শিব মূর্তিটার মত

শিব মূর্তিটার মত

রাতের খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে আছি আমি, সাত্তার সাহেব ও তাঁর স্ত্রী জয়গুন নাহার। বাহিরে গুড়ি গুড়ি মিহি বৃষ্টি, হাল্কা বাতাস। কারেন্ট আসেনি এখনো। আমি বসেছি চেয়ারে। সাত্তার সাহেব মাদুর বিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন। হুক্কা টানছেন। গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। চারপাশে মিষ্টি জাফরানের ঘ্রাণ। জয়গুন নাহার স্বামীর পাশে বসে পানের খিলি সাজাচ্ছেন।

“এরপর কি হল? তাজল মারা যাবার পরের ঘটনা?” কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি।
হুকার পাইপে বারদুয়েক টান দিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার দিকে তাকালেন সাত্তার সাহেব,
চোখে বিচিত্র একটা দৃষ্টি, “এরপরের ঘটনাটা একটু আজব -অবাস্তব বলে মনে হবে তোমার”।
জয়গুন নাহারকে দেখলাম সামান্য ভীত চোখে অন্ধকার জমিটার দিকে তাকালেন একবার।
চাপা গলায় বললেন, “রাত বিরাতে কিসব শুরু করলা? জামাই মানুষ, ভয় টয় পাবে তো!”
“আরে পাবে না। সাহস আছে ছেলের”। আমার দিকে তাকালেন। আমি ঢোক গিললাম।

“তাজল শেখ মারা যাওয়ার দিনের ঘটনা।
কবরটা দেয়া হয়েছিল এখান থেকে এক মাইলের মত পূবে একটা গোরস্থানে।
অল্প কয়েকটা কবর মাত্র সেখানে। বেশিদিন হয়নি ওখানে গোরস্থানের জন্য জমি দেয়া হয়েছে।
জঙ্গল ধরনের জায়গা। বড় বড় বাঁশঝাড় আর ঝোপে ভরা। দিনের বেলাতেই যেতে কেমন লাগে যেন।
রাতের বেলাতো ওটার ধারে কাছ দিয়েও মানুষ যায় না। তাজলের কবরটা দেয়া হল জঙ্গলের মাঝামাঝি একটা জায়গায়।
সরু পথ কেটে জঙ্গলের ভেতর তাজনের কবর পর্যন্ত নেয়া হয়েছিল।

তাজলের জানাযার সময় অনেক মানুষ এসেছিল ওকে দেখতে। তাই কবর দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রচন্ড গরম পড়েছিল সেদিন।
কবর দিতে গিয়ে সবাই ঘেমে নেয়ে একাকার। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টির ভাব শুরু হল। ঘন মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন করছে গম্ভীর স্বরে। গোরস্থানের বাঁশঝাড়গুলো একবার এদিক দুলছে আরেকবার ওদিক।

দাফনের কাজ শেষে সবাই মোনাজাত ধরেছি সবে এমন সময় বৃষ্টি নামল চারপাশ ঝাপিয়ে। এমনিতেই সন্ধ্যা তার ওপর ঘন মেঘের জন্য চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। জানাযার নামাজে মুসল্লি যতজন হয়েছিল-দাফনের সময় এসেছে একেবারেই কম। মাত্র আটজন।

ইমাম সাহেব সবে হাত তুলে দোয়া পড়ানো শুরু করেছেন তখন নামল বৃষ্টি। আমরা কবরটা চারপাশ থেকে ঘিরে মোনাজাত করছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াতে খারাপ লাগছে না। গরমের হাত থেকে বাঁচা গেল। চোখ বন্ধ করে মোনাজাত করছি।

প্রথম দিকে কেমন একটা গোঁ গোঁ চাপা শব্দ হচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল না শব্দটা কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ ঘটল ঘটনাটা।
প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আচমকা কবরের ভেতর থেকে কাঁচা মাটি ফুঁড়ে একটা কালো কুচকুচে হাত বের হয়ে এলো!

বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা হাতটার গায়ে লেগে থাকা কাদা মাটি ভিজিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা যারা ছিলাম ওখানে ব্যাপারটা অনেকেই প্রথমে খেয়াল করল না কারণ মোনাজাত করছিল সবাই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে। সম্ভবত আমিই প্রথম দেখলাম ব্যাপারটা।
জমে গেলাম বরফের মত। আমার থেকে বড়জোড় দুই হাত সামনে কবরের ভেতর থেকে হাতটা কব্জি সহ আরো একটু বেরিয়ে এসেছে!

কয়লার মত কালো হাত। দ্বিতীয় ধাক্কায় অন্য হাতটা বের হয়ে এলো কবর ফুঁড়ে! সেই হাতে একটা ত্রিশূ্ল ধরা!
ত্রিশূলের চকচকে ফলা বজ্রপাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছে! আমি শুনতে পেলাম বাকিরা ভয়ঙ্কর আতংকে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালানো শুরু করেছে!  আমিই কেবল নড়তে পারছিনা। আমার দুই পা যেন হাজার মণ ভারি হয়ে গেছে। মাটি থেকে তুলতেই পারছি না।

বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম কবরের বাঁশ চাটাই সব ঠেলে নিচ থেকে কালো কুচকুচে একটা মানুষের মাথা বের হল কবরের মাটির ওপর!
বজ্রপাতের সাদা আলোতে দেখতে পেলাম হলুদ রঙের দুটো চোখে মানুষটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে!  মানুষের চোখের মণি এরকম হলুদ হতে পারে না! লোকটার গলায় পেঁচানো কালো বিষধর একটা সাপ! ফণা তুলে হিস্ হিস্ করছে……

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বোধহীন জড়বস্তুর মত সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের সামনে মানুষটা কবর ভেঙে উঠে এল মাটির ওপর। কাদা মেখে আছে লোকটার গায়ে। সাদা কাফনটা দিয়ে কোমড়ের অংশটা পেঁচিয়ে রেখেছে। তাজল শেখ!

এত কালো ছিল না দাফনের আগেও….. এখন দেখতে ওকে ঠিক সেই শিব মূর্তিটার মত লাগছে অবিকল…..
তাজল আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারার মত কোনো ভাব দেখালো না। হলুদ রঙের জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে খুরওয়ালা পায়ে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে বৃষ্টির মাঝে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল!
ওর পিঠে আরো দুইজোড়া হাত টিউমারের মধ্য থেকে নড়ছে….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত