তাজল খুবই শক্ত সামর্থ ছেলে। টানা দশ দিন এভাবে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ল, তবু ছেলেটা দিব্যি চলে ফিরে বেরাচ্ছে। এর মাঝেই একদিন আমাকে একা ডেকে জানাল তার কোমরের নিচ থেকে পঁচন ধরেছে। কেমন মাছের মত আঁশে ঢেকে যাচ্ছে। আমাকে দেখালো পা আর ঊরুর অবস্থা। আমি তো দেখে থ হয়ে গেলাম। ইলিশ মাছের মত জ্বলজ্বলে রুপালী আঁশে ঢেকে গেছে কোমর থেকে পা পর্যন্ত। পায়ের আঙ্গুল গুলো পঁচে যাচ্ছে……. আমি মহা দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম।
তাজল মাথা চুলকে বলল, “সাত্তার ভাই, মোর মনে হয় ওই মূর্তি কুপাইয়া এই ব্যারাম ধরাইছ। নাইলে এতদিন তো ভালা আছিলাম।”
“কি করতে বলো তাহলে আমাকে?”
“গিয়া মূর্তিটার কাছে মাফ চাইয়া আসিম? ঠাকুরক কহিম মন্ত্র পড়ে পূজা দেয়ে দেক?”
“এরকম করে যদি লাভ হয়- করে দেখতে পারো। আমিও গেলাম তোমার সাথে।”
সেদিন আমি আর তাজল সন্ধ্যার দিকে রওনা হলাম পূর্ব দিকের শিব মন্দিরে। দশ মাইলের বেশি পথ। তাজল পায়ের পঁচন ব্যাথায় হাটতেই পারছে না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে হেটে যাচ্ছে।
আমরা যতক্ষণে পৌছালাম- রাত হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি নতুন কাহিনী- মন্দির গত পরশু রাতে আপনা আপনি ভেঙ্গে পরেছে! ভেতরের সব মূর্তি মাটির নিচে চলে গেছে! একটা মূর্তিও নেই! আমাদের সেই মূর্তিটাও না।
কি আর করা, তবুও পুরোহিত দিয়ে ছোট একটা পূজা দেয়ালাম। চলে এলাম তাজলকে নিয়ে। কিন্তু আসার বেলা তাজল হাটতেই পারলো না, ওর পায়ের আঙ্গুল পঁচে খুব খারাপ অবস্থা, গোড়ালির দিকটা কাঠের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন খুড়ের মত অবস্থা…….ভীষণ জ্বর তারওপর।
শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
আমি উপায় না দেখে একটা মোষের গাড়ি ভাড়া করলাম।
ফেরার পথে সারা রাত জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকতে লাগল তাজল শেখ। প্রায় সব কথাই অর্থহীন, বিজাতীয় ভাষায় ও কি সব বলল। মনে হল কথাগুলো তাজল না, অনয কেউ বলছে। একতা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল- বারবার বলছিল বলে বুঝতে পেরেছিলাম কথাটা-
“মোক ঠান্ডায় নিয়ে যা, মোক খুব গরম লাগেছে। মুই আলো বাতাসত রহিবা পারিমনে……”
তাজল শেখ মারা যায় এক মাসের মাথায়। মৃত্যুর পূর্বে ওর দুপা পঁচে গিয়ে খুড়ের মত হয়ে গিয়েছিল।
পিঠের মেরুদন্ডের দিকে টিউমারের মত হয়ে দুই জোড়া হাতের মত তৈরি হয়েছিল- কিন্তু খুব ছোট।
সারাক্ষণ মাটির বাড়ির মেঝেতে শুয়ে থাকতো।
আর বিড়বিড় করে বলত ওকে বরফ দিয়ে চেপে ধরে রাখতে। কয়েকবার বলেছিল মাটি খুড়ে তাকে মাটি দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিতে। কোনোটাই করা হয়নি।
সুলতানা ওর ওসুখ দেখে পাগলের মত হয়ে যায়।
তাজল মারা যাওয়ার দিন রাতে নাকি একটা কালো সাপ এসে ওর গলায় পেঁচিয়ে বসেছিল। মারা যায় তারপর।
সুলতানা তাজলের মৃত্যুর পাগল হয়ে গিয়েছিল।”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফ্বলল্বন সাত্তার সাহেব।
আমি চুপচাপ তাঁর কথাগুলো শুনছিলাম, উনি থামতেই বললাম,
“এখানেই শেষ? তাজল আসলে ঐ মূর্তিটার রূপ ধরে মারা গিয়েছিল- তাই না? এরপর? এরপর আর কিছু হয়নি?”
হাসলেন বিচিত্র ভাবে, কাঁশলেন খুক খুক করে, “এর পরেই তো আসল কাহিনীর শুরু। বললাম না ব্যাখ্যাতীত ঘটনা? তাজলের মৃত্যুর পরেই আসল ঘটনা শুরু হয়েছিল। যেটার কোনো ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত ভেবে বের করতে পারিনি।”
বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশ। আমি অন্ধকার জমির দিকে তাকালাম নিজের অজান্তেই। গা শির শিরে একটা অনুভূতি হল………..