যাদের দাদা-দাদি এখনও বেঁচে আছেন তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনা যিনি শোনেননি তাদের মতো দুর্ভাগা আর নেই। আমি কিন্তু ওইসব দুর্ভাগার কাতারে নেই। আমি শুধু দাদির কাছ থেকে নয়। দাদির বোনের কাছ থেকেও শুনেছি তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব অদ্ভুত গল্প।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে তার কাছ থেকে শোনা অদ্ভুত গল্প আজ আপনাদের বলবো। সেদিন থেকে ৩০ বছর আগে ঘটে যাওয়া দাদির জীবনের অদ্ভুত একটা গল্প আমাকে শোনান। আগেই বলে নেই, আমাদের জেলার প্রধান ডোম দুলাল মিয়া (যিনি মৃত মানুষকে কেটে ময়না তদন্ত করেন) আমার দাদির দূসম্পর্কের ভাই হন।
একদিন আমার ওই দাদির মেয়ের বাড়ি কাকচিড়া থেকে তার বাড়ি কদমতলা আসছিলেন। এখনকার মতো ওই সময় গাড়ির ব্যবস্থা না থাকায় তিনি হেটেই আসছিলেন। দূরত্ব অনেক হওয়ায় জেলা শহরে আসতেই রাত হয়ে যায় তার। কি আর করা একা আর বাড়ির পথে যাওয়ার সাহস না করে চলে গেলেন শহরের চরকলোনিতে তার ভাই ডোম দুলালের বাসায়।
তিনি বাসায় যাওয়ার পরে হাসি খুশি সবাই। আমার দাদির ভাই ডোম দুলালের ঘর (রুম) ছিলো একটা। ঘরটির অবস্থান ছিলো নদীর একেবারে পাশেই। বলতে গেলে দূর থেকে ঘরটা দেখলে মনে হবে ভূতুরে কোন বাক্স যেন। তার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় জড়াজীর্ণ ওই একরুমের ঘরেই তিনি ও তার স্ত্রী থাকতেন। জড়াজীর্ণ ঘর হলেও সেদিন রাতে তিন জনের হাসি তামাশার কোনো কমতি ছিলো না তাদের।
কিন্তু ভাইর বাড়ির এই হাসিখুশি আবহটা যে এই তিন জনের বাইরে আরেক লোক শেষ করে দিবে তা তখনও জানতেন না কেউ। যা হোক, রাত তখন ৮টা, খাবার খেয়ে শুতে যাবেন সবাই। তবে একটা সমস্যা ছিল। ঘর একটা, সেই ঘরে শোয়ার খাটও ছিলো একটা। কিন্তু মানুষ তিনজন। তাই অতিথি হিসেবে দাদিকে ঘুমুতে দেয়া হলো খাটে। আর দাদির ভাই আর তার স্ত্রী ঘুমালো নিচে মানে খাটের পাশেই মাটিতে।
এসময় দুলাল বললো ‘আপা আমরা দুই জন নিচে ঘুমাই, কারণ আমাদের ঘরে একটা লাশ আছে। লাশটা খাটের নিচেই আছে। কালকে এটা কাটতে হবে, আপনি আবার ভয় পাবেন না। একদিন আমাদের সবারই মরে যেতে হবে। তাই লাশকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই’
এই বলে তারা স্বামী-স্ত্রী ওই লাশের পাশেই মাটিতে মাদুর পেতে ঘুমিয়ে পরলো। তাদের কাছে এমন মনে হয় যেন লাশটি কোন মানুষের নয়। ওটা কোন একটা মৃত মুরগির দেহ। তাদের কাছে লাশটা মুরগি মনে হলেও আমার দাদির কাছে কিন্তু মুরগি নয়। লাশের থেকেও বড় কোন ভয়ঙ্কর কিছু মনে হলো।
ওই সময়টার কথা বলতে গিয়ে দাদি বলেন, ‘তখন যেন মনে হচ্ছিল আমি অর্ধেক মরে গেছি। যখনই বালিশে মাথা রাখি তখনই মনে হয় আমি যেন লাশের বুকের ওপরে মাথা রাখছি। ইচ্ছে হচ্ছিল পাখির মতো উড়ে নিজের বাড়ি চলে যাই। সেদিন পুরো রাত আমি কীভাবে কাটিয়েছি তা আমার মনে নেই। সেদিন বেঁচে ছিলাম, নাকি মরে গিয়ে আবার ভোর রাতে বেঁচে উঠেছিলাম তাও জানি না। ’
দাদির কাছে বাস্তব গল্প শুনে ডোম দুলালের দুঃসাহস কত তা এবার নিজে দেখার ইচ্ছে হলো। আমাদের জেলায় ডোম দুলালকে এক নামেই সবাই চিনে। তিনি যে কতটা সাহসী তা কম বেশি সবারই জানা। দাদির কাছে ওই ঘটনা শুনে চিন্তা করলাম এবার আমি নিজেই যাবো তার কাছে। সরাসরি শুনবো তার কাছ থেকে অদ্ভুত সব বাস্তব গল্প।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তিনি জেলার চরকলোনিতে এখন আর থাকেন না। এখন তিনি থাকেন ঢলুয়া পোটকাখালীতে সরকারিভাবে দেয়া লাশ কাটার ঘরেই। একদিন দুপুরে ছুটে গেলাম জেলার প্রধান ময়নাতদন্ত ঘরে (লাশ কাটার ঘর)। ওখানে গিয়ে দেখলাম অদ্ভুত এক কাণ্ড।
প্রধান সড়ক থেকে বাগানের মাঝ দিয়ে ভাঙা জোড়া ইটের সড়ক পাড় হয়েই ওই লাশ কাটার ঘর।
বাড়িটি দুই রুম বিশিষ্ট, দুটি রুমেই লাশ কাটা ঘরের আদলে তৈরি। মানে লাশ কাটার জন্য দুই রুমেই একটি করে সিমেন্ট ও টাইলস দিয়ে তৈরি দুটি করে খাট। যার ওপরে লাশ রেখে কাটাকুটি চলে মানে ময়নাতদন্ত করা হয়।
আমার জন্য অবাক হওয়ার ঘটনা হলো ঘরের পশ্চিম পাশের রুমটায় কাটা হয় লাশ, এছাড়াও পচা ও গলিত লাশগুলোও দিনের পর দিন রাখা হয় ওই রুমে। আর পূব পাশের রুমেই থাকেন ডোম দুলাল। লাশ কাটার জন্য তৈরি খাটেই ঘুমান তিনি।
তিনি শুধু লাশই কাটেন না, পাশাপাশি তিনি কবিরাজ হিসেবেও বেশ পরিচিত। তার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক সাহস করে পূব পাশের রুমে ঢুকলাম। ওই ঘরেও ভয় পাওয়ার মতো অনেক কিছুই তিনি রেখেছেন।
রুমের চারপাশে সাজিয়ে রেখেছেন অদ্ভুত সব জিনিসপত্র। কাঁচের বোতলে তেলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন পাঁচ/ছয় মাস বয়সের মৃত শিশুদের দেহ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারী লাশের পেটে থাকা ওইসব শিশুর দেহ আমি রেখেছি, ওগুলো আমার কবিরাজি কাজে প্রয়োজন হয়।
লাশ রাখার পাশের রুমেই আপনি নিজে থাকেন, অদ্ভুত কোন ঘটনার সাক্ষী আপনি হয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে আচমকাই অট্টহাসি দিয়ে ডোম দুলাল বলেন, ‘এ আর নতুন কি, ওসব ঘটনা আমার সামনে প্রতিনিয়তই ঘটে’।
বিশেষ অনুরোধে চেপে ধরলাম তাকে সেসব ঘটনার কিছু বলার জন্য। তেমন গাঁইগুঁই না করেই তিনি বলা শুরু করলেন। সেইসব কাহিনীর একটা আজ বলবো। ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর। ওইদিন পশ্চিম পাশের রুমে একটি লাশ ছিলো। রাতে শুরু হয় ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় সিডর।
ডোম দুলাল তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে যান ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে। পরের দিন ওই লাশ কাটা ঘরে এসে দেখেন ঘরের তালা ঠিকই আগের মতোই আছে। রুমের জানালাতো আগেই নেই। তাই রুমের জিনিসপত্র কিংবা লাশ পানিতে ভেসে যাওয়ার কথা না।
কিন্তু সেদিন ঘটনা ঘটলো উল্টো, ওইদিন রুমের দরজা খুলে দেখা গেলো ঘরে থাকা লাশটি আর নেই। আশপাশে বহু খোঁজাখুঁজির পরেও লাশটি পাওয়া গেলো না। যে ঘরে দরজা ছাড়া শুধু পানি যাওয়ার দুই ইঞ্চি পরিমাণে ফাঁক ছাড়া ভেতরে ঢোকা-বের হওয়ার আর কিছুই নেই, সেই ঘর থেকে কীভাবে একটি আস্ত লাশ উধাও হয়ে গেলো! বাকি অন্যসব জিনিসপত্র যার যার স্থানেই আছে। কেন এমন হলো? এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও দিতে পারেননি।
তবে ওই ঘটনার তিন দিন পরে লাশটি পাওয়া গেছে ঠিকই। কিন্তু লাশ কাটার ঘর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মানে জেলার পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামের একটি খালের পারে! এরও জবাব নেই!