অ্যান্টিকের দোকানে ঢুকেই সামনের টেবিলে রাখা সাদা মূর্তিটায় চোখ আটকে গেলো সৈকতের। সৈকত পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করে। শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি দেশ বিদেশের পুরোনো জিনিস দিয়ে ঘর সাজানো তার একটা বড় নেশা। দক্ষিণ কলকাতায় সৈকতের দুই কামরার ফ্লাটটাকে অনায়াসেই একটা মিউজিয়ামের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যায়। বৈঠকখানা থেকে শয়নকক্ষ সর্বত্রই বড় বড় শোকেসে সজ্জিত রয়েছে অপূর্ব সব অ্যান্টিক জিনিস, সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অনেক দামি এবং দুষ্প্রাপ্র্য। হাতির দাঁতের ফুলদানি, দুশো বছরের পুরোনো রাজকীয় পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র, ব্রিটিশ আমলের তৈরী কাষ্ঠনির্মিত দাবা খেলার বোর্ড, ছাইদানি, নবাবী আমলের তামাকপত্র, ঝাড়বাতি ইত্যাদি তো আছেই তার সাথে আছে দেশি বিদেশি অসংখ্য মূর্তি ও শোপিস। হাজার হাজার অর্থব্যয়ে বিদেশ থেকেও আসে বিভিন্ন সামগ্রী। কিছু কিছু জিনিসের জন্য সৈকতকে রীতিমতো নিলাম পর্যন্ত লড়তে হয়েছে। কিন্তু এই অ্যান্টিকের ব্যাপারে সে একটুও কার্পণ্য বা আপস বরদাস্ত করে না। কোনো জিনিস তার একবার পছন্দ হলে সেটাকে যে কোনো মূল্যে হস্তগত করবেই সে।
কেনাকাটা ছাড়াও এইসব জিনিস দেখতেও সৈকতের খুব ভালো লাগে। সে মনে করে সমস্ত প্রাচীন জিনিসের সাথে কিছু না কিছু ইতিহাস জড়িয়ে থাকে। প্রত্যেকটা জিনিসের সেইসব রক্তক্ষয়ী অথবা সুখময় ইতিহাস অনুভব করতে চায় সৈকত আর সেগুলো উপলব্ধি করে রোমাঞ্চিত হয় তার সারা শরীর। সেই সূত্রেই এই অ্যান্টিকের দোকানে তার নিত্য যাতায়াত। সপ্তাহান্তে একদিন হলেও সে ঢুঁ মারে এই দোকানে। দোকানের মালিক আদিদেব ঝুনঝুনওয়ালা তার সমবয়সী। ওর সাথে তার খুব বন্ধুত্ব, কোনো ইউনিক অ্যান্টিক পিস্ এলেই আদিবাবু সৈকতকে খবর দেন। সব কাজ ফেলে সৈকত ছুটে আসে দোকানে, পছন্দ হলে কিনে নেয় আর নাহলে একটু গল্পগুজব করে বাড়ি ফেরে।
সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সৈকত চলে আসে এই অ্যান্টিকের দোকানে যদি কোনো ভালো জিনিস এসে থাকে। ওর ভাবনাই সত্যি হয়, মূর্তিটা দেখে পুরো তাজ্জব হয়ে যায়, এমন জিনিস আগে কখনও দেখেনি ও। কি অদ্ভুত দেখতে মূর্তিটা! অদ্ভুত এই কারণেই যে মূর্তিটা কোনো স্বাভাবিক দেবদেবী, পশুপাখি বা মানুষের নয়। হাত দেড়েকের মূর্তিটা যে ঠিক কিসের তা বোঝা যাচ্ছে না। কোনো প্রাচীন অজানা দেবতা হবে হয়তো। তবে মূর্তিটির সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল সেটার গঠন উপাদান। সাধারণ কোনো ধাতু, পাথর বা কাঠ নয় অন্য কিছু, অনেকটা যেন কোনো প্রাণীর অস্হি দ্বারা নির্মিত এটি, কিন্তু কোন প্রাণীর তা এভাবে খালি চোখে বোঝা মুশকিল। মূর্তিটার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে সৈকত, ওটা ওর চাই। ওকে দেখে দোকানের মালিক হাসিমুখে এগিয়ে আসে আর তারপর মূর্তিটাকে উদ্দেশ্য করে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে বলে,
“আরি সৈকতবাবু যে। এ মূর্তি আনে কে বাদ সব সে পহেলে আপকা হি ইয়াদ আয়েথে মুঝে আর দেখেন সোচতে সোচতে আপ এসে ভি গেলেন, হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্স। নিবেন নাকি?”
“হুম নেব তো বটেই, খুব পছন্দ হয়েছে এটা আমার। তা আদিবাবু এই অদ্ভুত মূর্তি পেলেন কোথায়?”
“আরে ওভি তাজ্জব কি বাত, কি হয়েছিল শুনেন। আজ সুবাহ সবে দোকান খুলিয়েছি, এক সাধু আসে। পুরা লাল কাপড়ে ঢাকা। ও হামাকে ইয়ে মূর্তি দিল, আমি সেটা ভালো করে দেখে যেই মুখ তুলেছি দেখি কি ও সাধু সামনে নাই, বিলকুল ভ্যানিস। বিশোয়াস করবেন না সৈকতবাবু দো সেকেন্ড মে বিলকুল গায়েব।”
“ও বাবা এতো রীতিমত আশ্চর্যের ব্যাপার। এক সাধু নিজে আপনাকে এটা দিয়ে গেছে, তাহলে কোনো দেবদেবীর মূর্তি হবে নিশ্চয়। কিন্তু খটকা লাগছে যে কোনো টাকা নিল না কেন। তা সে যাইহোক আপনি কত নেবেন?”
“কি বলি বলুন,আপ যা ভালো বোঝেন দেন।”
মূর্তিটা কিনে বাড়ি ফিরে সৈকত বাবা মাকে দেখায়। ওনারাও খুব প্রশংসা করে মূর্তিটার। মূর্তিটা সৈকতের এতোটাই পছন্দ হয়েছে যে সে ওটাকে তার শোয়ার ঘরে টেবিলের উপর এমনভাবে সাজিয়ে রাখে যে বিছানায় শুলেই যেন সেটা ও দেখতে পায়। এতদিন এত জিনিস কিনেছে কিন্তু এই মূর্তিটার মত আকর্ষণ অনুভব সে কিছুতে করেনি। এটা কি নিতান্তই সৈকতের নতুন জিনিসের প্রতি ভালোলাগা নাকি এর পিছনে কোনো গুঢ় রহস্য রয়েছে!
তখন মাঝরাত, এ কোথায় এসে পড়েছে সৈকত। না এতো তার ঘরের নরম বিছানা নয়, সে এক পাহাড়ি গুহায় বসে আছে। তার থেকে কিছুটা দূরে আগুন জ্বলছে, একজন জটাধারী সাধক যজ্ঞ করছেন। পাশে আরো একজন হাতজোড় করে বসে আছে। আরে সাধুর সামনে ওটা কি, আজকের কিনে আনা মূর্তিটা না? নাকি ওটার মতই হুবহু দেখতে অন্য একটা মূর্তি। সৈকতকে কিন্তু কেউ লক্ষ্যই করছেন না, তাদের ক্রিয়াকলাপের নীরব দর্শক সে। একটু পরে সেই সাধু উঠে দাঁড়ালেন, তার হাতে একটা চকচকে ধারালো খাড়া। কি করবেন উনি, একি পাশে বসে থাকা লোকটাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিলেন হাড়িকাঠে। ধীরে ধীরে খাড়াটা উপরে তুললেন, একটা তীব্র আর্তনাদ বেড়িয়ে এল লোকটার গলা দিয়ে, তারপর……
ঘুমটা ভেঙে যায় সৈকতের, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে ওর। সে তাহলে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। কি ভয়াবহ কান্ড, কিন্তু স্বপ্নে যে মূর্তিটা দেখল সেটা কি তারটাই। কি মনে হতে সামনের টেবিলের দিকে তাকালো সৈকত আর তাকাতেই চমকে উঠলো, টেবিলে সেই মূর্তিটা নেই। কিন্তু ওর খুব ভালোভাবে মনে আছে ওইখানেই মূর্তিটা রেখে ঘুমিয়েছিল সে। তাহলে গেল কোথায় সেটা, কোনোভাবে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়নি তো আবার। সত্ত্বর বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালায় ও, আরে একি মূর্তিটা বিছানায় ঠিক ওর মাথার পাশে গেল কি করে। তাহলে কি ও সেটা পাশে নিয়েই শুয়েছিল কিন্তু ওর স্মৃতিশক্তি তো এত খারাপ নয়। যাইহোক মূর্তির তো আর ডানা গজায় নি যে সেটা নিজে নিজেই উড়ে আসবে, ওই হয়তো রেখেছে আর এখন ভুলে গেছে। তাই হবে হয়তো, মনকে সান্ত্বনা দিতে থাকে সৈকত। একটু পরে সব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে মূর্তিটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন রবিবার। প্রাতরাশ করেই সৈকত মূর্তিটা নিয়ে হাজির হয় উমাপতি চক্রবর্তীর বাড়িতে, ওদের ফ্ল্যাটের দুটো বাড়ি পরেই ওনার ফ্ল্যাট। উমাপতি বাবু সৈকতের বাবার বাল্যবন্ধু, একসাথে পড়াশোনা, খেলাধুলো করার হেতু ওদের পরিবারের প্রতি এক নাড়ির টান অনুভব করেন এই অকৃতদার ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। সৈকতকে নিজের ছেলের মতই স্নেহ করেন আর সৈকত, সে তো কাকাবাবু বলতে অজ্ঞান। ছোটো থেকেই ওর সব আব্দার ওনার কাছেই আর তিনিও হাসিমুখে সব পূরণ করেন। উমাপতি মহাশয় পেশায় একজন প্রত্নতাত্ত্বিক, সেই সূত্রে ঐতিহাসিক মহলে তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। সৈকতের প্রাচীন জিনিস সংগ্রহের যে নেশা তার বীজ বপন হয়েছিল মূলতঃ এনার কাছেই। কোনো নতুন জিনিস কিনলেই সৈকত ছুটে চলে আসে তার কাকাবাবুর কাছে সেই জিনিসের পিছনে লুক্কায়িত ইতিহাসের সন্ধানে। উমাপতি বাবুও নানান বই ঘেঁটে উদ্ধার করেন সেই গোপন ইতিহাস। কয়েকবার তো কিছু দ্রব্যের জন্য বিভিন্ন মিউজিয়ামের সাথেও যোগাযোগ করতে হয়েছিল, তবে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক হওয়ায় ওনার তেমন অসুবিধে হয়নি। মন্ত্রমুগ্ধের মত সৈকত শোনে সেইসব ইতিহাস আর সাথেই জানার নেশাটাও আরো জোরালো হয় তার মনে।
মূর্তিটা হাতে নিয়েই চমকে যান উমাপতি বাবু, কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথা থেকে পেলে এটা?”
দোকানদার কিভাবে ঐ অদ্ভুত সাধুর থেকে মূর্তিটা পায় তা সব খুলে বলে সৈকত শুধু রাতের স্বপ্নের কথাটা এড়িয়ে যায়। একটু চুপ করে থেকে উমাপতি বাবু বলেন, “সৈকত এই মূর্তিটি এক তিব্বতী দেবতার। এই দেবতা তন্ত্রমন্ত্রের প্রতিভূ এবং সেই উপাসনা কোনো শুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না। এই উপাসনায় যে ক্ষমতা প্রদত্ত হয় তা প্রাণঘাতী, মানুষের ক্ষতিসাধনই তার মূল লক্ষ্য। বড় কঠিন ও ভয়ঙ্কর এই উপাসনার প্ৰণালী। আরাধনার কিছু নির্দিষ্ট পর্যায়ের ব্যবধানে দেবতা বলি চান, নরবলি যার মধ্যে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ এক উপাচার। দেবতা খুবই জাগ্রত, কোনো সাধক একবার যদি এনাকে জাগান তাহলে বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে ইনি সেই সাধককে দান করেন সমগ্র পৃথিবী বশ করার ক্ষমতা। কিন্তু যথোপযুক্ত পূজার্চনা বা বলি প্রদান না করলে দেবতা ভীষণ রুষ্ট হন যার ফল হয় মারাত্মক, তার করাল গ্রাস স্বয়ং উপাসকের ওপরেও নেমে আসতে পারে। ”
রাতে ঘুমের মধ্যে আবার স্বপ্ন দেখলো সৈকত, সেই পাহাড়ের গুহা কিন্তু আজ অন্য ঘটনা। কালকের সেই সাধু ধ্যানে বসে আছেন আর সামনে সেই মূর্তিটা। হঠাৎ বাইরে অনেক লোকের কোলাহল, কারা যেন দৌড়ে আসছে এদিকে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গুহামুখ আলোয় ভরে উঠলো, প্রায় জনাত্রিশেক লোক প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল। এরপর যা ঘটলো তা কোনো সুস্থ মানুষ সহ্য করতে পারে না কিন্তু স্বপ্নে যে পালানো যায় না। নীরব দর্শক সৈকত দেখলো তারা কোনো এক তরল ছিটিয়ে দিচ্ছে গুহার চারিদিকে এমনকি সাধুর শরীরেও। তাদের রুদ্রমূর্তি দেখে সাধু থরথর করে কাঁপছেন, তার চোখ থেকে আতঙ্ক ঠিকরে বেরোচ্ছে। এরপর তারা তাদের মশাল গুলো ছুঁড়ে দিতে থাকে গুহার চারদিকে, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। মুহূর্তের মধ্যে পুড়তে শুরু করে গুহামধ্যস্থ সকল দ্রব্যাদি, আগুনের লেলিহান শিখা সাধুর দেহকেও মুক্তি দেয়না। যন্ত্রনায় তীব্র আর্তনাদ করতে থাকেন তিনি, আক্রমণকারী দল এই ধ্বংসলীলা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। হঠাৎ ওই সাধু উঠে বসেন, জ্বলন্ত দুহাতে ওই সাদা মূর্তিটা তুলে ধরেন, বিড়বিড় করে শুরু করেন এক দুর্বোধ্য মন্ত্রপাঠ। ধীরে ধীরে তার চোখদুটো জ্বলে ওঠে, আতঙ্কের জায়গায় সেখানে জন্ম নেয় এক তীব্র ক্রোধ। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসে চারিদিকে, ঘুম ভেঙে যায় সৈকতের।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে খুব দুর্বল লাগলো সৈকতের। দ্রুত পোশাক বদলে ছুটে গেলো কাকাবাবুর কাছে, তার এরকম উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে উমাপতি বাবুও ভয় পেয়ে গেলেন, বড্ড ফ্যাকাশে লাগছে তাকে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় সৈকত তার দুই রাতের অদ্ভুত স্বপ্নের কথা খুলে বললো ওনাকে। শুনে উনি বড্ড চিন্তিতভাবে বললেন, “আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তাই সত্যি হলো। ওই মূর্তি অভিশপ্ত এবং তোমার পিছনে একবার পড়েছে যখন তোমার ক্ষতি না ঘটানো অব্দি ও থামবে না। আমাকে তুমি ঠিক দুদিন সময় দাও আমি এই মূর্তির ইতিহাস জানার চেষ্টা করছি কিন্তু এই মূর্তি তুমি নিজের কাছে রেখো না। কখন কি বিপদ হয় বলা যায় না।”
কাকাবাবুর কথা কখনও অমান্য করে না সৈকত, তাই খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও অ্যান্টিকের দোকানে মূর্তিটা ফেরত দিয়ে আসে ও। মন খুব খারাপ হয়ে যায়, এতো পছন্দের মূর্তিটা কিনা শেষ পর্যন্ত ফেরত দিয়ে আসতে হলো। শরীরটা দুর্বল হওয়ায় সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ও, মাঝরাতে কিসের একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায় হঠাৎই। কেউ যেন ওকে ডাকছে। চোখটা ভালো করে মুছে সামনের দিকে তাকায় ও, দৃষ্টি অজান্তেই চলে যায় সামনের টেবিলে। এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে চলেছে ওখানে। একটা আলোর স্ফটিক তৈরী হয়েছে টেবিলের ওপর আর সেই আলোর মধ্যে রয়েছে আজ বিকেলেই দোকানে ফেরত দিয়ে আসা সাদা মূর্তিটা। একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় সৈকতের শিরদাঁড়া বেয়ে, এও কি সম্ভব।
পুতুলের ন্যায় হাঁ করে সেই আলোক মায়া দেখতে থাকে সৈকত, তার চেতনা বিলুপ্ত হয়ে আসছে। কেউ যেন তার কানে বিড়বিড় করে বলছে “রক্ত দাও, আমায় রক্ত দাও…..নিজেকে উৎসর্গ করো”। সেই আদেশ অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই সৈকতের। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় ও, ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। পেন্সিল কাটা ছুরিটা হাতে তুলে নেয়, আর মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে “এই যে রক্ত দিলাম, আমি নিজেকে উৎসর্গ করলাম”। নিজের বাঁহাতে বসিয়ে দেয় ছুরিটা, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়তে শুরু করে মূর্তির ওপর। ধীরে ধীরে সাদা মূর্তি লালচে হতে শুরু করে। অনেক রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় মাথা ঘুরতে থাকে সৈকতের, মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেঝেতে।
সৈকতের বাবা মা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ সৈকতের ঘর থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে আসেন। অনেকবার দরজা ধাক্কিয়েও ভিতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান তারা। লোক জড়ো করে দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করেন। গোলমাল শুনে উমাপতি বাবুও সেখানে উপস্থিত হন। দরজা খুলে সৈকতের অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করা হয়, বাঁহাত থেকে তখনো ক্রমাগত রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে আর মাথার পাশে সেই সাদা মূর্তিটা। উমাপতি বাবু সবটা দেখে যা বোঝার বুঝলেন, একটা কথাই বিড়বিড় করে বলে যেতে লাগলেন, “আমি এই আশঙ্কাই করেছিলাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে এই অঘটন ঘটে যাবে তা ভাবতে পারিনি। কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো, ওই সর্বনাশা মূর্তির ধ্বংশ আমার হাতেই হবে সে যেভাবেই হোক।”
বেহুঁশ অবস্থায় সৈকতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যে বিপুল পরিমান রক্ত দেহ থেকে বের হয়েছে তাতে ওর বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন ডাক্তার। একদিকে সৈকত যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলো অপরদিকে তখন উমাপতিবাবু মুখোমুখি হয়েছিলেন এক পৈশাচিক ইতিহাসের, অজানা অভিশাপের বিনাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে।
একটা গোটা দিন পার করে সৈকতের জ্ঞান ফেরে, অনেক রক্ত দিতে হয়েছে ওকে। জ্ঞান ফিরলেও পরের দুদিন শুধুই প্রলাপ বকেছে সে, যেন কেউ তাড়া করছে তাকে আর সে মরিয়া হয়ে প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছে। আজ সপ্তাহখানেক পরে ও একটু সুস্থবোধ করছে। যদিও ওর শরীর খুবই দুর্বল কিন্তু সেই ভীতি এখন অনেকটাই প্রশমিত। ওর জ্ঞান ফেরার খবর পেয়েই উমাপতি বাবু চলে এসেছেন। ওনাকে উদ্দেশ্য করে সৈকত বলে ওঠে, “ঐ মূর্তি সম্বন্ধে কিছু কি জানতে পারলেন কাকাবাবু ?” “হ্যাঁ, সবটুকুই জেনেছি আর সেটা বলতেই তো এলাম।”
সৈকত ও তার বাবা মা উদ্গ্রীব চোখে ওনার দিকে তাকালেন। উমাপতি বাবু একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করেন, “দেখো বাবা, এই মূর্তিটা যে অভিশপ্ত তা আমি তোমাদের আগেই জানিয়েছি। কিন্তু কিসের অভিশাপ বা এর পেছনে কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা আমি জানতাম না। কিন্তু তোমার ঐ অদ্ভুত স্বপ্নের কথাগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল এই স্বপ্নের মধ্যেই সকল রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে, কিন্তু তাও কোনো কিনারা করতে পারছিলাম না। সপ্তাহখানেক আগে রাতে হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মত একটা খবরের কথা আমার মনে পড়ে যায়। পুরোনো খবরের কাগজের মধ্যে থেকে সেই খবরটা পেয়েও গেলাম। বিশ বছর আগে ঠিক এরকমই দেখতে একটা সাদা মূর্তি গৌহাটির মিউজিয়াম থেকে চুরি যায় এবং সেই মিউজিয়ামের সিকিউরিটি গার্ডকে রক্তশূন্য অবস্থায় পরদিন সকালে উদ্ধার করা হয়। আমি পরের দিনই সেই মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে মূর্তির একটা ছবি পাঠিয়ে ওটার ইতিহাস জানতে চাই। ওরা যা বলে তা শুনে আমার রক্ত জল হয়ে যায়। এক নৃশংস ও মর্মান্তিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে ঐ মূর্তির সাথে।
“আমরা সবাই জানি যে কালাজাদু অর্থাৎ ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রধান দুটি পীঠস্থান হল এক আফ্রিকা এবং অপরটি আমাদের ভারতবর্ষ। ভারতের অসম রাজ্যের কামাখ্যা এই ব্ল্যাক ম্যাজিক আর তন্ত্রসাধনার আতুরঘর। নানা ধরনের গুপ্ত ও জটিল বিদ্যার চর্চা হয় কামাখ্যার ওই পাহাড়ে ঢাকা গ্রামগুলোতে। দূরদূরান্ত থেকে বহু সাধক, কাপালিক, তান্ত্রিক আসে এসব গূঢ় ভয়ংকর ক্ষমতার অধিকারী হতে। সেইসব শক্তি কেউ কেউ ভালো কাজে যেমন দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে ব্যবহার করেন আবার কেউ কেউ করেন নিজের স্বার্থে অপরের ক্ষতিসাধনে। এসব ছাড়াও এখানে আরও এক ধরনের সাধনা হয়ে থাকে, তন্ত্রের ভাষায় যার নাম ‘অঘোর শাস্ত্র’ আর এই শাস্ত্রের উপাসকরা হলেন অঘোরী। বড় কঠিন ও কষ্টদায়ী এই সাধনার পথ, বহু কৃচ্ছসাধনের পর সিদ্ধিলাভ ঘটে। সাধনার অন্তে খুব কম জনই পৌঁছতে পারেন। কারণ সাধনাকালে অনেক বাধায় অনেকে দিকভ্রান্ত হয়ে বিপথে চালিত হন যার ফল হয় প্রাণঘাতী।
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কামাখ্যায় পদার্পণ ঘটে এক তিব্বতী সাধকের। যেমন তার উগ্র রূপ তেমনি তার ভয়ংকর দৃষ্টি। সাধনার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করেছেন তিনি। এখন উদ্দেশ্য তন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ক্ষমতা করায়ত্ত করা। পাহাড়ের এক গুহায় লোকচক্ষুর অন্তরালে আস্তানা তৈরি করে তিনি শুরু করলেন তিব্বতি মতে অঘোর সাধনা। চিরাচরিত পদ্ধতিতে নয়, আরো উগ্র আরো ভয়ঙ্কর সেই সাধন প্রণালী।
সাধনার শেষ স্তরে তার প্রয়োজন হল এক সাংঘাতিক পূজা উপাচারের, কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জন্ম হওয়া এমন এক দ্বাদশ বর্ষের বালক যার রাশি হতে হবে কর্কট। সেই বালককে এক অমাবস্যার রাতে দেবতার নিকট উৎসর্গ করে তার বক্ষপিঞ্জরের অস্থি দিয়ে তৈরী করতে হবে এক দেবমূর্তি। অতঃপর সেই মূর্তিতে একশো আটজন মানুষের রক্ত নিবেদন করলেই সেই মূর্তি হয়ে উঠবে জীবন্ত, অপিরিসীম শক্তির আধার। সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে ওই সাধক হয়ে উঠবেন তন্ত্র সমাজের একচ্ছত্র অধিপতি। তন্ত্রশক্তিকে তখন নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করবেন তিনি। জল, বাতাস সর্বোপরি পৃথিবীর সকল শক্তির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবেন, যে উদ্দেশ্যে তার এখানে আসা তা পূরণ হবে।”
একটানা এতক্ষণ বলে দম নিতে থামেন উমাপতি বাবু। সকলে হা করে শুনছিলেন এই ভয়ংকর ঘটনা। উনি থামতেই সৈকত উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “তারপর কাকাবাবু?”
একটু জল খেয়ে আবার শুরু করেন তিনি,
“এদিকে অঘোর সাধনা হলো মহাকাল সাধনা সেখানে এরকম নৃশংসতা দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে সাধক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন আর যা তাকে টেনে নিয়ে গেলো পাপের অন্ধকারে। এতদিনের তপস্যার গুনে তিনি পাহাড়ের নিচের গ্রাম থেকে খুঁজে বের করলেন সাধনোপযুক্ত এক বালককে। বশীকরণে সিদ্ধহস্ত সাধক তাকে সহজেই বশ করে ফেললেন। সেই অমাবস্যার রাতে পাহাড়ের নিচের গ্রামটিতে যখন এক সদ্য সন্তানহারা বাবামা পাগলের মতো খুঁজছিলেন তার ছেলেকে তখন সবার আড়ালে পাহাড়ের উপরে এক গুহায় দপ করে জ্বলে উঠেছিলো এক অগ্নিকুন্ড। সেই আলোয় সারা পাহাড় জঙ্গল সাক্ষী থাকলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের। বাঘছালের উপরে বসে সাধক দুর্বোধ্য ভাষায় একটা মন্ত্র আওড়ে চলেছেন এবং সামনের অগ্নিকুন্ডে ছুঁড়ে মারছেন সিঁদুর মাখানো কিছু পাহাড়ি ফুল। পাশে পড়ে আছে সেই বালকটির অচৈতন্য দেহ।
মধ্যরাতে উপস্থিত হয় সেই চরম মুহূর্ত। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান সাধক। অচৈতন্য বালকটির জ্ঞান ফিরিয়ে কপালে সিঁদুরের ফোটা লাগিয়ে বসিয়ে দেন হাড়িকাঠে, হাতে তুলে নেন খড়গ। যজ্ঞের আগুনের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে শাণিত ধাতব অস্ত্রটি। শেষবারের মতো একটা আর্তনাদ বের হয় সেই বালকের গলা দিয়ে। দূরে জঙ্গল থেকে একদল শিয়াল ডেকে ওঠে, সেই আওয়াজের সাথে বালকটির তীব্র মর্মান্তিক আর্তনাদ মিশে গিয়ে এক নারকীয় পরিবেশ তৈরী করে। একটু পরে সবকিছু শান্ত হয়ে যায়, মৃত্যুর ন্যায় শীতল সেই নিঃস্তব্ধতা। কেউ জানতেই পারে না কি পৈশাচিক কান্ড ঘটে গেলো পাহাড়ের ওই গুহায়। গুহার রক্তস্নাত মেঝেতে বসে বালকটির বুকের পাঁজরের হাড় দিয়ে সাধক শুরু করেন মূর্তি গড়ার কাজ।”
উমাপতি বাবু একটু থামলেন, এই ভয়ংকর পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব তার মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। ঐ নিস্পাপ বাচ্চাটির জন্য তার মনও খানিক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে, একটু চুপ করে থাকেন তিনি। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকে, আর সেটা বুঝতে পেরেই নিজেকে সামলে নেন। ধীরস্বরে আবার বলা শুরু করেন।
তিনদিন পর বিকেল বেলায় সম্পূর্ণ হল মূর্তি নির্মান, নিজের শিল্পকলায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন সাধক। মুখে ফুটে উঠলো এক কুটিল হাসি, আর কিছুদিনের অপেক্ষা তারপরেই তিনি হয়ে উঠবেন এই পৃথিবীর সর্বেসর্বা। মূর্তি গড়া তো হল, এবারে এই মূর্তিকে রক্তপান করাতে হবে, একশো আটজন মানুষের তাজা রক্ত। আস্তে আস্তে শ্বেতশুভ্র মূর্তি হয়ে উঠবে রক্তিম আর তাতে বাসা বাঁধবে অমোঘ প্রাণঘাতী শক্তি। কিন্তু একসাথে এতো মানুষ তিনি পাবেন কোথায় আর তাছাড়াও হঠাৎই এতো মানুষ একসাথে গায়েব হয়ে গেলে চারিদিকে শোরগোল পড়ে যাবে যে। তিনি ভাবতে লাগলেন যাতে নির্ঝঞ্জাটে তার কার্যসিদ্ধি হয়, ভেবে এক ধূর্ত পরিকল্পনা করলেন তিনি।
পাহাড়ের নীচে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষদের ভুল বোঝাতে শুরু করলেন তিনি। গ্রাম্য সরল মানুষেরা তার কথায় ও অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে তাকে সহজেই বিশ্বাস করে ফেললো। তারা বুঝলো যে তাদের গ্রামে শয়তানের কুদৃষ্টি পড়েছে, অবিলম্বে শুদ্ধিকরণ না হলে সকলের মৃত্যু অনিবার্য। তাই প্রতি শনিবার রাতে একজন করে গ্রামবাসীকে এই সাধুবাবার গুহায় গিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে আসতে হবে আর একমাত্র তাহলেই তাদের গ্রাম রক্ষা পাবে। কিন্তু তারা তো আর জানলেন না যে আসল শয়তান এই সাধক আর তারা ভুল বুঝে ওনার ফাঁদে পা দিলেন।
ফলে যা হওয়ার তাই হলো, প্রতি শনিবার একজন করে গ্রামবাসীকে সাধক বলি দিয়ে তার রক্ত উৎসর্গ করতে থাকেন ওই মারণ মূর্তিতে। গ্রামের লোকেরা জানলো যারা মারা যাচ্ছেন তাদের পাপ এতটাই বেশি ছিল যে তারা পৃথিবীতে বাস করার অধিকার হারিয়েছেন আর তাই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এভাবেই বেশ কিছুদিন চলল এই নারকীয় মৃত্যুখেলা। গ্রামের লোক এখন প্রাণভয়ে তটস্থ কারণ তারা জানে, যে একবার সাধুর গুহায় যায় সে আর ফেরে না, পরের দিন গ্রামের সীমানায় পড়ে থাকে তার রক্তশূন্য মৃতদেহ। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে সবাই ঘুরে দাঁড়ায়, একটা শেষ চেষ্টা তারাও করলো। ধীরে ধীরে তাদের মনে সন্দেহের কালো মেঘ ঘনিয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে কেউই কি পাপ থেকে বিরত নয় কেউ কি বাঁচতে পারবে না, এ কিভাবে হতে পারে। এক শনিবার যার পালা চুপিচুপি তার পিছু নেয় গ্রামের কয়েকজন যুবক। গুহার বাইরে তারা লুকিয়ে সাধুর সমস্ত কার্যপ্রণালী দেখে এসে গ্রামে জানিয়ে দেয়। সকল গ্রামবাসীর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, তাদেরকে এভাবে ঠকিয়ে বলি দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছে ঐ ভন্ড সাধক। এর প্রতিশোধ তারা নেবেই।
সেই রাতে সকল গ্রামবাসী একত্রে মশাল ও কেরোসিন নিয়ে চড়াও হয় সাধুর আস্তানায়। পূজাপাঠ সেরে তিনি সবে বিশ্রামনের তোড়জোড় করছিলেন। ফলে এই আচমকা আক্রমণে তিনি কোনোরূপ বাধা দিতে পারলেন না। সারা গুহায় ও সাধুর দেহে কেরোসিন ঢেলে তারা আগুন জ্বালিয়ে দেয়, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে সবকিছু। নিজের অন্তিমকাল উপস্থিত বুঝে সাধক সেই মূর্তিটাকে তুলে নেয় দুহাতে। ধীরে ধীরে তার চোখে আতঙ্কের জায়গায় জন্ম নিলো হিংস্রতা, ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক কুটিল হাসি। জ্বলন্ত দেহে বিড়বিড় করে একটা মন্ত্রপাঠ করতে থাকেন তিনি। আশ্চর্যজনকভাবে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ঐ মূর্তিটা বেঁচে যায়।”
“মূর্তিটা তো মানুষের অস্থি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তাহলে সেটা পুড়লো না কেন?” বিস্ফারিত নেত্রে জিজ্ঞেস করেন সৈকতের বাবা। “আমার যা অনুমান তা হল মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সেই সাধক নিজেকে ওই মূর্তিতে উৎসর্গ করেন। এতে তার মৃত্যুর পর তার অতৃপ্ত আত্মা বন্দী হয়ে যায় ঐ মূর্তিতে। মূর্তি হয়ে ওঠে অভিশপ্ত, যার কাছে যাবে তার রক্তপান করবে মূর্তির ভিতরে থাকা সাধকের আত্মা। সাধকের বাসনা মতো একশত আটজনের রক্ত পান করার পর তার আত্মা হয়ে উঠবে প্রবল শক্তিশালী। বেঁচে থাকতে যে কাজ অসম্পূর্ণ ছিল মূর্তির ভিতরে প্রেতরূপে তা শেষ করবে সে। এই পঞ্চাশ বছরে না জানি কত লোকের রক্তপান করেছে ওই অভিশপ্ত মূর্তি।”
এতোটা বলে থামলেন উমাপতিবাবু। সৈকত জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা মূর্তিটার শেষ পর্যন্ত কি হল?” “ওই অভিশপ্ত রক্তপিপাসু মূর্তি আর নেই সৈকত। আমি ওটাকে নষ্ট করে দিয়েছি, যদিও তার জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। মূর্তিটিতে এমন অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যে সেটা অস্থিনির্মিত হলেও দাহ্য নয়। আমি আগুনে পুড়িয়ে দেখেছি, ঘন্টার পর ঘণ্টা গনগনে আগুনের আঁচে কি আশ্চর্যজনকভাবে অবিকৃত ছিল ওটা। এদিকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া বা মাটিচাপা দেওয়াতেও ভয় ছিল একটা, এসবে ওটা বিনষ্ট হবে না। ভবিষ্যতে কে বলতে পারে ঐ সর্বনাশা মূর্তি অন্য কারোর হাতে গিয়ে তার ক্ষতিসাধন করবে না।” একটু থামলেন উমাপতিবাবু। “কী করলেন তাহলে কাকাবাবু?” জিজ্ঞেস করে সৈকত।
“অ্যাকুয়া রেজিয়া যাকে চলতি কথায় বলে অম্লরাজ। শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম একবার, সমস্ত ধাতু দ্রবীভূত করার আশ্চর্য ক্ষমতাধারী এই রাসায়নিক তরল পারে কিনা এই মূর্তির বিনাশ করতে। আমার পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে ল্যাবরেটরি আছে, মূর্তিটা সাথে নিয়ে দুরুদুরু বুকে সোজা চলে গেলাম তার বাড়ি। একটা বিশাল পাত্রে অ্যাকুয়া রেজিয়া তৈরি করে তার মধ্যে মূর্তিটা দিতেই এক বিশাল বিষ্ফোরনের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় হল, সারা ঘর ধোঁয়ায় ভরে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম কিছুক্ষণ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে দেখলাম বোরোসিলের পাত্রটা ফেটে চৌঁচির কিন্তু সুখের বিষয় হচ্ছে মাটিতে পড়ে যাওয়া অ্যাকুয়া রেজিয়ায় মূর্তিটা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে আর একটা নীলচে সবুজ বাষ্প ঘরটাকে ভরিয়ে তুলছে। বিজ্ঞানী বন্ধুটির মতে এরকম ঘটনা অতি বিরল। আমি আর ওনাকে বেশি কিছু জানালাম না, একমাত্র এইভাবেই ওটাকে ধ্বংস করা যেত। আমি সামনের মাসে গয়ায় গিয়ে সাধক এবং যারা ঐ মূর্তির জন্য প্রাণ হারিয়েছেন সকলের পিন্ডদান করে আসবো। আশা করছি আর কোনো গোলমাল হবে না।”
মন্ত্রমুগ্ধের মত উমাপতিবাবুর কথা শুনছিলেন সকলে। সৈকতের বাবা তার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন, একমাত্র সন্তানের প্রাণরক্ষা করার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানালেন সৈকতের মা। তিনি সলজ্জ মুখে সৈকতের দিকে ফিরে ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,“ও তো আমার ছেলেরই মত, ওকে এই সাংঘাতিক বিপদ থেকে উদ্ধার করা যে আমার কর্তব্য, আমি যে সফল হতে পেরেছি এতেই আমি খুব প্রশান্তি অনুভব করছি। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা, এখন তাহলে আমি আসি।” এই বলে উমাপতি চক্রবর্তী ঘর থেকে প্রস্থান করেন।
সৈকত খুব শান্তি পেল। চোখ বুজে ভাবতে লাগলো এই দুনিয়ায় এখনও কত ঘটনাই যে ঘটে যা মানুষ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না। আলোর অপরদিকে যেমন অন্ধকার আদি অনন্তকাল ধরে সত্য, এসব ঘটনাও তেমনি ঘটে চলে সকল যুক্তিতর্কের একদম বিপরীতে, বুদ্ধি বিবেচনা যেখানে অর্থহীন। আস্তে আস্তে সৈকতের ক্লান্ত নয়নে ঘুম নেমে আসে, নাহ আজ আর কোনো স্বপ্ন দেখে না সে। তার সব বিপদ কেটে গেছে।