রাত বারোটা দীপের দক্ষিণ দিকটায় ঘন বনের মধ্যেও হালকা জ্যোস্নার আলোয় পরিবেশটা অন্য রকম তৈরি করেছে। হেনরি ও মাইকেল ধীর পায়ে হেঁটে চলছে দীপের ভেতরের দিকটায়,অদ্ভুত একটা দীপ সম্পূর্ণ শুনসান মনে হয়না কোন জীবজন্তু বসবাস করে। আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময় ঝড়ের তান্ডবে লঞ্চ চলে আসে এই অজানা দীপে। দীপে হেনরি ও মাইকেলদের আজ দ্বিতীয় দিন তাদের সাথে আরও নয় জন আছে।কিন্তু আজ দীপটা ঘুরে দেখতে হেনরি ও মাইকেল পথ হারিয়ে ফেলে আর তাদের নিদিষ্ট গন্তব্যে যাওয়া হয়নি।
হেনরি ও মাইকেল একটা বিষয়ে বেশ অবাক হচ্ছে তা হলো এই দীপে গাছগাছালি ছাড়া অন্য কোন জীবজন্তুর অস্তিত্ব লক্ষ করিনি। দুজনে হাটতে হাটতে দীপের বেশ গভীরে চলে আসে,এই দিকটায় গাছগাছালি সহ বেশ কিছু টিলায় জঙ্গলটাকে বেশ ভয়ানক করে তুলেছে। হেনরি ও মাইকেল ভাবে এসব টিলায় কোন গুহা থাকলে আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব। দুজনে যখন টিলার দিকে রওনা দিবে তখনি তাদের পিছন থেকে শো শো করে কিছু চলে যাওয়ার শব্দ শুনে দুজনেই ফিরে তাকায়। আকস্মিক এমন শব্দে দুজনের মনেই ভয়ের বাসা বোণে। পিছনে ফিরে দুজনই অবাক তাদের চোখে কিছু পড়ে না। তখনি আবার মনে হয় পিছন থেকে জঙ্গল ভেঙে চুরে কেউ যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আবার দুজনে পিছনে ফিরে তাকায় সাথে সাথেই সব কিছু স্বাভাবিক মনে হয়।
দুজনেরই ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠে। হেনরি ও মাইকেল দুইজনেই দৌড় দেওয়ার প্রস্তুত নেয় কিন্তু তাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে, পিচ্ছিল জাতীয় কিছু তাদের পাকে আটকে রেখেছে,পিছন থেকে কেউ এসে তাদের কানের কাছে এসে বলছে আমার রাজ্যে প্রাণ নিয়ে আসা খুবই সহজ কিন্তু প্রাণ নিয়ে ফিরে যাওয়া অসম্ভব বলেই হেনরির ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে সেই রক্তের ফোরোয়া গিয়ে পড়ে মাইকেলের মুখে তখনি ট্রেনের হুইসেলে রহিত বাস্তবে ফেরে এতক্ষণ ভৌতিক একটা উপন্যাস পড়ছিল সে, বইটা বন্ধ করে নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
বাইরে বেরিয়ে হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় রাত নয়টা এখন ও তার নিজ গন্তব্যে যেতে দুই ঘন্টা লাগবে সম্ভাবত।
এখানে এসেছে তার এক কলিগের বাড়িতে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে সেগুলো করবে দুজনে এক সাথে, তার কলিগকে স্টেশনে আসতে বলেছিল কিন্তু তার জরুরি এক কাজে বাইরে যেতে হয়েছে।স্টেশন থেকে একটা রিকশা নিয়ে যাত্রা করে তার গন্তব্যের দিকে, গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে থাকে রিকশা। রিকশাওয়ালা রহিতের কাছে জানতে চায় সে কোন গ্রামে যাবে। রহিত বলে — বল্লমপুর। নামটা শোনা মাত্রই রিকশাওয়ালা চুপ হয়ে যায়। রহিত বেশ অবাক হয়,তার মনে কৌতুহল জাগে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে-
— কি ব্যাপার নামটা শোনা মাত্রই আপনি কেমন চুপ হয়ে গেলেন, কারণ কি?
— না তেমন কিছু না,এমনিতেই। রহিত জানে রিকশাওয়ালা তার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু রহিত ও ছাড়ার পাত্র নয়। রহিতের কৌশলে অবশেষে রিকশাওয়ালা মুখ খোলে বলে-
— আপনি যে গ্রামে যাচ্ছেন, সেই গ্রামে ঢোকার আগ মুহূর্তে রাস্তার পাশেই একটা শশান দেখতে পারবেন। জায়গাটা বেশি ভালো না,রাতের গভীরে ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে নাকি কেউ আর ফিরে আসে না।নানা ভৌতিক ঘটনা আছে ঐ স্থানকে ঘিরে। রহিতের ছোটবেলা থেকেই ভৌতিক বিষয়ে বেশ কৌতুহল, তার ইচ্ছে তার সাথে কোন ভৌতিক ঘটনা ঘটুক সে এসব উপভোগ করতে বেশ কৌতুহল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার সাথে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।অনেক ভৌতিক বাড়িতে রাত্রি যাপন করছে কিন্তু তার আশা পূর্ণ হয়নি। হয়ত যারা চায় তাদের সাথে অদ্ভুদ কিছু ঘটুক কিন্তু তাদের সাথে কিছুই ঘটে না, আর যারা চায় না তাদের সাথেই ঘটে। রহিত এ পর্যন্তু যে কত ভৌতিক উপন্যাস পড়েছে তার হিসেব নেই।
— রহিত রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে যাক অনেক দিনের আশা আজ পূর্ণ হয় নাকি দেখি।
— কিসের আশা?
— ভুতের সাথে সাক্ষাৎ
বলেই রহিত হাসা শুরু করে। রহিতের হাসি হয়তো রিকশাওয়ালার সহ্য হয়নি তাই হঠাৎই রিকশা থামিয়ে দেয়।
রহিত অবাক হয়ে বলে –
— কি ব্যাপার থামালেন কেন?
— এখান থেকে আপনাকে একাই যেতে হবে এই বলে মাঠের মধ্য দিয়ে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে দ্রুত রিকশা ঘুরিয়ে অপর দিকে চলে যায়।
পরোক্ষণে রহিতের মনে পরে তাকে তো ভাড়া দেওয়া হয়নি সেই জন্য জোরে জোরে রিকশাওয়ালাকে ডাকতে থাকে কিন্তু দ্রুততার সাথে রিকশাওয়ালা অন্ধকারে মিশে যায়। রহিত রিকশাওয়ালার এমন ব্যবহারে বেশ অবাক হয়ে যায়। রহিত হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বিশ মিনিট। গ্রামের দশটা মানে গভীর রাত। যাইহোক রিকশাওয়ালার দেখানো মেঠো পথ দিয়ে হাটতে থাকে রহিত। মনের মধ্যে তার নানা কৌতুহল জমাট বাধছে আজ কি তার আশা পূর্ণ হবে। তার এমন অদ্ভুত আশা তার মা একটু ও পছন্দ করে না। অনেক বার রহিতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এতে অনেক বিপদ হতে পারে নাকি রহিতের তা নিয়ে বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নেই।
হাটতে হাটতে বেশ খানিকটা পথ চলে আসে রহিত। রিকশাওয়ালার বর্ননা অনুযায়ী বেশ কিছু দুর দুরে শশানের মত একটা স্থান চোখে পড়ে রহিতের। শশানের পরে জঙ্গল টাইপের কিছু মনে হলো রহিতের কাছে। আস্তে আস্তে এগোতে থাকে রহিত। শশানের কাছে আসতেই কেন যেন শরীরটা ভার হয়ে আসে,এর আগে তো কখনো এমন হয়নি তার।তবুও সাহস যুগিয়ে সামনে এগোতে থাকে। জঙ্গলের কিছুটা দুরে থাকতেই মনে হয় পেছন থেকে কেউ তাকে অনুসরণ করছে,পিছনে ঘুড়ে তাকায় রহিত কিন্তু কেউ নেই।আবার মনে হয় সামনের জঙ্গল থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে মুহূর্তে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় তার সামনে একটা লোক দাড়িয়ে আছে। রহিত আচমকা লোকটাকে দেখে ঘাবড়ে যায়। গায়ের লোম গুলো খাড়া হয়ে উঠে।
— কে কে আপনি? লোকটা রহিতের প্রশ্ন তার নিজের দিকেই ছুড়ে দিয়ে বলে-
— তুমি কে?
— রহিত, শহর থেকে এসেছি কিন্তু আপনি এত রাতে এখানে কি করেন?
— ভুতের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছি বলেই হো হো করে হাসতে লাগল।
লোকটার হাসিটা রহিতের কাছে অসহ্য লাগছিল। তবুও নিজেকে সংযত করে রহিত,এতক্ষণ পর লক্ষ করে লেকটির সব অঙ্গি ঠিক ঠাক তবে মাথা কাপড় দিয়ে পেচানো রয়েছে। রহিতের মনে সন্দেহ হয় তাই লোকটিকে জিজ্ঞেস করে
— কি ব্যাপার আপনার মাথাটা কাপড় দিয়ে পেচানো কেন?
— কোন ভৌতিক স্থানে আসতে হলে কিছু নিয়ম কানুন মেনে আসতে হয় যাতে নিজের কোন ক্ষতি না হয়।সেই জন্যই মাথায় কাপড় পেচানো। তা তুমি ও তো ভৌতিক বিষয়ে কৌতুহলি তাই না? লোকটির কথায় রহিত অবাক হয়ে বলে –
— কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
— আমার থেকে অনেক কিছু জানার আগ্রহ জেগেছে তোমার মনে, তোমার মুখ দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে তাই বললাম। যদি কিছু মনে না করো তাহলে চলো ঐ পাশটায় পুকুর আছে সেখানে গিয়ে দুজনে কথা বলি। কোন দ্বিধা ছাড়ায় রহিত লোকটির পিছু পিছু হাটতে থাকে। পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে দুজনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে লোকটি বলে উঠে–
— কিছুর একটা পোড়া গন্ধ আসছে এখানে তুমি কি পাচ্ছ।
— রহিত জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বুঝতে পারে অনেক দিনের মৃত কোন পশুপাখির শরীর পচে যে গন্ধ হয় সেটারি গন্ধ।
দুজনের মধ্যে বেশ কথা চলতে থাকে, এরি মধ্যে বাতাসের বেগ কিছুটা বেড়ে যায় পচা গন্ধটাও তীব্র হতে থাকে।
রহিতের মনে হচ্ছে যেন তার পাশ থেকেই এই গন্ধটা আসছে। রহিত হঠাৎ লক্ষ করে বাতাসের বেগে লোকটির মাথায় পেচানো কাপড়ের কিছু অংশ সড়ে গেছে মাথার সেই অংশ থেকে ঝড়ঝড় করে রক্ত পড়ছে। লোকটির হাতের দিকে চোখ পড়তেই রহিতের শরীর হিম হয়ে উঠে। লোকটির হাত থেকে মাংস খসে খসে মাটিতে পড়ছে।
বাতাসের গতি যেন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে লোকটির মাথায় পেচানো কাপড় উড়ে গিয়ে পড়ে পুকুর পাড়ে। তাতক্ষণিক লোকটি উঠে রহিতের সামনে দাঁড়িয়ে যায়, রহিত তার মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় এ যে সেই রিকশাওয়ালা।
রহিতের দম বন্ধ হয়ে আসে তবুও সে জোরে চিৎকার করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে লোকটি রহিতের গলা চেপে ধরে এক ঝটকায় ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে নেয়,রক্তের ফোরোয়া গিয়ে পড়ে লোকটির মুখে মুহূর্তে রহিতের সব রক্ত চুষে শেষ করে নেয়। রহিতের দেহ অশাড় হয়ে পড়ে থাকে পুকুর পাড়ে ।লোকটি আবারও মাথায় কাপড় পেচিয়ে বেরিয়ে পড়ে পরবর্তী শিকারের সন্ধানে।
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক