__ মাস ছয়েক অতিক্রান্ত। আমার সাথে রক্তিমের, একপ্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেছি, যোগাযোগ রাখার। ফোন ও করেছিলাম বার কয়েক। প্রতিবার ই হতাশ হয়েছি। এর কারণে আমার পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটছিল বুঝতে পারছিলাম। এর কারণে স্যারের কাছে খুব বকা খেতাম। রাজবল্লভ পাড়া থেকে বাসে উঠলে, বুকটা হু হু করে উঠত। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় এলে সেই শব্দ আরও বাড়ত। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত, বন্ধু বিহীনে।
__ মানুষ অভ্যাসের দাস। সবরকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। আমিও পেরেছিলাম। নিজেকে প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত করে নিয়েছিলাম। কারোর কারণে, জীবন তো আর থমকে থাকে না! কিন্তু, তবু; যদি এগুলো এসেই যেত। মনে হত রক্তিম থাকলে খুবই ভালো হতো।
__ সামনে আমার অনেক পরীক্ষা থাকার দরুন, রক্তিমের চিন্তা থেকে নিজকে মুক্ত করে পড়াশোনায় মন দিলাম। কারণ? এবছর কিছু না করতে পারলে বাড়ি থেকে, কপালে জুটত অনেক রকম ‘মন্ডামিঠাই’।
আমার বাবা কে তো আর চেনা নেই আপনাদের। পুরোদস্তুর চলছে পরীক্ষা প্রস্তুতি। রক্তিম টপিক ভুলে মন এখন, মন দিয়েছে নিজের জীবনকে গড়তে।
___ পরীক্ষার হাঁসফাঁস অবস্থায় থাকার দরুন, কোনো দিকে মন ছিল না। সদ্য একটু চাপ কমেছে। হাঁফ ছেড়ে একটু বেঁচেছি। মেসের বন্ধুদের সাথেও বাক্যালাম কমই হত। ছুটির দিন আজ। সবাই একসাথে হয়েছি অনেকদিন পর। মেসের, রান্নার মাসির হাতের ‘সুস্বাদু’ চিকেন খেয়ে দুপুরে আড্ডায় বসেছি সবাই। বিকেলের প্ল্যান চলছে। শম্পা বলে উঠল,
— “চল সিনেমা যাই”।
__ ওই অন্ধকারময় হলঘরে বসে পফ কর্ন চিবিয়ে, চুকচুক করে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে আড়াই ঘন্টা নষ্ট করার পক্ষপাতী কদাপি নই। তাই বিরোধীতা করলাম। এর চেয়ে গঙ্গার পাড়ে বসে, স্টীমারের আওয়াজ শুনতে শুনতে মাটির ভাঁড়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে বেশী পছন্দ আমার। তাই মতামত দিয়ে বসলাম, গঙ্গার পাড়ে বসে ফুরফুরে হাওয়া খাওয়ার। অবিশ্বাস্য ভাবে সবাই রাজীও হয়ে গেল।
___ বিকেলের দিকে বাগবাজার ঘাটের কাছে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি, ভাঁড়ের পর ভাঁড় চায়ে চুমুক পড়ছে সবার। রাজনৈতিক থেকে সিনেমা সবই ছিল আলোচনার বিষয় বস্তু। বেশ জমে উঠেছে সে আলোচনা। হঠাৎই আমার মুঠোফোনে টুং করে একটা শব্দ হল। জিন্সের পকেট থেকে বের করে দেখলাম, স্ক্রিনে লেখা
— “রিসিভ ওয়ান নিউ মেসেজ”।
__ দিনে এরকম হাজারো মেসেজ আসে। দুনিয়া সুদ্ধু সবাই ভুলে গেলেও একজনই আমায় মনে রাখে। হাচ। যার দৌলতে আমার, সবার সাথে যোগাযোগ প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সারাদিনে হাজারো কলস সমেত মেসেজস। এই ভেবে মুঠোফোন পুনরায় জিন্সের পকেটে সাঁটিয়ে দিলাম।
__ আকাশ তখন গোধূলির রঙ মেখেছে। জেটির কাছে আসছে একে একে স্টীমার। ভট ভট শব্দ তুলে। যাত্রীদের ওঠা নামা কখনও বাড়ছে বা কমছে। সেই সব পর্যবেক্ষণ করছি বুঁদ হয়ে। রুমাদির ডাকে হুঁশ ফিরল,
— “ওরে আমার প্রকৃতি প্রেমিকা, ওঠ”।
— “মেসে ফেরার সময় যে হল”।
__ চোখ টিপে মুচকি হেসে উঠে পড়লাম। গঙ্গার ঘাট ছেড়ে মেসের দিকে পা বাড়ালাম।
__ একটু ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসলাম। সন্ধ্যায় বইপত্রে একটু ধূপ ধূনো না দিলে মা সরস্বতী আবার রাগ করবেন। মা সরস্বতীর থেকেও যিনি বেশী রাগ করবেন, তিনি হলেন আমার পরম পিতৃদেব। পড়তে পড়তে হঠাৎই মুঠোফোনের লক টা খুলে মেসেজ বক্সের দোরগোড়ায় গেলাম। একের পর এক না পড়া মেসেজ গুলো ডিলিট করছি। একটা জায়গায় গিয়ে আঙ্গুল থেমে গেল।
__ ফোন টা নিয়ে বসেই আছি। আর পড়ার দিকে মন নেই। কখন যে রাতের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে! ভ্রুক্ষেপ ও নেই। মেসের এক বন্ধু,মনামীর ডাকে ইহজগতে ফিরে এলাম। রাতের খাওয়া সেরে বেশ পরিপাটি করে শুয়েছি। ঘুম না হলে আমার আবার মেজাজ খানা খিটখিটে হয়ে যায়। অনেকক্ষণ থেকে চেষ্টা করছি ঘুমোনোর। এদিক ওদিক করে, বার পাঁচেক জল খাওয়ার জন্য উঠে এবং বার কয়েক সেই জল ত্যাগ করেও ঘুম আর আসে না। অগত্যা মেসের বারান্দায় পায়চারি করলাম কিছুক্ষণ।
__পায়চারি করছি আর ভাবছি। কী করা যায়। এতদিন পর রক্তিম কেন মেসেজ করল? আর এরকমই একটা মেসেজ কেন? কি এমন হল? হাজারো প্রশ্নের ভিড় মাথার মধ্যে। সব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাকে আবারও মেদিনীপুর যেতে হবে। ওখানেই লুকিয়ে আছে সব উত্তর। ঠিক করলাম পরদিন ই রওনা দেব।
__ গতরাত্রে ঘুমোতে যখন এসেছিলাম, তখন প্রায় ভোররাত। একঘুমে সকাল হল ঠিক সওয়া ন’টায়। উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে পেপারের পাতা উল্টেপাল্টে বেলায় যখন বাথরুম দখলে পেলাম। তখন প্রায় একটা। সব কাজকর্ম সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে।
__ রাজবল্লভ পাড়ার মোড় থেকে হাওড়া গামী বাসে চড়ে যখন হাওড়া পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। টিকট কাউন্টারে টিকিট কেটে স্টেশানে অপেক্ষা করছি। অ্যানাউন্সমেন্ট আসছে একের পর এক মেদিনীপুর গামী ট্রেন ক্যান্সেল এর। বিকেল গড়িয়ে একটু সন্ধ্যার আভাস দেখা দিয়েছে। যাওয়া স্থগিত রেখে মেসে ফিরে আসার প্ল্যান করছি। এমন সময় বার্তা এল মেদিনীপুর গামী ট্রেনের। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পনেরো। দৌড় লাগালাম প্ল্যাটফর্মের দিকে।
__ হাঁফিয়ে উঠেছি রীতিমতো। লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে জানালার ধারে একটা সীট দখল নিয়ে বসেছি। এক এক করে মহিলা সহযাত্রীরা উঠছেন। ভর্তি হচ্ছে কামরা। আমারও ধড়ে যেন একটু প্রাণ ফিরল। ভাবছিলাম, এই সন্ধ্যায় এতটা পথ একলা যাব কিভাবে!
__ লোকাল ট্রেন গ্যালোপিন হয়ে ছুটছে ঝমঝমিয়ে। একের পর এক স্টেশান অতিক্রম করে চলেছে নিমেষে। ভাবলাম একবার, রক্তিমকে ফোন করি। থেমে গেলাম, ওকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য। ইয়ারফোন লাগিয়ে গানে মননিবেশ করলাম।
__ পাঁশকুড়া আসার আগে আগেই অনেক যাত্রী নেমে গেলেন। আমি সহ আর বাকি চার জন কামরা দখল করে আছি। ঘড়ির কাঁটা তখন সাতের ঘর ছুঁয়ি ছুঁয়ি।
__ আরও মিনিট পনেরো পর পাঁশকুড়া স্টেশানে ট্রেন পৌঁছালো। বাকি মহিলা যাত্রীরা সব নেমে গেছেন কখন। যা একজন ছিলেন, উনিও আমাকে হতাশ করে দিয়ে নেমে গেলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহুর্ত অবধি। যদি কোনো সঙ্গী পাই। ট্রেন যখন হুইশেল দিয়ে স্টেশান ত্যাগ করল, আশাহত হয়ে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম। অন্ধকারময় রাস্তায় যেটুকু চোখে পড়ে ফাঁকা একটা রাস্তা ছুটছে। ছুটছে তীব্র গতিতে, অজানা গন্তব্যস্থলে।
— “এখানে একটু বসতে পারি”?
__ চেনা গলা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম।
— “কাকিমা”!
–“আপনি কখন উঠলেন”?
__ কাকিমা উত্তর দিলেন,
— “তুমি যখন অন্যমনা হয়ে জানালায় তাকিয়ে ছিলে তখন উঠেছি”।
__ আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম নিঃশব্দে। কাকিমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
— “এখানে কোনো দরকারে এসেছিলেন”?
–“হুম… হ্যাঁ ” বলে কাকিমা অন্য প্রসঙ্গ টানলেন।
–“জানো তিথি, রক্তিমের তোমাকে খুব দরকার এই মুহুর্তে। একমাত্র তোমার কাছেই ওসব কথা মন খুলে বলে। দেখলে না কলসেন্টারের ঘটনাটা”।
__ আমি অবাক হয়ে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
–“কেন কাকিমা? কি এমন হল আবার? সবই তো ঠিক ছিল”।
__কাকিমা আবার শুরু করলেন,
— “সব ঠিকঠাক চলছিল। মেদিনীপুর শহরে ও একটা সফ্টওয়ারের দোকানও শুরু করেছিল। বেশ রমরমিয়ে চলছিল। হঠাৎই একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকল। জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল, কোথায় কোন সাইটে রঞ্জনাকে দেখেছে”।
— “কি যা তা বলছে”!
__ আমার বলা কথায় কাকিমাও সমর্থন জানিয়ে বললেন,
— “আমরাও প্রথমত তাই ভেবেছিলাম। ওকে অনেক বোঝালাম, রঞ্জনার আত্মা মুক্তি পেয়েছে। ও আমাদের কথা গ্রাহ্য না করে নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে করে ঘর বন্দি করে নিল”।
— “এটা ওর মনের ভুল বা হতে পারে ওর মনের অন্দরে কোথাও রঞ্জনার জন্য জায়গা তৈরী হয়েছিল। তার জন্য ও এইসব ভাবছে”।
__ আমার বলা কথাগুলো, কাকিমা আগের মতোই সমর্থন জানিয়ে বললেন,
— “এর জন্য ওকে এস.এস.কে.এম এ সাইকোলজিস্ট দেখাতে নিয়ে যেতাম। ডাক্তারের ওপিনিয়ন ও এরকমই ছিল”।
__ একটু থেমে কাকিমা আবারও শুরু করলেন,
— “ছেলেটা আমার পাগল হতে বসেছে, তিথি”।
— “তুমি ওর সবথেকে কাছের বন্ধু “।
__কাকিমার জল ভরা চোখ দেখে আমারও চোখে জল এল। কি বলব বুঝতে পারলাম না। কাকিমাকে জানালাম, রক্তিমের মেসেজের কথা। এটাও জানালাম মেসেজের কারণেই আমি মেদিনীপুর এসেছি।
___ কাকিমা সব দেখে চোখ মুছে বললেন,
— “কি দরকার ছিল ওই ভুতুড়ে কলসেন্টারে চাকরি করার”?
— “তাহলে আজ এই দিনটা আর দেখতে হত না”!
__ আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললাম,
–“এত কিছু হয়ে গেল, আমাকে একবার জানালেন না”?
–“আমি কত চেষ্টা করেছি, রক্তিমের সাথে যোগাযোগ করার”।
–“ফোন করলেই একটা কি বিশ্রী ঘড়ঘড় শব্দ হত। তারপর তো একদিন সে আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল। যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন হল”।
— “রাগ কোরো না, তিথি”।
–“ছেলেটার ওই অবস্থায় মাথার ঠিক ছিল না”।
–” ওকে নিয়ে এই এত দূর থেকে এস.এস.কে.এম এ যেতাম”।
–“শুধু ওকে আগের মতো অবস্থায় ফেরানোর জন্য”।
__ কাকিমার বলা কথা গুলোর কোনো উত্তর ছিল না আমার কাছে। পরিস্থিতির অবস্থা বুঝে চুপ করে রইলাম। গল্প করতে করতে কখন মেদিনীপুর স্টেশানে ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। ভাগ্য ক্রমে এটাই শেষ স্টপ ছিল। ট্রেন থেকে আমি আর কাকিমা নেমে, রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিলাম। আজ আর রক্তিম নিতে আসেনি আমাকে। ও তো জানেই না আমি আসছি।
___ রিক্সা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও কিছু নেই আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। সাথে মেঘের গর্জন। বিদ্যুতের ঝিলিক। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর ছুঁয়েছে। আমি আর কাকিমা দাঁড়িয়ে রইলাম।
_”কি করে এবার যাব, কাকিমা”?
— “এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত “।
__ এই পরিস্থিতিতে কাকিমা পরিশ্রান্ত না হয়ে একদম শান্ত এবং নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
–“ঠিক পৌঁছে যাবে”।
–“পৌঁছতে তোমাকে যে হবেই, তিথি”।
–“রক্তিমের যে বড্ড দরকার, তোমাকে “।
__ কাকিমার সব কথার মানে বুঝতে পারিনি তখনও। তখন একটাই চিন্তা রক্তিমের বাড়ি যাব কি করে। রাত ও বাড়ছে। সাথে পেটের মধ্যে ছুঁচো গুলোও ডন দেওয়া শুরু করেছে।
__ ভাবনায় ছেদ পড়ল। একটা রিক্সা আসতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছোট্ট শিশুর মতো লাফিয়ে উঠলাম। আমার কান্ড দেখে কাকিমা শুধু মুচকি হাসলেন।
— “যাবেন দাদা”?
–“কালেক্টর রোড”।
–“দু’জন আছি”।
__ রিক্সার মালিক এমনভাবে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! যেন ভূত দেখেছে। আমরা রিক্সায় চড়ে বসলাম। এবার আমি একলাই বকবক করতে করতে যাচ্ছি। কাকিমার কোনো উত্তর নেই। বুঝলাম কাকিমার মন ভালো নেই, রক্তিমের জন্য। বিদ্যুতের ঝলকে দেখলাম, রিক্সার মালিক মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখছে।
__ মিনিট পনেরো পর কালেক্টর রোডে পৌঁছালাম। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে রক্তের বাড়ির দিকে এগোলাম। কাকিমার কথা মতো আমিই আগে ছিলাম। রক্তমকে চমকে দেব বলে। ওর বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়া দিলাম। অনেকবার আওয়াজ করাতে রক্তিমের বোন, রাকিয়া এসে দরজা খুলল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে,
— “তিথি দি তুমি”?
__আমি সেসব পাত্তা না দিয়ে, পেছনে থাকা কাকিমার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সোজা রক্তিমের ঘরে হানা দিলাম।
__ চমকটা আমাকে ভালোই দিয়েছিল রক্তিম সহ ওর বাড়ির সবাই। রক্তিমকে চমক দিতে গিয়ে আমি নিজেই তার শিকার হই।
__রক্তিমের ঘরে যখন প্রবেশ করলাম, ওর অবস্থা দেখে আমিই চমকে উঠি। তরতাজা একটা ছেলে বসে আছে হইল চেয়ারে। চুলগুলো উস্কো খুস্কো। মুখে সেই চার্মিং ভাব হারিয়ে গেছে। একরাশ হতাশা গ্রাস করেছে রক্তিমকে।
__ রক্তিমের ওই অবস্থা দেখে আমি থ বনে গিয়েছিলাম কয়েক মুহুর্তের জন্য। হঠাৎই মনে পড়ল কাকিমার কথা। উচ্চস্বরে ডাকা শুরু করলাম,
–“কাকিমা। কাকিমা।”
–“এ ঘরে”
__আমাকে থামিয়ে দিয়ে রক্তিম ই বলে ওঠে,
–“তুই কাকে ডাকছিস”?
— “কেন কাকিমা কে”
–“আমার সঙ্গে তো এলেন একসাথে “।
–“পাঁশকুড়া থেকে ট্রেনে উঠলেন”।
–“তোর কথা বললেন”।
__ একপ্রকার বিরক্ত হয়েই রক্তিম বলে উঠল,
— “তোর ইয়ার্কি করার অভ্যাস আজও যায়নি, তিথি”!
— “মানে”?
— “ইয়ার্কি করব কেন”?
__ পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ি।
__রক্তিমের বোন রাকিয়া ঘরে ঢুকল। সাথে কাকু। রাকিয়াই উত্তর দিল,
— “তুমি এলে বলে, দাদা তাও কথা বলল”।
–“এতদিন হাতে গুনে কয়েকটি কথা বলেছে মাত্র”।
–“মা তো…”
__ আমি রাকিয়াকে থামিয়ে বলি,
— “কাকিমার কি হয়েছে”?
–“তোমার কাকিমা গত হয়েছেন কয়েক মাস হল”।
__ কাকুর উত্তরে আমি অবাক হই বৈকি। উত্তেজিত ভাবেই বলি,
–“মানে? কি সব…”
–“এতটা রাস্তা কার সাথে এলাম আমি”?
__রক্তিমের দিকে তাকিয়ে নিজের মুঠোফোন থেকে ওর মেসেজ বের করে দেখালাম,
–“দেখ তোর মেসেজ”।
–“তুই আমাকে মেসেজ করেছিলি তাই এসেছি”।
__ নির্লিপ্ত কন্ঠে রক্তিম বলে ওঠে,
–“আমি তোকে মেসেজ করেছি”?
–“আমার ফোন কবেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেছে”।
— “অ্যাক্সিডেন্টের পর”
__রক্তিম সমেত বাকিদের কথা আমাকে আরও অবাক করে তুলছিল।
— অ্যাক্সিডেন্ট! কি অ্যাক্সিডেন্ট”?
__ আমার প্রশ্নে রক্তিম বলে ওঠে,
–“আমি বেশ কিছুদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলাম। মনে হচ্ছিল রঞ্জনা আবার ফিরে এসেছে। আমাকে কিছু বলতে চায়। ওর বোধহয় অনেক কথা বলা বাকি ছিল। তাই আবারও ফিরে এসেছে। এসবের জন্য নিজেকেই নিজে বন্দি করে নিই। পাগল হবার উপক্রম প্রায় উপস্থিত। মা’র জন্য সেই অবস্থার হাত থেকে ফিরে এসেছি”।
__ এগুলো কাকিমার থেকে শুনেছি। বাকিটা বল। মেজাজ তখন সপ্তমে রীতিমতো। কিছুটা বিরক্তির সুর চড়িয়েই বললাম।
__ রক্তিম আবার বলা শুরু করল,
–“সাঁতরাগাছি অবধি বাসে এসে ওখান থেকে ট্রেন ধরতাম। এরকমই এক দিনে ট্রেনের ট্র্যাক পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্যে আসছি চোখের নিমেষে কিছু যাত্রীকে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন পিষে দিয়ে চলে যায়। তার মধ্যে আমার মা ও ছিল। আমিই দায়ি মা’র মৃত্যুর জন্য”।
__ আরও বিরক্তি যেন গ্রাস করছে আমাকে। আগের তুলনায় একটু বেশীই বিরক্তি সুরে বলতেই যাচ্ছিলাম, রক্তিম বলে উঠল,
— “আমি জানি তুই কি ভাবছিস”!
–“কি শুনি”?
–“আমি এসব বুঝলাম কিভাবে। তখন তো আমার ই পাগল পাগল অবস্থা “।
–“ঠিক তাই”।
–“মা’র কারণে আমি তখন একটু সেরে উঠেছি। তাই জানি”।
— “মা কে নিয়ে মজা করব”!
–“তাও আবার মৃত্যু “।
__রক্তিম আবার শুরু করে,
–“মা কে বাঁচানোর অহেতুক চেষ্টা করেছিলাম। সেই চেষ্টায় সফল হইনি। পা দুটো খুইয়েছি”।
__ তবু মনটা খচখচ করছিল এসব শোনার পরও। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে তখনও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ট্রেনে আমার সহযাত্রী কে ছিল? মেসেজ ই বা কে করেছিল আমাকে?
__ প্রথমটার উত্তর পেয়েছিলাম তৎক্ষণাৎ। রক্তিমের কথা শুনেও পাগলের মতো দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম ওদের বাড়ির বাইরে।
__ গল্পকথার মতো অনেকেই বিশ্বাস করতে নাও পারেন। বাড়ির বাইরে এসে আমি যা দেখেছিলাম তা নিজের চোখেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।
__ কাকিমার প্রতিচ্ছবি বলব না কি প্রতিরূপ না কি প্রতিকৃতি। সেইরকম দেখতে একটা ছায়ামূর্তি আমার আসার অপেক্ষাতেই ছিল বোধহয়। আমাকে দেখে একইরকম মুচকি হাসি হেসে বলল,
— “বলেছিলাম না রক্তিমের তোমাকে দরকার”।
–“ওর পাশে থেকো, তিথি”।
–“ওকে বোলো, ওটা ছিল অকস্মাৎ মৃত্যু “।
— “নিজেকে দায়ি না করে, বোঝা যেন না বাড়ায়”।
__ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই ছায়াময় অবয়ব টা। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও আমাকে দিয়ে গেছে, আমার সহযাত্রী।
__ ফিরে আসি রক্তিমের কাছে।
__ বন্ধুর অসময়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিই।
__ এরপর থেকে সপ্তাহান্তে রক্তিমের বাড়ি আসতাম। ও ক্রমে নর্মাল জগতে ফিরে যাচ্ছে। ও যাতে আবারও দু’পা এ ভর করে হাঁটতে পারে কাকু তার জন্য কৃত্রিম পা এর ব্যবস্থা করেছেন। চাকুরির প্রস্তুতি চলছে আমাদের জোরকদমে।
___ রাতের ট্রেনে এলে আমার সহযাত্রীটির সাথে সাক্ষাৎ হয় প্রায়ই । ইহজাগতিক খবরাখবর ওনাকে প্রদান করি। বিশেষত রক্তিমের।
__ সেদিন বৃষ্টির রাতের একমাত্র সাক্ষী রিক্সা ওয়ালার সাথে বেশ সখ্যতা হয়েছে আমার। হঠাৎই একদিন কি মনে করে প্রশ্ন করে ফেলি,
— “দাদা, তুমি সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে কাউকে দেখেছিলে আমার সাথে”?
___ রিক্সাওয়ালার উত্তরে বিশেষ চমকের কিছুই ছিল না। সব কিছুই কাঁচের মতো স্বচ্ছ ছিল আমার কাছে। তবুও জানতে ইচ্ছে করায় প্রশ্ন করি। উত্তর টা স্বাভাবিক ভাবেই ‘না’ আসে। আজ বুঝলাম, ওঁর বারবার পেছন ফিরে তাকানোর কথা।