সেই রাতের কথা এখন মনে পড়লেও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন আব্বা ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন। আমরা থাকি সিভিল সার্জনের বাংলোতে। সাহেব কোয়ার্টারে। বিশাল বড় বাংলো। অনেক প্রাচীন গাছপালায় ঠাসা। কত গাছপালা! তেঁতুল গাছ, মেহগনি, কাঁঠাল, আম, বেল, আতা- কত রকম গাছ।
বাড়িটায় একটা প্রাচীন প্রাচীন গন্ধ আছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হয়। দোতলায় আমরা থাকি। বেশ খোলা একটা ব্যালকনি আছে। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী স্পষ্ট দেখা যায়। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোয় আমরা সেখানে এসে বসি। বসে বসে চা খাই, চাঁদ দেখি, গল্প করি।
আমার ঘরটা হচ্ছে ডানপাশে। বিরাট বড় জানালা। জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়। নদীর ওপারে শ্মশানঘাট। মাঝরাতে চাঁদের আলোয় এক অপার্থিব জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে কবিতা লিখতে বসি। আমি ছোটবেলা থেকেই সাহসী। সাহসের আমার কোনো অভাব নেই। আমার ঘরে দুটো জানালা। তখন গরমের দিন। নদী থেকে হু হু করে হাওয়া আসে। আমি দুটো জানালা খুলে ঘুমিয়ে থাকি।
মাঝে মাঝে দূর থেকে মাঝিদের গান ভেসে আসে। খুব ভাল লাগে শুনতে। রাতে বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। এরপর একদিন এল সেই রাত। সেই রাতের কথা ভাবলে এখন মনে হয় এটি দুঃস্বপ্ন ছিল।
আমার ঘুমাতে ঘুমাতে ১১টা-১২টা বেজে যায়। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেব। রাত জেগে পড়াশোনাও করি। সেদিন ছিল জুন মাসের ১২ তারিখ। আমি পড়াশোনা করে শুয়ে পড়েছি। যথারীতি জানালা দুটো খোলা। নদী থেকে বাতাস আসছে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ল্যাম্পপোস্টের আলোটাও নিভে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমি জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েকটা তারা জ্বলছে নিভছে আকাশে। এক সময় অন্ধকারটা সহনীয় হয়ে গেল। হালকা একটা আলো ফুটে উঠছে। জানালাটার দিকেই তাকিয়ে আছি। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। গির্জার পেটা ঘণ্টায় তখন ঢং ঢং করে দুটো বাজল।
একসময় দেখলাম জানালা দিয়ে কালো কালো ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে কী যেন একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে। আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম জানালার দিকে। দেখলাম ধোয়াগুলো আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে। চিৎকার দিতে চাইলাম। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ধোঁয়ার কুণ্ডলিগুলো আস্তে আস্তে আমার বুকের ওপর এসে আমার দম বন্ধ করে দিতে চাইছে!
মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি। ভয়ে, আতঙ্কে মরার মতো পড়ে রইলাম। আমার শরীরে নড়াচড়া করার ক্ষমতাও আর অবশিষ্ট নেই। ঠিক কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। একসময় মনে হলো আমি যেন নড়তে পারছি। হাত-পা শিথিল হয়েছে। মনে মনে আল্লাহ-আল্লাহ বলে একসময় ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে লাইট জ্বাললাম।
ঘড়িতে দেখলাম তিনটা বাজে। জানালাগুলো বন্ধ করলাম। তারপর আয়াতুল কুরসি পড়ে বসে রইলাম। সারারাত আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হতে থাকে, এই বুঝি আবার কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো আমাকে মেরে ফেলবে। একসময় সকাল হলো। আম্মাকে বললাম রাতের কথা। কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই বলল তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছ। আজেবাজে বই পড় আর চিন্তা কর- তাই এসব দেখো। এ ঘটনা কিন্তু এখানেই থেমে থাকলো না।
এরপরের দিন রাতেও ঠিক দুটোর সময় এক অস্বস্তি নিয়ে জেগে উঠলাম। তারপর আমার সারা গা শিউরে উঠল। মনে হলো বুকের মাঝে কী যেন চেপে বসেছে। আবার দমবন্ধ অবস্থা। ভয়ে-আতঙ্কে আমি চিৎকার করতে চাইলেও পারি না। একসময় সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। লাইট জ্বাললাম। দেখলাম কিছু নেই। এভাবে প্রায় প্রতি রাতে দুটো বাজলেই আমার এরকম অনুভূতি হতো। তবে আলো জ্বেলে রাখলে ভয় পেতাম না।
এরপর থেকে আমি কখনোই জানালা খুলে ঘুমাতে পারতাম না। সারারাত আমার ঘরে আলো জ্বলত। যে দিন লোডশেডিং হত বা ঝড়-বৃষ্টি হত, আমি আম্মার পাশে গড়িয়ে ঘামাতাম। আম্মা আয়তুল কুরসি পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিয়ে দিতেন।
তবে তখন থেকেই মাঝে মাঝে ভৌতিক স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যেত। একদিন দেখলাম একটা প্রাচীন বাড়ির মধ্যে আমি বন্দি হয়ে আছি। চারদিকে ঘর অন্ধকার। আমাকে কে যেন গলা টিপে মারতে আসছে। আমি ক্রমাগত দৌড়াচ্ছি। ঘুম ভেঙে দেখি ঘামে আমার কামিজ ভিজে গেছে।
এরপর থেকে ওই বাংলো বাড়িটিকে আমার আর ভালো লাগতো না। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ঢাকায় চলে আসি। এপর আর ওই ধরনের দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করেনি।