রাক্ষস রাজ্যে আজ খুশির বন্যা বইছে। রাজ্যজুড়ে হুম, হাম, দুম, দাম শব্দ হচ্ছে। রাক্ষসরাজা মন্ত্রীকে ডাকলেন – মন্ত্রী?
– জি হুজুর।
– শব্দ এতো কম হচ্ছে কেন? শব্দ বাড়াতে হবে। তুমি শব্দের ব্যবস্থা করো।
– জি হুজুর। আমি এখনই যাচ্ছি। পুরো রাজ্য এবার টের পাবে, শব্দ কাকে বলে!
– ৬০০ বছর পর আমার একটা পুত্র হয়েছে, এটা কি আনন্দের সংবাদ নয়?
– অবশ্যই আনন্দের সংবাদ। হুজুর ঘুমানোর আগে দুই মিনিট জানালাটা খোলা রেখে শব্দের ব্যাপারটা খেয়াল করবেন। শব্দ আপনার পছন্দ না হলে নতুন ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্ত্রী চলে গেলেন। রাজা এলেন রাক্ষসী রানীর ঘরে। রাক্ষসরাজা তার পুত্র দেখে মুগ্ধ। রাক্ষস-রাক্ষসীর মনে আজ খুব আনন্দ।
রাজ্যের উৎসব নিয়ে রাজার মনে দুঃখ ছিল, এখন তাও নেই। মন্ত্রী ভালোই ব্যবস্থা নিয়েছে। দুম-দাম শব্দ বেড়েই চলছে।
বেশ কয়েক বছর পর। রাক্ষসরাজা তার দরবারে মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজ্য নিয়ে আলোচনা করছেন। এমন সময় ঝড়ের বেগে রানী দরবারে ঢুকলেন তার রাজপুত্রকে কোলে করে।
রানী চিৎকার করছেন। মহারাজ মহারাজ এদিকে দেখুন, দারুণ ঘটনা ঘটেছে।
রানী রাজার কোলে রাজপুত্রকে দিল। রাজা করুন ঘটনার কিছুই বুঝতে পারলেন না।
উপস্থিত মন্ত্রীরা সবাই একে একে রাজপুত্রকে কোলে নিল। তারাও কিছু বুঝলো না।
এবার রানী বললো, আমাদের রাক্ষসপুত্রের দাঁত উঠেছে।
রাজা বললেন, ওয়াও।
তিনি রাজপুত্রের ঠোঁট আঙুল দিয়ে একটু ফাঁক করে দাঁত দেখতে চাইলেন, কিন্তু কোনো দাঁত দেখা গেল না।
দরবারের সবাই একে একে ঠোঁট ফাঁক করে দেখলো। কিন্তু কেউ দাঁত খুঁজে পেল না।
রানী বললেন, দাঁত একটা উঠেছে। তবে সেটা মাড়ির দাঁত।
রাজা বললেন, এটা কেমন কথা, দাঁত উঠলে প্রথমে সামনের দাঁত ওঠার কথা।
রাজা এবার রাজপুত্রের মুখ টেনে হা করিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। রানী ঠিকই বলেছে। রাজপুত্রের ডানপাশের ওপরের মাড়িতে ছোট্ট একটা দাঁত দেখা যাচ্ছে।
দরবারের সবাই একে একে সেই মাড়ির দাঁত দেখলো।
রাজা ঘোষণা করলেন, আমার পুত্রের দাঁত উঠেছে। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। আজ সারাদিন রাজ্যে উৎসব চলবে।
দরবারের সবাই উৎসবের ব্যবস্থা নিতে চলে গেলেন।
আরো বেশ কয়েক বছর পর রাজা-রানী খাটের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছেন।
রাজা বললেন, রানী …
রানী বললেন, জি মহারাজ …
– ঘটনা কিছু বুঝতে পারছো।
– জি না মহারাজ।
– আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।
রাজা-রানীর সামনেই রাক্ষসপুত্র লাল রঙের একটা বল নিয়ে খেলছে।
মহারাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এ বয়সের রাক্ষসদের মুখভর্তি দাঁত থাকে। তারা সমানে কামড়াকামড়ি করে। আর আমাদের ছেলের দাঁত মাত্র একটা।
রানী বললেন, তুমি ভেবো না, বয়স হোক ঠিক হয়ে যাবে।
রাজা গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যাঁ, বয়স হলে বুড়ো হবে, তখন ওই একমাত্র দাঁতও পড়ে যাবে।
রাক্ষসপুত্র এখন যুবক। তার মনে অনেক দুঃখ, তার মুখের ভেতরে একটি মাত্র দাঁত। সে কোনো শক্ত খাবার খেতে পারে না।
অথচ অন্য রাক্ষসরা সবাই কামড়ে কামড়ে কত্তো মজার মজার খাবার খায়। সে একদিন রাজ্য ছেড়ে চলে গেল।
রাক্ষসপুত্র মানুষের দেশে হাজির হয়েছে। সে সারাদিন শহরে ঘুরে বেড়ালো, যা দেখে তাতেই সে অবাক হয়।
সে খুবই অবাক হলো সূর্য ডোবার পরও মানুষ ঘরে যায় না। তখন রাস্তাঘাট সব উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে।
রাতের শহরে হাঁটতে তার আরো ভালো লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে সে এক নিরিবিলি এলাকায় চলে এলো। এখানকার রাস্তাঘাট কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা।
অন্য রাস্তার তুলনায় এখানে আলোও বেশ কম। হঠাৎ রাক্ষসপুত্রের চোখে পড়লো এক মহিলার ব্যাগ ধরে তিনজন ছেলে টানাটানি করছে। রাক্ষসপুত্র সেদিকে গেল।
সে ছেলে তিনজনকে বললো, কি ভাই, আপনারা ওনার ব্যাগ টানছেন কেন?
সেই তিনজনের একজন কোনো কথা না বলে তার মাথায় লোহার একটা রড দিয়ে বাড়ি দিল। এতে রাক্ষসপুত্রের বেশ মেজাজ খারাপ হলো।
সে তিনজনকে ধরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলো। তিনজন এতোই অবাক হয়েছে যে, ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করতেও ভুলে গেছে।
রাক্ষসপুত্র এবার মহিলাকে বললো, চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই।
ভদ্র মহিলা বললেন, বাবা, আমি সামনের ওই হাসপাতালে চাকরি করি। চলো, তোমার মাথায় আঘাত লেগেছে কি না পরীক্ষা করে দেখবো।
রাক্ষসপুত্র বেশ অবাক হলো। মাথা আবার পরীক্ষা করে কিভাবে?
সে কোনো কথা না বলে হাসপাতালে এলো। ডাক্তার তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে বললেন, তুমি তো একদম সুস্থ। আচ্ছা তোমার শরীরে অন্য কোনো সমস্যা নেই তো?
রাক্ষসপুত্র একটু চিন্তা করে বললো, আমার মুখে একটা দাঁত আছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই।
এবার ভদ্র মহিলা বললেন, আচ্ছা তাহলে তুমি আমার রুমে আসো। আমি একজন ডেন্টিস্ট।
তিনি সব দেখে শুনে রাক্ষসপুত্রের মুখে পাথরের দাঁত লাগিয়ে দিলেন। তবে তিনি কোনো পয়সা নিলেন না। অবশ্য পয়সা চাইলেও রাক্ষসপুত্র দিতে পারতো না।
রাক্ষসপুত্র হাসিমুখে তার রাজ্যে ফিরে গেল।
রাক্ষস রাজ্যে আজ খুশির জোয়ার বইছে। রাজা-রানী মহাখুশি, তাদের ছেলের মুখভর্তি দাঁত হয়েছে।
তবে তাদের মনে একটু খুঁতখুঁতানি আছে। তাদের ছেলের দাঁতগুলো কেমন যেন ভোঁতা ধরনের। আর একটু ধারালো হলে ভালো হতো।
দাঁত তো ভোঁতা হবেই। ডেন্টিস্ট তো আর বোঝেনি সে রাক্ষসের মুখে দাঁত লাগিয়েছে।