হাড় কাঁপানো ভয়

হাড় কাঁপানো ভয়

আমার এক আত্মীয়, নাম ফাকিহা হায়দার। ল-পাস, কিন্তু ওকালতি করে না। বেসরকারি একটা অফিসের আইন বিভাগীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বান্ধবীকে সাথে নিয়ে ঢাকায় থাকে। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। মুগদার ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকে দু’জন।
এরই মধ্যে একদিন জানতে পারলাম বিয়ে হয়ে গেছে ফাকিহার। বরও উচ্চশিক্ষিত। একটা কোম্পানির মালিক। বিয়ে হয়ে যাবার প্রায় মাসখানিক পর আচমকা একদিন গুলিস্তানের মোড়ে দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে আমার। আমাকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা ফাকিহা।
‘আ-রে হাকিম ভাই যে! কি ভাগ্য আমার! আপনাকেই তো খুঁজছিলাম মনে মনে।’
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ?’
‘কেন, আপনার খোঁজ করাটা কি অন্যায় না বারণ?’ বলল ফাকিহা।
‘বললাম, ‘আরে না না , ঠিক তা বলিনি। আসলে অনেক দিন দেখা নেই তো…’
‘বুঝেঝি, বুঝেঝি,’ আমার কথায় বাদ সেধে বসল মেয়েটা, তারপর আচমকা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘শুনুন, আপনি তো অনেক কিছুর খোঁজ রাখেন। আমাকে একটা বাড়ি খুঁজে দিতে পারবেন?’
‘কিনবে?’ ভুরু নাচালাম আমি।
‘নাহ্, ভাড়া নেব। দু’জন মানুষ থাকার মতো হলেই চলবে।’
ফাকিহাকে আশ্বস্ত করে পরদিন থেকেই লেগে গেলাম, বাসা খোঁজার কাজে। শুধু নিজেই নয়, আরও দু-একজন বন্ধু-বান্ধবকেও লাগিয়ে দিলাম।
কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকটা বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। আমি, ফাকিহা আর তার স্বামী ইউসুফ মিলে একবার ঢু মেরে এলাম বাড়িগুলো থেকে। কিন্তু এমনই খুঁতখুঁতে মেয়ে ফাকিহা, একটা বাসাও পছন্দ করল না।
আবার শুরু হলো বাসার খোঁজ। ঢাকার বাজারে মনমত বাসা পাওয়াটাও এক বিরাট ঝক্কি। কেটে গেল একমাস, দু’মাস, তিন মাস। অবশেষে দেখা মিলল তার। ৩৩/৬, সেগুনবাগিচা। একটু পুরানো বাড়ি। শীর্ণ। যদিও সদ্য রং করা হয়েছে। দুটো কামরা। বারান্দা, বাথরুম সংলগ্ন। ভাড়াও কম। বাড়ির মালিক দোতলায় থাকেন। আশপাশে লোকজন কম। নির্জন পরিবেশ। দেখামাত্র পছন্দ করে ফেলল ফাকিহা।
এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ফাকিহাদের বাসায়। কিন্তু একদিন বাসায় বসে দু’তিনজন বন্ধুর সাথে গল্প করছি, হঠাৎ ফাকিহা এসে হাজির। প্রথম নজরেই মনে হলো মেয়েটার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। পরিশ্রান্ত ভাব।
বন্ধুদের বিদায় দিয়ে ফাকিহার সামনে এসে বসলাম আমি। আমাকে দেখে ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে, হাকিম ভাই।’
‘সে তো তোমার চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছি’, নরম সুরে বললাম আমি। ‘কি ব্যাপার? শরীর খারাপ?’
‘জ্বী না, তবে…’ থেমে গেল ফাকিহা। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলাম আমি, ‘খারাপ কিছু ?’
‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল সে। ‘রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না।’
‘সে কি! ঘুম না হওয়া তো খুব খারাপ রোগ। ডাক্তার দেখিয়েছ?’
‘ডাক্তার কিছু করতে পারবে না, হাকিম ভাই,’ ফাকিহার নিরাসক্ত উত্তর।
‘তার মানে!’
‘মানে…হাকিম ভাই,’ একটা ঢোক গিলে কিছুক্ষণ থেমে রইল ফাকিহা, ‘ওই বাসাটা ঠিক ভাল না…।’
তার কথা শুনে কেন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার বুকের ভেতর। বললাম, ‘কেন, বাসাটা তো বেশ পছন্দ করেছিলে তোমরা। তাছাড়া নিরিবিলিতে থাকাটা যখন তোমাদের পছন্দ…’
‘সেসব কিছু নয়, অন্য একটা ভয় আছে বাসাটাতে।’
কম্পিত কণ্ঠে কথা বলছে ফাকিহা, লক্ষ করছি, কেমন যেন ইতস্তত করছে সে আসল কথাটা বলতে। সময় নিচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুচছে কপাল।
বললাম, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ফাকিহা, তোমার কথা।’
আমার কথা যেন কানেও যায়নি এমনই ভঙ্গিতে সে বলল, ‘ওই বাড়িতে আমরা দু’জন ছাড়াও অন্য কেউ একজন আছে, হাকিম ভাই।’
ওর কথা শুনে শিরশির করে উঠল আমার মেরুদণ্ড। ‘অন্য কেউ মানে?’
‘মানে মানে, তৃতীয় কেউ একজন,’ কম্পিত কণ্ঠে বলল ফাকিহা। ‘তাকে প্রায় রাতেই দেখি আমি, অন্ধকার হলেই বের হয় মানুষটা। যন্ত্রণায় বিদগ্ধ হয়ে… উফ, হাকিম ভাই, বিশ্বাস করুন, একটুও বানিয়ে বলছি না আমি। জানি ভূতে বিশ্বাস নেই আপনার। কিন্তু মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী আমি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, অতৃপ্ত কামনা নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে যায় যারা, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা হয়ে আবার ওরা ফিরে আসে পৃথিবীতে। কেঁদে কেঁদে বেড়ায় আমাদের চারপাশে। কেউ দেখতে পায় না ওদের। আর যখন পায়…’ আতঙ্কে চোখ বুজে কেঁপে উঠল সে।
ওকে একটু শান্ত করার জন্য বললাম, ‘শোনো ফাকিহা, তোমার আসলে কিছু কোথাও ভুল হচ্ছে।’
‘না হাকিম ভাই, আমি ভুল করিনি,’ মাথা নেড়ে বলল ফাকিহা। ‘আসলে আমার ভুল, প্রথম থেকেই ঘটনাটা খুলে বলা দরকার ছিল আপনাকে। হ্যাঁ, বরং তাই বলি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে, মনে মনে গুছিয়ে নিল ঘটনা। তারপর বলল, ‘শুনুন তাহলে…
‘মাস দু’য়েক আগের কথা। মাঝ রাতের দিকে হঠাৎ ‘‘খুট’’ করে একটা শব্দ কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো, ড্রইংরুম থেকে যেন কার পায়ের আওয়াজ আসছে। ইউসুফ পাশেই শুয়েছিল। ওর ঘুমের ছিরি তো জানেনই। বুকের ওপর দিয়ে হাতি হেঁটে গেলেও ঘুম ভাঙবে না। তাই ওকে ডাকার চেষ্টা না করে নিজেই উঠে পড়লাম।
‘প্রথমে জানালা দিয়ে তাকালাম পাশের ঘরে। চোখে কিছুই পড়ল না, কিন্তু ‘‘খুটখাট’’ শব্দগুলো তখনও কানে আসছে আমার। মনে হলো শক্ত কিছু পায়ে দিয়ে কে যেন অস্থিরভাবে পায়চারি করছে সারা ঘর। অথচ কোন লোকজন চোখে পড়ছে না। রাতে মাংস রান্না হয়েছিল। একবার ভাবলাম, ইঁদুরের উৎপাত বোধহয়, শব্দের উৎসটা ওখান থেকেই…। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এল না। এপাশ-ওপাশ করছি। অথচ আমার পাশের মানুষটি অকাতরে ঘুমাচ্ছে। বিচিত্র সব আওয়াজ করছে নাক দিয়ে।
‘হাকিম ভাই, আপনি তো জানেন, ছোটবেলা থেকেই বরাবরের অভ্যাস আমার, অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না। তাই জিরো পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বালিয়ে রেখেছিলাম ঘরে। এরই মধ্যে লক্ষ করলাম দীর্ঘ একটা ছায়া অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে এঘর থেকে অন্যঘরে চলে গেল।
‘ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। ইউসুফকে ডেকে বললাম, ‘‘এই ওঠো, ওঠো। ঘরে লোক ঢুকেছে।’’ আশ্চর্য মানুষ। চোখ পর্যন্ত খুলল না। বরং পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, ‘‘ওসব কিছু না, ঘুমিয়ে পড়ো।’’
‘ছায়াটা সরে সেই যে দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল, তারপর আর দেখিনি ওটাকে। অথচ মনকে কিছুতেই যুৎসই ব্যাখ্যা দিয়ে শান্ত করতে পারছি না। ছায়া দেখা গেল অথচ মানুষ দেখা গেল না—এ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। হতেই পারে না।’
একটানা কথাগুলো বলে থামল ফাকিহা। পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গলা ভেজাতে বললাম আমি। ঢকঢক করে কয়েক গ্লাস বেমালুম গিলে সে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
প্রত্যুত্তরে হাসলাম আমি। ‘তারপর?’
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল ফাকিহা। ‘তারপর,’ আবার বলতে শুরু করল সে, ‘কয়েকদিন বেশ স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল। কোন গোলমাল নেই। সেদিন রাতে যে অমন ভয় পেয়েছিলাম ভাবতেই লজ্জা লাগে। একেবারেই ছেলেমানুষী কাণ্ড। এরই মধ্যে হঠাৎ অফিসের কাজে সিলেট গেল ইউসুফ। বেশি দিন নয়, মাত্র দু’দিনের জন্য।
‘বাড়িতে আমি একা। তখন রাত কত হবে, এই একটা কি দেড়টা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এবারে স্পষ্ট দেখলাম জিনিসটাকে। দীর্ঘ, একহারা চেহারা, খালি গায়ের সমস্তটা অংশ পুড়ে ঝলসে গেছে, খসে খসে পড়ছে মাংস। দাঁতের মাড়ি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, সামনের দিকে ঝুলে আছে জিভ। মুখের কিছু অংশ পুড়ে চোয়াল ঠেলে বেরিয়ে এসেছে দাঁত। ঘরের ভেতরে কি যেন খুঁজছে সে অস্থিরভাবে।’
‘সেই মুহূর্তে রক্ত জমে হিম হয়ে যায় আমার। মনে হলো, তখনই বোধহয় হার্টফেল করব। ‘গলায় জোর নেই, তবু বিকৃত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘‘কে, কে ওখানে?’’
‘জবাব নেই। মাংসপিণ্ডের ঝলসানো অংশটা ফিরে তাকাল আমার দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি! পলকহীন! কলজে বেরিয়ে আসার উপক্রম আমার। তখনই মনে হলো, ওটা এ জগতের কিছু নয়, কোন অতৃপ্ত আত্মা। অতৃপ্ত থাকায় আবার ফিরে এসেছে আমাদের এই সংসারে।’ কথাগুলো বলতে বলতে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে এল ফাকিহার চেহারা।
ওর কথা শুনে কতটুকু ভয় পেলাম বা বিশ্বাস করলাম জানি না, তবে বলে বসলাম, ‘ওসব যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বাসাটা ছেড়ে দিলেই পারো।’
‘হ্যাঁ, ছেড়েই দেব,’ মাথা মাথা ওপর-নিচ করল ফাকিহা। ‘কিন্তু সমস্যা হয়েছে ইউসুফকে নিয়ে।’
প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম। ‘আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না সে। বলছে, এসব নাকি আমার চোখের ভুল। অতিমাত্রায় হরর ফিল্ম দেখার ফল।’
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ফাকিহা, তোমার প্রবলেমটা বুঝতে পারছি আমি। কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না তোমাকে। করবে বলে মনেও হয় না। তবে আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। তোমার কথা বিশ্বাস করেছি আমি। কাল সময় হবে না, পরশু তোমাদের বাসায় যাব আমি।’
চলে গেল ফাকিহা। মাঝে একদিন বাদ দিয়ে পরদিনই গিয়ে হাজির হলাম ফাকিহাদের বাসায়। কিন্তু গিয়েও কোন লাভ হলো না। জানতে পারলাম অফিসের কাজে আবার কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছে ইউসুফ। অগত্যা ফাকিহার সাথে কথা বলেই ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় কাকুতি ঝরে পড়ল মেয়েটির কণ্ঠে, ‘হাকিম ভাই, প্লিজ, যদি কিছু মনে না করেন, আমাদের বাড়িঅলার সাথে একবার কথা বলতে বলছিলাম আপনাকে।’
‘না না, এতে মনে করার কি আছে। আমি আজই যাবার সময় দেখা করে যাব ভদ্রলোকের সঙ্গে।’
আরও কিছু সময় গল্পগুজব করে কাটালাম আমরা। তারপর সন্ধের কিছু আগে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। কেন যেন ফাকিহার জন্য মনে মনে একটু কষ্ট অনুভব করলাম আমি। ইস, সারাটা রাত আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হবে মেয়েটাকে। কিছু অঘটন
ঘটিয়ে না বসে।
ফাকিহাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি, হাজির হলাম বাড়িঅলার ওখানে। ভদ্রলোক বাসায়ই আছেন। শ্যামলা বর্ণের গোলগাল চেহারা। ইয়া বড় মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। আমার মুখে তার বাসার ব্যাপারে ভৌতিক কথাবার্তা শুনে তো মহা খাপ্পা।
‘কি বলছেন এসব! এটা ভুতুড়ে বাসা! এই বিজ্ঞানের যুগেও ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী আপনি? যত্তসব!’ রাগে লালচে আভা ধারণ করল তাঁর গাল।
অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এ ধরনের কথা আশা করিনি। দ্রুত তাঁর নাকের সামনে হাত নেড়ে বললাম, ‘দেখুন, আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি কিছু বলিনি যে বাসাটা ভুতুড়ে, শুধু জানতে চেয়েছি ওখানে কেউ অপঘাতে মরেছে কিনা।’
খেঁকিয়ে উঠলেন বাড়িঅলা, ‘অপঘাত তো দূরের কথা, কস্মিনকালেও কেউ মরেনি ও বাসায়। যত্তসব গাঁজাখুরি কথাবার্তা!’
ভদ্রলোকের কথা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল আমার। তবু নীরবে বিদায় নিলাম সেখান থেকে।
এরপর প্রায় দু’মাস আর দেখা নেই ফাকিহার। মনে মনে স্বস্তি পেলাম আমি, যাক তাহলে ভাল আছে হয়তো ওরা। কিন্তু আমার স্বস্তিকে অস্বস্তিতে পরিণত করে একদিন ইউসুফ এসে হাজির। একা। কোটরাগত চোখ, বিবর্ণ মুখ, ঘোলাটে দৃষ্টি। বললাম, ‘কি হে, শরীর খারাপ নাকি? ফাকিহা কেমন আছে?’
আমার কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল, ‘প্লিজ, সব বলছি, আগে একটু পানি খাওয়ান।’
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগল না আমার। তাড়াতাড়ি এক জগ পানি আর গ্লাস এনে ধরিয়ে দিলাম তার হাতে। পানি খেয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে তাকাল আমার দিকে। ‘হাকিম ভাই, ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটে গেছে গতকাল রাতে।’ ফাকিহাকে ধানমন্ডিতে ওর মামীর বাসায় রেখে এসেছি আমি।’
‘কেন, কী হয়েছে?’ হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল আমার। এতক্ষণ সরাসরি আমার দিকে চেয়ে ছিল ইউসুফ, এবারে দৃষ্টি নামিয়ে বলল, ‘আপনি তো…ইয়ে…সবই জানেন, মানে ফাকিহার মুখে সবই শুনেছেন। আমি কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কিছুই দেখিনি। তাই এতদিন ঠাট্টা করে এসেছি ফাকিহার সাথে। তাছাড়া ভূত-প্রেতে বিশ্বাসও নেই আমার।
‘গত রাতে এক বন্ধুর ম্যারিজ ডে থেকে ফিরেছি আমি আর ফাকিহা, রাত বারোটা বোধহয় তখন। বাসায় এসে দেখি কারেন্ট নেই। চারদিকে বিদঘুটে অন্ধকার। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই একটা তীব্র দুর্গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। মনে হলো বাসার ভেতর থেকেই আসছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, গন্ধটা একটুও অনুভব করতে পারল না ফাকিহা। শুধু আমার নাকেই আসছে। অনেক চেষ্টা করেও অনুমান করতে পারলাম না গন্ধটা কিসের।
‘এরপর ফাকিহাকে বেডরুমে রেখে রান্নাঘরের উদ্দেশে রওনা হলাম আমি মোমবাতি আনতে। রান্নাঘরে ঢুকছি, আগের দুর্গন্ধটা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল। অবাক বিস্ময়ে শুনতে পেলাম কে যেন গোঙাচ্ছে রান্নাঘরের ভেতরে। ছুটে গেলাম তাড়াতাড়ি। আর গিয়েই যা দেখলাম…ইয়ে…বিশ্বাস করবেন না হাকিম ভাই, দেখলাম একটা জলজ্যান্ত মানুষের অর্ধেকটা শরীর পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গেছে। চুল, ভুরু সব পুড়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে গোটা চেহারা। দেখে মনে হলো এই মাত্র গোরস্তান থেকে উঠে এসেছে নরকের পিশাচটা। এখনও মৃদুমৃদু ধোঁয়া উঠছে ওটার পোড়া শরীর থেকে। চামড়া পোড়ার অসহনীয় দুগর্ন্ধ হড়হড় করে বমি করে দিলাম আমি।
‘ওদিকে আমার দেরি দেখে কখন যেন রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে ফাকিহা। আমাকে বমি করতে দেখেই ছুটে এল সে অথচ হাজার চেষ্টা করেও ওকে কিছুতেই দেখাতে পারলাম না মাংসপিণ্ডের আধপোড়া অংশটা।’ কথাগুলো বলতে বলতে মাথা চেপে ধরল ইউসুফ। বুঝতে পারলাম প্রচুর ভয় পেয়েছে বেচারা।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর? মাথা ঝাঁকাল সে, ‘রাতটা কোনরকমে বাসাতেই কাটিয়ে দিলাম দু’জনে, যদিও আর কিছুই ঘটল না। কিছু দেখতে না পেলেও আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে ফাকিহা। কারণ এসবের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে ওর। আজ সকালে ওকে ধানমন্ডিতে রেখে এসেছি। তারপর এসেছি আপনার কাছে।’
‘কেন? শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার। ইতস্তত করল ইউসুফ, ‘হাকিম ভাই, ফাকিহার ইচ্ছা বাসায় একবার যান আপনি। মানে আমার দেখাটা সত্যি কিনা…ইয়ে…ওই রান্নাঘরে…।’
এক ঘণ্টার মধ্যে ইউসুফকে নিয়ে হাজির হলাম সেগুনবাগিচায়।
তালা লাগানো রয়েছে দরোজায়, খুলে সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে। এদিক-ওদিক চেয়ে একটু যেন সাহস ফিরে পেলাম। জানতে চাইলাম, ‘কই হে, তোমার সেই আধপোড়া মাংসপিণ্ডটা কোথায়?’
‘অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইউসুফ, উসখুস করতে করতে বলল, ‘ইয়ে… তবে কি ভুল দেখলাম রাতে…?’
‘হয়তো,’ বলেই ভুল বুঝতে পারলাম নিজের, হঠাৎ মাংসপোড়ার বীভৎস একটা দুর্গন্ধ ধাক্কা মারল আমার নাকে। আতঙ্কিত চোখে ইউসুফের দিকে চেয়ে দেখি, একই দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে সে।
গন্ধটা যে মাংসপোড়ার সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না আমার মনে। কারণ বহুদিন আগে এক হিন্দু বন্ধুর মায়ের সৎকারে শ্মশানে গিয়েছিলাম। বৃদ্ধাকে চিতায় শুইয়ে যখন গায়ে আগুন ধরানো হলো, ঠিক এমনই অসহনীয় একটা গন্ধ পেয়েছিলাম।
ভাবছি, এ ঘটনার সত্যি কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা। শত চেষ্টায়ও ভেবে পেলাম না কিছু। এদিকে ভূতে বিশ্বাস করতেও মন চাইছে না।
এরপর আর ওই বাসায় ফিরে যায়নি ফাকিহারা। পরদিনই উঠে পড়েছে অন্য বাসায়।
এ ঘটনার প্রায় মাসখানেক পর হঠাৎ একদিন ওই বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক কেন যেন থতমত খেয়ে গেলেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তাঁকে বললাম, ‘এই যে মিস্টার, ভণিতা না করে এবারে ঝেড়ে কাশুন তো। এর আগে কি ঘটেছিল আপনার বাসায়?’
না, কিছুতেই মুখ খুলবেন না ভদ্রলোক। কিন্তু আমিও কম নাছোড়বান্দা নই। শেষ পর্যন্ত ভীষণ পীড়াপীড়ির মাঝে পড়ে হড়হড় করে সব বলতে শুরু করলেন তিনি।
‘দেখুন…মানে…ইয়ে, আপনার ধারণাই ঠিক। আজ থেকে দু’বছর আগে ওই বাসায় একজন বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেন। কুষ্ঠরোগে ভুগছিলেন। স্ত্রী বহু আগেই মারা গেছেন। কি যেন নাম ছিল, ও হ্যাঁ, এনামুল্লা চৌধুরী। তিন ছেলের বাপ। বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন রোগে। হতভাগ্য ছিলেন তিনি। তিন ছেলে অথবা ছেলের বউরা, কেউই দু’চোখে সহ্য করতে পারত না বৃদ্ধকে। অবহেলা, অনাদরে ধীরে ধীরে রোগ বাড়তে থাকে, সেই সাথে যন্ত্রণাও। ঘেন্না করে, এড়িয়ে চলে কুষ্ঠরোগী বলে।
এভাবেই দিন চলছিল। কিন্তু কতদিন? এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেছেন বৃদ্ধ। জীবনে ওই প্রথম মানুষ পোড়া গন্ধ নাকে পেয়েছি আমি,’ বলেই নাক কোঁচকালেন বাড়িঅলা। হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।.

………………………………….(সমাপ্ত)……………………………….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত