কালবৈশাখীর এই ঝড় বৃষ্টির রাতে হঠাৎ করে লোডশেডিং হতেই, তিতলি আর বুকান তাদের দাদুর কাছে ছুটে যায় পল্প শোনার আশায় । তিতলি ক্লাস সেভেনে আর বুকান ফাইভে পড়ে । তাদের মা বাবা দুজনেই শিক্ষকতা করেন। তাদের কাছে দাদু আর ঠাম্মাই সব। বাড়িতে তাই তিতলি আর বুকানের সব ব্যপারে দাদু, ঠাম্মা থাকেন।
আজ এই ঝড় জলের রাতে তাই লোডশেডিঙের দৌলতে দাদুর কাছে গল্প শোনার জন্য তারা দুজনেই ছুটে আসে । দাদুর বেশ ভালই লাগে নিজের পুরনো স্মৃতির কথা মনে করতে । তিতলি আর বুকান গল্প শোনার জন্য দাদুর কাছে আজ ভুতের গল্পের আবদার করে ।
তিতলি –দাদু আজ কিন্তু আমরা ভুতের গল্প শুনব । সঙ্গে সঙ্গে বুকান ও তালে তাল মিলিয়ে এক ই স্বরে হ্যাঁ বলে । অগ্যতা দাদু বেশ জম্পেস করে বসে গল্পের ঝুলি খুলে শুরু করে দিলেন তার নানারকম স্মৃতি দিয়ে ঘেরা গল্পের ডালি। দাদু বুঝলি দিদি , বছর তিরিশেক আগের কথা । তখন আমার চাকরি মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে। রেলের গার্ড হিসাবে কাজ করায়, বেশিরভাগ সময় আমাকে মালগাড়ি নিয়ে দূরে দূরে ডিউটি করতে হতো। তাই বেশীরভাগ সময়ে আমার বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত হত। তখন অবশ্য এতো গাড়ি ,অটো , ট্রেকার , রিকশা এসব চলত না । তাই নিজের যাতায়াতের সুবিধের জন্য আমার মোটরসাইকেল স্টেশনে রেখে দিতাম।
আমি সেদিন দুপুরে ডিউটিতে এসে জানলাম যে আমাকে মাল গাড়ি নিয়ে যেতে হবে একটু দুরেই। তাই সেদিন না ফিরতে পারলেও ,পরের দিন ফিরতে ফিরতে আমার সকাল হয়ে যাবে । সেদিনে দুপুরে ডিউটিতে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু মালগাড়ি নিয়ে যাবার সময় মাঝে সিগন্যাল এর সমস্যা থাকায় পরের দিন মালগাড়ি নিয়ে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে হয়ে গেল । কি আর করা যাবে ? তারপর আমি সমস্ত কিছু স্টেশন মাষ্টারকে কাজের সব কাগজপত্র বুঝিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন সব সেরে যখন বেরোচ্ছি তখন রাত প্রায় আটটা হবে। গ্রীষ্মের রাতে ফুরফুরে বাতাসে আমার মোটরসাইকেলে যেতে বেশ ভালই লাগে। বাড়ি ফেরার ওই আধঘণ্টা বেশ আরামেই যেতে পারব ভেবে তখুনি বেরিয়ে পড়লাম। তিতলিদের মন যখন গল্পের মধ্যে টানটান উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে , ঠিক সেই সময় তার মা চা নিয়ে এসে হাজির। তিতলির মা– তোরা এখানে গল্প শুনছিস ? আর আমি জানি মে তোরা ঘরে পড়ছিস । তা আজ কি বই খুলবি না ?
দাদু— থাক না , আজ না হয় ওরা গল্পই শুনুক । একে বাইরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে তার উপর লোডশেডিং । ওই এমারজেন্সি আলোতে পড়লে বাচ্চাদের চোখে অসুবিধে হবে । কি আর করবে, দাদুর কথা শুনে তিতলির মা দাদুকে চা দিয়ে চলে গেলেন । দাদু— হ্যাঁ, সেদিন রাতে আমি আমার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে মনের সুখে গানের কলি গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছি । আমাদের বাড়ি ফেরার পথে মাঝে প্রায় দু কিলোমিটারের মত একটা মস্ত ঘন জঙ্গল পড়ে।
সেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে শাল ,মহুয়া ,শিরিষ আর কত রকম যে নাম না জানা বড় বড় অজস্র গাছ আছে, তার কোনো হিসেব নেই। দেখলে মনে হয় যেন ওই সব গাছ গোটা বন জুড়ে একে অপরকে ধরে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে । আবার কোন কোন গাছ তার নিজের মত কাউকে তোয়াক্কা না করেই যেন অহংকারীর মত সোজা নিজের ইচ্ছে মত দাঁড়িয়ে আছে। সকালের সূর্যের কিরণ সেই ঘন জঙ্গলের সব জায়গায় ঠিকমত পৌঁছতে পারেনা। আর তাই সকালেও সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতে খানিক হলেও বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। সেই জঙ্গলের পথ পেরোতে যে কোন নতুন মানুষের অবশ্যই ভয় লাগবে। আর রাত হলে তো কোন কথাই নয়। আমাদের রোজকার অভ্যেসের দরুন আমাদের সাধারণত অতটা ভয় লাগে না ।
কিন্তু সেদিনটা ছিল অমাবস্যা। আমার কেন যেন ওই নিকষ গাঢ় কালো অন্ধকার দেখে নিজের বুকটাই কেমন যেন একটু হলেও কাঁপছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া রাস্তার চারপাশের অন্ধকার যেন গিলে খাচ্ছিল । রাস্তার দুপাশের সার দেওয়া গাছে আবছা গাড়ির আলোয় এক আলো আঁধারের মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে আমাকে অন্য জগতে যেন নিয়ে যেতে লাগলো। শাল মহুয়া ফুলের গন্ধ মন আর শরীরকে এক বন্য মাদকতায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল । রাতের কত বুনো নাম না জানা ফুলের সুবাসে ক্লান্ত শরীরের অবসন্নতা যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মাতাল করে দিচ্ছিল । সব চোখের আড়ালে ঘটলেও যেন মনের পর্দায় অনুভবে দেখতে পাচ্ছিলাম।
কিছুক্ষন যাবার পর আমার গাড়িটা হঠাৎ একটা কেমন ঝাঁকুনি মত লাগলো । আমি ভাবলাম গাড়ির আলো টা আবার খারাপ হল নাকি ? তারপর মনে হল গাড়িটা একটু কেমন লাগছে ? ঠিক যেমন পিছনে কাউকে বসিয়ে
চালালে অনুভব হয় বেশ ভারি, ঠিক তেমন ।
তারপর হঠাৎ কেমন একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে এল । আমার আবার ভূতের টুতের ভয় ছিল না তবে চোর ডাকাত হলে সত্যি বিপদ। মনে হল দুদিন ডিউটি করে শরীর-মন ক্লান্ত, তাই আমার বোধহয় এইসব আগডুম -বাগডুম ভাবনা ভাবছি । যদি বিপদ আসে তখন না হয় দেখা যাবে বলে আমি যেতে লাগলাম। জঙ্গলের মাঝে আবার একটা সাঁকো পড়ে। সেই সাঁকো আবার শাল গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো তাই সেই সাঁকো বেশ সাবধানে পেরোতে হয়। আমি সেই কাঠের সাঁকো তাড়াতাড়ি করে পেরিয়ে যাবো বলে আমার বাইকের এক্সেলেটরে একটু বেশ মোচড় দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে চললাম। এতে আমার গাড়ির গতি বেড়ে গিয়ে জোরেই ছুটে চললো।
এমন সময় আমি লক্ষ্য করি যে দূরে আমার পিছনে একটা আলো যেন আমার দিকেই ছুটে আসছে । একটু বাইকটা আস্তে করতে, বুঝি মে ওটাও আমার মত কোন বাইকের আলো।তারপর সত্যি সত্যি দেখি আমার পিছু পিছু আরও একটা মোটর সাইকেল বেশ জোরেই ধেয়ে আসছে । দেখে একটু ভরসা পেলাম । যাক আর কোন চোরের ভয়ও নেই । কখনও আমি আগে কখনও সেই গাড়িটা । তারপর সাঁকো আসতেই সন্তর্পণে পেরিয়ে যেতেই পেছনের গাড়ির হর্নে দাড়ালাম। তারপর ঐ বাইকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক নাকি আমাকে অনেকক্ষন থেকে অনুসরণ করছেন। তিনি ট্রেন থেকে নেমে ফিরতে গিয়ে স্টেশন থেকে আমার মোটরসাইকেল দেখে পিছু পিছু নাকি আসেন ।
তিনি আমার কাছে এসে কানে কানে বলার মত বেশ ফিসফিস স্বরে বলে উঠলেন” আচ্ছা আপনি এতক্ষণ কাকে আপনার বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে আসছিলেন ? কে ছিল আপনার সঙ্গে ?” ভদ্রলোকের অদ্ভূত গলার স্বর আমাকে আরো বেশি করে যেন ভয় ধরিয়ে দিতেই আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে তাঁর কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । যেন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর সেই গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোতে চাইছে না। কিন্তু আমি কেমন যেন জোর করে কথা বলার চেষ্টা করছি। আর তাই পরিষ্কার স্বরের বদলে কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিলাম” কে আসবে ? আ আ মি তো কা উ কে বাইকে চাপায়নি। আপনি ভুল দেখেছেন। অন্ধকারে কি দেখেছেন কে জানে ? আর আমাকে একা পেয়ে ভয় দেখাচ্ছেন ?”
ভদ্রলোক আবার আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন কি মশাই ভয় লাগছে নাকি ?” আমি বললাম “না আমি ওসব ভূত পেত্নী র ভয় পাইনা।” তখন উনি হাসতে হাসতে বেশ গোলগোল চোখ পাকিয়ে এক অদ্ভূত ঠান্ডা গলায় বলেন যে আমার গাড়ির পিছনে তার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দ্যাখে যে আমার পিছনের সিটে কে একজন ভদ্রলোক বসে আছে । সেই লোকটার হাবভাব কেমন নাকি সন্দেহজনক । কখন তাকে সশরীরে দেখা যাচ্ছিল , আবার কখন সেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। তাই সে বারবার আমাকে সেই কথাটা বলার জন্য আমার দিকে এগিয়ে আসছিল ।
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে একটু মনে বল পেলাম ঠিকই ,কিন্তু মনের মধ্যে ভয়টা কিন্তু পুরোপুরি তখনও যায়নি।
উনি আবার বলে উঠলেন”আর কোনো চিন্তা নেই সাঁকোর এপারে ওই ভূত্ আর আসবে না । চলুন আমরা এগিয়ে যাই।”
কথাটা শুনে একটু আশ্বস্ত হলাম যে , যাক বাকি পথটুকু নিশ্চিন্তে যাওয়া যাবে। এরপর আমি বাইক নিয়ে আগে আগে আর সেই ভদ্রলোক আমার বাইকের পিছনে ।
সেই জঙ্গলে আমরা প্রায় মিনিট পনেরো যাবার পর ঠিক জঙ্গল পাতলা হবার মুখেই আমি বাইক আস্তে করে ঘুরে দেখি পিছনের সেই ভদ্রলোকের বাইকের কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।
আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে কি আমি গাড়িটা কি একটু জোরেই চালিয়ে এসেছি ? দেখি বলে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু না কোথাও কোনো আলো , না আওয়াজ কিছুই শোনা বা দেখা যাচ্ছিল না। তাহলে কি ভদ্রলোকের কোন বিপদ হলো ? এই অন্ধকারে লোকটা হঠাৎ ভোজবাজির মত করে উবে গেল নাকি ? তাহলে কোথায় বা সে মিলিয়ে গেল ?
ঠিক সেইসময় আচমকা দূরে কোথাও যেন একটা পেঁচার কর্কশ আওয়াজ আর কোন অজানা পাখির ডানা ঝটপটানিতে মিলেমিশে এক রোমহর্ষক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল। আমার কাছে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। অভাবনীয় ঘটনার চাক্ষুষ প্রমাণ আমার কাছে ছুটে আমাকে বিশ্বাস করবার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। আমার হাত পা সব যেন শিথিল হয়ে আসছিল। আমি সেই ঘন অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম কারা যেন আমার দিকে ছুটে আসছে। তাদের অশরীরী আত্মা আমাকে স্পর্শ করতে এগিয়ে আসছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
তারপর আমি চোখ খুলে দেখি আমি আমার ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। পরে শুনেছিলাম , যে ওই রাস্তায় পাশের গ্রামের রেলের কিছু কুলি সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিল। আমাকে ওই জঙ্গলের শেষ সীমানায় বাইক নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে চিনতে পেরে বাড়িতে পৌঁছে দেয় । তারপর সব কথা মনে পড়লেও আমি কোনোদিন কাউকে কিছু বলিনি।
পরেরদিন সকালে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলাম যে, বেশ অনেক দিন হল কোন এক পথ দুর্ঘটনায় এক ভদ্রলোক নাকি মারা যান । তিনি নাকি কোন কাজে এই রাস্তায় বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করে ট্রেন ধরবে বলে বাইক দুর্ঘটনায় সেই জঙ্গলের সাঁকো পেরোতে গিয়ে পড়ে মারা যান।
তারপর থেকে এই পথে রাতের বেলায় মোটর সাইকেল আরোহীর কাছ থেকে তিনি এখনও নাকি মাঝে মধ্যে লিফট নিয়ে থাকেন।
কিন্তু আমি ভয়ে সেই ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলতে পারিনি। বলিনি যে এটা গল্প নয় সত্যি । সেদিন সেই ভূত ভদ্রলোক শুধু আমার বাইকের পিছনে নয় আমার সাথে পুরো জঙ্গলের পথ একসাথে কথা বলতে বলতে এসেছেন।