সালটা 2014,বার্লিনের একটি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি আমি।ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা আটটা বেজে তিরিশ মিনিট।বার্লিনে যদিও প্রবল ঠান্ডা পড়ে, সেসময়ে তেমন জাঁকিয়ে শীত পড়েনি।তবুও আবহাওয়ায় ছিল শীতের ছোঁয়া।এমন সময় চোখ ধাঁধানো আলো আর প্রচণ্ড হুইসেল দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করল ট্রেনটি।বেশ বড়,সবুজ রঙের ট্রেনটি থামল স্টেশনে।উঠলাম ট্রেনে।কিছুক্ষণ পর ট্রেন চলতে আরম্ভ করল।সিটে গিয়ে বসলাম।গন্তব্য ড্রেসডেন।সিটে বসে ভাবছি এতদিন জার্মানির ড্রেসডেন শহরের শিল্প-স্থাপত্যের কথা শুধু শুনেই এসেছি,দেখার সাধ ছিল মনে।তবুও দেখার সৌভাগ্য হয়নি।আজ সেই সাধ পূরণ হতে চলেছে।মন বেশ উৎফুল্ল হয়ে রয়েছে।
পকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে আবার দেখলাম।ঠিকানাটা আমার বন্ধু জোনাসের।তার বাড়ি ড্রেসডেনে।বেন,লরা ও শার্লটের বাড়িও সেখানে।বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট আমরা।সবাই প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করছি।পড়াশুনোর কারণে এখানে এলেও এরমধ্যেই অনেক বন্ধু-বান্ধবী জুটেছে।এখানে এসে আমার নিজস্ব উপলব্ধি দিয়ে বলতে পারি দেখতে সুদর্শন হলে এখানে বন্ধু-বান্ধবী জুটতে সময় লাগে না।তারমধ্যে এই সালে স্টুডেন্টসদের ফি তে ছাড় আমার এক উপরি পাওয়া।শুধু জার্মান স্টুডেন্টস নয়,এই ছাড়ের আওতায় বাইরের দেশের স্টুডেন্টরাও রয়েছে।তাই আমিও বাদ যাইনি।মনে যখন উৎসাহের কমতি নেই,হাতেও প্রচুর অর্থ আর বন্ধু সান্নিধ্যও মিলেছে,তখন বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের ইচ্ছেপূরণের আর বাধা কোথায়?তাই ঘুরছি জার্মানির বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান।এরইমধ্যে হেইডেলবার্গ কাসেল,রুগেন আইল্যান্ড ঘুরে দেখা শেষ।পরবর্তী গন্তব্য ড্রেসডেন,আমার স্বপ্ননগরী। রাতের অন্ধকার।বাইরে শীত।প্রবল বেগে ট্রেন ছুটছে।আমার সিটের উল্টোদিকে বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক,সুট
-কোট-হ্যাট পরে।লোকটিকে দেখে রাশিয়ান মনে হচ্ছে।যেচে কথা বলা আমার স্বভাব নয়।তাই কথা না বলেই চলছি আমরা।কামরায় উঠেই মোটামুটি সবকিছু দেখে নিয়েছি।সে কামরাতে শুধুমাত্র আমরা দু’জন ছিলাম।গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে গিয়ে গোয়েন্দা না হলেও বেশ একটা গোয়েন্দাসুলভ মনোভাব হয়েছে।এখন কারো দিকে তাকালেই খুঁটিয়ে দেখে নিমেষে তাকে জরিপ করে নেই।যেন শার্লক হোমস্ আমি,আমার পরবর্তী কেসটিতে তথ্যগুলো কাজে লাগবে।
যাইহোক,ট্রেন ছুটে চলেছে রাইন নদী পেরিয়ে,রেললাইনের দু’ধারে ফার্ণ গাছের ঝোপ,ছোটো-ছোটো হলুদ আর তুঁতে রঙের ফুলগাছদের ছাড়িয়ে,দু’পাশের সারি-সারি পাইন,প্রুস,ফার গাছেদের ভিতর দিয়ে।যদিও বাইরের অন্ধকারে কিছুই দৃশ্যমান নয়।তবুও কখনও অল্প আলো কোথা থেকে এসে পড়ায় আলো-আঁধারের আবছায়াতে তাদের অস্তিত্বকে অনুভব করতে- করতে চলেছি।কতটা সময় এভাবে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে সে খেয়াল নেই।গভীর কোনো চিন্তায় ডুবে গিয়ে বাইরের জগৎ সম্পর্কে পুরোপুরি আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল ভারী গলার আওয়াজে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ প্রশ্ন শুনে তাকাতেই দেখি সামনের সিটে বসে থাকা ভদ্রলোকটি একেবারে আমার মুখোমুখি এসে বসেছে।উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
-‘ও হ্যাঁ,ড্রেসডেন…ড্রেসডেন যাচ্ছি।’ আমার উত্তর শুনে তার মুখের ফরসা পাতলা কোঁচকানো চামড়াগুলোকে আরও খানিকটা কুঁচকিয়ে,কপালে অনেকগুলো ভাঁজ ফেলে বললেন,’ড্রেসডেন?কিন্তু কেন?’
– ‘আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে’ কথাটি ইংরেজিতে বলায় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম আমি জার্মান শিখছি।তাই খুব ভালো জার্মান এখনও বলতে পারিনা।তবে বুঝতে পারি। তিনি ব্যাপারটা উপভোগ করে ‘হেঃ হেঃ’শব্দে হেসে উঠলেন।’ঠিক আছে…ঠিক আছে’বললেন তিনি।(জার্মানিরা দেখছি বেশ হাসিখুশি স্বভাবের।কথার শেষে সামান্য কারণেই তাদের অনেককেই ‘হেঃ হেঃ,হিঃ হিঃ এইরকম করে হাসতে দেখেছি।)বুঝলাম লোকটি জার্মান।এখানে আমার গোয়েন্দার চোখ ধোঁকা খেল সে ভালই বুঝলাম।তবে লোকটি ভারী মিশুকে।লক্ষ্য করলাম লোকটির পড়নের পোশাকগুলো অনেক পুরোনো ফ্যাশনের।লোকটি এত মিশুকে হলেও তার মুখের প্রতিটি ভাঁজে অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন লুকানো ছিল।সেটুকু আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি।তারপর অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলে চলল লোকটি।জার্মানির অনেক কথা জানতে পারলাম তার থেকে।শুনলাম,জার্মান জেলবন্দিরা যদি কেউ পালাতে পারে,তবে তাদের ধরে আবার জেলে পুরে দেওয়া কিংবা তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো চেষ্টাই জেলকর্তৃপক্ষ করে না।তাদের দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধীরও নিজেকে বাঁচাবার অধিকার রয়েছে।কথায় – কথায় তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন,’তুমি মিউজিক পছন্দ কর?’
-‘হ্যাঁ করি’।
-‘কে তোমার পছন্দ?’
জার্মান মিউজিক কম্পোজার বলতেই চোখের সামনে বাচ আর বিঠোফেনের নাম ভেসে ওঠায় তাদের নামই বলে দিলাম।শুনে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন।খুশির অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।বললেন,’তারা আমার প্রিয়।তারাই সেরা।’
শুনে সম্মতিসূচক মৃদু হাসলাম আমি।শুনলাম বার্লিন থেকে বাড়ি ফিরছেন তিনি।বলতে লাগলেন,’তুমি ভাবতে পারবে না ইয়াংম্যান বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমি আমার স্ত্রী ও মেয়েকে দেখিনা।হায়!ভগবান জানেন,তারা কেমন আছে।’ তিনি আবারও বললেন,’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম।তারপর…’
তার কথাগুলো শুনে কেমন যেন রহস্যজনক মনে হল।শিহরিত হয়ে উঠল সমস্ত শরীর।ভাবছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন,তাহলে তখন তার বয়স যদি কুড়ি-একুশ বছরও হয়ে থাকে,তাহলে তো তার এখন বৃদ্ধ হয়ে যাবার কথা।কিন্তু দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না মোটেও।বড়জোর চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের কোঠায় বয়স বলেই মনে হচ্ছে!এইসব চিন্তা করে সামনে তাকাতেই দেখি সামনে কেউ নেই।চমকে উঠলাম।এইমাত্র তো কথা বলছিলেন !কোথায় গেলেন তিনি?তবে কি…ভয়ে সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠল।ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে যেন আমার সারা শরীর।মুখ দিয়ে আওয়াজ করার শক্তিটুকুও নেই যে চিৎকার করব।খুব জোরে ঢিবঢিব করছে বুকের ভিতর।প্রচণ্ড শীত যেন থাবা বসিয়ে হাত-পা আড়ষ্ট করে দিল।
হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাকুনিতে দুলে উঠল ট্রেন।সমস্ত কামরা জুড়ে নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।দিকবিদিক্ শূন্য মনে হল।সমস্ত কিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো প্রচণ্ড আওয়াজ হল।চারপাশে প্রবল আর্ত-চিৎকার শুনতে পেলাম।সবকিছু যেন নিমেষেই দুমড়ে -মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল।মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল।তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞানফিরতেই দেখি বার্লিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।আমার বন্ধুরা খবর পেয়ে ততক্ষণে অনেকেই আমায় দেখতে এসেছে।শুনলাম রেসকিউ করে আনা হয়েছে আমাদের।আমি ছাড়াও আরও কয়েকজন সেই স্টেশনে কোনো ঘোষণা না শুনেই ট্রেনটিতে উঠে পড়েছিল।সবাইকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। পরেরদিন বার্লিনের সংবাদপত্রগুলিতে শিরোনাম হিসেবে ছাপা হয় এই খবরটি,’মৃত্যুমুখ থেকে ফিরল সাতযাত্রী ভূতুড়ে ট্রেন যাত্রায়।’
পরবর্তীতে গবেষণা চালিয়ে আজও এই রহস্যের কিনারা মেলেনি।শোনা যায় ষাটের দশকে বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল এই ট্রেন।ড্রাইভার সহ যাত্রীরা কেউই আর বেঁচে নেই।সেই থেকে সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিন ট্রেনটি বার্লিন থেকে ড্রেসডেন অভিমুখে রওনা দেয়।ভীষণ আতঙ্ক ছড়ায় মানুষের মনে।পরবর্তীতে রেলপথ খুলে ফেলেও আটকানো যায়নি এই ভূতুড়ে ট্রেনটিকে।তারপরও প্রতিটি স্টেশনে নির্দিষ্ট সময় যাত্রীদের জন্য থেমে -থেমে ট্রেনটি একইভাবে দানবীয় বেগে চলতে থাকে।কোনোভাবেই ট্রেনটির চলাচল বন্ধ করতে না পারার কারণে সমস্ত যাত্রীদের সর্তক করে দেওয়া হয় তারা যেন ‘Berlin to Dresden 1953’ লেখা সবুজ রঙের কোনো ট্রেনে না ওঠে।