রাত দুইটা বেজে পঁচিশ মিনিট।ব্যাথায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। গ্যাস্টিকের ব্যাথায় বুক চেপে ধরেছে। উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলাম।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও আর ঘুম এলো না। বারান্দায় গিয়ে গ্রীলের পর্দা সরিয়ে আকাশে চোখ রাখলাম। দৃষ্টি দিগন্তে আটকে গেলো। লক্ষ করলাম রাতটা অনেক
নিরব। আশেপাশে সারাদিন যে হট্রগোল লেগে থাকে! বাস,ট্রাকের হর্ণ বেজেই চলে সারাক্ষণ। এই রাতে সব থেমে গিয়েছে। নিরব, নিস্তব্ধ রাত। উপরে আকাশ আর নিচে
আমি ছারা বাকি সবকিছু যেনো হারিয়ে গিয়েছে। ইজি চেয়ারে বসলাম। সামান্য ঘুমের ঘোরে চোখঁ বুজে এসেছিলো হঠাৎ কি একটা শব্দে চমকে উঠলাম। শব্দকে আরো
স্পষ্টভাবে জানার ইচ্ছায় ভালোকরে কান পাতলাম। তাতে যা শুনতে পেলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এটা ছিলো নুপুরের শব্দ। এতো রাতে নুপুরের শব্দ কোথা থেকে
আসবে? মনে হলো বারান্দার পাশের আম গাছটার নিচ দিয়ে কেউ নুপুর পরে হাঁটছে। গাঁ শিউরে উঠলো।
—
একটু পরেই শব্দটা আর শোনা গেলো না। মনে মনে ভাবলাম, কি হচ্ছে এসব? নাহ্! অনেক্ষণ তো হয়ে গেলো শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। তবে কি এটা আমার মনের
ভুল? হতে পারে। চেয়ারে বসে থেকেই এসব ভাবছিলাম। ভয়ে ভয়ে আমগাছটার মাথার দিকে তাকালাম। এখান থেকে গাছটার শুধু মাথাটাই দেখা যাচ্ছে। বাতাশে দুই
একটা পাতা নরে উঠলো। পাতার ফাঁক দিয়ে একটা বাদুর পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বেরিয়ে এলো। উড়ে গিয়ে আরেকটা গাছের ডালে বসলো। এক গাছ থেকে উড়ে
গিয়ে আরেক গাছে বসবে তারজন্য কি তার পাখা ঝাপটানি। মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। আবার সেই নুপুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শব্দটা এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
উঠে দারালাম। গুটি গুটি পা ফেলে বারান্দার ওইপাশ থেকে সোজা এইপাশের কোনায় চলে আসলাম। এখন আমি আমগাছটার মুখোমুখি দাড়িয়ে আছি। গ্রীলের
পর্দাটাই শুধু আমার আর গাছটার মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি করেছে। এমন সময় একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।
পর্দাটা খুব ধীরে ধীরে সরিয়ে হাতের এক পাশে রাখলাম। ভয়ে যে কলিজাটা উড়ে গিয়েছিলো মনে হলো এবার তা ফিরে পেলাম। কারণ গাছটির নিচে কিছুই দেখতে
পেলাম না। কিন্তু কান্নার শব্দটা এখনো শুনতে পাচ্ছি। আমার হাতের কাছেই একটা চেয়ার রাখা আছে আর তার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা টর্চলাইট হাতে
নিলাম। ক্ষানিকটা দুরে বটগাছের নিচে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সাদা কাপড় পরা বেশ লম্বা চওড়াই মনে হলো। দুরত্ব বেশী হওয়ায় তাকে চেনা যাচ্ছে না। কোন
বাড়ির মেয়ে হতে পারে? এতোক্ষণ এই মেয়েটাই কি নুপুর পরে এদিক সেদিক হাটঁছিলো? আর এতো রাতে মেয়েটা এখানে কি করছে? মাথার মধ্যে এ ধরনের নানান
প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। উওরে পুনরায় দৃষ্টি ফেরাতেই দেখছি ও দড়ির ভেতরে নিজের মাথা ঢুকাচ্ছে যে দড়িটার প্রথম প্রান্ত বট গাছটার ডালের সাথে বাধাঁ আর এখন দড়ির
অপর প্রান্ত মেয়েটার গলাকে জাপটে ধরেছে। পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা সরিয়েই সে ঝুলে পরলো।
–
চোখ খুলতেই নিজেকে চেয়ারে বসা অবস্থায় পেলাম। আমি তো চেয়ারে বসেই আছি।এতোক্ষন কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি ভয়ে অঙ্গান হয়ে গিয়েছিলাম? কপাল
থেকে ঘাম ঝরছে। এই মুহুর্তে প্রচন্ড গতিতে বেয়ে চলা বাতাস আমাকে কাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঝড় আসবে। যা ঘটলো তাতে বারান্দায় আর এক মুহুর্ত থাকার ইচ্ছে নেই।
এদিক সেদিক আর একবারও তাকালাম না। একটু দ্রুতই পা ফেলে রুমে চলে আসলাম। রুমে এসে দেখি ২টা ৪০ বেজে গিয়েছে। আমাকে আবার ফজর পড়তে হবে।
তাই এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পাশে কেউ নেই। এতো রাতে ভয় আর উৎকন্ঠা নিয়ে একা একা ঘুমও আসছে না।
–
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে আম্মির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে আম্মিকে দেখেই জরিয়ে ধরলাম।আম্মি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
কি রে, কোনো স্বপ্ন দেখছিলি? কালরাতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা আম্মিকে বললাম। আম্মি বললো এটা শুধু স্বপ্নই ছিলো। তোর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথে তার
অস্তিত্বও শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন মন থেকে সব ঝেরে ফেল। আম্মির কথায় স্বস্তি পেলাম। হয়তো আম্মি ঠিক বলছে। মনে বল ও ফিরে পেলাম। আরো কিছু কথা হলো
তারপর আম্মি ফ্রেস হয়ে নাস্তা করার জন্য বলে রুম থেকে চলে গেলো।সামনের দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িতে চোখ পরতেই দেখি ৮টা বেজে গিয়েছে। ইসসইরে, আজ
পড়া হলো না। কি আশ্চার্য! নামাজ না পড়লে আম্মি আমার খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতো অথচ আজ কিছুই বললো না।
–
কি যেন মনে হয়ে তারাতারি উঠে বিছানাটা গুছিয়ে নিলাম তারপর ঝুড়িঁটা হাতে নিয়ে শিউলি গাছটার কাছে চলে এলাম। প্রতিদিনের মতো আজ শিউলিতলা ভরে নেই।
কারনটা অবশ্য আমার জানা। ও বাড়ির দিদি পূজোঁর জন্য ফুল নিয়ে গিয়েছে। আর পাশের বাড়ির পিচ্চিগুলো এসে বাকি ফুলগুলো নিয়ে গিয়েছে। গাছটা একটু ঝোঁক
দিতেই কিছু ফুল পরলো। ওগুলো নিয়েই চলে এলাম। টেবিলের পাশে আগের দিনের ফুলগুলো সরিয়ে নতুন ফুলগুলো রাখলাম।
–
রাতে স্বপ্ন দেখে আবারও ঘুম ভেঙ্গে গেলো। স্বপ্নে ওই মেয়েকে দেখলাম। তার মুখটা ফ্যাকাশে,চোখের মনি ভেতর থেকে বাহিরে বেরিয়ে এসেছে। দেখতে কি ভয়ানক!!
চুলগুলো অগোছালোভাবে পেছনে ছরিয়ে দেওয়া। আমার সামনে এসে বলছে তুমি আমাকে আত্মহত্যা করতে দেখেও আটকালে না কেনো? আমি খুব কষ্টে আছি।
এখন আমি তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যেতে এসেছি। চলো আমার সাথে এই বলে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। অতিরিক্ত ভয়ের কারনে চোখ খুলে গেলো।
দেখলাম আমার আসে পাশে কেউ নেই। বুঝতে পারলাম এসব শুধুই স্বপ্ন ছিলো। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বিছানা থেকে নামলাম
।একটু এগিয়ে গিয়ে পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলাম। ভালো লাগছে না। এই মুহুর্তে খোলা আকাশটা আর গাঁ শিতল করা শিরশিরি
বাতাসের জন্য বারান্দায় যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাল রাতে যা হয়েছে। না বাবা, এতো রাতে আবার বারান্দায় যাওয়ার সাহস আমার নেই। কাল আমি ঐ মেয়েটাকে
আত্মহত্যা করতে দেখেছি। এভাবে মরে গিয়ে সে কষ্টে আছে। ওপারে গিয়ে আত্মহত্যা করার জন্য চরম শাস্তি ভোগ করছে মেয়েটা। আর এজন্য ওর আত্নাও মুক্তি পায়
নি। এখন ওর আত্না আমাকে মারতে চায়। কারন আমিই একমাত্র ব্যাক্তি যে ওকে আত্মহত্যা করতে দেখেও আটকাই নি। নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে দেখেছি। কিন্তু
এতোদুর থেকে আমি কিভাবে তাকে বাচাঁতে পারতাম? ওর কান্ড দেখে তো নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো এসব
তো শুধু স্বপ্ন ছিলো তাই না? নাকি বাস্তবতার কোনো চিহ্ন আছে? এখন যদি ওর প্রেতাত্মা সত্যি সত্যি আমাকে মারতে আসে?
নাহ্!! আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। উঠে দাড়ালাম, এতোক্ষণ চেয়ারে বসে ছিলাম। একটু দ্রুত পা ফেললাম বিছানার উদ্দেশ্যে। মনে হচ্ছে আমার পেছনে কেউ দারিয়ে আছে কারণ সামনে তার ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ওই প্রেতাত্মাটা আমার ঘরে ঢুকে পড়লো নাতো!!
পেছনে তাকিয়ে দেখার সাহস আর হলো না। হঠাৎ একটা হাত আমার পা ধরে ফেললো। হাঁটার বেগ থাকার কারণে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। মাথায় প্রচন্ড
ব্যাথা অনুভব করছি। মাথাটা ঘুরিয়ে বামপাশে তাকাতেই দেখলাম ওই আত্নাটার লাল রংয়ের দুটো বড়ো বড়ো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সব কিছু অন্ধকার হয়ে
এলো। আমি ঙ্গান হারালাম।
–
সকালে চোখ মেলতেই দেখি আম্মি আমার মাথাটা কোলে নিয়ে কান্না করছে আর আব্বু পাশে বসে আছে। চাচ্চু আমার মুখে পানি দিয়ে ঙ্গান ফিরানোর চেষ্টা
করছিলেন। বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে আছে। আমি পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম খেলার দড়িঁটা আমার পায়ের সাথে পেঁচিয়ে আছে। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি
রইলো না। তারমানে হলো রাতে এই দড়িঁতে উসটো খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। আর দড়িঁটা পায়ে এমনভাবে পেঁচিয়েছিলো মনে হচ্ছিলো ওটা দড়িঁ না ওটা কোনো
প্রেতাত্মার হাত। কিন্তু ওই চোখগুলো আর ছায়াটা কিভাবে দেখলাম?
একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর খুঁজতে গিয়ে দেখি বিছানার নিচে দুটো লাল আলো জ্বলছে। এটা ছিলো আমার ছোট ভাইয়ের প্রিয় খেলনা গাড়িটার
হেডলাইট। এবার ওই ছায়াটা খোজার পালা। ঘরের ডিমলাইটটা ছারা বাকি সব আলো নিভিয়ে দিলাম। দরজা, জানালা সব বন্ধ করলাম। চেয়ারটার পাশে দারালাম ঠিক
কাল যেভাবে দাড়িঁয়েছিলাম সেভাবে। তারপর দেখলাম সামনে একটা বিরাট মানুষের ছায়া আর পাশে তাকিয়ে দেখি দাদুর পাঞ্জাবীটা আনলায় ঝুলিয়ে রাখা আছে।
পাঞ্জাবীটা হাতে নিলাম। হুররে, আমি প্রেতাত্মা উদ্ধার করেছি দাদু। আমি প্রেতাত্মা উদ্ধার করেছি। দৌড় দিলাম দাদুর রুমের দিকে।
………………………………………………..সমাপ্ত…………………………………………..