাশের দিকে চেয়ে হাজার বার
পড়বে।
আমি দেখলাম  মহিনাথও হেঁটে যাচ্ছে শ্মশানের দিকে৷  আমি মহিনাথের পিছু পিছু শ্মশানে গেলাম৷

দেখলাম মহিনাথ কে  একটা গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছে৷ আর পার্থ কত্তান হাতে নিয়ে মহিনাথের দিকে আগিয়ে যাচ্ছে।  আমি পুর্ব আমাকের দিকে  চেয়ে হাজার বার ওঁম ওইং  ওম হ্রিম ক্লিম   ফট মহাকালি নমঃ মন্ত্রটি পড়তে লাগলাম। পার্থ  মহিনাথের গলা বরাবর কোপ দিবে
এমন সময় দেখলাম পার্থ দাড়িয়ে আছে কোন
নড়াচোড়া করছে না৷ এদিকে আকাশ লাল হয়ে এসেছে। একটা চেহারা ভেসে উঠেছে পুর্ব আকাশে৷ 
দেখলাম আকাশ থেকে কি একটা এসে পার্থর মাথাটা দু ভাগ করে দিলো। শরীরটা লুটিয়ে পরলো
মাঠিতে৷  আমি তাড়াডাড়ি মহিনাথের হাতটা খুলে
দিলাম। দেখলাম একটা জায়গায় অজ্ঞান অবস্থায়
পরে আছে মধুমিতা৷ আমি মধুমিতার কাছে গিয়ে
মধুমিতার জ্ঞান ফিরালাম৷ 

গল্প বলার পর তারানাথ উঠতে যাবে এমন সময়
কিশোরী বললো
– আচ্ছা ঠাকুর মশাই পুর্ব আকাশে একটা চেহারা ভেসে উঠেছিলো কার চেহারা ছিলো ওটা৷

তারানাথ হেসে বললো
– তুমি বুঝতে পারো নি সয়ং কালি মা  মহাকালি রুপে আমার সামনে এসে ছিলো তিনিই মহিনাথ
আর মধুমিতাকে রক্ষা করেন।
                         সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত