অলৌকিক প্রেম-২

অলৌকিক প্রেম-২

বাসায় বসে একা একা খবরের চ্যানেল দেখতেছিলাম। চ্যানেলে তখন খবর দেখাচ্ছিল, শহরে রহস্যময়ভাবে ৩ যুবক খুন। কয়েকজনের সাক্ষীতে জানা গেল, রাতে যুবক তিনটে একটা হোটেল থেকে বের হয়ে কেন্দ্রীয় কবরস্থানের পাশে ঘুরঘুর করছিল অনেক্ষণ। ভোরবেলায় ৩ জনের লাশ একসাথে কবরস্থান থেকে কিছুটা দূরে উদ্ধার করে পুলিশ। শরীরে তাদের কোনো মারের দাগ বা ক্ষতচিহ্ন নেই। কে মেরেছে তাদের? কীভাবে মেরেছে? তা এখনো রহস্য! একসাথে তিন যুবকের মৃত্যু, কোনো স্বাভাবিক বা কাকতালীয় ঘটনা নয়। এই ঘটনা নিয়ে শহরে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ইতোমধ্যে।
.
.
খবরের চ্যানেলটা অফ করে দিলাম। এরকম অনেক ঘটনা ঘটবে আরো, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বড় ভাবীর উদ্দেশ্যে ডাক দিয়ে বললাম:
–ভাবী, এক কাপ চা বানিয়ে আনো তো….”
.
কিছুক্ষণ পর বড়ভাবী চা বানিয়ে নিয়ে এলো। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম, ঠিক তখনই বাইরে শুনা গেল কলিংবেলের শব্দ। বড় ভাবী বললেন:
–রানা, দেখো তো কে এলো……
.
আমি চায়ের কাপটা রেখে দরজা খুলে দিলাম। বাইরে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসার আমাকে দেখে বললো:
–মি.রানা, আমরা আপনার সাথে তিনটে যুবকের খুনের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি……”
আমি অবাক হয়ে বললাম:
–আমার সাথে? কেন?
–আপনি এই খুনগুলোর ব্যাপারে কিছু জানলে বলুন……
–আমি? আমি কেন এই খুনের ব্যাপারে জানবো?
–আপনি গতরাতে ১১ টার দিকে কোথায় ছিলেন?
–রাস্তায় ছিলাম, বাহির থেকে বাসায় আসিতেছিলাম হেটে হেটে।
–ঠিক কোন জায়গায় ছিলেন তখন?
–মানে কি? আপনি কি বলতে চাইছেন খুনগুলো আমি করেছি?
–মি.রানা, যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন। বলুন রাত ঠিক ১১ টায় আপনি কোথায় ছিলেন?
–মনে নেই। টাইম দেখিনি তখন।
–আমি বলছি, ঠিক ১১ টায় আপনি কবরস্থান রোডে ছিলেন। আর ওখানে যুবক তিনটের সাথে আপনার কিছু একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।
–হ্যাঁ তো?
–ওরা হয়তো আপনার সাথে হাতাহাতিও করে, যার কারণে আপনার হাতঘড়িটা ওখানে পড়ে যায়। এই যে, এটা আপনার ঘড়ি, ঠিক তো?” পুলিশ অফিসার একটা হাতঘড়ি বের করে আমার হাতে দিলেন।
আমি হাতঘড়িটা নিতে নিতে জবাব দিলাম:
–হ্যাঁ এটা আমার ঘড়ি। রাতে আমি কবরস্থান রোডে ছিলাম। ঐ তিন যুবকের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়, এবং হাতাহাতিও হয়। তার মানে এই নয় যে আমি খুন করেছি ওদের।
–কেন ঝগড়া হয় ওদের সাথে?
–ওরা একটা মেয়েকে তুলে এনে জোর করে শ্লীলতাহানি করতে চেয়েছিল। আমি শুধু বাঁধা দিয়েছি ওদেরকে।
–কিন্তু ওরা খুন হয়েছে কীভাবে?
–কিভাবে খুন হয়েছে তা আমি জানিনা….
–আপনি বলতে চাইছেন আপনার কোনো হাত নেই এতে?
–পারলে প্রমাণ করুন….
–ঠিক আছে, লাশ তিনটে পোস্টমর্টেম করতে নেয়া হয়েছে। যদি আপনার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রমাণ পাই, তাহলে আপনার কিন্তু খুব খারাপ অবস্থা হবে।
–ধন্যবাদ। আগে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট তো হাতে পান, তারপর প্রমাণ খুঁজুন আমার বিরুদ্ধ। ওরা কীভাবে মারা গেছে তা জানতে চেষ্টা করুন।
–আচ্ছা, আসি তাহলে…..”
–জি, আসুন। বেস্ট অব লাক…….
.
.
পুলিশগুলোকে বিদায় দিয়ে আমি দরজা অফ করে ভেতরে আসলাম। মা, বড় ভাবী আর ছোট ভাবী এলো রুমে। মা তো খুব ভয় পেয়ে গেছে পুলিশ দেখে। আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে মা বললো:
–বাবা বল, তুই কিছু করিসনি তো?”
–আরে মা, বললাম তো আমি খুন করিনি ওদের….” গলার আওয়াজটা বাড়িয়ে জবাব দিলাম আমি।
–তাইলে ঠিক আছে…..” বলেই মা বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
দুইভাবীর দিকে তাকিয়ে এবার বললাম:
–কি ব্যাপার, তোমরা যাবেনা?”
ছোটভাবী আমার কান ধরে বললো:
–না, আমরা তোমার সাথে প্রেম করবো এখন।
–হুহ, আমার মতো স্মার্ট, হ্যান্ডসাম ছেলে প্রেম করবে তোমাদের মতো বুড়ির সাথে? ভাবাই যায়না। যাও ভাগো। আর বড়ভাবী, তুমি এটা কি চা দিছো? ঠান্ডা চা বানাও নাকি আজকাল?”
এবার বড়ভাবী আমার অপর কানটা টেনে ধরে বললো:
–এতক্ষণ ধরে কি চা টা ঠান্ডা না হয়ে গরম হবে? এতই যখন স্মার্ট ছেলে, যাওনা একটা বউ নিয়ে এসে দেখাও। নাকি কোনো মেয়ে পাত্তা দেয়না?
–যতই পাম্প আর উস্কানি দাওনা কেন তোমরা, সফল হবেনা। বিয়ে আমি করবনা।”
ছোটভাবী বড়ভাবীকে সাপোর্ট করে বললো:
–ভাবী, আমাদের রানা সোনার কখনো বিয়ে হবেনা। ওকে আসলেই কোনো মেয়ে পাত্তা দেয়না।
–ভাবী, তোমরা জানো যে আমি জেরিনকে ভালোবাসি…….” গলার স্বরটা করুন করে বললাম।
–জেরিন এখন মৃত। ওর চিন্তা মাথা থেকে রেখে এবার একটা মিষ্টি বউ আনো…..” আমার কান ছেড়ে দিয়ে বললো বড়ভাবী।
–তা হবেনা, তোমরা হয়তো জানোনা, জেরিন এখনো আসে আমার কাছে।
–হোয়ট!” দুইভাবী চমকে উঠলো আমার কথা শুনে।
–হুমমমম, জেরিন আসে আমার কাছে অশরীরী আত্মা হয়ে।”
–কিসব বলছ? পাগল হয়ে যাওনি তো আবার?”
–না, সুস্থ মস্তিষ্কেই বলছি। জেরিন আমাকে এতো বেশি ভালোবেসেছে যে, মরার পরেও ছাড়তে পারেনি।
–কি বলছ বুঝছিনা ভাই। তবে সাবধানে থেকো, এসব অশরীরী জিনিসটাকেই ভয় লাগে আমার।” বলতে বলতে বড় ভাবী বেরিয়ে গেল। তার পিছুপিছু ছোটভাবীও চলে গেল।।
.
***
.
বিকেলে পুলিশ অফিসারটা আবার এলো বাসায়। উনাকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম:
–কিছু পেলেন আমার বিরুদ্ধে।
–নাহ, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আমাদের হাতে এসেছে।
–কি বুঝলেন?
–রিপোর্ট ঐ যুবকগুলোর মৃত্যুর কারণ অস্পষ্ট। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। পোস্টমর্টেম বিদ্যাকে মিথ্যে করে দিলো ঐ তিন যুবকের ডেডবডি। তাদের শরীরে মৃত্যু হতে পারে এমন কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই……”
–তাহলে মারা গেল কীভাবে?
–আমার মনে হয় তাদের এমন কেউ মেরেছে, যার অনেক শক্তি……
–কে সে?
–অশরীরী কেউ……
–হোয়াট? আপনি অশরীরী বিশ্বাস করেন?
–কেন? আপনি করেননা? শুনেছি আপনি নাকি রাতের বেলায় কোনো অশরীরীর সাথে দেখা করতে যান?
–কে বলেছে?
–অনেকেই আপনাকে রাতের বেলায় অনেকবার কবরস্থানে ঘুরতে দেখেছে। শুনেছি, কবরস্থানে একটা পরীর কবর আছে।
–হুমমম…….
–আমরা ঐ কবরটা একবার খু্ড়ে দেখতে চাই……
–মানে? কি বলতে চান আপনি?
–মানে আমরা কবরটা খুড়ে দেখতে চাই পরীর লাশটা ওখানে আছে নাকি নাই…..
–এতে কি প্রমাণ হবে?
–কিছু প্রমাণ হবেনা, শুধু জানতে চাই ঐ কবরে অস্বাভাবিক কিছু আছে কিনা, যার সাথে এই খুনগুলোর সম্পর্ক আছে।
–না, আপনারা এটা করতে পারেননা….
–আমাদের কাছে গভার্নমেন্ট পারমিশন আছে…. এই দেখুন….” বলেই পুলিশ অফিসারটা তার হাতে একটা কাগজ দেখালো। আমি ওটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বললাম:
–বেশ, পরীর কবর খু্ঁড়ে দেখার যখন এতই শখ আপনাদের,আমি আর বাঁধা দেবোনা…….
–ধন্যবাদ…..
–কবে খুঁড়বেন কবরটা?
–আজ রাতে…….
–বেশ, তাই হবে।

রাত ১০ টা বেজে ৩৯ মিনিট, আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে আছি কবরস্থানে। আকাশের চাঁদটা উজ্জ্বলভাবে আলো ছড়াচ্ছে। আমার পাশে কয়েকজন পুলিশ আছে, আর কয়েকটা ভাড়া করা লোক জেরিনের কবর খুঁড়তেছে।
.
কিন্ত অনেক্ষণ ধরে কবর খুঁড়ার পরেও কোনো হদিস পেলনা ওরা জেরিনের লাশের। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল তখন। মাটিগুলো আবার আপনাআপনি ভরে যেতে লাগলো কবরে। হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলো চারপাশে। আশেপাশের গাছপালাগুলো ভয়ংকরভাবে দুলতে লাগলো। বাতাসের সাথে ধূলিকণা উড়ে এসে সবার চোখেমুখে ঢুকতে লাগলো। কিন্তু আমি স্বাভাবিক। আমার কিছুই হলোনা। আমি দেখতে লাগলাম সবার ছুটাছুটি, যে যেদিকে পারে ছুটছে। যারা কবর খু্ঁড়তেছিল এতক্ষণ, তারা সবার আগে পালিয়ে গেল। আর পুলিশগুলো ছুটলো তাদের পিছুপিছু। আমি দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলাম, কারণ আমি জানতাম এরকম কিছু একটা হবে। ওরা চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হলো। আমার পাশে এসে দাঁড়ালো জেরিনের অশরীরী আত্মা। তাকে দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। জেরিন আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বললো:
–ভয় পেয়োনা, কিছুই হয়নি…..”
আমি মুখে হাসি নিয়ে বললাম:
–ভয় পাইনি একটুও…. আমি জানি, এটা তুমি করছো।
–ওরা আর আমার কবর খু্ঁড়ার সাহস পাবেনা…..
–কিন্তু, পুলিশগুলো আমাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হয়না……
–সহজে না ছাড়লে ভয় পাওয়ার পর নিশ্চয়ই ছাড়বে….”
–হুমমম….”
–তুমি কিন্তু আজ আমার কবরে ফুল দাওনি….
–এনেছি তো ফুল, এই যে……” বলে আমি একটা রজনীগন্ধা ফুল বের করলাম, তারপর ওটা জেরিনের কবরে রাখলাম। আর জেরিনের আত্মা তখন কবরের উপর থেকে ফুলটা তুলে নিল, তারপর আমার হাত ধরে বললো:
–চলো হাটি…..
–কোথায় যাবো?”
–পুকুরঘাটে, যেখানে তোমার আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
–হুমমম…..চলো।” তারপর দুজন পাশাপাশি হাটতে লাগলাম।
.
.
জেরিনের মৃত্যুর পর আমার প্রায় পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল। কারো সাথে কথা বলতামনা, ঠিকমতো খেতামনা, পাগলের মতো পড়ে থাকতাম দিনরাত জেরিনের কবরের পাশে। একরাতে তার কবরের পাশে হাটুগেড়ে বসে কান্না করতেছিলাম, তখন পেছন থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠ শুনতে পাই, কেউ আমার নাম ধরে মৃদুকণ্ঠে ডাক দিলো:
–রানা…….”
কণ্ঠটা শুনে মনে হলো জেরিনের কণ্ঠ। চমকে তাকালাম আমি পেছনে। দেখলাম সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে আছে জেরিন। পেছনে তার ডানা দুইটাও আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–জেরিন তুমি?”
জেরিন আমার চোখেরজল মুছে দিয়ে বললো:
–এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? জানোনা তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনা?
–কিন্তু তুমি…..
–হুমমম আমি তোমার জেরিন। কি বিশ্বাস হচ্ছেনা?
–হচ্ছে, কিন্তু…..
–কিন্তু আমি অশরীরী, তোমার সেই আগের জেরিন হয়ে আসতে পারিনি, মৃত্যু সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।
–তবুও যে তুমি ফিরে এসেছো, তাতেই আমি খুশি।” বলেই জেরিনকে জড়িয়ে ধরলাম। জেরিন বললো:
–এবার থেকে কিন্তু নিজেকে আর কষ্ট দিতে পারবেনা। ঠিকমতো খাবে, সবার সাথে কথা বলবে, হাসবে।
–ঠিক আছে, কিন্তু কথা দাও তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে।
–চাইলেও যে পারিনা। আমি এখন অশরীরী। দিনের বেলায় আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি প্রতিরাতে তোমাকে দেখা দিবো।
–সত্যি তো? ছেড়ে যাবেনা তো?
–না…. যাবোনা। তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবোনা আমি।
–তাহলে ঠিক আছে….”
.
.
এরপর থেকে জেরিনের আত্মার সাথে আমার প্রতিরাতে দেখা হয়, কথা হয়। গতরাতেও দুজন কথা বলে বলে হাটছিলাম। তখন দেখলাম কবরস্থানের পাশ দিয়ে ৩ টা যুবক একটা মেয়েকে জোর করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিলো। জেরিনকে রেখে আমি এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। কিছুক্ষণ বুঝালাম ৩ যুবককে। ওরা বুঝলনা, উল্টো আমাকে মারতে চাইলো। ওদের সাথে হাতাহাতি হলো কিছুক্ষণ। সেই সময় আমার হাতঘড়িটাও পড়ে যায় আমার অজান্তে। এক পর্যায়ে জেরিন তার ডানাদুটো লুকিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে ৩ যুবকের মাথা ঘুরে গেল। এত রূপসী মেয়ে তারা আগে কখনো দেখেনি। হা করে তাকিয়ে থাকলো তারা কিছুক্ষণ জেরিনের দিকে। জেরিন তাদেরকে বললো:
–ভাই, আপনারা একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?”
যুবক তিনটে তখন বললো:
–এবার তো তোমাকেসহ নিয়ে যাবো…”
তাদের কথা শুনে আমার মাথায় রাগ উঠে গেল। ওদেরকে মারার জন্য যেতে চাইলাম, তখন জেরিন আমাকে বাঁধা দিয়ে ওদেরকে বললো:
–বেশ, আমি রাজি….চলো কোথায় যেতে হবে, কিন্তু মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।”
তারা মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো। জেরিন এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
–রানা, তুমি মেয়েটাকে সাবধানে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসো।”
–ওকে….” বলে আমি মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসতে লাগলাম। পেছন থেকে তিনযুবক হাসতে হাসতে আমার উদ্দেশ্যে বললো:
–কি ছেলে রে ভাই তুই? নিজের সুন্দরি প্রেমিকাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছিস?”
জবাবে তাদেরকে আমি কিছুই বললাম না। শুধু একটু হেসে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে হাটতে লাগলাম। আর কল্পনা করতে লাগলাম, একটু পর তাদের কিরকম নির্মম পরিস্থিতি হবে……”
পুকুরঘাটে বসে আছি অশরীরী জেরিনকে নিয়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম:
–কি দেখ এভাবে?”
–হুমম…? কিছুনা… ” অস্ফুটে শব্দ করলো সে। তারপর একটু নীরবতা নিয়ে বললো:
–তোমার সেই প্রথম দিনের কথা মনে আছে রানা, আমার পায়ে কাটা ঢুকেছিল, আর তুমি বের করেছিলে?
–হুমমম….মনে আছে…
–তুমি তখন খুব বোকা ছিলে, আমার পেছনে ডানা দেখার পর তুমি ভেবেছিলে আমি সিনেমায় কাজ করি….
–হুমমম, সেই বোকা ছেলেটা আজ আর বোকা নেই, সব তোমার জন্য হয়েছে।
–কিন্তু আমি প্রেমে পড়েছিলাম সেই বোকা ছেলেটার, মনে আছে তোমার, আমি যখন তোমার নাক টেনে দিতাম, তখন তুমি কি বলতে?
–আমি তো তখন বুঝতামনা, প্রেম কি….
–এখন একটু টেনে দিই তোমার নাকটা?
–হুমমম….” সম্মতি দিলাম আমি।
.
.
জেরিন মুখে হাসি নিয়ে আলতো করে আমার নাকটা টেনে দিলো। তারপর বললো:
–সেই আগের মতো আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ো তো….”
আমি মাথাটা জেরিনের কোলে রেখে লম্বা হয়ে শুইলাম। চাঁদের আলো এসে পড়েছে আমার মুখের উপর। জেরিন আমার মুখে চুলে হাত বুলাতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর সে আমার নাম ধরে ডাক দিলো:
–রানা…..
–হুমমম?
–আমি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এতদিনে আমাদের বিয়েটা হয়ে যেতো তাইনা?
–হুমম, একটা বাচ্চাও হয়ে যেতো হয়তো…..
–মানুষ বা জীনপরী যাইহোক, বেশি স্বপ্ন দেখতে নেই, পূরণ হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। জানো, আমি না আমাদের বাচ্চার নাম সুদ্ধ ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমাদের একটা মেয়ে হতো, আর তার নামটা হতো তোমার নামের সাথে মিল রেখে….
–কি নাম?
–ইরানা….” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জেরিন।
আমি উঠে বসলাম। তারপর জেরিনের চোখের দিকে তাকালাম, দেখলাম সে কান্না করতেছে। আমি বললাম:
–জেরিন, তুমি কাঁদছো?”
তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে জেরিন বললো:
–না, কাঁদছিনা। আচ্ছা রানা, তুমি এখনো বিয়ে করতেছোনা কেন?
–নাহ, আমি তোমাকে পাইনি, আর বিয়ে করবোনা।
–তা হয় নাকি পাগল? ইশাকে তো বিয়ে করতে পারো, একসময় সে তোমাকে পাওয়ার জন্য কতকিছুই না করেছে।
–বাদ দাও তো এসব, ইশা এখন বিদেশে থাকে, অনেকদিন যোগাযোগ হয়না তার সাথে।
–তবুও সে তোমায় অনেক ভালোবাসতো।
–আমি জানি, কেউ আমাকে তোমার মতো ভালোবাসতে পারবেনা। বাদ দাও এসব। এখন একটা প্রশ্ন করি?
–কি প্রশ্ন?
–গতকাল তিন যুবককে তুমি কিভাবে মেরেছো, পোস্টমর্টেমেও তাদের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।”
জেরিন একটু হেসে বললো:
–বেঁচে থাকতেই পরীদের কত শক্তি থাকে, এখনতো আমি অশরীরী পরী, শক্তি আরো বেড়ে গেছে। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে মারতে পারি ওদের…..
–কী হয়েছিল বলো তো আমি যাওয়ার পর?
–তুমি যখন মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাচ্ছ, তখন যুবক তিনটে আমাকে ধরে, আমিও হেসে তাল মেলালাম ওদের সাথে, তারপর ওরা আমার বুকের দিকে হাত দিতে চাইলো, তিনজনেই তখন কাঁপতে শুরু করলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম:
–কি হলো ভাই? আমার ইজ্জত নেবেনা?”
তিনজনে তখন একসাথে বললো:
–কে তুমি? আর আমরা এভাবে কাঁপতেছি কেন?”
তাদের কথা শুনে আমি হেসে উঠে বললাম:
–তোমরা কাঁপতেছো কেন আমি কি করে বলবে? একটা সুন্দরি মেয়ে তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এতরাতে, তোমরা তাকে কিছু করতে এত সময় নিচ্ছ কেন?
–প্লিজ, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমাদের যেতে দাও। কিন্তু আমরা নড়তে পারছিনা কেন একই জায়গা থেকে?”
তাদের কথা শেষ হতেই আমি আমার আসল রুপটা দেখায় ওদের। ডানা মেলে কিছুক্ষণ উড়লাম ওদের চারপাশে। ওরা একই জায়গায় কাঁপতে শুরু করলো ভয়ে। আমি তখন ওদেরকে বললাম:
–ধর্ষণকারী এবং ধর্ষণের চেষ্টাকারী উভয়েই সমান অপরাধী। আর তাদের মতো কীট পৃথিবীতে না থাকলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হবে। তাই কিছু মনে করোনা, তোমাদেরকে এই পৃথিবী ছাড়তে হবে।”
ওরা কিছুই বলতে পারলোনা আমার কথার জবাবে। কারণ আমি তাদের কথা বলার শক্তিটা রোধ করে দিয়েছিলাম, তারা শুধু কাঁপতেছিল। আমি তখন উড়া বাদ দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়ালাম, আর ওরা পড়ে গেল মাটিতে। দেহ থেকে তাদের প্রাণ বেরিয়ে গল। আর আমি তাদের শরীরটা চোখের ইশারায় দু’ফাক করলাম। এবং ভয় জিনিসটা যেখানে থাকে, ওটা মুছে দিলাম। তারপর শরীরটা আবার বন্ধ করে দিলাম।” কথাগুলো বলেই জেরিন থামলো।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–অশরীরী পরীদের এতো শক্তি?”
জেরিন হেসে বললো: এখনো তো অনেক কিছু দেখার বাকি।জেরিনের কোলে মাথা রেখে রোমান্টিক সময় কাটাচ্ছিলাম, হঠাৎ কেউ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো:
–কার সাথে কথা বলছো একা একা?”
.
চমকে উঠে বসলাম আমি জেরিনের কোল থেকে। পেছনে ফিরে দেখলাম ছোট ভাবী দাঁড়িয়ে আছে। ভাবী আবার বললো:
–এতো রাতে এখানে কি? আর কার সাথে কথা বলছো একা একা?”
আমি একবার ভাবীর দিকে তাকালাম আরেকবার জেরিনের দিকে। জেরিন হেসে বললো:
–ভাবী আমাকে দেখছেনা।”
ভাবী এবার কিছুটা আওয়াজ বাড়িয়ে বললো:
–কি হলো? কথা বলছো না কেন? আর ওদিকে এভাবে কি দেখছো? সবাই তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করতেছে, আর তুমি এখানে একা একা পাগলামি করতেছো?”
–একা না ভাবী, আমি ওর সাথে….” কথাটি বলার সময় জেরিন আমাকে মাথা নেড়ে বাঁধা দিলো ওর কথা না বলার জন্য। তাই আমি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম:
–তুমি যাও ভাবী, আমি আসতেছি……”
.
.
ভাবী চলে যাওয়ার পর আমি উঠে।দাঁড়ালাম, জেরিন আমার হাত ধরে বললো:
–যাওয়ার আগে একবার “ভালোবাসি” বলে যাও……
–অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায় জেরিন……”
আমার কথা শেষ হতেই জেরিনের চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমি বললাম:
–জেরিন, তোমার চোখের জলের দাম সেদিন যারা দেয়নি, তাদের আমি বিনাশ দেখতে চাই……”
–এখনো সময় হয়নি…… সময় হোক।আগে। যাও তুমি এখন, সবাই তোমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে, আমার তো এখন খেতে হয়না, ঘুমাতে হয়না।
–রাতে রুমে এসো, সেই আগের মতো তোমাকে নিয়ে ঘুমাবো আমি।
–সেই আমি কি আর এই আমি?
–তবুও এসো……
–আচ্ছা…… ”
.
আমি বাসার দিকে হাটতে লাগলাম। জেরিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর মিলিয়ে গেল।
.
.
খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসলাম। তখন বাবা আমার বিয়ের প্রসঙ্গ তুললো। বড় দুই ভাইয়াও বাবার সাথে তাল মিলিয়ে বলল এবার আমাকে বিয়ে করিয়েই ছাড়বে।
আমি রাজি না হয়ে বললাম:
–এসব বিয়েসাদী আমার দ্বারা হবেনা। আমি এখন ভালো আছি।”
বাবা বললো:
–তা হবেনা। আমি আমার ছোট ছেলেকে বিয়ে না করিয়ে শান্তি পাবো না। আর কোনো কথা হবেনা এ নিয়ে। কাল রেডি থাকবে পাত্রী দেখতে যাওয়ার জন্য।” বলেই বাবা খাওয়া শেষ করে হাত মুছে উঠে দাঁড়ালো। আমি হা করে চেয়ে রইলাম। মাকে বললাম:
–মা আমাকে জোর করে তোমরা বিয়ে করাতে পারোনা তোমরা……”
মা বললো:
–এবার তোকে বিয়ে করিয়েই ছাড়বো……” মায়ের কথার সাথে সুর মেলালো সবাই।
আমি রেগে উঠে বললাম:
–তোমাদের যা খুশি তাই করো।” বলেই আমি উঠে চলে গেলাম নিজের রুমে।
.
.
বেডে শুয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছিলাম বিয়েটা কেমনে আটকানো যায়। তখনই জেরিনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম:
–মন খারাপ?
–হুমম….. সবাই উঠেপড়ে লেগেছে আমার বিয়ে দেয়ার জন্য।
–তো বিয়ে করে ফেলো?
–বিয়ে করে ফেললে তোমাকে ভুলে যেতে হবে, আমি চাইনা তোমাকে ভুলে যেতে, আমি সারাজীবন তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।
–তা হয়না রানা। আমি তোমার অতীত। আমি মিথ্যে। বাস্তবতা নিয়ে একটু ভাবো।
–তারপর?
–তারপর কি? তুমি সংসার করবে, একদিন তুমি বাবা হবে……
–আর তুমি?
–আমি? আমি মিশে যাবে আড়ালে। ওপার থেকে উকি দিয়ে দেখবো আমার রানা সংসারী হয়ে গেছে, অথচ একদিন তার সাথে আমি সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। নিয়তি সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।
–এভাবে বলে আমার কষ্টটা আর বাড়িয়ে দিওনা।”
জেরিন জোর করে ঠোটে একটা হাসির রেখা টেনে আমার গাল টেনে দিলো। তারপর বললো:
–কাল তাহলে পাত্রী দেখতে যাচ্ছ?
–যাবো?
–হুমম….
–তুমি বলছো?
–হুমম…এভাবে নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে পারোনা তুমি…”
–বেশ, তুমি যখন বলছো কাল যাবো পাত্রী দেখতে…..”
–এখন চুপ করে ঘুমাও……আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
–ওকে…. ” বলে আমি চোখ বুজলাম। মাথায় জেরিন আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
.
পরদিন পাত্রী দেখতে গেলাম আমরা একটা বাসায়। পাত্রীর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ভালো, বাবা ডাক্তার, মা ব্যাংকার, আর পাত্রী নিজে মেডিকেল স্টুডেন্ট, নাম মিম। আমাদের বাসার সবার পছন্দ হয়েছে মিমকে। তাই বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে ফেললো। সন্ধ্যার পেরিয়ে গেল,, আমরা মিমদের বাসা থেকে বের হলাম খেয়েদেয়ে। চাদেঁর আলো ছিল বাইরে। চারপাশের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে যখন উঠতে যাবো তখন কিছুটা দূরে চোখ গেল আমার। চাদেঁর আলোয় স্পষ্ট দেখলাম জেরিন দূর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এদিকে।
গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। গাড়ি চলতে শুরু করলো। জেরিনও একই গতিতে উড়ে উড়ে আসতে লাগলো আমাদের পিছুপিছু। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। তখন আমার মা বললো:
–কি রে ওভাবে ওদিকে চেয়ে আছিস কেন?”
–নাহ, এমনি…..”
–পাত্রী কি পছন্দ হয়নি?
–পছন্দ হয়ছে….
–তাহলে মন খারাপ কেন?
–কই? না তো….” বলেই জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
–দেখ বাবা, পাত্রী কিন্তু সবদিক দিয়ে ভালো, তোর সাথেও মানাবে।
–হুমমম…..” অস্ফুটে শব্দ করে আমি জেরিনের দিকে তাকালাম। জেরিন তখন গাড়ির কাছে চলে এসেছে উড়তে উড়তে। শুধু আমিই দেখতে পাচ্ছি তাকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কোন কথা বলছেনা। তার দৃষ্টিটা খুব করুণ মনে হলো। বাসায় পৌঁছা পর্যন্ত সে ওভাবেই ছিল। আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলাম, তখন ও মাটিতে নেমে হেটে হেটে চলে যাচ্ছিলো, আমিও পিছু নিলাম ওর। কিছুদূর গিয়ে ওকে আটকালাম। জিজ্ঞেস করলাম:
–মন খারাপ?
–নাহ….” জোর করে ঠোঁটে একটা হাসির রেখা টানলো জেরিন।
–তোমাকে দেখে মনে হলো তুমি কষ্ট পেয়েছো।”
–আরে না, কষ্ট পাইনি। এইতো আমি হাসতেছি, তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতেছি। চলো একটু মজা করি। তাহলেই বুঝবা আমি কষ্ট পাইনি।
–কীভাবে মজা করবো?
–ঐ যে একটা লোক আসতেছে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে, উনাকে নিয়ে একটু মজা করি।
–কীভাবে?
–উনি তো আমাকে দেখছেনা, আমি উনার মাথা থেকে ঝুড়িটা নিয়ে ফেলবো….”
–হা হা হা…..”
–তুমি দাঁড়িয়ে দেখো লোকটার কি অবস্থা হয়….” বলেই জেরিন এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। তারপর মাথা থেকে ঝুড়িটা নিয়ে ফেললো। লোকটা চিৎকার করে উঠলো:
–হায়! হায়! এসব কি হচ্ছে? আমার ঝুড়ি দেখি বাতাসে ভাসতেছে।” লোকটা ঝুড়ি ধরার জন্য চেষ্টা করলো। জেরিন ঝুড়িটা উপরে তুলে ফেললো লোকটার নাগালের বাইরে।
লোকটা আবার চিৎকার করে বললো:
–বাবা ঝুড়ি, আমি কি দোষ করেছি? ফিরে আয় বাপ?”
লোকটার কথা শেষ হতেই জেরিন বললো:
–ঐ আমি বাপ না, আমি মা। তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছো এতদিন তোমার কাছে থাকার পরেও? যাও, আমি আর কোনোদিন তোমার কাছে আসবোনা।”
লোকটা অবাক হয়ে বললো:
–এসব কি হচ্ছে? আমার ঝুড়ি দেখছি কথাও বলে। আজ মাল কি বেশি খেয়ে ফেললাম। এগুলো কি মনের ভুল? ভাই একটু এদিকে আসেন তো?” লোকটা আমাকে ডাক দিলো।
আমি উনার কাছে গিয়ে বললাম:
–কি হলো ভাই?
–আচ্ছা, আপনি সত্যি সত্যি আছেন তো? নাকি আমি ভুল দেখছি?
–মানে কি আবোলতাবোল বকছেন?
–না ভাই, আবোলতাবোল না। আপনাকে একটা চিমটি কাটতে পারি?
–আমাকে কেন চিমটি কাটবেন? আমি তো কিছু ভুল দেখছিনা।
–ও তাইতো? চিমটি তো নিজেকেই কাটতে হবে। আসলে আজ মাল একটু বেশি খাইছি তো তাই। আচ্ছা বাদ দিন। আমাকে একটা কথা বলুন তো….??
–কি কথা?
–আচ্ছা আপনি আমার মাথায় কোনো ঝুড়ি দেখতে পাচ্ছেন? নাকি ঝুড়িটাকে শূন্যে ভাসতে দেখছেন?
–আরে তাইতো? শূন্যে কি করে ঝুড়িটা ভাসছে?
–হ্যা ভাই, আমিও তাই ভাবছি। ঝুড়িটা আবার কথাও বলছে আমার সাথে।
–কি বলেন এইসব? কথাও বলছে?
–হ্যা, ঝুড়িটা ফিমেইল।
–ও তাই নাকি? আবার কথা বলুন তো।
–দাঁড়ান, আপনাকে শুনাচ্ছি….” বলেই লোকট ঝুড়ির উদ্দেশ্যে বললো:
–মা ঝুড়ি, আর রাগ করিসনা, ফিরে আয় মা….”
উপর থেকে জেরিন বললো:
–আসবো না, তুমি খারাপ লোক, তুমি মদ খাও। আমি তোমার কাছে থাকবোনা।”
জেরিনের কথা শেষ হতেই আমি বললাম:
–ভাই ঝুড়িটা তো প্রতিবাদী ঝুড়ি। আপনার বিরুদ্ধে ঝুড়িবন্ধন করতে পারে…”
–ঝুড়িবন্ধন কি ভাই?” লোকটা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। মাতাল হয়ে ঢুলতেছে সে।
আমি বললাম:
–মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলে হয় মানববন্ধন। আর ঝুড়িরা আন্দোলন করলে হয় ঝুড়িবন্ধন।”
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো:
–মা ঝুড়ি, আমি আর মদ খাবোনা। ঝুড়িবন্ধন করোনা। ফিরে আয় ঝুড়ি মা।”
জেরিন তখন ঝুড়ির হয়ে বললো:
–ঠিক আছে, এবারের মতো ক্ষমা করলাম।” বলেই জেরিন ঝুড়িটা লোকটার মাথায় রাখলো। লোকটা তখন নিজে নিজেই বললো:
–যে মদ খেলে ঝুড়িরাও আন্দোলন করে, এমন মদ আর খাবোনা।” বলতে বলতে লোকটা চলে গেল। জেরিন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। দুজনে একসাথে হেসে উঠলাম তখন।
এরপর জেরিনের সাথে আমি হাটতে লাগলাম পুকুরঘাটের দিকে। জেরিন হঠাৎ চুপসে গেল। কোনো কথা বলছেনা। আমি বুঝলাম এতক্ষণ সে যে মজা করেছে সেটা ছিল তার অভিনয়। আসলে সে কষ্ট পেয়েছে। নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারো হতে দেখলে যে কারোর কষ্ট হবে। হোক সে মানুষ, হোক সে অশরীরী। জেরিনও কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু সে তার কষ্টটা আমাকে বুঝতে দিতে চাইনা। হাটতে হাটতে খেয়াল করলাম জেরিন নিরবে কান্না করতেছে। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম:
–জেরিন, কেন নিজের কষ্টটাকে লুকোতে চাইছো?”
জেরিন চমকে উঠে বললো:
–কই না তো? আমি মোটেও কষ্ট পাচ্ছিনা। চলো ঘাটে গিয়ে বসি….”
–আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তুমি যেমন আমার কষ্ট সহ্য করতে পারোনা, তেমনি তোমার কষ্টও আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি তো তোমাকে নিয়ে বেশ আছি, কেন শুধু শুধু আরেকটা অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?
–হুমমম, তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। কারণ আমি আমি তোমার জীবনে মিথ্যে। এই মিথ্যেটাকে এতোটা গুরুত্ব দিলে জীবন ধ্বংস হবে তোমার।
–তারপরও…..”
আমি কথাটা শেষ করতে পারলামনা, জেরিন আমার মুখটা চেপে ধরে বললো:
–আমায় যদি সত্যি ভালোবেসে থাকো, তাহলে তোমাকে বিয়ে করতেই হবে।
–ঠিক আছে, কিন্তু একটা কথা…..
–কি?
–যারা তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, আগে তাদের বিনাশ দেখতে চাই, তারপর আমি বিয়ে করবো।
–হুমমমমম, অবশ্যই। যারা আমার সাজানো স্বপ্নটাকে শেষ করে দিয়েছে, তাদের শেষ না দেখে আমারও শান্তি নেই। জানো, কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি, সব শেষ করে দিলো ওরা, ওদের কি করে সহজে ছেড়ে দিই বলো?
–তাহলে চলো…..
–কোথায়?
–পরীর দেশে…..
–যাবো….তবে আজ না…..
–কেন?
–সামনের অমাবস্যার পর আমি পূর্ণ শক্তি পাবো। তখন তোমাকে নিয়ে যাবো পরীর দেশে।
–হুমমম, এখন চলো আমাকে নিয়ে আকাশে উড়বে। খুব মনে পড়ে সেইদিনগুলোর কথা, তুমি আমাকে নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে। কতো মজা হতো তখন।
–আসো আজ তোমাকে নিয়ে সেই আগের মতো আকাশে উড়ে বেড়াবো।” বলেই জেরিন তার ডানা মেলে দিলো, আমি তার পিঠে উঠে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তারপর জেরিন ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলো আমাকে নিয়ে। চারপাশ থেকে শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগতে শুরু করলো। জেরিন ছিল চুপচাপ। আমি তার নাম ধরে ডাক দিলাম:
–জেরিন….
–হুমমম….” অস্ফুটে শব্দ করলো সে।
–মন খারাপ?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–হুমম….. একটু….আসলে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তেছে। আচ্ছা রানা,আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো শুধু ভালোবেসেছিলাম, তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কেন তা পূরণ হলোনা?
–ওভাবে বলোনা জেরিন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
–হুমমম…ওকে। এখন তাহলে নিচে নেমে যায়, কি বলো?
–ওকে।
.
.
তারপর জেরিন নিচে নামতে শুরু করলো আমাকে নিয়ে। নিচের নামার পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। জেরিন মিশে গেল তার কবরে। আর আমি আমার বাসার দিকে হাটতে লাগলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে। কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো:
–হে মানব সন্তান, কে তুমি?”
আমি পেছনে ফিরে দেখলাম একটা পরীর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তার ডানা আছে। দেখতে খুব সুন্দরি। আমি অবাক হয়ে বললাম:
–আপনি…?
–আমার নাম শিমু। ডানা দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি পরীর মেয়ে। আসলে আজ আপনাকে আকাশে উড়তে দেখে আপনার পিছু নিলাম। একটা মানব সন্তান হয়ে কি করে আপনি আকাশে উড়েছেন। আমি মুগ্ধ হয়েছি। হয়তো প্রেমেও পড়ে গেছি।
এই পরীটার কথা শুনে আমি বললাম:
–দেখুন, আমি উড়তে পারিনা, আপনি ভুল দেখেছেন।
–নিজ চোখে তো দেখলাম আপনাকে উড়তে। আপনি যখন উড়তেছিলেন, কিছুটা দূরে আমিও উড়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। মানব সন্তান হয়ে আপনি কীভাবে উড়লেন? আমি তো হতবাক!
–আসলে আপনার দেখার মাঝে ভুল ছিল। আমার সাথে তখন একটা অশরীরী পরী ছিল। তার সাথেই উড়ছিলাম আমি।”
আমার কথা শুনে শিমু “হা হা হা” করে হেসে উঠলো। তারপর বললো:
–পরী আবার অশরীরী হয় নাকি? আপনি আমার সাথে মজা করতেছেন।
–আপনার সাথে মজা করে আমার কি লাভ?
–লাভ হলো এটাই, মিথ্যে বলে আমার হাত থেকে বেঁচে যাবেন। একটা কথা কি জানেন? আমি খুব জেদি। ছোটবেলা থেকেই যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি। তাই আপনাকে সহজে ছাড়ছিনা।
–আমার পেছনে লেগে আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনবেননা।”
আমার কথা শেষ হতেই শিমু আবার “হা হা হা” করে হেসে উঠলো। তারপর বললো:
–মানব সন্তান হয়ে আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আপনি আপনাকে এখন আমার সাথে নিয়ে যাবো।” বলেই শিমু কি যেন একটা মন্ত্র পড়লো। সাথে সাথে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। একটু পর আমি জ্ঞান হারালাম। এরপর কি হয়েছে আমার কিচ্ছু মনে নেই। তবে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম, আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় আছি। চারপাশটা দেখে মনে হলো এটা আমাদের পৃথিবী নয়। তাহলে কি আমি পরীর দেশে? কিন্তু জেরিন কোথায়? ও কি আমাকে বাঁচাতে আসবে? অমাবস্যার আগে তো সে এখানে আসবেনা বলেছিলো, এতদিন কি শিমু আমাকে বিয়ে না করে রেখে দেবে?
.
.
একটুপর শিমু এলো হাতে কিছু ফলফ্রুটস নিয়ে, যা আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার সামনে ফলগুলো রেখে শিমু বললো:
–খেয়ে নেন এগুলো……”
–না, আমি খাবোনা…..” জবাব দিলাম আমি।
–কেন শুধু শুধু জেদ করছেন? খেয়ে নিন তো…… আপনি জানেন আপনি কিছুই করতে পারবেননা। এখান থেকে পালাতেও পারবেননা। পালাতে গেলেই আপনার বিপদ।” বলেই চলে গেল শিমু ফলগুলো রেখে। এমনিতে খুব খিদে পেয়েছে আমার। ফলগুলো দেখে আর লোভ সামলাতে পারলামনা। সবগুলো মুহূর্তেই পেটে চালান করে দিলাম। আড়াল থেকে হঠাৎ কারো হাসি শুনা গেল। শিমু হাসতে হাসতে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আমার সামনে। তারপর বললো:
–একটু আগে না গলা উচু করে বললেন খাবেননা? এখনো একটা ফলের বীচিও রাখেননি। সব সাবাড় করে ফেলেছেন।
–খিদে পেয়েছে তো আমি কি করবো?
–তো শুধু শুধু নেকামি করেছিলেন কেন? আমি আড়াল থেকে আপনার অবস্থা দেখছিলাম।
–ও তারমানে আড়াল থেকে আমাকে নিয়ে মজা নেয়া হয়েছে?
–আরে রাগ করেনন কেন বাবু? আমি কি একটু দুষ্টামিও করতে পারিনা আপনার সাথে? আপনি তো আমার বর হতে চলেছেন।
–ও তাইতো, হবু বউ হিসেবে তো আপনি আমার সাথে একটু মজা করতেই পারেন। আমার না এখনো পেটের একপাশ খালি। আরো কিছু…..
–হয়ছে আর বলতে হবেনা। আরো ফল নিয়ে আসতেছি……”
–আচ্ছা…… ”
.
.
শিমু ফল আনতে চলে গেলো। আমি ভাবলাম এখন যদি তার সাথে তাল মিলিয়ে না চলি, তাহলে নিজেরই বিপদ হবে। এখন তাকে ভুলিয়েভালিয়ে বিয়েটা আটকানো দরকার অমাবস্যা পর্যন্ত। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতেছিনা, জেরিন বলেছিল পরীরা মানুষের মনের কথা বুঝে। তাহলে শিমু আমার মনের কথা বুঝলোনা কেন? যদি বুঝতো তাহলে তো আমি ধরা পড়ে যেতাম।
.
.
শিমু আবার এলো আরো কিছু ফল নিয়ে। আমার সামনে রেখে বললো:
–আরো লাগলে বলুন…..
–আরে না, এগুলোই যথেষ্ট……..
–আমার কপালে একটা পেটুক স্বামী জুটতেছে। থাকগে….. অসুবিধা নাই। হ্যান্ডসাম আছে কিন্তু।
–লজ্জা দিচ্ছো?” ইচ্ছে করেই “তুমি” করে বললাম। যাতে ও ভাবে আমি তার ঘনিষ্ঠ হতে চাইছি।
–আরে না, লজ্জা দেবো কেন? এই আমরা কিন্তু দুদিনের মধ্যে বিয়ে করতেছি। তুমি কি বলো?” আমাকে “তুমি” করে বলতে দেখে সেও “তুমি” করে বলতে শুরু করলো আমাকে। তার কথা শুনে বললাম:
–না গো, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবোনা। আগে আমি তোমাদের জগৎটা ঘুরে দেখবো, সবার সাথে পরিচিত হবো। তারপর বিয়ে করবো।
–ঠিক আছে লক্ষীটি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে বের হতে আমার ভয় হবে।
–কেন?
–এখানে কিছু দুষ্ট জীন আছে। ওরা মানুষ দেখতে পারেনা। ক্ষতি করার চেষ্টা করে।
–তুমি আমাকে কেমন ভালোবাসো? রক্ষা করতে পারবেনা ওদের কাছ থেকে?”
কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে শিমু বললো:
–হুমমম…..পারবো। তুমি যা বলো তাই হবে।
–এইতো আমার লক্ষী বউ এর মতো কথা…..”
শিমু লজ্জা পেয়ে বললো:
–এখনো বউ হয়নি কিন্তু……” সত্যি বলতে, লজ্জা পেলে পরীদের অসম্ভব সুন্দর লাগে। এই সৌন্দর্য আমি জেরিনের মুখেও দেখেছিলাম।
আমি আমতা আমতা করে বললাম:
–ও তাইতো, সরি হবু বউ……”
–আচ্ছা, তুমি এখন রেস্ট নাও, কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিও।
–হুমমম…..আচ্ছা….. ”
.
.
শিমু চলে গেল আবার। আমি মনে মনে বললাম, অভিনয় করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। যতোদিন জেরিন আসবেনা আমাকে উদ্ধার করতে, ততোদিন এভাবে অভিনয় করে যেতে হবে। স্যরি শিমু, স্যরি ফর এভরিথিং।
.
একদিন শিমুকে নিয়ে বের হলাম বাইরে। পরীর জগতটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। এটাও আমাদের পৃথিবীর মতো একটা জগৎ। শুধু পার্থক্য এটা উপরে, আর আমাদের পৃথিবী নিচে।
.
.
চারপাশটা মুগ্ধ হয়ে দেখতেছিলাম। আরো অনেকগুলো পরী দেখলাম নিজেদের কাজে ব্যস্ত। তবে আমাকে দেখার পর হা করে চেয়ে থাকে। কেউ কেউ আমার সাথে পরিচয় হতে আসে। শিমু সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। কিছু জীনের সামনেও পড়ে গেছিলাম। জীন দেখলেই নিজেকে শিমুর আড়ালে করে ফেলতাম। যাতে শিমু আমাকে বাঁচাতে পারে। ভাগ্যিস এই পর্যন্ত কোনো দুষ্ট জীনের সামনে পড়িনি।
.
.
কয়েকটা জীনের সাথেও আমার পরিচয় হলো। তারা ভালো জীন। মানুষের ক্ষতি করেনা। আমার একটা জীন বন্ধু হলো। তার নাম সালেহীন। আমি, শিমু আর সালেহীন একসাথে হাটতেছিলাম। তখন মাঝেমাঝে খেয়াল করতাম সালেহীন আড়চোখে শিমুকে দেখার চেষ্টা করে। আমি তখন বুঝেছিলাম সে শিমুকে পছন্দ করে। মনে মনে বললাম, এদের দুজনকে জোড়া লাগাতে পারলে আমি বেঁচে যাবো। তাই কীভাবে জোড়া লাগানো যায় চিন্তা করতে লাগলাম সেদিন থেকে।
.
.
সালেহীন আর আমি অন্য একদিন ঘুরতে বের হলাম। সেদিন শিমু ছিলনা। দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে গেছি আমরা। অবশ্য সালেহীন নিজের স্বার্থে আমার সাথে বন্ধুত্ব করে, যাতে সে শিমুকে পাই।
পাশাপাশি হাটছিলাম আমরা গল্প করতে করতে। একটা জীনের বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম ল্যাংটা হয়ে খেলা করতেছে। আমি তার মেইন পয়েন্টটা ধরে টান দিয়ে বললাম:
–বাবু, তোমার বাবা বুঝি তোমাকে পোশাক কিনে দেয়না?”
জীনের বাচ্চাটা “হা” করে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। বোধহয় এর আগে কখনো মানুষ দেখেনি। হঠাৎ একটা মানুষ দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। দৌঁড় দিল সে কোনো কথা না বলে। আমি আর সালেহীন হেসে উঠলাম তখন।
.
.
দুজনে আবার হাটতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ পেছনে চেঁচামেচি শুনা গেলো। পেছনে ফিরে দেখলাম, বাচ্চাটা তার বাবাকে নিয়ে আসছে। আমার দিকে ইশারা করে বাচ্চাটা কি যেন ইশারা করলো তার বাবাকে। সালেহীন তখন বললো:
–সর্বনাশ রানা, ও খুব খারাপ জীন। আমাদের এখনই পালাতে হবে।”
সালেহীনের কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম কিছুটা। নিজেকে নিজে গালমন্দ করতে লাগলাম। শুধু শুধু কেন বাচ্চা জীনটার মেইন পয়েন্ট ধরে টান মারতে গেলাম। আর ভাবার সময় নেই। সালেহীনের হাত ধরে পালাতে শুরু করলাম। সে আমাকে কাঁধে নিয়ে পালাতে শুরু করলো। ভালো দৌড়বিদ জীন এই সালেহীন। সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম আমি তার কারণে। তখন বুঝতে পারলাম সালেহীন আমার একজন ভালো বন্ধু। সে আমাকে শিমুদের বাসায় পৌঁছে দিলো। মনে মনে সেদিন সংকল্প করলাম, এখানে যতদিন আছি, কোনো জীনের বাচ্চাকে ল্যাংটা দেখলেও মেইন পয়েন্ট ধরে টান মারবোনা আর। মনে করবো এই জগতে ল্যাংটা বলতে কিচ্ছু নেই। যা দেখছি সবি চোখের ভুল।
.
.
আরো একদিন আমি আর সালেহীন বসে কথা বলছিলাম বাইরে। সেদিন সে তার মনের কথাটা খুলে বললো। অনেক বছর ধরে সে শিমুকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে তার মনের কথা শিমুকে বলতে পারেনি। আর শিমুও তার ভালোবাসার কথা বুঝতে পারেনি কখনো। আমি সালেহীনকে বললাম:
–বন্ধু, তুমি তোমার মনের কথা তাকে খুলে বলো। আমি এখানে যতোদিন আছি সে মনে হয় তোমার প্রতি দুর্বল হবেনা। তুমি এক কাজ করো, আমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিয়ে আসো।
–না বন্ধু, আমি এতোটা স্বার্থপর নয়। এটা করলে শিমুর সাথে বেইমানি করা হবে। সব ভালোবাসায় পেতে হবে কেন? কিছু ভালোবাসা না হয় না পাওয়াই থাক।
–আমি চেষ্টা করবো বন্ধু, যতোদিন এখানে আছি, তোমার আর শিমুর মিল করিয়ে দিতে।
–ধন্যবাদ বন্ধু……”
সালেহীনের কথা শেষ হতেই কোথা থেকে যেন ঐ দুষ্ট জীনটা হাজির হলো আমাদের সামনে। সাথে আরো কয়েকটা দুষ্ট জীন আছে। ওরা সবাই আমাকে মারার জন্য প্রস্তুত। সালেহীন তখন আমাকে আড়াল করে বললো:
–ভাই, ও আমাদের অতিথি। ওকে মাফ করে দাও…..”
দুষ্ট জীনটা বললো:
–তা হয়না সালেহীন, মানব সন্তান দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। তাছাড়া ও আমার ছেলেকে নিয়ে যা করলো….. তাতে তো ওকে ছেড়ে দেয়া যায়না। আমার ছেলেটা ওকে দেখে ভয় পেয়েছে।
–ভাই, ও আসলে মজা করেছে, ভুল হয়ে গেছে ওর…. এবারের মতো ক্ষমা করে দেন ওকে।
–ক্ষমা তো করবোনা, তুইও শাস্তি পাবি ওর সাথে, ওকে সাহায্য করার জন্য।
–আমাকে যা করার করুন, কিন্তু ওকে ছেড়ে দিন…..” সালেহীন হাতজোড় করলো।
দুষ্ট জীনগুলো তখন সালেহীনকে আগে মারতে শুরু করলো। সাথে আমাকেও মারার জন্য হাত বাড়ালো। তখন শিমু এলো আমাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু আমি জানি শিমুর অবস্থাও সালেহীনের মতো হবে। ও একটা পরী হয়ে এতগুলো জীনের বিরুদ্ধে পেরে উঠবে। ভয় হতে লাগলো আমার, আমাদের ৩ জনের সম্ভাব্য করুণ পরিণীতির কথা ভেবে।
অনেক্ষণ ধরে শিমু আমাকে আড়াল করে দুষ্ট জীনগুলোর বিরুদ্ধে লড়লো। সে এবার হাঁপিয়ে উঠেছো। তবুও আমাকে বাঁচানোর জন্য লড়ে যেতে যাচ্ছে। ঐদিকে কয়েকটা দুষ্ট জীন সালেহীনকে খুব মারতেছে। সালেহীনের অবস্থা খুব করুণ। এভাবে আর কিছুক্ষণ মার খেলে সে মারা যাবে। সেও ওদের মারার চেষ্টা করতেছে, কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে পেরে উঠছেনা। একসময় ঢলে পড়লো সালেহীন। শরীরের সমস্ত শক্তি তার ফুরিয়ে এসেছে। আমি তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলাম:
–সালেহীন…..”
সালেহীন চোখ খুলে একবার আমাকে দেখলো, আরেকবার শিমুকে দেখলো, তারপর চোখ বুজে ফেললো। আমি সালেহীনের কাছে গিয়ে ওকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করলাম। তখন দুষ্ট জীনগুলো আমাকে ধরে মারতে লাগলো। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে জোরে একটা চিৎকার বের হলো। অথচ আমি কোনো চিৎকার দিইনি। সেই চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালো দুষ্ট জীনগুলো। পিছু হটতে শুরু করলো। আমি ধীরে ধীরে ঠের পাচ্ছি আমার মাঝে একটা অজানা শক্তি ভর করছে। আমার চোখ থেকে কয়েকটা জ্যোতি রেখা বেরিয়ে দুষ্ট জীনগুলোকে ঘিরে ফেললো। শিমু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। খারাপ জীনগুলোও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আমাকে:
–কে তুমি? এতো শক্তি পেলে কোথায়? প্লিজ তোমার চোখের ঐ জ্যোতিটা বন্ধ করো। আমরা সহ্য করতে পারছিনা।”
ওদের কথা শেষ হতেই আমি সালেহীনের লাশের দিকে একবার তাকালাম। নিষ্পাপ চেহারাটা তার শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। ওরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। ওদেরও বাঁচার অধিকার নেই।
.
.
বিস্ময় কাটিয়ে শিমু আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর ওদের দিকে ইশারা করে বললো:
–রানা, ওরা তোমার বন্ধুকে মেরে ফেলেছে। তুমিও ওদের শেষ করে দাও তোমার শক্তি দিয়ে।”
–হুমমম শিমু, ওদের বাঁচতে দেয়া যায়না। ওদের কারণে আমি হারিয়েছি আমার এক ভালো বন্ধুকে।” বলেই আমি আমার সমস্ত অজানা শক্তি প্রয়োগ করলাম দুষ্টজীনগুলোর উপর। চোখ এবং হাতের তালু থেকে আলোকরশ্মি বেরিয়ে ওদের উপর পড়লো। তার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ওরা চিৎকার করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ওদের চিৎকার থেমে গেলো। ঢলে পড়লো ওরা নিচে। ওরাও সঙ্গী হলো সালেহীনের।
.
.
তারপর আমি আর শিমু গেলাম সালেহীনের লাশের পাশে। কেন জানি খুব কষ্ট হলো ওর লাশটা দেখে। ওর লাশটাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। শিমুর চোখেও জল বেরিয়ে এলো। আমি তাকে বললাম:
–শিমু, বেচারা তার মনের কথাটা তোমাকে বলে যেতে পারলোনা।
–কি তার মনের কথা?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো শিমু।
–ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো।” নরমকণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।
–কি বলছো এসব?” শিমু যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা।
–হ্যা শিমু, সত্যি, ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি। শুধু আমাকে বলেছে। অনেকদিন ধরে ও তোমাকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে। সে ভালোবাসার কথা আর কখনো বলা হয়ে উঠবেনা।”
শিমু আবেগে আর থাকতে পারলোনা আর। সালেহীনের লাশ জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করলো। তারপর তার লাশটা ঝাকিয়ে বলতে লাগলো:
–এই সালেহীন এই, এতোই যখন ভালোবাসতি একবারো বলতে পারলিনা আমাকে? কি হলো কথা বলছিসনা কেন? ও তুইতো আর কথা বলবিনা, ঘুমিয়ে পড়েছিস তুই। ঘুমানোর আগে কেন তুই একবার বললিনা, তুই আমাকে অনেক ভালোবাসিস? কেন বললিনা? কেন?” জোরে চিৎকার করে উঠলো শিমু।
আমি তাকে বললাম:
–শিমু শান্ত হও তুমি। সালেহীনের লাশ কষ্ট পাবে এতে। ওর সমাধি করা দরকার এখন।
–হুমমম…. তাই করো।” চোখের জল মুছে বললো শিমু।
.
.
রাতে শিমুকে মন খারাপ করে বাইরে বসে থাকতে দেখে, আমি গেলাম তার পাশে। জিজ্ঞেস করলাম:
–মন খারাপ?
–হুমম…..সালেহীনের জন্য মনটা খুব কাঁদছে।” জবাব দিলো শিমু।
–আমারো খুব কষ্ট হচ্ছে তার জন্য। সে আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার স্মৃতিগুলো যেন এখনো জীবন্ত। মনে হচ্ছে যেন সালেহীন আমাদের পাশে আছে। সব শুনতে পাচ্ছে সে।
–আচ্ছা রানা, একটা প্রশ্ন করি?
–করো?
–তুমি কি করে ঐ খারাপ জীনগুলোকে শায়েস্তা করলে?
–আমি জানিনা। আমার শরীরে একটা অদৃশ্য শক্তি ভর করেছে। মনে হয় জেরিন ফিরে এসেছে।
–জেরিন কে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো শিমু।
–আমি জেরিন….” পেছন থেকে হঠাৎ একটা মেয়েলী কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। চমকে তাকালাম আমি আর শিমু। দেখলাম ডানামেলে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন। তাকে দেখে আমার মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। বললাম:
–জেরিন, তুমি এসেছো?”
জেরিন আমার আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রাখলো। তারপর বললো:
–হুমমম…. এসেছি রানা……”
–আমি জানতাম তুমি আসবে।
–আমার ভালোবাসা এখানে আটকে আছে, আমি কি না এসে পারি বলো? শুধু অমাবস্যা রাতের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।
–এখানে তো পূর্ণিমা রাত। তাই বুঝিতেছিলাম না, আমাদের জগতে অমাবস্যা নাকি পূর্ণিমা। যাইহোক, তুমি এসেছো বেশ করেছো। এসো তোমার সাথে শিমুর পরিচয় করিয়ে দিই।” বলেই শিমুর দিকে ইশারা করে বললাম:
–ও শিমু, ও আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে বিয়ে করবে বলে। কিন্তু ও হয়তো এখন তার ভুল বুঝতে পেরেছে।” তারপর জেরিনের দিকে ইশারা করে শিমুকে বললাম:
–আর শিমু, ও হচ্ছে জেরিন, আমার ভালোবাসা, আমার প্রেম, আমার সবকিছু। আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু কি জানো? আমাদের মধ্যে অনেক ব্যবধান। ও এখন অশরীরী। ঐ রাতে তুমি আমাকে উড়তে দেখেছো, তখন আসলে ওর সাথে আমি উড়েছিলাম। ও যাকে দেখা দেবে, শুধু সে-ই দেখতে পাবে ওকে।”
–হুমমম….বুঝলাম। কিন্তু ও অশরীরী হলো কেমনে?” প্রশ্ন করলো শিমু।
তারপর আমি শিমুকে সব (“অলৌকিক প্রেম” দ্রষ্টব্য) খুলে বললাম। সব শুনে শিমু আফসোস করে বললো:
–তোমরা তো তবুও একে অপরকে ভালোবাসতে পেরেছো? কিন্তু আমি? আমি তো সালেহীনের ভালোবাসা বুঝতেও পারিনি কখনো। সালেহীন আমাকে ভালোবাসতো, কথাটি কখনো সে আর বলতে পারবেনা। ওরা ওকে বাঁচতে দেয়নি।” বলতে বলতে শিমু হু হু করে কেঁদে উঠলো। আসলে কাছে থাকলে কারো ভালোবাসা বুঝা যায়না। যখন হারিয়ে যায় তখন বুঝা যায় ভালোবাসা কি….. শূন্যতা তখন বারবার হৃদয়ে আঘাত হানে, আর জানিয়ে দেয় কেউ একজন তাকে খুব ভালোবাসতো। তেমনি আমারো হয়েছিলো, যখন আমি জেরিনকে হারিয়েছিলাম…….”
.
.
শিমুকে কাঁদতে দেখে জেরিন তার কাঁধে হাত রেখে বললো:
–শিমু, তুমি কি সালেহীনকে ভালোবাসো?
–এখন ভালোবেসে কি হবে? ও তো নেই।” কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো শিমু।
–মন থেকে তাকে ডাকো, নিশ্চয়ই একদিন তোমার ডাকে তার আত্মা সাড়া দেবে। এই আমি যেমন রানার ডাকে সাড়া দিয়েছি।”
–বেশ, আমিও আজ থেকে সালেহীনের প্রত্যাশা করে যাবো।
–হুমমমম তাই করো। সালেহীনের হৃদয়টা অতৃপ্ত। নিশ্চয়ই আসবে সে।
–তাই যেন হয়…..” বলেই শিমু আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো:
–রানা, আমি দুঃখিত। আমি না বুঝে তোমার উপর অন্যায় করে ফেলেছি।
–না ঠিক আছে। তুমি এই অন্যায়টা করেছো বলেই, আমি কিছুদিনের জন্য হলেও সালেহীনের মতো একটা বন্ধু পেয়েছিলাম।” শিমুকে সান্ত্বনা দিলাম আমি।
এরপর জেরিন বললো:
–রানা, এবার সময় এসেছে প্রতিশোধ নেয়ার, যাদের কারণে আমার মৃত্যু হয়েছে তাদের শেষ করবো।
–হুমমম….. কিন্তু কীভাবে শেষ করবা কিছু ভেবেছো?
–আমি তোমার উপর ভর করবো। তোমার মাঝেই আমার শক্তি থাকবে। তারপর ওদের তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারবো।
–আচ্ছা ঠিক আছে।” মাথা নেড়ে সায় দিলাম জেরিনের কথায়।
তখন শিমু বললো:
–আমি কি তোমাদের সাহায্যে আসতে পারি?”
–হুমমম….. প্রয়োজনে তোমার সাহায্যও লাগবে আমাদের।” শিমুর কথার জবাবে বললো জেরিন।
–আচ্ছা, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তোমাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো।” শিমু চোখ মুছে বললো।
–ধন্যবাদ তোমাকে শিমু।” আমি আর জেরিন তার প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম।

একটা প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর শিমু। কিছুটা আড়াল থেকে লক্ষ্য করতেছি ভেতরে কে যাচ্ছে আর বের হচ্ছে। বলে রাখা ভালো, প্রাসাদটা আমার শত্রুর। মানে যার কারণে আমি হারিয়েছি আমার জেরিনকে।
.
.
আমার মাঝে এখন দুইটা শক্তি, একট মানুষের, অন্যটা অশরীরীর। কারণ জেরিন ভর করেছে আমার উপর। যাইহোক, প্রাসাদটার ভেতরে উকি দিচ্ছিলাম। দেখলাম একটা জীন তার কোলের বাচ্চাকে আদর করতেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী। আমার টার্গেট ঐ জীনটা। সে আমার জেরিনের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। সহজে ছাড়া যাবেনা।
.
.
জেরিন আমার উপর ভর করে সব ইঙ্গিত দিচ্ছে কি কি করতে হবে, সে-ই আমায় জানিয়ে দিয়েছে ঐ জীনটার পরিচয়। নাম ইয়াজিদ। এই প্রাসাদেই থাকে স্ত্রী পুত্র নিয়ে। ক্ষমতাধর জীনদের মধ্যে সেও একজন। শিমু আরো খোঁজ নিয়ে এই জীনটা সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। জেরিনের মৃত্যুর পর সে বিয়ে করে অন্য একটা পরীকে। এখন একটা বাচ্চা হয়েছে।
.
.
কিছুক্ষণ পর ইয়াজিদের কাছে এলো আরো কয়েকজন জীন। তারা ইয়াজীদের সাথে কথা বলতে লাগলো। আর ইয়াজীদের স্ত্রী বাচ্চাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। জেরিন আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে এরাও শত্রু। আপাতত শত্রুগুলোকে চিনে রাখলাম। ধীরে ধীরে শেষ করতে হবে।
.
.
রাত নেমেছে জীনপরীর দেশে। চাঁদটা উজ্জ্বল আলো দিচ্ছিলো। আমি আর শিমু এলাম একটা আস্তানায়, এখানে ইয়াজীদের সঙ্গীরা থাকে। ওদের পিছু নিয়ে এসেছি আমরা। আমি শিমুকে বললাম:
–শিমু, যাও তুমি…. ওদের সামনে যাও।
–কিন্তু আমার ভয় করে…..” কিছুটা কেঁপে জবাব দিলো শিমু।
–ভয় পেয়োনা। আমি আছি, আর সাথে আছে জেরিনের শক্তি।
–ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।” বলেই শিমু পা বাড়ালো ভেতরে। আমি বাইরে থেকে কাঁন পাতলাম ভেতরের কথা শুনার জন্য। শিমুকে দেখে প্রথমে ওরাই জিজ্ঞেস করলো:
–কে আপনি?”
শিমু জবাব দিলো:
–আমার নাম শিমু, হঠাৎ আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমি কি একটু আশ্রয় পেতে পারি?”
দুষ্টজীনগুলো এককথায় রাজি হয়ে গেল। একা একটা সুন্দরী পরীর আবদার কি তারা না রেখে থাকতে পারে? আমি জানি একটু পর ওরা শিমুর উপর সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়বে। আর আমিও প্রস্তুতি নিলাম ওদেরকে প্রথম আঘাতটা করার জন্য।
.
.
আস্তানার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটু পর শিমুর চিৎকার শুনা গেল:
–একি করছেন আপনারা? আমি আশ্রয় নিয়েছি বলে আপনারা কী শুরু করেছেন আমার উপর?
দুষ্ট জীনগুলো তখন “হা হা হা” করে উঠলো, যেন খুব মজা পেয়েছে তারা শিমুর কথা শুনে। আমি বুঝলাম সময় এসেছে এবার প্রথম আক্রমণটা করার। চোখ দিয়ে ইশারা করলাম আমি, সাথে সাথে খুলে গেল আস্তানার দরজা। আমাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল দুষ্ট জীনগুলো। জিজ্ঞেস করলো:
–কে তুই মানবসন্তান? এখানে এলি কি করে?”
আমি একটা বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বললাম:
–একটা পরীকে একা পেয়ে সবাই মিলে কি করতেছিস লজ্জা করেনা?”
একটা দুষ্ট জীন তখন বললো:
–তোর সাহস দেখে আমরা অবাক হচ্ছি। জানিস আমরা মানব সন্তানদের দেখতে পারিনা, আর তুই নিজে আসলি আমাদের আস্তানায়? এতো সাহস তোর?
–সাহসের এখনো কি দেখলি? আমি যখন এসেছি, তখন প্রতিটা মুহূর্ত তোদের ভয়ে ভয়ে কাটবে।
–তাই নাকি??” সব জীনগুলো একসাথে “হা হা হা” করে উঠলো। তারপর তারা আমার দিকে এগিয়ে এলো আমাকে মারার জন্য। আমি তখন চোখ দিয়ে ইশারা করলাম শুধু, ছিটকে তারা দূরে গিয়ে পড়লো। তারপর আমার ইশারায় ওরা একজন আরেকজনকে মারতে লাগলো। আমি আর শিমু তখন মজা নিচ্ছিলাম ওদের অবস্থা দেখে। অনেক্ষণ এভাবে চলার পর আমি অশরীরী শক্তিটা থামিয়ে দিলাম। ওরাও থামলো পরস্পরের সাথে মারামারি করে। হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। বিদ্রুপ করে জিজ্ঞেস করলাম:
–আহারে, যুদ্ধ করে খুব কষ্ট হয়েছে বুঝি? এখন একটু রেস্ট নাও।”
ওরা তখন ভয় পেতে শুরু করলো আমাকে। সবাই একসাথে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো:
–কে আপনি?”
–আমি মানব সন্তান। তোমাদের মতো দুষ্ট জীনদের শেষ করতে এসেছি।
–আমাদের কী অপরাধ?
–সেটা পরে জানতে পারবে। আজ থেকে প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যু ভয়ে কাটাবে তোমরা। আর তোমাদের ইয়াজিদকে জানিয়ে দেবে, একজন মানব সন্তান এসেছে তাকে শেষ করার জন্য। তাকে প্রস্তুত থাকতে বলবে।” বলেই আমি শিমুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দুষ্টজীনগুলো তখনো ভয়ে কাঁপতেছিল। হয়তো ভাবতেছে, একটা মানবসন্তান হয়ে তাদের এভাবে শায়েস্তা করে গেল? এতো শক্তি তার?”.
অচিরেই পৌঁছে গেলো খবরটা ইয়াজিদের কানে। একটা মানব সন্তান এসে তার সৈন্যদের নাজেহাল করে গেছে। ছিঃ! কী লজ্জা! কী লজ্জা! এই লজ্জাটা ইয়াজিদের মাথায় আগুণ ধরিয়ে দিলো। তাই সেই রাতেই ইয়াজিদ তার সৈন্য নিয়ে খুঁজে বের করলো আমাদের। আমরা তখন বাইরে বসে কথা বলছিলাম। হঠাৎ এলো ওরা। সবার সামনে ছিল ইয়াজিদ। বাকিরা তার পেছনে জড়োসড়ো হয়ে ছিল। কারণ আমার শক্তি সম্পর্কে ইতোমধ্যে তাদের ধারণা হয়ে গেছে।
.
.
হঠাৎ ইয়াজিদ চিৎকার করে বললো:
–কে? কে তোমাদের এমন নাজেহাল করলো? কে সেই মানব সন্তান?”
আমি তখন ইয়াজিদের সামনে গেলাম। তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে বললাম:
–চোখ বড় বড় করে দেখে নাও আমাকে…..”
.
.
চড়টা খেয়ে ইয়াজিদ কিছুক্ষণ ঢুলতে লাগলো। তারপর আমাকে মারার জন্য হাত তুললো সে। কিন্তু মারতে পারলোনা। হাত কাঁপতে লাগলো তার। তার চেহারা দেখে বুঝা গেলো সেও ভয় পেয়েছে কিছুটা। তার সঙ্গিরা পেছন থেকে বলতে লাগলো:
–ভাই, আমরা আগেই বলেছিলাম এ কিন্তু যেই সেই মানবসন্তান না। ওর অনেক শক্তি।”
সঙ্গিদের কথা শুনে ইয়াজিদ আরো বেশি ভয় পেয়ে বললো:
–কে তুমি?”
–আমার পরিচয় তো এতো সহজে পাবিনা। তবে এটা জেনে রাখো, আমি তোর মৃত্যুদূত হয়ে এসেছি। আজ থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাক।”
ভয় পেয়ে তখন চলে গেল ইয়াজিদ ও তার দল। আমি জানি সে এখন আমাকে মারার উপায় খুঁজতে থাকবে।
.
.
ইয়াজিদরা চলে যাওয়ার পর জেরিন এলো সামনে। আমার পাশে বসলো কাঁধে মাথা রেখে। শিমু মুখ নিচু করে কান্না করছিলো। হয়তো সালেহীনকে মনে পড়তেছে তার। তাকে বাঁধা দিলামনা। কাঁদুক সে। কেঁদে মনটা হালকা করুক। বিষাদের গ্লানিসব ভেসে যাক চোখের জলে।
–জেরিন…..” হঠাৎ ডাক দিলাম জেরিনের নাম ধরে।
–হুমমম….” অস্ফুটে জবাব দিলো জেরিন। মন খারাপ তার।
–কথা বলছোনা কেন?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
–ভাবছি….
–কি ভাবছো?
–ভাবছি, ইয়াজিদকে তাড়াতাড়ি শেষ করে দেবো। ওকে দেখলেই আমার সহ্য হয়না।
–তাহলে তাই করো।
–আর একটা দিন বেঁচে থাকুক সে।
–আচ্ছা…. তুমি যা ভালো মনে করো, তাই হবে।”
তারপর আমি শিমুকে জিজ্ঞেস করলাম:
–শিমু, মন হালকা হয়ছে তোমার?”
আমার প্রশ্ন শুনে শিমু কান্নায় ভেঙে।পড়লো। কান্না করতে করতে বললো:
–রানা, আমার ভাগ্য কেন এমন বলতে পারো? সালেহীন আমায় এতো ভালোবাসতো? কেন আমি বুঝতে পারিনি? কেন? কেন? কেন?
–কেঁদোনা শিমু। নিয়তিকে মেনে নাও। মনে রেখো, ভালোবাসা গোপনে আসে। আর তাকে যত্ন নিতে হয়।”
আমার কথা শেষ হতেই জেরিন বললো:
–শিমু, মন থেকে ডাকো ওকে। আসবে সে নিশ্চয়ই। তোমাকে আগেই বলেছি কথাটা। এভাবে কান্না করলে তার আত্মা কষ্ট পাবে। তুমি নিশ্চয়ই তার আত্মা কষ্ট পাক, তা চাওনা? আর তুমি এভাবে কান্না করো, তাও নিশ্চয়ই সে চায়না।”
শিমু দু’চোখ মুছে বললো:
–কী করবো আমি? কষ্ট সহ্য হয়না আমার।
–কিছু কিছু কষ্টকে মানিয়ে নিতে হয় শিমু….” নরম সুরে বললো জেরিন।
তার কথা শুনে শিমু কান্না থামিয়ে দিলো।
.
.
পরের দিনটা কেটে গেল কোনমতে। কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু রাতে ইয়াজিদ এলো আরো বেশি দলবল নিয়ে। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বললো:
–হে মূর্খ মানব, আমার দেশে এসে আমাকে মেরে যাবি, তা তুই ভাবলি কী করে? দেখ আজ কতো সৈন্য নিয়ে এসেছি।
–সব সৈন্যের মরণ ডেকে আনলি তুই……” আমার ভেতর থেকে তখন জেরিনের আত্মা চিৎকার করে বললো।”
জেরিনের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো ইয়াজিদ। ভয়ে পিছু হটলো কিছুটা। তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো:
–কে? কে তুমি? কণ্ঠ চেনা চেনা লাগে কেন?”
জেরিন আবার বলে উঠলো:
–চিনিসনি এখনো আমি কে?”
–না… কে তুমি? সামনে আসো…..” ভয়ে কাঁপতে লাগলো ইয়াজিদ। জেরিন তখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসলো সামনে। তাকে দেখেই চমকে উঠলো ইয়াজিদ। ভয়ে ভয়ে সে উচ্চারণ করলো:
–জে…রি…ন…. তুমি???
.চিনতে পেরেছিস তাহলে?” জেরিনের মুখে বিদ্রূপের হাসি দেখা গেলো।
–হুমম, চিনতে পেরেছি…..কিন্তু তু…তুমি তো….” ইয়াজিদ কথা শেষ করতে পারলোনা। জেরিন গিয়ে তার গলা চেপে ধরে উপরে তুলে ফেললো। তারপর প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে বললো:
–কিন্তু আমি মরে গেছি তাইতো? হুমম, মরে গেছি…… তোদের জন্য মরেছি, আমার ভালোবাসাকে না পেয়ে মরেছি। আজ আবার এসেছি তোদের উপর প্রতিশোধ নিতে, এসেছি আমার ভালোবাসার টানে।
–কিন্তু জেরিন, আমি তো শুধু তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম…..” বলতে বলতে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো ইয়াজিদ।
–তুই আমাকে আমার ভালোবাসার কাছ থেকে আলাদা করেছিস। আমার ডানা কেটে নিয়েছিস, আমাকে মারা যেতে বাধ্য করেছিস, আজ তোর পালা, তোকেও আজ মরতে হবে।” জেরিনের রাগ বেড়ে গেলো।
ইয়াজিদ নিজেকে ছাড়াতে না পেরে তার সঙ্গিদের হেল্প চাইলো। তার সঙ্গিরা এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে সব কান্ড দেখতেছিল। ইয়াজিদের আদেশ পেয়ে তারা জেরিনকে মারতে এলো। জেরিন চোখ থেকে কয়েকটা জ্যোতি বের করে দিলো ওদের দিকে। ওরা ছিটকে দূরে পড়লো। আমি বসে বসে মজা দেখছিলাম। এসব মারামারি আমার না করলেও চলবে। জেরিন একাই সবাইকে সাবাড় করতে পারবে।
.
.
আমার বসে থাকাটা মনে হয় কয়েকটা দুষ্ট জীনের সহ্য হলোনা। তারা জেরিনকে কিছু করতে না পেরে আমাকে মারতে এলো। তাদেরকে বাঁধা দিলো শিমু। শিমু আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালো। কিন্তু ওরা শিমুকে ধরে আঘাত করতে লাগলো। আরো কয়েকটা দুষ্ট জীন এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। তখন জেরিন ইয়াজিদকে হাতের উপর চরকার মতো ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলো ওদের দিকে। ওরা আর কাছে আসতে পারলোনা আমার। পড়ে গেল সবাই। যারা শিমুকে আঘাত করতেছিল, তারা এবার শিমুর ইজ্জতে হাত দিলো। আমি তখন জেরিনের উদ্দেশ্যে বললাম:
–জেরিন, শিমুকে বাঁচাও……”
জেরিন তখন শিমুকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে যেতে চাইলো। ঠিক তখনি একটা আলোকরশ্মি ঘূর্ণির মতো ঘুরে এগিয়ে যেতে লাগলো শিমুর দিকে। ওটা গিয়ে থামলো শিমুর পাশে। ধীরে ধীরে ওটা একটা জিনের আকৃতি নিলো। জিনটাকে দেখে আমি অস্ফুটে শব্দ করলাম:
–সালেহীন…..” মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমার। শিমুর মুখেও হাসি দেখা গেলো সালেহীনের আগমনে। সালেহীন তখন দুষ্ট জিনগুলোর হাত থেকে শিমুকে বাঁচিয়ে তাদের আঘাত করতে লাগলো। আর জেরিন ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার শত্রুকে নিয়ে। ইয়াজিদ এবং তার অন্যান্য সঙ্গীকে সে ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। এতক্ষণেই আমি একটু আরাম করে বসতে পারলাম। শিমু বসলো আমার পাশে। জেরিন এবং সালেহীন শত্রু বিনাশে ব্যস্ত। পায়ের উপর পা তুলে দেখতে লাগলাম দুষ্ট জিনের করুণ পরিণতি।
.
.
একসময় হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালো জেরিন এবং সালেহীন। শত্রুর বিনাশ হয়েছে ইতোমধ্যে। কিছুটা দূরে পড়ে আছে ওদের লাশ। সেদিকে আর তাকালাম না। আমি জড়িয়ে ধরলাম জেরিনকে, আর শিমু জড়িয়ে ধরলো সালেহীনকে। শিমু সালেহীনকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে শুরু করলো, আর অভিযোগ করতে লাগলো কেন সে বলেনি ভালোবাসার কথা। সালেহীন শিমুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো:
–এইতো এসেছি আমি, তোমার সালেহীন তোমারই সামনে।”
–কিন্তু তুমি তো বাস্তব নও, তুমি অধরা। আমি তো তোমাকে সবসময় পাবোনা।” শিমুর অভিযোগের শেষ নেই।
সালেহীন বললো:
–এই দূরত্বটা আছে বলেই আমাদের ভালোবাসাটা আজীবন থাকবে, দেখছোনা রানা এবং জেরিনকে। আমরাও নয় হয় ওভাবে থাকবো।”
এবার জেরিন মুখ খুললো:
–অটুট থাকুক তোমাদের এই ভালোবাসা। আমাদের কাজ শেষ এখানে। এবার আমরা ফিরে যাবো।”
বিদায়ের কথা শুনে শিমুর ভেজা চোখদুটো আরো ভিজে উঠলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
–রানা, আজীবন মনে রাখবো তোমাকে। তুমি কি ভুলে যাবে আমায়?”
আমি শিমুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম:
–নাহ, ভুলবোনা আমিও। ভালো থেকো তোমরা। আমরা তাহলে যাই……”
–শুভ বিদায়।”
–বিদায়…..” হাত নেড়ে বিদায় জানালাম ওদের। তারপর আমি আর জেরিন রওনা দিলাম পৃথিবীর উদ্দেশ্যে।
.
.
উড়তে উড়তে আমরা যখন পৃথিবীর মাটিতে নামতে যাবো, তখন সামনে পড়ে গেলো ঐদিনের ঝুড়িওয়ালা। বেঁচারা অন্ধকারে লাইট জ্বালিয়ে ঐদিনের মতো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলো ঢুলতে ঢুলতে, আর ছন্দ মিলিয়ে গান গাচ্ছিলো এভাবে:
–মনেতে আমার শান্তি নাইরে বউ জালায় বারবার,
ঝুড়িবন্ধন হয়না দেখে মদ ধরলাম আবার…
হায়রে মদ ধরলাম আবার….”
.
.
লোকটা তার গান শেষ করার আগেই আমরা মাটিতে নেমে দাঁড়ালাম। জেরিনকে দেখলোনা লোকটা। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। লাইটের আলো ফেললো সে আমার মুখের দিকে। তারপর মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে জিজ্ঞেস করলো:
–ভাই, আপনারে চেনা চেনা লাগে কেন? আর আপনি কীভাবে উড়ে আসলেন?”
আমি লোকটাকে বললাম:
–ঝুড়িবন্ধনের কথা মনে আছে?”
–ও মনে পড়েছে…. আপনি ঐ লোকটা। ভাই আপনার সাথে যতবার দেখা হয়, ততবার এসব কি হয় আমার সাথে? ঐদিন আমার ঝুড়িটা ভাসতেছিলো শূন্যে, আজ দেখলাম আপনাকে উড়তে। এটা কি চোখের ভুল, নাকি সত্যি সত্যি? ভাই আপনাকে একটা চিমটি কেটে দেখি।”
–আমাকে কেন চিমটি কাটবেন?”
–ও তাইতো চিমটি তো নিজেকেই কাটতে হবে।” বলেই সে নিজেকে চিমটি কেটে বললো:
–হায়! হায়! ভাই এটা তো সত্যি! আপনি কি সত্যি সত্যি উড়তে পারেন?”
–তার আগে বলুন আপনি আবার খেয়েছেন কেন?”
লোকটা হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো:
–দুঃখের কথা কী বলবো ভাই, ঐরাতের পর থেকে আমার শান্তি নাই। সেইরাতে বাসায় গিয়ে আমি বউকে বলেছিলাম যে, আমার ঝুড়ি কথা বলতে পারে। সে ফিমেইল।
–তারপর?
–তারপর বউ আমাকে পাগল ভেবে বললো:
–ঝুড়ি আবার কথা বলতে পারে নাকি?” আমি বললাম,
–দাঁড়াও তোমাকে চোখের সামনেই দেখাচ্ছি…” বলেই আমি ঝুড়িটাকে বললাম:
–মা ঝুড়ি একটু কথা বলো তো মা। আমার বউ তোমার কথা শুনতে চাইছে, একটু দেখিয়ে দাও তুমিও কথা বলতে পারো…..” কিন্তু এই ঝুড়ি তখন একটুও কথা বলেনি। আমার বউ সেই রাতে আমাকে খেতেও দেয়নি। পরদিন থেকে সবাইকে বলে বেড়িয়েছে আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি। মনের দুঃখে তখন আমি শুধু ঝুড়িকে গালি দিতাম, আর মারতাম। ও কেন কথা বলেনি তখন?” বলতে বলতে কাঁদতে লাগলো লোকটা। আমি লোকটার কাঁধে হাত রেখে বললাম:
–ভাই, আপনার ঝুড়িটা রাগ করে অনশন পালন করতেছিল হয়তো তখন, তাই কথা বলেনি।
–কিন্তু এতদিনেও তো আমার ঝুড়ি একটুও কথা বলেনি আর, শুধু ঐরাতে বলেছিল।
–কি করে কথা বলবে? আপনি তাকে এতো মেরেছেন, ঝুড়িটার বুঝি রাগ হয়না?”
–ওমা তাইতো? আমার কী মনে হয় জানেন?
–কী?
–আমার মার খেয়ে আমার ঝুড়িটা মনে হয় বোবা হয়ে গেছে। আর কখনো কথা বলতে পারবেনা। হায়! আমি এ কী করলাম? নিজহাতে আমার ঝুড়ির কথা কেড়ে নিলাম?” লোকটার কান্না বেড়ে গেল।

–আপনি মদ খাওয়া ছেড়ে দেন। নইতো ঝুড়িটা আবার ঝুড়িবন্ধন করতে পারে। এমনিতেই ঝুড়িটা বড্ড অভিমান করে আছে। তার উপর আপনি মদ খেয়েছেন, জানেননা ঝুড়িটা মদ খাওয়া পছন্দ করেনা?” লোকটাকে কাঁদতে দেখে বললাম আমি।
লোকটা কান্না থামিয়ে বললো:
–না ভাই, ঝুড়িটার ক্ষমতা নাই আর। ও আর কিছু করতে পারবেনা।”
.
.
জেরিন এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। লোকটার কথা শেষ হতেই এবার সে ঝুড়িটা নিয়ে উপরে তুলে ফেললো। লোকটা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললো:
–হায়! হায়! আমার ঝুড়ি আজকেও শূন্যে ভাসতেছে।”
আমি বললাম:
–হুমমম….. এখন তো আপনার সর্বনাশ! আপনি আজকে আবার মদ খেয়েছেন, তাই ঝুড়ি রেগে গেছে। এখন ঝুড়িবন্ধন থেকে কেউ আপনাকে আর বাঁচাতে পারবেনা।
–আমার ভুল হয়ে গেছে। এই কানে ধরলাম, আমি আর মদ খাবোনা কোনদিন।” আবারো কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো লোকটা।
–এখন ঝুড়িটার কাছে ক্ষমা চান আপনি।”
–ঠিক আছে, ক্ষমা চাচ্ছি।” বলে লোকটা উপরে তাকিয়ে বললো:
–মা ঝুড়ি, আমার ভুল হয়ে গেছে মা। ফিরে আয় মা।”
উপর থেকে তখন জেরিন জবাব দিলো:
–নাহ, তুমি পঁচা, তুমি মিথ্যে বলো, মদ খাও, আমাকে মারো। আমি আর আসবোনা তোমার কাছে।”
–আমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দে মা। আমি সব ছেড়ে দেবো। তোমাকেও আর মারবোনা।
–ঠিক তো?
–হুমমম….. এবার আমার বউ মিথ্যে হয়ে যাবে, কিন্তু আমার কথার নড়চড় হবেনা।
–বেশ, এবারের মতো ক্ষমা করলাম। ফিরে আসলাম আমি।” বলেই জেরিন ঝুড়িটা লোকটার মাথায় রাখলো আবার।
লোকটা খুশি হয়ে বললো:
–এবার বউকে মজা দেখাবো। আমার ঝুড়ি নাকি কথা বলেনা। এবার বউ বুঝবে মজা।” বলতে বলতে লোকটা চলে যেতে লাগলো। বেসুরা কণ্ঠে সে আবার গান গাওয়া শুরু করলো। ধীরে ধীরে তার গানের কণ্ঠ দূরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। আমিও ফিরে এলাম বাসায়।
.
.
এদিকে অনেকদিন আমার খোঁজ না পাওয়াই আমার পরিবারের সবাই টেনশনে ছিল। পত্রিকাতে একটা হারানো বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিল আমার নামে। এখন হঠাৎ আমাকে ফিরে পাওয়াই সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো আবার। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো এতদিন কোথায় ছিলাম আমি। আমি জবাবে বললাম:
–একটা পরী আমাকে ধরে নিয়ে গেছে…..” এরপর সব খুলে বললাম আমি।
খবরটা পরদিন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। এর কান থেকে ওর কানে, ওর কান থেকে তার কানে যেতে যেতে একসময় খবরটা গিয়ে পৌঁছলো আমার হবু শ্বশুরবাড়ির সবার কানে। তারা তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, নাহ! এই ছেলের সাথে কিছুতেই তাদের মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবেনা। এই ছেলের পেছনে জিনপরী আছে। না জানি আরো কি কি আছে। এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে তাদের মেয়ের সর্বনাশ হবে। এই ভেবে আমার হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়েটা ভেঙে দিলো। আমারো আর বিয়ে করা হলোনা। সবার সামনে এমন ভান করতে লাগলাম, যেন বিয়েটা ভেঙে যাওয়াই আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। মনে মনে যে অনেক খুশি হয়েছি, তা আর কাউকে বুঝতে দিইনি আমি। আমার জেরিন আছে, হোক সে অশরীরী, ভালোবাসা তো পাচ্ছি আমি। আর কী চাই আমার?
.
.
আরো বেশ কয়েকটাদিন কেটে গেলো। একরাতে পুকুরঘাটে বসে আছি আমি আর জেরিন। জেরিনের মুখটা সেদিন মলিন ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে:
–মন খারাপ?
–হুমমম….
–কেন?
–মনে হচ্ছে আমার বুঝি সময় ফুরিয়ে এসেছে।
–মানে?” চমকে উঠলাম আমি।
–মানে আমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, এবার তোমার জীবনে অন্য কেউ আসবে।
–কি বলছো এসব?”
–হুমমম, সেবার তোমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিলো। এবার আর ভাঙবেনা।
–জেরিন তুমি কি ঠিক আছো? কার বিয়ে? কিসের বিয়ে ভাঙবেনা।
–আমার মন বলছে, খুব শীঘ্রই তোমার জীবনে কেউ আসবে, যে তোমার জীবনসঙ্গিনী হবে।
–আরে বাদ দাও তো….. কীসব আবোলতাবোল বকতেছো…..
–সত্যি বলছি রানা। হয়তো এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো জেরিন। আমার বুকে মুখ লুকিয়ে সে কান্না করতে লাগলো।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম:
–জেরিন, কিচ্ছু হবেনা…. তুমি একটু শান্ত হও।
–আমি চলে গেলে তুমি নিজের ঠিকমতো যত্ন নিবা, নিজের প্রতি খেয়াল রাখবা। আর তোমার বউকে বলবা, তোমার খেয়াল রাখতে।” জেরিনের কণ্ঠটা খুব করুণ শুনালো। আমি কিছুই বলতে পারলামনা হঠাৎ তার এসব কথা শুনে। জেরিন আবার বললো:
–যাও, অনেক রাত হয়েছে, বাসায় যাও এবার। ঠিকমতো ঘুমাবে। দেখো রাত জেগে জেগে চেহারার কি হাল করেছো। আর রাত জাগবেনা এভাবে, কেমন?
–হুমম….” অস্ফুটে শব্দ করলাম আমি।
.
.
রুমে এসে শুয়ে পড়লাম আমি। ভাবতে লাগলাম জেরিনের কথা। ও হঠাৎ এসব কী বললো আমাকে? কিসের ইঙ্গিত দিলো সে আমাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। এতো রাতে আবার কার ফোন? ফোনের স্ক্রিনে একটা অচেনা নাম্বার দেখা গেলো। ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে হলোনা। বারবার রিং হওয়ায় ফোন রিসিভ করলাম।
–হ্যালো….
–হ্যালো, রানা?” একটা মেয়েলী কণ্ঠ শুনা গেলো।
–হুমম, রানা বলছি। কে আপনি?
–আমি ইশা……..” ওপাশ থেকে জবাব দিলো মেয়েটা।
হঠাৎ চমকে উঠলাম ইশার কণ্ঠ শুনে। অনেকদিন পর তার কণ্ঠ শুনলাম। সেই যে সে বিদেশ চলে গিয়েছিল, তারপর থেকে আর কোনো কথা হয়নি তার সাথে। আজ হঠাৎ তার ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলাম। হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো সে আবার?
–কি হলো? কথা বলছোনা কেন?” আমাকে চুপ থাকতে দেখে ওপাশ থেকে ইশা প্রশ্ন করলো আবার।
–হুমমম… বলো। তুমি হঠাৎ এতদিন পর?
–এইতো দেশে ফিরে এলাম একটা কাজে। কেমন আছো তুমি?
–ভালো, তুমি কেমন আছো?
–আমিও ভালো। রানা….?
–হুমমম…..
–কাল একটু মিট করতে পারবা আমার সাথে?
–কোথায়?
–ভার্সিটি মোড়ে। তুমি এসো বিকেল ৪ টায়। আমি অপেক্ষা করবো।
–আচ্ছা।
–গুড নাইট, ঘুমাও এখন।
–গুড নাইট।” বলেই ফোন রেখে দিলাম। তারপর কিছুক্ষণ ইশার কথা ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
.
পরদিন বিকেল চারটায় ইশার সাথে মিট করলাম ভার্সিটি মোড়ে। সে আগে থেকেই ওয়েট করে ছিল তার প্রাইভেট কারটা নিয়ে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে একটা হেসে “হাই” বললো। আমিও প্রত্যুত্তরে “হাই” বললাম। তারপর সে গাড়ির দরজা খুলে দিলো, আমি গিয়ে বসলাম তার পাশে। বসতে বসতে বললাম:
–তারপর…..কী খবর?
–এইতো আছি…..
–দেশে কবে এলে?
–মাত্র গতকাল এলাম।
–কোনো বিশেষ কাজে?
–হুমমম….. ভাবছি এবার বিয়েটা করেই ফেলি, কতদিন আর কুমারী থাকবো?
–তা পাত্র দেখছো? দেখতে কেমন?”
ইশা মৃদু একটু হেসে জবাব দিলো:
–দেখতে ভালোই, হ্যান্ডসাম। অনেকদিন ধরেই তাকে পছন্দ করে আসছি।
–কে সে?
–তুমি নিজে…..
–মানে?
–মানে তোমার ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলি মিলে আমাদের বিয়ে ঠিক করেছে?
–এসব কী বলছো তুমি?
–হুমমম, আমাকে জোর করেছিল আমার ফ্যামিলি বিয়ে করার জন্য। আমি রাজি হয়নি প্রথমে, পরে ওরা পাত্রের ছবি পাঠায়, তোমার ছবি দেখে তখন রাজি হয়ে যায়, আর ছুটে আসি দেশে।
–কিন্তু এসবের আমি কিছুই জানিনা কেন?
–তোমাকে জানানো হয়নি, বিয়ের সব ঠিকঠাক করে তোমাকে জানানো হতো।
–কিন্তু আমি তো এই বিয়ে চাইনি?
–কেন? তুমি কি এখনো জেরিনকে ভুলতে পারোনি?
–নাহ, আর পারবোওনা কখনো ভুলতে।
–রানা, তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে যে জেরিন আর নেই।
–হুমমম জানি, সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার সাথে আমার কথা হয়।
–তবুও সে বাস্তব নয়। তোমাকে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।
–আমি তো তার আত্মাকে নিয়েই বেশ আছি।
–রানা, একটা কথা বলি?
–বলো….
–আমাদের বিয়ের পরও আমি তোমাকে জেরিনের আত্মার সাথে মিশতে বাঁধা দেবোনা। তবুও প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা, অনেক ভালোবাসি তো তোমায়। বুঝোনা কেন তুমি?” ইশার চোখে জল দেখা দিলো এবার।
–আচ্ছা আমি ভেবে দেখবো…… আর কিছু বলবে?
–কেন? তোমার কি তাড়া আছে?
–না…
–তাহলে আরো কিছুক্ষণ থাকোনা আমার সাথে? অনেকদিন পর তোমাকে এভাবে কাছে পেয়েছি।
–আচ্ছা….. এখন কি করবে?
–তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো সারা শহরে। অনেকদিন পর দেখছি তো শহরটাকে……
–হুমমম….. ওকে….”
.
.
এরপর দিনের বাকিটা সময় ইশার সাথে কাটিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। বাসায় এসে সবার সাথে একটু রাগারাগি করলাম, কেন আমাকে কিছুই না জানিয়ে ইশার সাথে বিয়ে ঠিক করতে গেলো? রাগ করে বেরিয়ে পড়লাম রাতে বাসা থেকে। পুকুরঘাটে গিয়ে মন খারাপ করে বসে পড়লাম একা একা। পুকুরের পানির দিকে চেয়ে জেরিনের কথা ভাবতে লাগলাম। তখন জেরিন এসে পাশে বসলো আমার। বসেই জিজ্ঞেস করলো:
–মন খারাপ করে আছো কেন?”
–এমনি….
–জানোনা, তুমি মন খারাপ করলে আমার কষ্ট হয়?
–কিন্তু আমি কী করবো বুঝতেছিনা….”
–বিয়ে করে ফেলো ইশাকে…..”
–তুমি জানো ইশার কথা?
–হুমমম…. তখন তোমাদের সাথে যে আমিও ছিলাম……
–আমি কি করবো এখন বলো?
–বিয়ে করে নাও ইশাকে। আমার তো কোনো অস্তিত্ব নেই। এভাবে জীবন চলেনা রানা। তুমি বিয়ে করবা, সংসার করবা, তোমার বাবা মা কতো আশা করে আছে তোমাকে সংসারী দেখতে, তোমার ওরশে তাদের নাতিনাতনির মুখ দেখতে। তাদের আশাটা তোমার পূরণ করা উচিত। আমার শুধু আফসোস থাকবে একটাই, তোমার সাথে সংসার করতে পারলামনা, তোমার সন্তানের মা হতে চেয়েছিলাম, আফসোস তা হয়ে উঠলোনা। তবে মন থেকে চাই, ইশার সাথে তোমার সংসার জীবন সুখী হোক।
–আর তুমি কী করবে?
–আমি? আমার তো অস্তিত্ব নেই। হয়তো হারিয়ে যাবো….
–না, তুমি হারাবেনা…..
–আমি থাকলে যে তুমি ইশাকে কখনো ভালোবেসে উঠতে পারবেনা। তখন তোমার সংসারে অশান্তি নেমে আসবে।
–না, আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। তুমি যেভাবে আছো, ওভাবেই থাকো। ইশা তো রাজি, সেও বিয়ের পর তোমাকে মেনে নেবে।
–আচ্ছা, আগে বিয়ে তো হোক তোমাদের।
–হুমমম…..
–যাও, এখন আর রাগ করে থেকোনা। খাওনি রাতে তাইনা? যাও, বাসায় গিয়ে এখন খাবে। আর একটা কথা…..
–কি?
–তুমি কিন্তু ইদানীং আমার কবরে ফুল দেয়া কমিয়ে দিয়েছো।
–কাল থেকে রোজ ফুল দেবো। রাগ করোনা তুমি।
–বিয়ের পর তুমি আর ইশা মিলে রোজ রাতে আমার কবরে ফুল দিতে আসবা?
–হুমমম….”
–তাই যেন হয়….. আমি অপেক্ষা করে থাকবো। যাও এখন বাসায় গিয়ে খেয়ে নাও।
–আচ্ছা।” বলেই আমি ধীরে ধীরে হাটা দিলাম বাসার দিকে।
.
***
.
কয়েকদিন পর ইশার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। বাসর রাতে আমরা দুজন বের হলাম বাসা থেকে। আগে থেকেই অনেকগুলো ফুল সংগ্রহ করা ছিলো। দুজনে মিলে ফুলগুলো নিয়ে কবরস্থানে গেলাম। তারপর জেরিনের কবরে রাখলাম ফুলগুলো। তখন জেরিন এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। এসেই বললো:
–তোমাদের দুজনকে খুব ভালো মানিয়েছে, সুখী হও তোমরা আজীবন।”
ইশা বললো:
–জেরিন, আমি দুঃখিত তোমার ভালোবাসায় আমি ভাগ বসিয়েছি বলে, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, কখনো তোমার রানাকে কষ্ট দেবোনা।
–শুনে খুশি হলাম ইশা। আমার রানার সবকিছু খেয়াল রাখবা আজ থেকে তুমি। রানা, তুমিও জেরিনের প্রতি নজর দিবা।
–হুমমম…..” অস্ফুটে শব্দ করলাম আমি। কারণ কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার।
জেরিন আবার বললো:
–আমি আমার ভালোবাসাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম, ইশা তার যেন কখনো অযত্ন না হয়।
–তোমার ভালোবাসার কখনো অযত্ন করবোনা আমি, কথা দিলাম।
–রানা, বাসায় যাও এবার তোমরা। আজ তোমাদের মধুচন্দ্রিমা। ভালো কাটুক তোমাদের এই রাতটা।
–তুমি কি চলে যাবে এখন?” কথাটি বলার সময় কেঁপে উঠলো আমার গলাটা।
–হুমমম, আর কী করবো আমি। তোমার একটা ঠিকানা হয়েছে এখন। আমি নেই তাতে কী? আমার রানাকে আমি উপযুক্ত পাত্রীর হাতে দেখতেছি, কখনো তার অযত্ন হবেনা। আর কী চাই আমার। তুমি সুখী হও, এটাই আমার বড় চাওয়া।
–আরো কিছুক্ষণ থাকোনা তুমি?” বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। জেরিনকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। জেরিনও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভার কাঁদার পর জেরিন বললো:
–আমি মাঝেমাঝে তোমার সংসার দেখতে আসবো। আর দূর থেকে সবসময় ভালোবেসে যাবো। তোমরা ফিরে যাও এখন। আর একটা কথা…..
–কি?
–শেষবারের মতো একবার “ভালোবাসি” বলবা আমাকে?
–হুমমম, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আজীবন অটুট থাকবে এ ভালোবাসা।
–আসি তাহলে, ভালো থেকো তোমরা….” বলেই ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো জেরিন। আমি তার কবরের পাশে বসে কাঁদতে লাগলাম, আর ইশা আমার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললো:
–রানা, চলো এবার……”
আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ইশার সাথে ফিরে চললাম বাসার দিকে…….
.
.
…………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত