গোরস্থান

গোরস্থান

আমি নিজের পায়ের উপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। কেবল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর অশুভ-অশূচি কিছু একটা ঘটছে…….

ঘটনাটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রাম জুড়ে। এমনকি শিব মন্দিরের পুরোহিতদের কান পর্যন্ত চলে গেল। সেই রাতেই মন্দিরের পুরোহিতরা চলে এলো গোরস্থানে।
তাদের কথা অনুযায়ী তাজল শেখ হল তাদের দেবতা- তার শরীরে শিব ভর করেছে। কবরটার ভেতরে তখন হাজার হাজার সাপ কিলবিল করছে যখন পুরোহিতরা যায় ওখানে।
কিন্তু তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। মশাল জ্বালিয়ে সারা জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজল মন্দিরের সবাই।

বার বার বলতে থাকল তারা- তাদের দেবতা মন্দির ছেড়ে চলে এসেছে বলে মন্দিরটা ভেঙে গেছে। মাটির নিচে চলে গেছে মূর্তিগুলো। তাই তাদের দেবতাকে খুঁজে বের করতে হবে।
কিন্তু চারপাশের দশ মাইল চষে ফেলার পরও তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। সে রাত থেকে আমার প্রচন্ড জ্বর শুরু হল। এমন জ্বর বহুদিন হয়নি। কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। ক
েবল বিছানায় শুয়ে কাথার নিচে কাঁপছিলাম থরথর করে আর পাগলের মত প্রলাপ বকছিলাম।

সুলতানার কোনো আত্বীয় স্বজন ছিল না। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার সময় কেউ আসেনি। থাকলে নিশ্চই আসতো। স্বামী মারা যাওয়ায় মেয়েটা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল।
তোমার চাচী সুলতানাকে এবাড়িতে এনে রেখেছিল কিছুদিন।
কারো সঙ্গে কোনো কথা বলত না। একা একটা ঘরে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। কিছু খেতেও চাইত না। ফেলে দিত সব।

জয়গুন অনেক চেষ্টা করেও সুলতানাকে কিছু খাওয়াতে পারত না। দেখতে দেখতে হাসিখুশি মেয়েটা চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে লাগল।
শুঁকিয়ে চোয়ালের হাড় বের হয়ে এল। বড় মায়া লাগত মেয়েটাকে দেখে।

আমার জ্বর থেকে সেরে উঠতে পাঁচদিন সময় লাগল। সুস্থ হবার পর প্রায়ই গিয়ে সুলতানাকে বোঝাতাম খাওয়া দাওয়া করার জন্য। মানুষ মারা যাবে এটাইতো স্বাভাবিক।
এভাবে ভেঙে পরলে তো জীবন চলবে না। ওর বয়স কম। সামনে ওর পুরো জীবনটা পরে আছে। কিন্তু এত কথা বলে কোনো লাভ হত না।
মূর্তির মত যে মেয়েটা বসে থাকত তো থাকতই। কোনো কথাই বলত না।

প্রায় রাতেই মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে ফিরে আসলে সুলতানার ঘরের দিক থেকে শুনতে পেতাম একা একা কথা বলছে মেয়েটা।
শুনে মনে হয় যেন কারো সঙ্গে কথা বলছে -কেবল অন্যজনের কথা শোনা যাচ্ছেনা। আমি পাগলের প্রলাপ ভেবে পাত্তা দিতাম না।

তাজল শেখের কবর থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনাটা সুলতানাকে কেউ বলেনি। বললে কি করত কে জানে। এমনিতেই তাজলের শোকে পাথর হয়ে আছে।

আমি শুক্রবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে হুজুর এনে মিলাদ দেয়ালাম। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার পর থেকেই এই বাড়িটা কেমন যেন হয়ে গেছে।
যদিও এ বাড়িতে তাজল থাকত না। কিন্তু সুলতানা আসার পর থেকে এ বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।
খুব বেশি সাপ বের হচ্ছে বাড়ির নানান জায়গা থেকে। হাঁস মুরগি গুলো সব মরতে শুরু করেছে একে একে।
আর বাড়ির চারপাশে কে যেন মাটি খুঁড়ে বড় গর্তের মত করে রাখে প্রতিরাতে।

মিলাদের পরদিন কাজের চাপে সারাদিন বাসায় আসতে পারলাম না। গঞ্জে যেতে হয়েছিল মালপত্র নিয়ে আসতে।
সেসময় এখানে লোক এসে কোল্ড স্টোরেজ়ে বস্তা দিয়ে যেত না।
গঞ্জে আমার মূল অফিসে দিয়ে যেত। আমাকে নিয়ে আসতে হত।

ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। নামাজের পর ফিরলাম। রাতে আমি মসজিদ থেকে ফিরে সবে বাড়িতে পা রেখেছি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। বাড়ির কোথাও কোনো আলো নেই।
কারেন্ট না থাকতে পারে কিন্তু হারিকেন তো জ্বলবে-সেটাও জ্বলছে না। আমি হাতের টর্চ দিয়ে এদিক সেদিক দেখলাম। জয়গুন কিংবা আমার বড় মেয়ে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই।
অবাক হলাম ভীষণ। এমনকি চারপাশে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা, কোনো ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দও নেই। হাঁস মুরগির খোঁপ গুলোতেও কোনো আওয়াজ হচ্ছে না!
সারা বাড়ি যেন কবর হয়ে আছে!

আমি জয়গুনের নাম ধরে সবে ডাকতে যাবো- মুখ খুলেছি- হঠাৎ শুনতে পেলাম সুলতানা ওর ঘরটা থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,
অস্পষ্ট গলায় কিছু বলছে। বোঝা যাচ্ছে না। আমি টর্চের আলো ফেললাম ওর ঘরটার দিকে, জানালা বন্ধ, দরজাও বন্ধ। অন্ধকারে ভয় পেয়ে কাঁদছে নাকি?
আমি এগিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। ওর ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে যাবো-থমকে গেলাম আমি। স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা পুরুষ কন্ঠে কেউ বলছে,
“মোর নগত কাহো আসিবা পারিবা নাহায় …….”

কন্ঠটা শুনে জমে গেলাম। তাজল শেখের গলা! শুনতে পেলাম সুলতানা ভাঙা গলায় বলছে, “মুই যাম, মুই একলা রহিবা পারিবা নহু।”

আমি দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকালাম ভেতরে কি হচ্ছে দেখার জন্য। কিন্তু তার আগেই আমার হৃদপিন্ডটা ধরাস করে উঠল।
আমি দরজার যে অংশে চোখ রেখে তাকাতে গেছি- ঠিক সেখানেই হলুদ একটা চোখ আমার দিকে ওপাশ থেকে চেয়ে আছে দরজার ওপাশ থেকে!
গোরস্থানের সেই তাজলের চোখগুলো!

আমি আতংকে পেছন দিকে ছিটকে এলাম। পায়ে পা বেঁধে হোচট খেয়ে পরে গেলাম উঠানে। টর্চটা হাত থেকে গড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
আমি ভয়ার্ত চোখে দেখলাম সুলতানার ঘরের দরজা খুলে গেল। চাঁদের ঘোলাটে আলোয় দেখা গেল তাজল শেখের সেই দেবতা রুপটা একহাতে ত্রিশূল নিয়ে,
গলায় সাপ পেঁচানো- কালো কুচকুচে মুখে হলুদ দুটো চোখ। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!

অন্য হাতে সুলতানার একটা হাত ধরে রেখেছে। আমি নড়তে পারছিলাম না ভয়ের চোটে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাজল সুলাতানার হাত ধরে নেমে এল উঠানে।
আমার দিকে না তাকিয়ে দুজন সোজা হেঁটে যেতে লাগল ওদের মাটির বাড়িটার দিকে!
পুরো দৃশ্যটায় ভয়ংকর একটা অশুভ আর অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি খুব ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি।

কারণ আমি চাঁদের আলো আর পরে থাকা টর্চের আলোতে আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছি সুলতানার ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে-সিলিং থেকে সুলতানা ঝুলে রয়েছে ঘরের ভেতর!
ওর শাড়িটা ফাঁস বানিয়ে গলায় দেয়া, ব্লাউজ আর পেটিকোট পরনে। দু’পা সোজা হয়ে রয়েছে, আঙ্গুল গুলো মাটির দিকে!

বিস্ফোরিত চোখে অন্য দিকে তাকালাম। এখনো চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে সুলতানা ওর স্বামীর দেবতা মূর্তির হাত ধরে ওদের পুরনো ভিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জমির আল দিয়ে।
সুলাতানা যদি ওখানে থাকে-তবে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে কে?

আমি হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে টর্চ হাতে দৌড়ে ঘরটায় ঢুকলাম। সুলাতানা ঘরে ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে। এক নজর দেখেই বোঝা গেল ফাঁসটা এখন না, বেশ আগেই খেয়েছিল। ফুলে রয়েছে সারা শরীর!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত