প্রথম পরিচ্ছেদ
ওটা কী? কিসের আলো দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে? গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে একটা কালো গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। খুব কাছে চলে এসেছে আর মাত্র কয়েক মিটারের ব্যবধান,কিছুক্ষন পরেই সে ছিটকে পড়বে খাদের অতলে।
ঘুম ভেঙে উঠে বসলো অর্ণব। আবার সেই স্বপ্নটা, স্বপ্ন না বলে দুঃস্বপ্ন বলাটাই ভালো।এই দুঃস্বপ্ন টা সে গত তিন ধরে সে দেখে আসছে। এই শীতের রাত্রেও তার গা ঘামে ভিজে জবজব করছে। বিছানার পাশের বেড ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে দেখলো সময় রাত 2 টো, একগ্লাস জল ঢক ঢক করে খেলো সে।
অর্ণব খেয়াল করে দেখেছেন 3 দিন ধরে ঠিক এই সময়ে তাঁর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মিঃ অর্ণব রায়, আসানসোলের বিখ্যাত বিজনেসম্যান ও অন্যতম ধনী ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী মিসেস লীনা রায়, তাদের বিয়ে হয়েছে এক বছর হল। ভালই সংসার চলছে তবে এখন তার মিসেস গেছেন বাপের বাড়ী। অফিসের দরকারি কাজের জন্য অর্ণব যেতে পারেনি।
এখন ফিরে আসা যাক বর্তমানে । অর্ণব খুবই চিন্তিত স্বপ্নটা নিয়ে , একবছর আগে ঘটা ঘটনাটা হটাৎ করে তাকে আবার ভাবিয়ে তুলছে, দিনটা ছিল 25 শে ডিসেম্বর 2019, অর্ণব খ্রিস্টমাস পার্টিতে গিয়েছিল। পার্টি শেষ হতে হতে রাত দেড়টা বেজে গেছিলো।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ফিরে যাওয়া যাক সেই রাত্রের ঘটনায়,মিসেস রায় তাঁকে বারবার ফোন করছে তাই অর্ণব ঠিক করলো যে শর্টকাট রাস্তাটা দিয়ে যাবে, যদিও একটু রিস্ক আছে, রাস্তাটা একটা ব্রিজ খুবই পুরনো আর অন্ধকার,গাড়ি আসছে কিনা বোঝার উপায় নেই, একটু বেসামাল হলেই গড়িয়ে পড়তে হবে খাদে, তবে রাত বেশি হওয়ায় গাড়ি থাকবে না ভেবে অর্ণব সেই রাস্তা দিয়ে এগোতে থাকে। সেদিন তার নেশাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, ফুল ভলিউমে রোমান্টিক গান চালিয়ে ব্রিজ ধরে এগোচ্ছিল সে, হেডলাইট জ্বালায়নি ফাঁকা রাত থাকবে ভেবে , খেয়াল করেনি সামনে দিয়ে একটা কালো অ্যাম্বাসাডর আসছে, যখন খেয়াল করলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, অর্ণবের গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা মারলো সেই কালো অ্যাম্বাসাডরটাকে , গাড়িটা ব্রীজের দেওয়ালে ধাক্কা খেল, তারপর সব চুপচাপ।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অর্ণব এর হাত পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এলো, এ কি করল সে!!সে তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলো গাড়িটির কাছে,টর্চ বের করে জ্বালায় সে, দেখে গাড়ির ভিতরে একটি ছেলে ও মেয়ে, তারা বেঁচে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা, মনে মনে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে অর্ণব তাদের নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখলো মেয়েটির নিশ্বাস পড়ছেনা, কিন্তু ছেলেটির ক্ষীণ নিশ্বাস পড়ছে, অর্ণব প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো, মেয়েটির মাথায় কাঁচের টুকরো বিঁধে আছে, মেয়েটি মারা গেছে!!!!, ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে গেছে, অর্ণব প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো, যদি ছেলেটা উঠে তার সঙ্গিনীকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে নিশ্চয় তার পুলিশ কেস হবে এবং জেল অবধারিত। সে কিছুক্ষন ভাবলো, তার মনে পড়লো ব্রিজ তার শেষের দিকের দেয়াল টা অনেকটা ভাঙ্গা, একটা গাড়ি সেখান দিয়ে আরামসে ফেলে দেওয়া যাবে, তবে টা শক্তি সামর্থ, অর্ণব গাড়িটাকে থেকে শুরু হলো , 2 মিনিটের মাথায় সে ওখানটায় পৌঁছে গেলো, একটুখানি রেস্ট নিয়ে সে গাড়িটিকে আবার ঠেলতে শুরু করলো , এরপর গাড়িটা ব্রিজ থেকে খাদের অতলে গড়িয়ে পড়ল। তাঁর গা এই শীতের রাতেও ঘামে ভিজে গেছে, সে গাড়িতে উঠে এসি টা চালিয়ে দিল, সময় দেখলো রাত 2 টো বেজে পাঁচ, তারপর যদিও নিরাপদেই বাড়ি পৌঁছে গেছিলো সে।
খবরের কাগজে যদিও খবরটা বেরিয়েছিল তবে সেখানে সেটা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই ধরা হয়েছে, কেউ যে ধাক্কা মেরে ব্রিজ থেকে গাড়িটা ফেলে দিয়েছে একথা কারোর মাথায় সহজে আসবেনা।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কিন্তু হঠাৎ এতদিন পর, ঘটনাটা সে যখন প্রায় ভুলতেই বসেছে , তখন দুঃস্বপ্ন হয়ে বারবার ফিরে আসছে কেনো?? কোনো অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে নাকি!! এ যুগের ছেলে হয়ে অর্ণব এর এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে স্বপ্ন টা কোনো অশুভ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, তার অবচেতন মনে থাকা ঘটনাটা হয়তো কোনো যোগসূত্রের মাধ্যমে আবার বেরিয়ে এসেছে মনের লুক্কায়িত গহ্বর ছেড়ে। যাই হোক এতকিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে অর্ণব খেয়ালই করিনি, তাই সে আর না ঘুমিয়ে অফিসের ফাইলগুলো নিয়ে বসলো
অফিসে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে ক্যালেন্ডার এর দিকে চোখ পরতেই গা টা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে উঠলো, আজ 24 শে ডিসেম্বর , কালকের দিনেই সেই দুর্ঘটনাটা ঘটে ছিল।কাল আবার তার খ্রিস্টমাস পার্টি আছে, ফিরতে রাত হবে, হয়তো কালকের রাত্রেই ঘটনা ঘটেছিল বলেই সে দুঃস্বপ্ন টা দেখতে পাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কাকতালীয়।
24 শে ডিসেম্বর bolar moto kono উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি, তবে সেদিন রাত্রে তার ঘুমটা ভালো হয়েছিল, সেই দুঃস্বপ্নটা আর দেখেনি।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অবশেষে এলো সেই রাত, যে রাতের অপেক্ষায় এক নিষ্পাপ দম্পতি দিন গুনছিল।
25 শে ডিসেম্বর এর রাত যা অর্ণবের কাছে কালরাত্রি, সে জানতোনা স্বয়ং মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করছে।
পার্টি শেষ হতে হতে 1.30 বেজে গেলো, যথারীতি ড্রিংক করেছে সে, তবে আজ সে আর গান চালায়নি, যথেষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। সেরাত্রে কুয়াশাটা যেনো একটু বেশি গাঢ় হয়ে উঠেছিল, অর্ণব ঠিক করেছিল হাইওয়ে ধরেই ফিরবে, কুয়াশার মধ্যে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাহলে সে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা, তবে ব্রীজের মধ্যে হলে তার উপায় আছে। সে মনে মনে একটা কুটিল হাসি হেসে ড্রাইভিং করতে লাগলো হাইওয়ে ধরে। অনেক্ষন পর হঠাৎ তার মনে হল সে ব্রিজটির কাছে চলে এসেছে, গাড়িটা ধরে ধীরে হিমশীতল হয়ে উঠছে। সে কি চোখে ভুল দেখছে?? কোনো রাস্তায় দিয়ে এখন ব্রিজে আসা অসম্ভব। সে যাচ্ছিল হাইওয়ে দিয়ে, ব্রিজ টা সম্পূর্ণ উল্টোদিকে।
সে বুঝতে পারলো গাড়িটা যেনো তার বিশ্বে নেই, কোনো অমোঘ আকর্ষণে গাড়িটা যেনো সেইদিকে ছুটে চলেছে। ব্রিজ টা কে সম্পূর্ন9 দেখাও যাচ্ছে, ঘন কালো কুয়াশা বৃধেটাকে ঢেকে ফেলেছে । কুয়াশা ভেদ করে এক ঝলক তীব্র আলো অর্ণব কে বাধ্য করলো চোখ ঢেকে ফেলতে। একটা কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি তার দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে, আসন্ন পরিস্থিতির কথা ভেবে শিউরে উঠলো। কিন্তু গাড়িটা তার গাড়ির সামনে এসে যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, শুধু একরাশ ঠান্ডা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলো।
অর্ণব গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পেছনে তাকালো, ও- ও- ও রা কারা দাঁড়িয়ে !!? সেই ছেলে ও মেয়েটা যাদের সে আগের বছর গাড়ি সুদ্ধ খাদের অতলে ফেলে দিয়েছিল, এটা কি তার চোখের ভ্রম না বাস্তব??!!নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছেন আজ। সে একটা ঝাঁকুনিতে টের পেল তার গাড়িটা নিজে নিজে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ভাঙ্গা পাঁচিলটার দিকে। সে গাড়ির ব্রেক মারলো কিন্তু কাজ করলনা। সে দরজা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু দরজা যেনো সিল করা। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ণবের গাড়ি গড়িয়ে পড়লো খাদে । হয়তো এইভাবে সেই রাতের দম্পতি তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল, যা অর্ণবের প্রাপ্য ছিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আসানসোল, 26 শে ডিসেম্বর: বিখ্যাত ব্যবসায়ী মিঃ অর্ণব রায় ,গতরাতের পার্টি থেকে গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনাবশত ব্রিজ থেকে খাদে পরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মিসেস লীনা রায় তার স্বামী বাড়ি না ফেরায় পুলিশ কে জানান. তদন্তের পরে তাঁর গাড়িটি খাদে চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায় এবং খাদের গায়ের একটা গাছের ডালে মিঃ অর্ণব রায়ের মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।।
সমাপ্ত
