সীমাহীন লালচে গতের্র অতলে আমরা

সীমাহীন লালচে গতের্র অতলে আমরা

হালকা পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। রাত এগারোটা হবে। আমি ভূরঘাটা বাসস্টান্ডে অপেক্ষা করছি। কুষ্টিয়ার এক অখ্যাত বাসস্টান্ড এটি। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। কুকুর আর শিয়ালের ডাক শোনা যায় থেমে থেমে। এই গ্রামে বিদ্যুত নেই বলে রাত নামে সন্ধ্যার পর পরেই । বাসের কাউন্টারে একটা আধময়লা হ্যারিক্যান জ্বলছে। আমি কাউন্টারে এসে কোন টিকেট পাইনি। তবে কাউন্টারের লোকটা দয়াবান। বলল আমার একটা ব্যাবস্থা করবে। ড্রাইভারের পাশে ইঞ্জিনের উপর এক টুকরো ফোম দিয়ে অস্থায়ী সিট বানিয়ে দিবে। আমি চাইলে সেটায় বসে যেতে পারব। আমি ঢাকায় যাব।

ঢাকা যাওয়া দিয়ে কথা, ড্রাইভারের পাশে বসে যাই আর মন্ত্রির পাশে যাই। বাস আসতে আরো একঘন্টা দেরি হবে। দূরে একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। সেখানে মোটা সলতের কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। রাস্তায় ফিছফিছে কাদা। আমি কাদা মাড়িয়ে চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাঁশের তৈরি নড়বড়ে দোকান। দোকানের ভেতর দুটি মাত্র বেঞ্চি। বৃদ্ধ দোকানদার। একটা কেতলি চুলার উপরে তোলা। চুলা নিভানো। আমার অনুরোধে তিনি চুলা জ্বাললেন। আমি চায়ের অপেক্ষায় আছি।

হঠাৎ একলোক হাজির। মোটাসোটা দীর্ঘদেহী। মোটা গোঁফ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটা ট্রাক ড্রাইবার। এখন মোটা গোঁফ সাধারণত এখনো ট্রাক ড্রাইভারাই রাখে। আকাশের বুক চিড়ে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। লোকটা বাহিরে তাকিয়ে বলল, ‘সেদিন ছিল এমন রাত!’

গ্রামের মানুষেরা সাধারনত গল্পবাজ হয়। প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলে। এদের প্রশ্রয় দেওয়া বিপদজনক। প্রশ্রয় পেলে কানের পোকা বের করে ফেলে। রাতে একা ভালো লাগছিলোনা। তাই তার কথায় সায় দিয়ে বললাম,

‘কোন দিনের কথা বলছেন?’

‘গত বছর ঘটনা। একদিন সকালে এই চায়ের দোকানে। দেখি একটা ছেলে মাথা নীচু করে বসে আছে। চায়ের দোকনদার চাচা বলল, ছেলেটা চরের তোনে আইছে। অর একটা কাজের দরকার।’

দেখে মনে হল অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান। হয়ত বাড়ি থেকে রাগ করে এসেছে। আমার মায়া লাগল। কারণ একদিন আমিও মেট্রিক ফেল করে লজ্জায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। পরে জানলাম ছেলেটা নাম আসাদ। মুখ গোল। গায়ের রং র্ফসা। হাটা চলা মাইয়্যালোকের মত। যাই হোক ছেলেটাকে আমার ট্রাকে রেখে দিলাম। হেলপার করব। আমি কাঁচামাল নিয়ে শহরে যাই। ও আমার সাথে শহরে যায়। আবার সকালে শহর থেকে গ্রামে চলে আসি।

একদিন দুপুরের ঘটনা। প্রচন্ড রোদ। আমরা এই স্টেশনেই একটা হোটেলে ভাত খেয়ে বিশ্রামে আছি। বিশ্রাম শেষে হোটেল থেকে ট্রাকে গিয়ে উঠলাম। ভাবলাম ট্রাকটা পেছনের গ্যারেজে রেখে আসি। ট্রাকে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট করলাম। একটু ব্যাকে গিয়ে রাস্তায় উঠব। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার। আমার হাত স্টিয়ারিং থেকে নেমে গেল। লোকজনের হায় হায় রব শুনে ট্রাক থেকে নিচে নেমে আসি। একটা থেতনানো মানুষের শরির পড়ে আছে ট্রাকের চাকার নিচে। শরীর আর চেনা যায় না। দেখে মনে হয় এক দলা মাংশের পিন্ড। রক্ত আর মাংশ একাকার হয়ে আছে। হলুদ মস্তকটা ছিটকে পড়ে কাঁপছে। ঘটনা হইল কঠিন গরম। ছায়া নাই কোথাও। দুপুরের খাওয়ার শেষে আসাদ ছায়ায় বিশ্রম নিতে গাড়ির নিচে শুয়ে ছিল। একটা পেপার বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ঘুমই ছিল জীবনের শেষ ঘুম। হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোন অবস্থা ছিল না।

লাশ পোষ্টমার্টম শেষে হাতে নিতে নিতে রাত হয়ে গেল। একটা কাঠের কফিন বানিয়ে কাফন পরিয়ে লাশ নিয়ে রোয়ানা দিলাম। গন্তব্য আসাদের গ্রামের বাড়ি। জানাজা না পড়িয়ে লাশ নিয়ে রোয়ানা দিতে অনেকেই নিষেধ করেছে। জানাজা পড়াতে হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ট্রাকের সিটের পেছনে কফিনটা বসিয়ে রাখলাম।

সন্ধ্যার পর থেকে আকাশটা ধীরে ধীরে মেঘলা হতে শুরু করে। হঠাৎ আকাশের বুক চিড়ে শুরু হলো বিদ্যুৎ চমকানো। আমি আমার সাথে একজন সাহসী কামলা দুলালকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। নিকষ কালো রাত। হেডলাইটের আলো অন্ধকারের বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রা¯তার পাশের কিছুই চোখে পড়ছে না। দূর গ্রামেরর কোন পিটপিটে আলোও চোখে পড়ে না। চিরপরিচিত রাস্তাকে মনে হলো অচিনপথ। দূরে একটা সাদা বিন্দু চোখে পড়ল। বিন্দুটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একসময় মনে হল একজন মানুষ হেটে যাচ্ছে। গাড়ির সামনে হেটে যাচ্ছে। তবে হাটার ভঙ্গিটা আমার কাছে পরিচিত।

আমি হর্ন বাজালাম। না সে পথ ছেড়ে দিবে না। আমি দুলালের দিকে তাকালাম। ও মনে হয় কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। ও পেছনের গিয়ে কফিনের ঢাকনা খুলে দেখে। আমি ওর দিকে তাকালে বলে, কফিন খালি। আমি বললাম, শক্ত হয়ে বসে থাক। এর পর গাড়ির গতি বাড়িয়েই দিলাম একশোতে একশো। সাথে পাগলের মতো হর্ন টিপছি। কিন্তু সামনের ওটা মধ্যে সাইড দেওয়ার কোন লক্ষণ দেখলাম না। ধীরে ধীরে আকৃতিটা বড় হতে থাকল। একসময় মনে হল গাড়ির কাচের সাথে লেপ্টে গেছে। কাফনের কাপড় মেয়েদের শাড়ির মতো জরিয়ে পরা। তারপর ওটা ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। মুখ বলতে কিছু নেই। ওখানে একদলা জমাট রক্ত। সেই রক্তের মাঝে দুটি গর্ত। যেই গর্তের শুরু আছে শেষ নেই। আমি গাড়ি থামিয়ে দিলাম। গাড়ির হেডলাইটও নিভিয়ে দিলাম। সব অন্ধকার।

জানালার ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখি একটা বাজারের মধ্যে চলে এসেছি। আমি গাড়ির দরজা খুলে ডাক দিলাম। একজন পাহাড়াদারকে ডেকে বলালাম আমরা রাতে আপনাদের সাথে থাকেত চাই। তারা থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। দুলাল আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা দোকানে গেলাম রাত কাটানোর জন্য। তাদেরকে বললাম না আমাদের সাথে কফিন আছে।’ আমি তাকে বললাম, ‘গাড়ি থেকে নামার আগে কফিন খুলে দেখেন নাই।’

‘দেখেছি।’

‘লাশ ছিল।’

‘না। কোন লাশ নেই। লাশ গায়েব। তবে অনেকেই ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কাফন পরা একজনকে গাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে দেখে।’ আমার গাড়ি চলে এসেছে। আমি চায়ের বিল দিয়ে উঠলাম। লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও উঠে যাচ্ছে। সে বলল, ‘স্যার আমার কথা বিশ্বাস করেন নায়।’ আমি তাকে খুশি করার জন্য বলালম, ‘আপনি যেহেতু দেখেছেন। অবিশ্বাস করি কি করে!’

গ্রামের মানুষ এম্নিতেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। এসব গল্প বিশ্বাস করার কোন কারণ দেখছি না। কাউন্টারের সামনে এসে দেখি গাড়ি দাড়িয়ে আছে। কোন সিট খালি নেই। ড্রাইভারের পাশে একটা অস্থায়ী সিটে দিয়ে আমাকে বসার ব্যাবস্থা করা হল। আমাদের গাড়িও ঢাকার উদ্দেশ্যে রোয়ানা দিয়েছে।

পরিশিষ্টি গাড়ি এগিয়ে চলছে। নীকষ কালো অন্ধকার রাত। কোথাও কোন আলোর চিহ্ন নেই। থেমে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাথে মেঘের কানফাটা আর্তনাত। আমি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন। একটু পরেই্ পাগলের মতো হর্ণ টিপা শুরু করেন। দূরে তাকিয়ে দেখি একটা সাদা বিন্দু। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ব্রীজের রেলিং ভেঙে গাড়ি নদীতে পড়ার আগে আমিও সেই জমাট বাধা রক্তাক্ত মুখ দেখিছি। আর সীমাহীন লালচে গতের্র অতলে আমরা বাসসমেত হারিয়ে গেলাম চিরতরে।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত