ভয়ংকর আত্মা

ভয়ংকর আত্মা

হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতাল। বেড নং ১১১। বেডের উপর পায়ে শিকল দিয়ে বাধা ৩০-৩২ বয়সী এক সুদর্শন পুরুষ শুয়ে আছে আর মিনমিনিয়ে কি যেনো বলে

যাচ্ছে। গতকালই এই পেশেন্টকে ভর্তি করা হয়েছে। পেশেন্টের নাম আবির রহমান। হাসপাতালের স্টাফ নার্স সুমির উপর দায়িত্ব পড়েছে সার্বক্ষণিক আবির

রহমানকে দেখাশুনো করার। খুব বেশিদিন হয়নি সুমি এখানে জয়েন করেছে। খুব শান্ত স্বভাবের সুমির সেবা শুশ্রূষা পেয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীগুলো খুব

সহজেই সুস্থ হতে শুরু করে। সুমি টেবিলের উপর রাখা আবির রহমানের ফাইলটা হাতে নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো।

নাম:আবির রহমান
বয়স: ৩১
পেশা: ডাক্তার
একজন ডাক্তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এভাবে শিকলে বাধা অবস্থায় আছে দেখে সুমি অবাক হবার সাথে সাথে কষ্টও পেলো।

রোগীর বিস্তারিত:
ডা: আবির রহমান ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন অবন্তিকা রহমানকে। ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না দুজনের সংসারে। আসলে অবন্তিকা মেয়েটাই ছিলো

অন্যরকম। অপরিসীম ভালোবাসা দিয়ে সব সময় মাতিয়ে রাখতেন পিতা-মাতাহীন আবির রহমানকে। ডাঃ আবির অবন্তিকে প্রথম দেখেছিলেন টাংগাইলের একটা

ক্লিনিকে সাপ্তাহিক ডাক্তার হিসেবে চেম্বার করতে গিয়ে। তখন ছিলো শীতকাল। শুক্রবার সকাল সকাল নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে টাংগাইলের উদ্দেশ্যে

বেড়িয়ে পড়েন আবির রহমান। ক্লিনিকে পৌছাতে পৌছাতে ১০টা বেজে যায়। নিজের চেম্বারে বসে সদ্য আসা মেইলটা চেক করছিলেন ডাঃ আবির। এরমধ্যেই প্রথম

রোগী প্রবেশ করলো। রোগীর দিকে না তাকিয়েই নিজের প্যাড বের করে ডাঃ আবির নাম জিজ্ঞেস করলেন।

-জী আমার নাম অবন্তিকা।
মিষ্টি একটা কন্ঠ সেদিন ডাঃ আবিরের কলিজায় আঘাত করেছিলো। মাথা নিচু থেকে উচু করে অবন্তিকা নামের রোগীর দিকে তাকালেন ডাঃ আবির। নিজের চোখ

যেনো নিজের সাথে প্রতারণা শুরু করে দিয়েছিলো সেদিন। একটা মেয়ে এতোটা সুন্দর হতে পাড়ে অবন্তিকাকে না দেখলে জানতেনই না ডাঃ আবির। প্রয়োজনীয়

চিকিৎসা দিয়ে অবন্তিকার ঠিকানা রেখে দিয়েছিলেন সেদিন। এরপর একদিন চাচা-চাচীকে নিয়ে অবন্তিকাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন। ছেলে ডাক্তার

আর দেখতেও বেশ সুদর্শন বলে অবন্তিকার বাবা-মা সেদিন হাসি-খুশিভাবে ডাঃ আবিরের কাছে অবন্তিকাকে তুলে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর খুব সুখেই কাটছিলো

অবন্তিকা আর ডাঃ আবিরের দিন। বিয়ের চার মাসের মাথায় অবন্তিকা যখন জানিয়েছিলো সে গর্ভবতী তখন আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন ডাঃ আবির। এতোবড় একটা

খুশির সংবাদের উপহার হিসেবে অবন্তিকা সেদিন কক্সবাজার যাবার বায়না করেছিলো। ডাঃ আবির ফেলতে পাড়েননি ভালোবাসার মানুষের বায়না। গাড়িতে গেলে

সমস্যা হতে পাড়ে ভেবে বিমানের টিকেট কেটেছিলেন। কিন্তু কথায় আছে না বিপদ যখন আসে কোনো প্রস্তুতি কিংবা সতর্ক ব্যবস্থাও তাকে আটকাতে পাড়েনা। ডাঃ

আবিরের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সমদ্রের জলে জলকেলি খেলতে গিয়ে সেদিন চোখের সামনে গভীর জলে হারিয়ে গিয়েছিলো অবন্তিকা। সন্তান সম্ভাব্য ভালোবাসার স্ত্রীকে

হারিয়ে ডাঃ আবির সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

এইটুকু পড়ে চোখের পানি মুছতে লাগলো পেশেন্ট ডাঃ আবিরের দায়িত্বে থাকা নার্স সুমি। পাতা উল্টিয়ে পড়ের পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলো সুমি..

ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ডাঃ আবির কেমন যেনো হয়ে গেলেন। সারাদিন একটা বদ্ধঘরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে লাগলেন। ভালোবাসার মানুষকে ফিরে

পাবার জন্য একটা উদ্ভট চিন্তা করে বসলেন ডাঃ আবির। তিনি শুনেছিলেন প্ল্যানচেট এর মাধ্যমে নাকি মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগ করা যায়। ভালোবাসার মানুষের

সাথে আবার যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্ল্যানচেট করার সিদ্ধান্ত নিলেন ডাঃ আবির। অনলাইনের মাধ্যমে প্ল্যানচেট করে এরকম একজনের সাথে যোগাযোগ করে

প্ল্যানচেট সম্পর্কে কিছু ধারণা জেনে নিলেন তিনি। প্ল্যানচেট এর জন্য যে বোর্ড দরকার হয় সেটা সংগ্রহ করে ডাঃ আবির প্ল্যানচেট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু একা

একা তো প্লানচেট করা যাবে না। এর জন্য কমপক্ষে চারজন লোক লাগবে। ডাঃ আবির বাকি তিনজন লোকও সংগ্রহ করে ফেললেন। বাকি তিনজন স্বেচ্ছায় প্ল্যানচেট

করতে সম্মতি দিলো। ডাঃ আবির সহ বাকি তিনজনকে নিয়ে মোট চারজন অমাবস্যা রাতে একটা পরিত্যক্ত পুরোনো বাড়িতে আসলেন। বাড়ির মাঝখানে একটা

জায়গায় সংগে করে আনা কাপড় বিছিয়ে নিয়ে তার উপর বোর্ডটি বসালেন। আত্মার উপস্থিতি টের পাবার জন্য একটি মোমবাতি পরিত্যক্ত ঘরটির এক কোনায় রেখে

দিলেন। সংগ্রহ করে আনা একটা মরা মানুষের মাথার খুলি সামনে রাখলেন ডাঃ আবির। পেশায় ডাক্তার হবার কারনে মাথার খুলি সংগ্রহ করতে কোনো বেগই পেতে

হয়নি ডাঃ আবিরকে। যাইহোক সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেলে চারজন গোলাকায় হয়ে বোর্ডটার চারপাশে বসলেন।

এরপর মৃত স্ত্রীর আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য কিছু মন্ত্রপাঠ করে সবাই চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে লাগলেন। বেশকিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর

হঠাৎ করে পুরোনো বাড়িটার দরজা-জানালার কপাট ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে একটার সাথে অন্যটা বারি লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো সমস্ত ঘরটাতে একটা তাণ্ডবনৃত্য

শুরু হয়ে গেছে। ভয়ে সবাই সবার হাত শক্ত করে ধরে রইলেন। রক্তহীম করা একটা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেলো পরিত্যক্ত বাড়িটাতে।

ডাঃ আবির প্ল্যানচেট করার আগে একটা ভুল করে বসেছিলেন আর সেটা হলো জায়গা নির্বাচন। প্ল্যানচেট এর জন্য তিনি যে বাড়িটা নির্বাচন করেছেন এখানে আগে

থেকেই একটা ভয়ংকর আত্মার বসবাস ছিলো। প্ল্যানচেট করে নিজের বিবির আত্মার সাড়া পেতে গিয়ে পুরোনো বাড়িটাতে বিদ্যমান ভয়ংকর আত্মাটা সাড়া দিয়ে

বসলো।

ঘরের কোনায় রাখা মোমবাতিটা বাতাসের ঝটকায় নিভে গেলো। ডাঃ আবিরের সাথে যে তিনজন ছিলো তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ অনুভব করলো।

পেছন থেকে ঠাণ্ডা একজোড়া হাত এসে তাকে ঝাপটে ধরে টান দিয়ে কোথায় যেনো নিয়ে গেলো। চারজনের থেকে একজনের হাত ছুটে গেলেও কেও ভয়ে চোখ

খুললো না। বাকি তিনজন তাদের হাত শক্ত করে ধরে রইলো তখনো। তীব্র একটা চিৎকার শুনতে পেলো সবাই। আত্মাহীম করা চিৎকারে কিছু বুঝে উঠার আগেই

একজন হাত ছুটিয়ে দৌড় দিলো। দৌড় দেয়া লোকটার ছিন্নমস্তক ডাঃ আবিরের সামনে এসে পড়লো। বাইরে কোথাও মেঘ না করলেও পরিত্যক্ত বাড়িটার উপর বিদ্যুৎ

চমকাতে লাগলো। দুইজনকে হারিয়ে ডাঃ আবির আর অন্য আরেকজন ভয়ে একজনের সাথে অন্যজন লেগে রইলেন। চোখ বন্ধ থেকে চোখ খুললেন তিনি। চোখ খুলে

বিদ্যুত চমকানোর ঝলকানিতে সংগী একজনের ছিন্নমস্তক পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন ডাঃ আবির। চিৎকারের সাথে সাথে খিলখিল

একটা হাসির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো পরিত্যক্ত বাড়িটার চারপাশে। সে হাসির আওয়াজ এতোটাই ভয়ংকর ছিলো যে ডাঃ আবির আর সংগে থাকা জীবিত অন্যজনের

কলিজা ফেটে যাবার উপক্রম হলো।

বিদ্যুতের ঝলকানিতে ডাঃ আবির ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একজোড়া চোখ ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই খিলখিলিয়ে হেসে

উঠলো অশুভ আত্মাটা।

ডাঃ আবিরের সাথে থাকা লোকটার ভয়ে হাত-পা কাপতে শুরু করলো। ডাঃ আবিরের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে এখানে এসেছে বলে নিজেই নিজের চুল টানতে লাগলো

সে। পরিত্যক্ত ঘরটাতে হঠাৎ করে হাজার হাজার পোকা উড়তে লাগলো। ডাঃ আবির তাকিয়ে দেখলেন পোকাগুলো সংগে থাকা লোকটার নাক,মুখ আর কান দিয়ে

ভেতরে প্রবেশ করছে। লোকটা চিৎকার করতে লাগলো এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে। সবগুলো পোকাই লোকটার শরীরের ভেতর ডুকে গেলো। লোকটা মাটিতে পড়ে

কাপতে লাগলো। কাপতে কাপতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো সে।

এইটুকু পড়তেই কারেন্ট চলে গেলো। কারেন্ট চলে যাওয়ায় খুব বিরক্ত হয়ে গেলো সুমি। কারেন্ট যাওয়ার আর সময় পেলো না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো সুমির।

ডাঃ আবিরের সাথে কি এমন ঘটলো যে সে পাগল হয়ে গেলো? আর তাছাড়া সবাইকে মারলেও ডাঃ আবিরকে অশুভ আত্মাটা কেনো মারলো না। ডাঃ আবির যেহেতু

মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তাহলে ফাইলে লেখা এই ঘটনাগুলো বললো কে? একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের পক্ষে তো তার মানসিক ভারসাম্য

হারানোর কারন নিজে বলা সম্ভব না। তাহলে এই কথাগুলো কে বললো? তাহলে কি ডাঃ আবিরের আথে ওই তিনজন ছাড়াও অন্য আরো একজন ছিলো?আচ্ছা

হাসপাতালে তো জেনারেটর আছে তাহলে জেনারেটর এখনো চালু করছে না কেনো? সুমি নিজের কাছে থাকা মোবাইল বের করে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখলো

মোবাইলের ব্যাটারি শেষ। ব্যাটারি শেষ হবার আর সময় পেলো না? সুমি আস্তে আস্তে দরজার দিকে হাটতে লাগলো। দরজার কাছে এসে দরজা খুলতে যেতেই সুমি

দেখলো দরজা বাইরে থেকে আটকানো। ভয় পেয়ে গেলো সুমি। হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। বিদ্যুতের ঝলকানিতে সুমি রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো

একজোড়া ভয়ংকর চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে চিৎকার করতে লাগলো সুমি। কিন্তু বন্ধ কামড়া থেকে সে চিৎকার বাইরে না গিয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ওর

নিজের কানেই ফিরে আসতে লাগলো। হঠাৎ একজোড়া ঠাণ্ডাহাতের স্পর্শ অনুভব করলো সুমি। হাতদুটো ওর গলা চেপে ধরলো মনে হলো। আবার বিদ্যুৎ চমকালো।

এবার ভয়ংকর চোখ দুটো একদম ওর সামনে দেখতে পেলো। চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সুমি।

পরদিন নতুন পেশেন্ট ডাঃ আবিরের রুমে এসে সুমির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেলো। কিন্তু ডাঃ আবিরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত