_ কোলকাতায় কেটে গেছে বছর দুয়েক। চাকরিশূন্য তখনও। বাবা বলল, বাড়ি যেতে। আমি নাকচ করে দিয়ে আরও কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করতে হয়েছিল বৈকি। তারপর গিয়ে বাবা মত দেন, রাজি হন আরও কিছুটা সময় দেওয়ার। চাকরি কি আর হাতের মোয়া! চাইলাম আর পেয়ে গেলাম।
__ চাকুরী সন্ধানের জন্য গাইড লাইনের প্রয়োজনে সুদূর গড়িয়া স্টেশানে পড়তে যেতাম। প্রাইভেটে পড়তাম। রাইস-মাইসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে পড়ার কোনো রকম প্রবৃত্তি আমার কস্মিন কালেও ছিল না।
__ সেই সূত্র ধরে আমার এক বন্ধু জুটেছিল। রক্তিম। সে ও জুতোর সোল খোয়াচ্ছে অনেকদিন হ’ল। সিকে ছেঁড়েনি ভাগ্যে। একটু আলাপ পরিচয় হবার পর জানলাম, ওর ও নিবাস শ্যামবাজারের কাছেই। আমি থাকতাম রাজবল্লভ পাড়ার একটি মেসে।
__কিছু দিনের মধ্যেই আমরা বেশ বন্ধু হয়ে উঠলাম। পড়তে যাবার সময় একসাথেই যেতাম বেশী। বাগবাজার-গড়িয়া স্টেশান গামী সাদা বাসে, রাজবল্লভ পাড়া থেকে উঠে দু’টো সীটের দখল নিতাম। রক্তিম উঠত শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে। সারা রাস্তায় জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা কখোনো ইংলিশ, জি কে এইসব আলোচনা করতে করতে যেতাম। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তায় চলত, আমাদের গ্রুপ স্টাডিজ।
__এরকম ই একটা সকালে রক্তিমের জন্য বরাদ্দ সীট ও এসে ভরাল না। একরাশ মনখারাপ নিয়ে একাই পড়তে গেলাম স্যারের কাছে। সেখানে পৌঁছে ও দেখলাম, রক্তিম ডুব মেরেছে। পড়া শেষে, বেরিয়েই ওকে ফোনে ধরলাম। অনেকবার বেজে বন্ধ হয়ে গেল। উত্তর পেলাম না।
__মেসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাবারের একটা গাল সবে মুখের সামনে ধরেছি। ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে রক্তিমের নাম ভেসে ওঠা দেখেই ঈগলের মতো ছোঁ মেরে ফোন টা রিসিভ করলাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ মাত্র না দিয়ে…
–“বিকেলে ঘোষের কেবিনে দেখা করিস। কথা আছে”। বলেই ফোন কেটে দিল।
__যথা সময়ে বেশ পরিপাটি হয়ে আমি পৌঁছে গেলাম, ‘ঘোষ কেবিনে’। বসেই আছি। অনেকক্ষণ বসে থেকে, কিছুটা বিরক্ত হয়েই উঠে যাচ্ছিলাম। দেখি দরজার প্রবেশ পথ ধরে রক্তিম আসছে। আমি হাত তুলে ওকে ডাকলাম। কাছে আসতেই…
–“কিরে এত জরুরী তলব করে নিজেই বেপাত্তা”?
–“আজ পড়তেও গেলি না”।
–“রোশো বন্ধু”।
__রক্তিমের কথায়, ফুলস্টপ টানি।
–“বাবা কদিন থেকে খুব প্রেশার দিচ্ছিল। আর টাকা পাঠাতে পারবে না, জানিয়েও দিয়েছিল। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে বলেছিল”।
__রক্তিমকে থামিয়ে আমি বলে উঠলাম,
–“এসব আবার কবে হল”?
–“চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। তাই চেষ্টা চালাচ্ছিলাম একটা বেসরকারী চাকরীর। এক বন্ধুর কারণে পেয়ে গেলাম, একটা চাকরি। ভেবেছিলাম সব ঠিকঠাক হলে তোকে জানাব। আজ ঠিক হয়ে গেল সব”।
__হাত তুলে ইশারায় রক্তিমে আবারও থামিয়ে,
–” কোথায় কি চাকরি”?
–“তাহলে স্যারের কাছে আর যাবিনা”!
–“স্যার কে জানিয়েছিস”?
–“তোর মতো একটা ব্রাইট স্টুডেন্ট… স্যার দুঃখ পাবেন…..
__কথা শেষ করতে দেয় না রক্তিম। আমাকে থামিয়ে বলে ওঠে,
–“স্যার কে সব জানিয়েছি। শনি-রবি স্যারের কাছে যাব”।
__আমি আবারও বলে উঠি,
–“কিসের চাকরি বললি না”?
–“কল সেন্টারে”।
–“রাতের দিকে ডিউটি নিয়েছি, বস কে বলে”।
–“বাকি সময় টা সরকারি চাকুরীর জন্য প্রস্তুতি নেব”।
–“মাইনে যা দেবে চলে যাবে আমার”।
__একটানা কথাগুলো বলে থামল রক্তিম।
–“তাহলে তোর সাথে আর দেখা হবে না”। বিমর্ষ হয়েই বললাম।
–“সে ব্যবস্থা করে এসেছি। স্যার কে বলে, শনি-রবি তোকে সঙ্গী করে নিয়েছি। বাকি তিন দিন যেমন যাস যাবি”।
__রক্তিমের কথায় এক চিলতে হাসি ফুটল মুখে।
__এরপর বেশ কিছুদিন সময় পেরিয়ে গেছে। আমাদের জীবন যাত্রার একটু পরিবর্তন ঘটেছে। একটা বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম রক্তিমের কথা বার্তায়। দেখে হলেই একটা বিশেষ ভাষা প্রয়োগ করত ও।
__শনিবারের এক সকালে, পুরোনো প্রথাগতভাবে ওর জন্য সীট রেখে রাজবল্লভ পাড়া থেকে গড়িয়া স্টেশানের বাসে উঠলাম। রক্তিম উঠল শ্যামবাজার থেকে। বাসে উঠেই আমার দিকে তাক করে,
–” bonjour”!
__আমি, ওর কথার মানে না বুঝে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
__ মাথায় গাট্টা মেরে, রক্তিম বলে ওঠে…
–“এটি ফ্রেঞ্চ ভাষায়, Good morning “!
–“তুই আবার ফ্রেঞ্চ কবে থেকে শিখছিস, বলিসনিতো”!
একটু রাগত ভাবেই বললাম।
__আগে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা জি.আই, জি. কে এসব আলোচনায় সাঙ্গ হত। তার জায়গা দখল করেছে রক্তিমের টুকরো টুকরো ফ্রেঞ্চ কথায়।
__এই তো সেদিন। পড়া শেষে মেসে ফিরছি। রীতিমতো ও শ্যামবাজারে নেমে যাবে। নামার আগে আবারও সেই ফ্রেঞ্চ বিদ্যা অ্যাপ্লাই করল…
–“A bientot”
__আমি মানে জিজ্ঞেস করার আগেই ও নেমে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম একদিন ওর সাথে এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করব।
__না! সেদিনের পর থেকে রক্তিমের সাথে আমার অনেক দিন দেখা হয় নি। ফোনেও পাইনি। স্যারকে জিজ্ঞেস করেও কিছুই জানতে পারিনি। শনি-রবি স্যারের কাছে যাওয়া কার্যৎ বন্ধ।
__এরপর আরও কয়েক মাস কেটে গেছে। রক্তিমের কোনো খোঁজ পাইনি।
__একদিন সন্ধ্যায় মেসের ঘরে বসে পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত। সাইলেন্ট মোডে থাকা ফোনে হঠাৎই কাঁপুনি দেখা দিল। উল্টোদিকে ফেলে রাখা ফোন সোজা করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে চমকেই উঠলাম। চমকে উঠলাম এতদিন পর রক্তিমের ফোন পেয়ে।
–“salute”
–“allo”
__ বিরক্ত হয়ে একটু তিক্ত স্বরেই বললাম,
–“ঠিক করে কথা বলতে হলে বল। নইলে রাখ ফোন “।
__রক্তিম একটু শুষ্ক কন্ঠে বলে ওঠে,
–“তোকে আমার বাড়ির ঠিকানা পাঠাচ্ছি”।
–“প্লিজ। কাল আয়”।
–“অনেক কথা আছে”।
__একইরকম ভাবে নিজের বলা কথা শেষ করে ফোন কেটে দেয়, রক্তিম।
__কথামতো পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। রক্তিমের বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাওড়া স্টেশান থেকে মেদিনীপুর গামী একটি ট্রেনে চড়ে বসলাম। প্রায় দুই কি আড়াই ঘন্টা পর মেদিনীপুর স্টেশান পৌঁছলাম। সেখান থেকে একটি রিক্সায় কালেক্টার রোডের বাড়ি, রক্তিমের বাড়ি পৌঁছালাম।
__ভীষণ ক্লান্তি থাকায় দুপুরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে একটা সুখ নিদ্রা দিলাম। তিন ঘন্টার নিদ্রাভঙ্গ যখন হল তখন আকাশে গোধূলির রঙ লেগেছে।
__রক্তিমের বাড়ির সবার সাথে পরিচয় পর্ব আগেই হয়েছিল অল্প করে। বাকিটুকু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেরে ফেললাম। রক্তিমের দিকে তাক করে,
–“কি বলবি বলছিলি”?
–“যার জন্য তলব করলি”!
__রক্তিম শুরু করল যখন তখন ঘরের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্ট।
–“তোর সাথে সেদিন পড়ে ফিরে সবে মেসের দরজায় পা দিয়েছি। বসের ফোন। রাতের ডিউটি তে কেউ নেই। আমাকে যেতে হবে। এর জন্য এক্সট্রা টাকা দেবে। লোভ সামলাতে না পেরে গেলাম রাতের ডিউটি করতে”।
__রক্তিমকে থামিয়ে, সেদিনের ফ্রেঞ্চ কথাটার মানে জানতে চাই।
–“A bientot__ see you soon”
–“সেদিন তোকে এটাই বলেছিলাম”।
__রক্তিম থামলে বলে উঠি,
–“তুই ফ্রেঞ্চ কি করে জানলি”?
__একটু চুপ থেকে রক্তিম বলে ওঠে,
–“সে সব জানাব বলেই তোকে ডেকেছি”।
__রক্তিম কি একটু ভেবে শুরু করল,
–” রাতের কল সেন্টার পুরো খাঁ খাঁ করত। প্রথম দিন একটু ভয় ভয় করছিল। ভয়টা কেটে গিয়েছিল একজন সঙ্গী কে দেখে। মনে একটু প্রশান্তি এসেছিল”।
__আমি বলে উঠলাম,
–“তারপর”?
__রক্তিম আবার শুরু করে,
–“প্রথম ক’দিন যে যার মতো কাজ করে ফিরে যেতাম। অফিস থেকে আমিই আগে বেরিয়ে আসতাম। বা আমি অফিস যাওয়ার আগে থেকেই সে উপস্থিত থাকত। মুখ গুঁজে নিজের ডেস্কটপে কাজ করত। ওই একদিন নিজে থেকে আলাপ করতে আসে।”
–“হুম”।
__একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি অপেক্ষায় থাকি রক্তিমের পরবর্তী কথা গুলো শোনার জন্য।
–“একটা রাতে আমিও আমার ডেস্কটপে মন দিয়ে কাজ করছি। সারা অফিসে আমি আর সে ছাড়া কেউ নেই। এমতাবস্থায়…..”
–“বঁসোয়া ম্যাদমোজায়েল”
_”একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় উঁচিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দেখি, একজন অপূর্ব সুন্দরী দু’হাতে দু’টি কফি কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে”।
–“আমার অবাক দৃষ্টি দেখে মেয়েটি বলে ওঠে….”
–“salute”
–” আমি তার কথার মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না দেখে মেয়েটি আবারও বলে ওঠে….”
–“ওহ্। সরি”।
–“আমি রঞ্জনা”।
__অনেকক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর অবস্থাটা একটু হালকা করার উদ্দেশ্যে আমি গুনগুনিয়ে উঠি,
–“রঞ্জনা আমি আর আসব না”।
__রক্তিম সহ পুরো পরিবারের নজর এখন আমার দিকে। কারণ ওই গম্ভীর মুহুর্তে আমি কি করে এতটা হালকা থাকতে পারি। আমার ইয়ার্কি করার স্বভাবে পরিচিত রক্তিম ও অবাক কম বিরক্ত বেশী মনে হল।
__রক্তিম ই কড়া সুরে বলে উঠল,
–“এটা ইয়ার্কির জিনিস নয়, তিথি”।
__বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। রক্তিম তো এত বিরক্ত হওয়ার মতো ছেলে নয়।
–“সরি” বলে পরের কথা গুলো বলার অনুরোধ করলাম।
__রক্তিম শুরু করল,
–” আমি ওর ওই সব শব্দের মাথা মুন্ডু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করাতে রঞ্জনা জানায়…”
–“ওগুলো ফ্রেঞ্চ শব্দ”।
–“রঞ্জনাকে ওই শব্দের মানে জিঞ্জাসা করার সাথে এও জানতে চাই ওর এই বিদ্যার কথা”।
__রঞ্জনা উত্তর করে,
–” বঁসোয়া ম্যাদমোজায়েল। অর্থ ফ্রেঞ্চ অভ্যর্থনা ”
–“Salute. এর অর্থ Hi”
–“শেষেরটা ফ্রেঞ্চ সম্ভাষণ”।
–“গোলপার্কের কাছে একটা ইন্সটিটিউশান আছে। যেখানে আমি এই ভাষা রপ্ত করার চেষ্টায় আছি। ”
__রক্তিম বলে,
–” তা তুমি এই কল সেন্টারে জব করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছ যে”!
__রক্তিমের কথার জবাবে রঞ্জনা উত্তর করে ওঠে,
–ধরে নাও পকেট মানি তে টান পড়েছে”।
__আমরা সবাই রক্তিমের কথা শুনছি। ঘরের মধ্যে কেউ কোনো কথা বলছে না। আমরা মানে আমি সহ রক্তিমের মা-বাবা আর এক বোন। মৌনতা ভঙ্গ করে বলে উঠলাম,
–“তারপর কি হল”?
__”রোজকার মতো অফিসে যাতায়াত করার ফলে আমার আর রঞ্জনার মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওর বদান্যতায় কিছু ফ্রেঞ্চ শব্দ আমিও রপ্ত করেছিলাম”।
–“যেগুলো তোর কাছে অ্যাপ্লাই করতাম”।
__আমার দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলে উঠল।
__রক্তিম আরও বলে চলল,
–“বেশ ভালোই চলছিল রাতের কল সেন্টারের কাজ। সারা অফিস জুড়ে শুধু আমি আর রঞ্জনা। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে, কাজের সাথে চলত নানারকম আলোচনা”।
__আবার একটু চুপ রক্তিম। আমি একটু বেশী অস্থির হয়ে পড়ছি। বড়ো গল্প না লাগে ধৈর্যের সাথে শুনতে ভালো লাগে না ভালো লাগে পড়তে। মনে মনে বলছি, “ওরে রক্তিম তাড়াতাড়ি শেষ কর। তোর এই এঁদো মার্কা গপ্পো “।
__এসব কথা জোরে বলার সাহস হল না। কারণ রক্তিমের পরিবর্তন আমার চোখে পড়েছিল। হঠাৎ হঠাৎ ওর ভাবুক হয়ে ওঠা আমার একটুও ভালো লাগছিল না। ওর মতো একটা চার্মিং ছেলের এই অকাল পরিবর্তন, কিছুটা অকাল বর্ষনের মতো ঠেকছিল আমার কাছে। আমার অস্থিরতার সাথে মুখ দেখে মনের ভাবের কথা রক্তিম বোধহয় বোধগম্য করতে পেরেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলে ওঠে…
–“তিথি! আর একটু ধৈর্য্য ধর”।
–“সব প্রশ্নের উত্তর পাবি”।
–“জানি তোর ধৈর্যের বড্ড অভাব”!
__একটু রাগ হচ্ছিল, রক্তিমের ওপর। যাইহোক। রক্তিম আবার শুরু করল,
–“সেই রাতে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অফিস গেলাম সেদিন। অফিসের গেটে বসে থাকা ওয়াচ ম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, রঞ্জনা ম্যাডাম এসেছে অফিস”?
–“আমার প্রশ্ন শুনে ওয়াচ ম্যান হাঁ হাঁ করে বলে ওঠে”..
—” রঞ্জনা ম্যাডাম কোথা থেকে এল, স্যার? সারা অফিসে আপনি তো একাই”।
__রক্তিম বলে উঠল,
–“ওয়াচম্যানের কথা শুনে তাকে এক ধমক দিয়ে একরাশ তিরস্কার করে সেখান থেকে অফিসে ঢুকলাম। সারা অফিসে কেউ কোথাও নেই। সারা অফিস খাঁ খাঁ করছে। লাইট গুলো দপ দপ করছে। প্রথমটা ভাবলাম, এই বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়ে রঞ্জনা আসবেই বা কি করে। মনকে শান্ত করলাম। নিজের জন্য বরাদ্দ করা জায়গায় চেয়ারে বসে ডেস্কটপ চালিয়ে কাজে মন দিলাম। হঠাৎই….”
_”হঠাৎই কি রক্তিম”? প্রশ্নকারী আমি।
__আমার দিকে তাকিয়ে রক্তিমের একজোড়া বিস্ফারিত চোখ। সেই অবস্থায় রক্তিম বলে উঠল,
–“কম্পিউটারে মুখ গুঁজে কাজ করছিলাম। মনটা রঞ্জনার দিকে পড়েছিল। ওর ফোন নাম্বারটা নেওয়া হয়নি। মনে মনে নিজেকে দুষতে লাগলাম। এইসব চিন্তার মাঝেই কিছু খুট খাট শব্দ কানে আসছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। কাজে মন দিলাম এই ভেবে আমি আর আমার ছায়া ছাড়া এ অফিসে কেউ নেই। হঠাৎই একটা ডেস্কে কম্পিউটার এর আলো জ্বলে উঠল। তার সাথে একটা গলা। নিশ্চিত করে বলতে পারি এ গলা আমার চেনা। রঞ্জনা কখন এল”!
–“আমাকে খুঁজছিলে, রক্তিম”?
–“তুমনে পুকারা অউর হাম চলে আয়ে”। রঞ্জনা দূর থেকেই বলে উঠল।
–“আমার মাথায় চিন্তাদের ভিড়। কখন কি করে এল রঞ্জনা”!
__ “রঞ্জনা বোধহয় আমার মনের অবস্থা ধরে ফেলেছিল”। রক্তিম বলে ওঠে।
–“আমি তো সেই কবে থেকেই তোমার সাথে ছিলাম, রক্তিম। তোমাকে ছেড়ে যাইনি তো! আমি সেই কবে থেকেই এই অফিসের তের নাম্বার টেবিলটা দখল করে বসে আছি”।
__ রঞ্জনার কথা গুলো রক্তিম কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। কি বলছে রঞ্জনা!
__ আবার রঞ্জনা, রক্তিমের কাছে এসে গা ঘেঁষে কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে…
–“ভাবছো তো কি যা তা বলছি”!
–“কোনো দিনও রেজিস্টার খাতায় আমার সই দেখেছো”?
__রক্তিমের সে সব দেখার প্রয়োজন হয়নি কদাপি। তাই দেখেনি। তবে আজ ওয়াচম্যানের বলা কথাটা মনে পড়তেই চমকে উঠল সে। কাঠ হয়ে বসে আছে রক্তিম। মনে অনেক চিন্তা ভিড় করেছে তার। রঞ্জনাকে সে কোনোদিন তার সাথে অফিস থেকে বেরোতে দেখেনি। বা অফিস আসতেও দেখেনি। শুধু তার উপস্থিতি দেখেছে এই অফিসে। তবে কি রক্তিম যা ভাবছে তাই!
__ একটা বিকট আওয়াজ। তের নম্বর টেবিল থেকে কম্পিউটার টা আপনা আপনিই পড়ে যায়। এবার একটু যেন ভয় পায় রক্তিম।
–” আমার অপেক্ষার অবসান হয়েছে আজ”।
–“তুমি আমায় মুক্তি দিতে সাহায্য করবে, রক্তিম”।
__রঞ্জনার কথায় রক্তিম তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞাসা করে,
–“আআআমি”।
–“কিকিকিভাবে”?
–“আমিই কেন”?
__ রঞ্জনা এবার বলে ওঠে,
–“শেষ ক’মাস এই অফিসে রাতের ডিউটিতে কেউ আসতে চাইত না। যে আসত, তারপর দিন বিদায় নিত। কারণ কেউ জানত না বা জানার চেষ্টাও করেনি। একমাত্র তুমিই এ কদিনে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছ। তোমাকে সব বলা যায়”!
__ রঞ্জনার কথা শুনে রক্তিমের শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মনে একরাশ প্রশ্ন ও জমে উঠল, কি এমন কথা যা তাকে বলা যায়!
— “জানো রক্তিম আমিও তোমার মতো পার্ট টাইম জব হিসেবে কল সেন্টারে জব করতাম। পকেট মানির সাথে নিজের পড়াশোনা আর ফ্রেঞ্চ বিদ্যা রপ্তে ব্যস্ত ছিলাম। অনেক স্বপ্ন নিয়ে কোলকাতা এসেছিলাম”।
__ রঞ্জনা থামলে রক্তিম একটু সাহসে ভর করে বলে ওঠে,
— “তারপর”?
__ রঞ্জনা আবারও বলা শুরু করে,
–” সব ঠিক ঠিক চলছিল। ছুটিতে ছিলাম সেদিন। বেসিক্যালি সবার ছুটি। এমারজেন্সি কাজের অজুহাতে বস আমায় অফিসে তলব করে। কিছুই বুঝিনি প্রথমটা। ভেবেছিলাম সবার তলব পড়েছে। অফিস এসে দেখি সারা অফিসে কেউ কোথাও নেই। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বস কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে কেবিনের দিকে যেতে ইশারা করেন। আমিও যাই। কাজের অছিলায় আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে থাকে। সেই পরিস্থিতি চরম সীমায় পৌঁছায়। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাক্ষস টা। তারপর সারা শরীর…..”
_ “প্লিজ। চুপ করো”।
— “আর শুনতে চাই না”!
–“পারছি না আর…..”
__ রক্তিমের চিৎকার থামিয়ে রঞ্জনা বলে ওঠে,
–“সেদিন আমিও এর চেয়েও বেশী জোরে চিৎকার করেছিলাম। বাঁচার জন্য। কেউ শুনতে পায়নি। পশুটার অত্যধিক অত্যাচারে একসময় আমি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ি। ক্ষুধাকাতর হিংস্র পশুটার শরীরের ক্ষুধা মিটলে আমার নিষ্প্রাণ শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। উন্মত্ত পশুর শরীরের জ্বালা ততক্ষণ মেটেনি যতক্ষণ না নিষ্প্রাণ শরীর টা…..”
__ রক্তিমের তখন নিষ্প্রভ হবার উপক্রম। এসব কি শুনছে ও। এতক্ষণ রক্তিম, রঞ্জনার দিকে ভুলেও ভুল করে তাকায় নি। হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখল, যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে রঞ্জনার দু’চোখ দিয়ে। প্রতিশোধ স্পৃহা।
__ রঞ্জনা আবার বলা শুরু করে,
— “পশু টা প্রথমে আমার শরীরটাকে পোড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সেদিন ও এরকম বৃষ্টি বাদলার জন্য পারেনি। তারপর নিজের এক পরিচিত রাজ মিস্ত্রি ডেকে ওই দেওয়ালে আমাকে পুঁতে দিয়েছে”।
__ রঞ্জনার নির্দেশ করা আঙুলের দিকে তাকাল রক্তিম। একটা ঘোরে তাকিয়ে আছে যেন। কি যেন একটা গ্রাস করেছে ওকে। বাইরে তখন বজ্র বিদ্যুৎ সমেত ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রক্তিম তাকিয়েই আছে দেওয়ালটার দিকে।
–“আমাকে মুক্তি দেবে তো রক্তিম”?
–“তুমি আমার বন্ধু “।
–“শাস্তি দেবে তো অপরাধী কে”?
__ রঞ্জনার কথা গুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না রক্তিম।
__আমরা এতক্ষণ সবাই চুপচাপ কিন্তু বিস্ফারিত নয়ণে সব শুনছিলাম। এই প্রথমবার আমি ইয়ার্কি না করে ব্যপারটার গুরুত্ব বুঝে বলে উঠলাম,
–“তারপর কি হল, রক্তিম”?
__ রক্তিম বলে উঠল,
— ” নর্মালি আমি অফিস থেকে সকাল আটটার সময় বেরিয়ে যাই। সেদিন সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বেরোইনি দেখে ওয়াচম্যান ডাকতে এল। এসে দেখে আমি নাকি মেঝেতে পড়ে। মুখে চোখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। জ্ঞান ফিরলে দু’টো জিনিস আমাকে অবাক করে”।
_ “কি কি”?
__ আমাদের সবার প্রশ্নে রক্তিম বলে ওঠে,
–“তের নাম্বার ডেস্ক অক্ষত অবস্থায় আছে”।
— “আর দ্বিতীয় টা”?
__ আবারও সমবেত কন্ঠে প্রশ্ন করি।
–” ওয়াচম্যান এর কাছের রেজিস্টার খাতা চেক করে কোথাও রঞ্জনার নাম পাইনি”।
__ রক্তিম থামলে আমি বলে উঠি,
— “তাহলে বডি টা”!
— “একশ ডায়াল করলে তৎক্ষণাৎ পুলিশ আসে ওই অফিসে। ঘটনার বিবৃতিতে সব জানাই। দেওয়াল খুঁড়ে একটি কঙ্কাল উদ্ধার হয়”।
__ আবার রক্তিম চুপ। আমি আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ি,
— “বডি টা যে রঞ্জনার সেটা কি প্রমাণিত “?
__ রক্তিমের জবাব,
— “অফিসের ফাইল পত্র ঘেঁটে রঞ্জনার ডিটেলস উদ্ধার করে পুলিশ। ওর বাড়ি থেকে তলব করা হয়। বডির ড. এন. এ টেস্ট হয়। পজিটিভ রিপোর্ট মেলে”।
__ আবার আমি,
” আর শয়তান বস! তার কি হ’ল”?
–“কঙ্কালের সমস্ত রকম ফরেনসিক টেস্ট করে প্রমাণিত হয় রঞ্জনার উপর হওয়া বারবার অত্যাচারের কথা। সেদিনের উপস্থিত থাকা রাজ মিস্ত্রির সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে শয়তান বসকে গ্রেপ্তার করে শ্রীঘরে পাঠানো হয়। রাজসাক্ষী হওয়ার দরুন রাজ মিস্ত্রির লঘু সাজা হয়”।
__ রক্তিম একটু থেমে আবার যোগ করে,
— ” এই জন্য তোকে না বলে কয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম। সেই ট্রমা কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক হতেই তোর সাথে যোগাযোগ করি”
— “বুঝলাম”।
–“কোলকাতা ফেরত যাবি তো”?
–“চাকরির অনেক প্রস্তুতি বাকি”!
__ আমার ছোঁড়া প্রশ্নে রক্তিম আমাকে কার্যৎ অবাক করেই উত্তর দেয়,
— “আর ফিরব না, তিথি”।
–“তুই ফিরে যা কোলকাতা”।
–“এখানে যা হোক একটা কিছু করব”।
__ পরদিন সকালে এক ঝুড়ি মন খারাপ নিয়ে হাওড়া ট্রেনে চড়েছিলাম। বন্ধু বিচ্ছেদ এর দুঃখ নিয়ে ফিরছিলাম। স্টেশান অবধি রক্তিম এসেছিল। দু’জনের চোখের জল লুকিয়েছিলাম, দু’জনের কাছ থেকে।
__ একদিন রাতে মেসের বন্ধুদের, রক্তিমের সেই হাড় হিম করা গল্প শোনাচ্ছি। ফোন টা বেজে উঠল। এত রাতে কে আবার ভেবে কলটা রিসিভ করতে গিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে। কলটা রিসিভ করতেই, অন্য প্রান্ত থেকে ঘড় ঘড় শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না।
__ পরদিন সকালে রক্তিমকে অনেকবার ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। যত বারই ফোন করি ততবারই ঘড় ঘড় শব্দটাই কানে ভেসে আসে। তাহলে…..