বড়শি ভূত

বড়শি ভূত

বা পরে বাপ্! মাত্তর চারটে টাকার বড়শি ধারে কিনতে গিয়ে এমন জন্ম-গেরোয় পড়তে হবে তা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেত হারু, তবে মাছ ধরার কথায় মরে গেলেও সায়

দিত না সে। উফস্, জোর বাঁচা গেছে এ যাত্রা। আশু সাহার দোকানের ঘুলঘুলি জানালার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে, আশু সাহার বড় নাতি কানাইয়ের হাতে এক মুঠো পয়সা

ঠকাস্ করে ফেলেই চাঁ চাঁ দৌড় লাগায় হারু। মনে মনে বলে, ‘রাম রাম!’ ধার শোধ হল। এবার বুড়ো শিবের থানে এক টাকার প্রণামী চড়িয়ে, ছোট নদীতে পটাপট

ক’খানা শুদ্ধিডুব মেরে তবেই বাড়ি ঢুকবে এক্কেবারে। হারু হল হারাধন। বাঁটী গাঁয়ের ‘সুমতি’ প্রাইমারী ইস্কুলে, একবার ফেল করে সিক্সে পড়ার বয়সে ফাইভ ক্লাসে

পড়ে। থাকে ছোট নদীর চরে, মণ্ডলপাড়ায়। বাবা নেই বেচারার। মা দিনভর লোকের বাড়ি ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চিঁড়ে কুটে, চাল কুটে, ছাতু কুটে যা পায়, তাই দিয়ে

কোনোমতে মা বেটার অন্ন সংস্থান করে। হারুর মা কাজে বেরোয় সেই কোন সক্কালে। বোঁটা ভাঙা কাপে চা আর দু’খানা বাসি রুটি খেয়ে। হারুও সোনামুখ করে তাই

খায়। তাপ্পর হারুর মা কোমরে শাড়ীর ফাঁসড় জড়িয়ে বাবুদের বাড়িতে চাল-চিঁড়ে কুটতে যায়। বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় তার। কোঁচড়ে চাট্টি চাল আর টাকা নিয়ে

ফেরে। ফিরতি পথেই পড়ে কিপটে আশু সাহার খুপরি মুদিখানা দোকান। সেখান থেকে আলু, তেল, নুন, মশলা নিয়ে আসে। রাঁধতে রাঁধতে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে।

উঠোনের কোলে বাঁশ ঝাড়ের ভেতর একশো ঝিঁ ঝিঁ পোকা একসুরে গান ধরে। হারুও তখন ফিরে আসে। ইস্কুল খেলাধুলা টো টো কোম্পানি সব কিছু সেরে সুরে। মা-

ছেলে একসাথে ভাত খায়। খেতে খেতে, গল্প করতে করতে খেয়ালই করে না কেউ, ঝুপ করে কখন অন্ধকার নেমে আসে। ছেয়ে ফেলে তাদের খড় ছাওয়া বাড়িটাকে।

ভর সন্ধ্যায় হারুদের পাড়ায় তখন নিঝুম রাত। দাওয়ায় লম্ফর আলো কাঁপতে থাকে বাঁশ বাগান থেকে উড়ে আসা এলোমেলো টুকরো হাওয়ায়। মা ছেলে দিনের শেষে

হাসিমুখে পেটভরে খায় স্বাদের পরমান্ন। এ অব্দি সব ঠিকই ছিল, তবে গোল বাঁধল কিসে? ওই যে, বর্ষায় ইস্কুল ঘরে জল ঢুকল বলে ইস্কুল ছুটি পড়ল আর হারুর বন্ধুদের

মাথায় ভূত চাপল। বর্ষাকালে, হাজা মজা ছোট নদীর বুকে জল থৈ থৈ করে। কুল ছাপিয়ে চরে ঢুকে পড়ে জল। হারুদের বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে ফেলে প্রায়। ওই যেখানে

মেঘছোঁয়া তালগাছ গুলো একপায়ে দাঁড়িয়ে, আর তার ঠিক তলায় লবু কাকাদের খুঁটিবাঁধা কালোগাই ধলোগাই নাদা থেকে দিনরাত জাবনা চিবোয় কচর-কচর, ঐখানে

নদীর চর সবচাইতে ঢালু। ছোট নদীর জল সেখানে ঢুকে পড়েছে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে। হাঁটু জলে কিলবিল করে খেলে বেড়াচ্ছে শোল সিঙ্গি ট্যাংরা মৌরালা মাছের ঝাঁক।

হারুর বন্ধু পানু, বিশু, তপু, মুংলা সবাই মিলে হৈ হৈ করে বড় গামছা কাদাজলে চুবিয়ে মাছ ধরল খুব। তারপর দলের পাণ্ডা পানু বলল, ‘ছোট নদীর চরে নরম ঘাসের

ওপর বসে ছিপে মাছ খেলানোর মজাই আলাদা। এবার চল ছিপ দিয়ে মাছ ধরি।’ যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে ফটাফট তৈরী হয়ে গেল ছিপ

শোলা কেটে ফাতনা। বাকি শুধু সুতো আর বড়শি। পানুর বাবা জেলে। সে বলল ওদের ঘরে জাল সেলাই-এর সুতোর বড় একটা গোলা আছে। সুতোর জোগান সেই

দেবে। আর কিপটে আশু সাহার দোকান থেকে দু- টাকা করে চার টাকায় দু’খানা বড়শি কিনে নিলেই হয়ে গেল। ব্যাস, ঝামেলা খতম। টোপের জন্য ভাবনা নেই। নদীর

চড়ে, কাদামাটির ভেতর কেঁচোদের রাজত্ব। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে, ভাত খেতে বসে, মায়ের কাছে বড়শি কেনার চারটে টাকা চাইল হারু। মা জিজ্ঞেস করল, ‘টাকা দিয়ে কী

হবে শুনি?’ হারু বলল, ‘মাছ ধরার বড়শি কিনব মা, আশু সাহার দোকানে।’ মায়ের চিন্তা হয়, ‘ওই ঝোপঝাড়ে মাছ ধরতে যাবি, সাপ খোপ পোকা মাকড় কী নেই

ওখানে।’ হারু আবদারের সুরে বলে, ‘তুমি না কত্তে পারবে না মা। ওই তো পানু বিশু তপু মুংলা সবাই যাবে। ওরাও বাড়ি থেকে পয়সা পেয়েছে বড়শি কেনার।’ মা বলল,

‘আচ্ছা নিস তবে। কাল পরশু করে নিস বাছা। রায় বাড়িতে চিঁড়ে কুটে বিশটা টাকা পাব কাল। তখন দেবো নিস।’ আর কিছু বলতে পারে না হারু। চুপ করে যায়।

মুখখানা তোম্বা করে বসে থাকে এঁটো হাতেই। মহা ফাঁফরে পড়ে যায় সে। ওদিকে পানুরা সব আজ রাতেই ছিপ তৈরী করে, কাল রোদ্দুর মাথায় চড়ার আগেই ছোট নদীর

চরে যাবে মাছ ধরতে। আর এদিকে তার মা পয়সা দেবে কাল সন্ধ্যায়। চারটে টাকাও নেই মার হাতে। ভাবতেই ভারি দুঃখ হল হারুর। খেয়ালই রইল না তার এঁটো হাত

কখন যে শুকিয়ে কাঠ হল। হঠাৎই টকাস করে একটা বুদ্ধি উঁকি মেরে গেল তার মাথায়। এঁটো হাত ধুয়ে ঢে…উ করে বড় একখানা ঢেকুর তুলেই হারু ছুট লাগাল

সাহাপাড়ার দিকে। একটু দূর থেকেই সে দেখতে পেল ঘুলঘুলি  জানালার ফাঁক গলে হ্যারিকেনের লালচে আলো ছড়িয়েছে। বাইরে চাপা অন্ধকার। জানালা দিয়ে বেরিয়ে

আসা আলোর রেখা ইতি উতি আলপনা কেটেছে দোকানের সামনের পথে। হারু গিয়ে চুপটি করে দাঁড়াল জানালার সামনে। মিহিস্বরে ডাকল, ‘দাদু গো, বড়শি আছে?’

‘কে, কে রে তুই?’ ভেতর থেকে প্রশ্ন ভেসে এল।

‘আমি হারু গো দাদু। ও…ই ছোট নদীর চরে থাকি।’

‘অ… তা এই কানা রাতে কী মনে করে?

দোকান বন্ধ করছি বাপু এখন… ওরে ও কানাই, ধরে তোল দেকিনি আমাকে। আর জানলার ঝাঁপ খানা ফেলে দে বাপ।’ কানাই আশু সাহার নাতি। চট পট হারু বলল,

‘কাল সকালে মাছ ধরব। দু’খানা পোক্ত বড়শি দাও না দাদু।’ ভাঙা গলায় খ্যানখ্যান করে উঠল আশু সাহা, ‘দূর হ, বড়শি! রাতচরা বাঁদর কোথাকার!’  জানালার ঝাঁপ

পড়েনি তখনও, ঝট করে ডান হাতখানা ভেতরে ঢুকিয়ে হারু বলল, ‘দাও না গো দাদু।’ একটা মুহূর্ত কী যেন ভাবল আশু সাহা। তারপর হাতটা বাড়িয়ে ঝাপসা ঘুম পাওয়া

চোখে বলল, ‘পয়সা এনেছিস?’

‘আগে তুমি বড়শি দাও, তবে তো পয়সা।’ হারু জানে সূর্য ডুবলেই আশু সাহার খুব ঘুম পেয়ে যায়। চোখে কম দেখে। কানেও কম শোনে। হারুর কথা শুনে বুড়ো ঘাড়টা

পেছনে হেলিয়ে কাঠের নড়বড়ে তক্তার ওপর থেকে তেলচিটে টিনের একটা কৌটা নামাল। তারপর গুনে গুনে দু’খানা বড়শি বাড়িয়ে দিল হাতের চেটোয়, ‘এই নে…

চার টাকা দে।’ তক্কে তক্কেই ছিল হারু। খপাৎ করে মুঠোয় ভরে নেয় বড়শি দুটো। তারপরেই উল্টে দৌড় লাগায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘চল্লাম দাদু, বড়শির

দাম পরশু পাবে… রায় বাড়িতে চিঁড়ে কুটে মা বিশ টাকা পাবে কাল, তার থেকে চার টাকা।’ কী হল বুঝে ওঠার আগেই হারু পগার পার। ঘোর কাটার পর বুড়ো চিৎকার

করে, ‘ধর ধর

ব্যাটাকে… পালাল…’ আর ধর! ধরবেটা কাকে? আশু সাহাকে দোকানের বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতেই ডাইনে বাঁয়ে দুটো লোক লাগে। আর নাতি কানাই তো পুরো ব্যাপার

দেখে থ বনে গেছে। রাতে শুয়ে হারু মনে মনে ভাবল, দোষের এমন কিছু করেনি সে। চারটে টাকার বড়শি বৈ তো নয়। ভালোমুখে ধার চাইলে হাড় কিপটে বুড়ো

কিছুতেই দিত না। তাই একটু চালাকি করতে হল। পয়সা ঠিক সে দিয়ে আসবে পরশু গিয়ে। সকালে হারুর মা কাজে বেরোলেই বাড়িতে হৈ হৈ করে হাজির হল তার

বন্ধুরা। জিনিসপত্র গুছিয়ে। কোমরে গামছা বেঁধে সবাই চলল মাছ ধরতে। ছোট নদীর চর আসতেই ওদের চোখে পড়ল – ওই দূরে, নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে

একদল লোক মড়া পোড়ানো শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। ওদিকে শ্মশান। গ্রামের লোক ওদিকেই মড়া পোড়ায়। হারু শুধাল, ‘কে মরল রে?’ বিশু বলল, ‘ঐ যে কিপ্টে বুড়ো,

আশু সাহা।’ ‘অ্যাঁ, বলিস কী?’ হারু চমকে উঠল। ‘হ্যাঁ রে, আমি তো ঐ পথেই এলাম। এইমাত্র শুনে এলাম, ওদের বাড়িতে এখনও মড়া কান্না চলছে…’ হারুর যেন বিশ্বাস

হচ্ছিল না। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে মরল হঠাৎ?’

‘শুনলাম, দোকান বন্ধ করার সময় কে নাকি জিনিস কিনে দাম না দিয়ে পালিয়েছে। আর তাইতে বুড়ো চেঁচামেচি করেছে বিস্তর। ওই থেকেই বুক ব্যথা, বুক ধড়ফড়

তারপর দম আটকে শেষ’ , সবিস্তারে জানাল বিশু। খবর শুনে খুবই মন খারাপ হল হারুর। বড়শি কেনার পয়সা ছিল না। তাই কায়দা করে দুটো বড়শি নিয়ে

পালিয়েছিল। বলেও এসেছিল, পরশু পয়সা দিয়ে আসবে। এরই মধ্যে এমন ঘটবে, জানবে কী করে সে? আশু সাহার মৃত্যুর জন্য মনে মনে নিজেকেই  দায়ী করল হারু।

ততক্ষণে পানু দুটো বড় ট্যাংরা, বিশু একখানা মাঝারি মাপের রুই, মুংলা গোটা কয়েক শোলের চারা তুলেছে ছিপে। হারুর চোখের সামনে আশু সাহার মুখটা ভেসে

উঠছিল বারবার। খেয়ালই করেনি হাতের ছিপখানা কখন গড়িয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর। ছিপ তুলতে গিয়ে দেখে বিষম ভারী। সুতোর টানে সেটি এগুচ্ছে জলের দিকে।

হারু ভাবল, নির্ঘাত বড় মাপের কাতলা গেঁথেছে বড়শিতে। মহানন্দে ছিপ টেনে ডাঙায় তোলার চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু আজব কাণ্ড, সে ছিপ টেনে তুলবে কী,

ছিপের প্রবল টানে হারু নিজেই গড়গড় করে গড়িয়ে পড়তে লাগল নদীর ঢালু পাড় বেয়ে। ছিপ সুদ্ধ কোমর সমান জলে কাদার মধ্যে গিয়ে পড়ল সে। তবুও মাছ

হাতছাড়া করবে না সে কিছুতেই। প্রানপন চেষ্টায় সপাং করে জল থেকে ছিপ টেনে তুলল হারু। তার বন্ধুরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, বড়শি দিব্যি খালি!

কেঁচোর টোপটা পর্যন্ত যেমন কে তেমন! ব্যাপারখানা তবে কী? তবে এমন করে টানছিল কে? ‘বাবারে!’ ভয়ে হারুর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বন্ধুদের চেষ্টায় বহু  কষ্টে

জল-কাদা থেকে উদ্ধার হয় সে। শেষ অব্দি অবশ্য ছোটবড় মিলিয়ে আধ- কেজিটাক মাছ উঠেছিল হারুর ছিপে। গামছায় মাছ বেঁধে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হারু ভাবছিল,

আজ জম্পেশ করে ভাত খাবে সে। কতদিন মাছ-ভাত খায়নি। ভেবে পাচ্ছিল না, মা কে গরম ভাতের সঙ্গে মাছ ভাজা করতে বলবে নাকি, মাখো মাখো মাছের ঝোল।

মুখ থেকে অজান্তেই ‘আহ্’ শব্দটা বেরিয়ে এল। আনন্দে দু’বার লাফিয়েও নিল হারু। সেইসাথে জ্যান্ত মাছগুলো খলবল করে উঠল গামছার মধ্যে। হারুদের বাড়ির

উঠোন ঘিরে বাঁশঝাড়। রোদ ঢুকতে পারে না ভালোমত। দিনের বেলাতেও ছায়া ছায়া অন্ধকার ছেয়ে থাকে। খুশি খুশি মনে বাঁশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে বাড়িতে ঢুকছে হারু,

কে যেন বলল, ‘অ্যাই, মাছ দে… খাব!’ চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল হারু। কেউ কোত্থাও নেই। কে বলল এ কথা? মহা জ্বালা তো! হারু ভাবল মনের ভুলই হবে। দু

পা এগিয়েছে কী এগোয়নি, আবার কানে এল সেই স্বর, ‘কী রে, মাছ না দিয়ে চলে যাচ্ছিস যে!’ স্পষ্ট শুনতে পেল হারু। ভাবল, নির্ঘাত বিশু তার পিছু নিয়েছে। ওর ছিপে

বেশি মাছ ওঠেনি। তাই ফেরার সময় দুটো মাছ চাইছিল সে হারুর কাছে। কিন্তু বিশুর গলা তো এমন খ্যানখ্যানে নয়। কে তবে!  গা ছমছম করে উঠল হারুর। এক লাফে

ঘরের দাওয়ায় উঠে পড়ল সে। ঘর খুলে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখল ভালো করে। না, কেউ কোত্থাও নেই। তবু অদ্ভুত একটা ভয় যেন চেপে ধরেছে তাকে। অথচ এখন

ভয় পেলে চলবে না হারুর। মা ফেরার আগেই বঁটিতে কেটে, ধুয়ে, আঁশ ছাড়িয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। অতগুলো মাছ দেখে মা চমকে যাবে। খুশিও হবে।

ভাবতেই হারুর মনটা কেমন চনমন করে উঠল। সন্ধ্যাবেলা মা বেড়ে দিল ধোঁয়া ওঠা এক থালা গরম ভাত আর ট্যাংরা মাছ ভাজা। সাথে শিঙি মাছের পাতলা ঝোল। বুক

ভরে গন্ধ নেয় হারু। হাসিহাসি মুখে ভাতে হাত দেয়। ছেলের খুশি দেখে মায়ের মন চকচক করে ওঠে। বলে, ‘খা বাবা, পেট ভরে মাছ-ভাত খা।’ কিন্তু একি! ভাত মাখতে

গিয়ে থালা খানা সড়কে যাচ্ছে কেন? প্রথমে সরলো বাঁ দিকে। হারু টেনে আনলো সামনে। ভাত মাখতে যাবে, এবার সড়কালো ডান দিকে। কী কাণ্ড! থালার হাত-পা

গজালো নাকি? হারুর মা তখন হাঁড়ি চেঁছে-পুঁছে নিজের ভাতটুকু বাড়ছিল। হারু শুধালো, ‘মা, ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? থালা হড়কায় কেন?’ মা বলে, ‘না রে বাছা, ভুঁই তো

কাঁপছে না! সানকি থালা ক্ষয়ে ক্ষয়ে পুরনো হয়েছে।তাই তলাটা মাটিতে থিতু হয়ে বসে না রে। সড়কে যায় খালি।’ বাঁ হাতে থালাটাকে কষকে ধরল হারু। আর মনে মনে

বলল, ‘নে, এবার সড়কা দেখি।’ ততক্ষণে হারুর মা এসে গেছে। হারু তখনও খায়নি দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, ভাত ছুঁসনি যে।’ ‘হাত বড় ভারী ঠেকছে মা। খেতে তো

চাইছি। কিন্তু মুখে ভাত তুলতে পারছি কই?’- করুণ মুখে বলে হারু। ‘ও মা বালাই ষাট! হাত আবার কে টানবে! বুঝেছি, এ হল একটানা ছিপ ধরে বসে থাকার ফল। আরো

মাছ ধর গে যা।’ – বেজার মুখে বলে হারুর মা। তারপর ভাতের থালা খানা টেনে নেয় নিজের দিকে। ভাত মেখে গ্রাস তুলে দেয় হারুর মুখে। হাসি মুখে মায়ের হাতে ভাত

খায় হারু। কিন্তু অবাক হয়, কই থালা তো সড়কাচ্ছে না আর! রাতে শুয়ে ঘুম আসে না হারুর। মাথার মধ্যে ভাবনা ঘুরপাক খায়। সকালে কে তার কাছে নাকি সুরে মাছ

চাইল? কেই বা হাত টেনে তার খাওয়া আটকালো? কার কী ক্ষতি করেছে সে? ভেবে কূল পায় না হারু। হঠাৎই জানালা দিয়ে চোখ পড়ে বাঁশঝাড়ের দিকে। কে দাঁড়িয়ে

ওখানে! সাদা কাপড় পরা একটা মানুষই তো মনে হচ্ছে! চোর নাকি! কিন্তু চোর কী করতে আসবে তাদের মত গরীবের বাড়িতে। তবে কে? বুক ঢিপ ঢিপ করে হারুর।

তবু সাহস করে তাকায় বাইরে। অন্ধকার চোখে সয়ে যেতে সাদা কাপড়ের লোকের চোখ-মুখ পরিষ্কার হয়। ওরে বাবা! এ তো আশু সাহা! সেই গোল গোল চোখ, ঝোলা

গোঁফ… ‘ওরে বাবারে! ভূত… ভূত…’ চিৎকার করে ওঠে হারু। ঘুমন্ত মা কে আঁকড়ে ধরে। কাঁথার মুড়ি দিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকে বিছানায়। দরদর করে ঘামতে থাকে

ভয়ে! সকাল হতে হারুর মা কাজে বেরোয়। রোজকার মতোই। বেরনোর সময় বলে যায়, আজ আর মাছ ধরতে বেরোসনি যেন। রোদে তেতে-পুড়ে কোথায় জ্বর-জারি

বাধবে।’ কিন্তু হারুর যে আর তর সয় না। মা বেরোতেই তড়াক করে উঠে বসে। মুখ ধুয়ে দু-মুঠো মুড়ি জলে ভিজিয়ে খায়। তারপর ছিপখানা হাতে নিয়ে কোমরে গামছা

বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। আজ পানু-বিশুরা আসার আগেই সে অনেক মাছ ধরবে। বেশি করে খাবে। বড্ড জ্বালায় ওরা। মন দিয়ে মাছ ধরতে পারে না হারু ওদের জন্য।

বাঁশঝাড় পেরিয়ে কাঁটাঝোপের জঙ্গল ঠেলে ছোট নদীর চরে নামল হারু। বড়শিতে টোপ গেঁথে ছিপ পেতে বসল। খানিক বাদে ফাৎনায় টান। বিশাল বড় মাছ বেধেছে

বোধহয়। মাছের হাঁ-মুখটা দেখতে পেল হারু, গোল গোল চোখ গুলোও। ছিপ গুটিয়ে মাছটাকে ডাঙায় তোলার চেষ্টা করল হারু। কিন্তু মাছ ডাঙায় আসা দূরের কথা,

উল্টে মাছ হারুকে টানতে লাগল জলের দিকে! একি বিপদ! হারু খানিক ভয় পেয়ে হাত থেকে ছিপ খানা ফেলে দিতে গেল। কিন্তু কী কাণ্ড, ছিপ যে হাতে আঠার মত

সেঁটে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল হারু, নদীর চরে সে ছাড়া জনমনিষ্যিও নেই। ওদিকে ছিপে গাঁথা বিশাল হাঁ-মুখের মাছ তাকে প্রবল টানছে! হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল

হারুর। চরের খাস জমি ছাড়িয়ে হারু তখন গড়িয়ে নেমে গেছে জলের দিকে। সাঁতার জানে হারু। কিন্তু কে যেন তার হাত পা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। একফোঁটাও

নড়তে পারছে না সে। হারু এখন একগলা জলে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। টোপ গেলা মাছ তার খুব কাছে। বিশাল হাঁ করে সেটা এগিয়ে আসছে

হারুর দিকে। হঠাৎই হারু লক্ষ্য করল, মাছের মুখটা অবিকল আশু সাহার মত! গোল গোল চোখে সে তেড়ে এল জলের মধ্যেই, ‘কী রে কেমন মজা? আর পালাবি বড়শি

নিয়ে? মর ডুবে এবার।’ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল হারু। আর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল ভেসে থাকার। কী সর্বনাশ! বুড়ো স্বর্গে গিয়েও চারটে টাকার মায়া

ছাড়তে পারেনি, হারুর পিছু নিয়েছে। এদিকে জল ঢুকতে শুরু করেছে হারুর নাকে-মুখে। হাত পা অসাড় হয়ে আসছে তার। ‘মা… গো…’, করে অস্ফুটে চিৎকার করে

ওঠে হারু। তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই। চোখ খুলে হারু দেখল সে শুয়ে আছে ঘরের দাওয়ায়। মাদুরের ওপর। সামনে বসে তার মা। ডুকরে কেঁদে উঠে তার মা বলল,

‘কালোগাই ধলোগাই কে জাবনা দিতে এসে লাবু কাকার নজরে পড়ে নদীর চরের কাছে লম্বা হয়ে একটা ছিপ ভাসছে, আর তার কাছাকাছি জলে খুব ভুড়ভুড়ি উঠছে। কী

যেন ভাসছে কালো গোল মতো। লাফিয়ে জলে পড়ে ডাঙায় টেনে তোলে হারুকে। নইলে এ যাত্রা আর হারুকে বাঁচানো যেত না। তারপর দু’দিন জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে

রইল হারু। ধুম জ্বর আর সাথে গায়ে হাতে প্রবল ব্যথা। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলছিল, ‘বড়শির চার টাকা কাল দিয়ে আসব দাদু… ছেড়ে দাও আমাকে…’ দু’দিন বাদে

সুস্থ হলে মা কে আসল কথাটা বলল হারু। মা শুনে বেশ একচোট বকল হারুকে। বলল, ‘কী সব্বোনাশ হতো বল দিকিনি! হাড়কেপ্পন মানুষ ছিল সে। চারটে টাকার

শোক ওপরে গিয়েও ভুলতে পারেনি বুড়ো। এই নে চার টাকা। ওঠ, নিজে হাতে বড়শির দাম দিয়ে আয়। আর এই নে আরও একটা টাকা, ফেরার সময় বুড়ো শিবের থানে

প্রণামী দিয়ে আশীর্বাদ চেয়ে নিস মনে করে। সব দোষ কেটে যাবে। কী বড় একখানা ফাঁড়া গেল বল দিকিনি বাছা! রাম রাম… রাম রাম…’ টাকা কটা মুঠোয় পুরে হারু

দৌড় লাগায়, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘ রাম রাম… রাম রাম…।’

…………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত