ভয়ংকর সেই রাত

ভয়ংকর সেই রাত
দাখিল পাস করার কয়েক মাস আগের ঘটনা, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। নাইন-টেন এই দু’বছর মাদ্রাসারই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছি। অনেকেই জানে, মাদ্রাসা বা দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে গভীর রাতে কোনো অলৌকিক বা হন্টেড ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। রাতে ভয়ংকর বা ভৌতিক কোনো কিছু টের পাওয়া যায় এসমস্ত প্রতিষ্ঠানের বাউন্ডারিতে। হ্যাঁ আসলেই তাই। ঠিক এমনই একটি ঘটনা আজ শেয়ার করতে যাচ্ছি…
মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের এক পাশে ছিল ১টি শিক্ষা ভবন, ১টি অফিস ভবন ও ১টি হেফজখানা। অন্য পাশে ছিল আরও ১টা শিক্ষা ভবন, ১টি এতিমখানা ও পাশেই রান্না-খাওয়ার ঘর। অন্য পাশে ছিল হোস্টেল এবং হোস্টেলের পিছনে ছিল ১টি ঘন কবর। বাকি পাশে ছিল রাস্তা এবং রাস্তার পাশেই ছিল কর্ণফুলি নদী। আর মাঝখানে ছিল মাঝারি আকারের একটা মাঠ। এমন একটা একটা প্লেসে রাত্রি বেলা কেমন পরিবেশ বিরাজ করে একটু ভাবুন তো!
সেদিন রাতটা ছিল খুবই কালো আর অন্ধকারচ্ছন্ন। হোস্টেলের নিয়ম অনুযায়ী আমরা ঠিক রাত ১১টার মধ্যেই যে যার বেডে শুয়ে পড়ি। কারণ ফজরের আগেই আবার সবাইকে উঠতে হয়। তো সেদিন হোস্টেল একদম খালি ছিল। কারণ পরিক্ষা শেষ হওয়াতে সবাই ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে গেছে। হোস্টেলে আমিই সবার বড় ছেলে বলে আমাকে ছুটি দেয়া হয়নি। সেদিন আমিসহ আরও ২/৩জনের মতো এত বড় হোস্টেলে ছিলাম।
যাইহোক, ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ঘুম পাতলা। ঘুমিয়ে পড়লেও আমার কানে পুরো দুনিয়ার খবর আসতো। নিত্য দিনের মতো সেদিনও নিজের বিছানায় শুয়েছি। রাত্রি যতই গভীর হতে থাকে ততই দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটার টিক-টিক শব্দ যেন আরও বাড়তে থাকে। এ আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু হঠাত্ ঘুমের ঘরেই শুনতে পাচ্ছি ঘড়িটার টিক-টিক শব্দটা চট-চট শব্দে রূপান্তর হয়েছে। মনে কেমন যেন খটকা লাগল নিত্যদিনের চেনা শব্দটার হঠাৎ এমন পরিবর্তিত সুর শুনে।
ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে আবারও ঘুমে মন দিলাম। কিছুক্ষণ পর চট-চট শব্দটা একদম স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আবারও গুরুত্ব না দিয়ে ঘুমে মন দিলাম। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর হঠাত্ দেখলাম জানালার ফাঁক দিয়ে একটা বড় মাপের ধবধবে সাদা রঙের বিড়াল রুমে ঢুকলো। আমি বিড়ালটার গায়ে টর্চ মারতেই সে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। সামান্য একটা বিড়ালের চাহনি দেখেই হঠাত্ ঘাবরে গেলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন আঁতকে উঠল। বিড়ালটা পরিচিত ছিল না। একদম অপরিচিত আর বড় আকারের স্বাস্থ্যবান একটা বিড়াল, যা মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে আগে কখনোই দেখিনি।
আমি বিড়ালটাকে রুম থেকে হিশ-হিশ করে তাড়িয়ে দিলে সে আবারও আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ-ই জানালা দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। আমার তখনো অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। তাই আমি রুমের সব জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আবারও সেই চট-চট শব্দ। এবার ঠিকঠাক লক্ষ করলাম এই চট-চট শব্দটা ঘড়ি থেকে নয়, বরং বারান্দায় কে যেন চটি পায়ে চট-চট শব্দ করে হাঁটছে, এটা সেই শব্দ। ব্যাপারটা গুরুত্ব দিলাম না, আবারও ঘুমিয়ে পরলাম। ঠিক তখনি হঠাত্ ঐ জানালাটায় ঝন ঝন করে সজোরে ৩টা থাপ্পড় দিলো। এত রাতে হঠাত্ জানালা চাপড়ানোর শব্দে একটু আঁতকে উঠলেও পরক্ষণে আবার নিজেই রিলাক্স হয়ে গেলাম। ভাবলাম, গরমের দিন তাই হয়তো বাইরে হোস্টেল সুপার হাঁটাহাঁটি করছে। আর সে হয়তো আমাকে জেগে থাকতে দেখেছে বলে ঘুমিয়ে পড়ার সংকেত দিছে। আমি আবারও আপন মনে একদম চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম বাইরে যেন কালবৈশাখি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবকিছু যেন ভেঙেচুড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে আর বিকট শব্দে ঝড় বইছে। কিন্তু ঝড়টা শুধু বারান্দার এক প্রান্ত থেকে আসে আর অন্য প্রান্তে যায়। ভাবলাম, বারান্দায় কিছু কাপড় আছে সেগুলো ভিতরে নিয়ে আসি। পরক্ষণে আবার ভাবলাম, নাহ একটু আগেই হুজুর ধমক দিয়ে গেছে। তাই এখন যদি বাইরে যাই তাহলে পরে আবার বকা দিবে। এরকম সাত-পাঁচ ভেবে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাগ্যেস ঐ টাইমে বাহিরে বের না হওয়াতেই ভালো হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম ঝড়-বাতাস একদম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাত্ বাইরে থেকে কোনো একটা পিচ্চি বাবুর কান্নার আওয়াজ আসছে। কান্নার শব্দটা প্রথমে হোস্টেলের পিছনে ঘন কবরের দিক থেকে ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে কান্নার শব্দটা বড় হচ্ছিল এবং একদম স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। কোনো একটা বাবুর কান্নার আওয়াজ ছিল এটা। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হলো, বাবুটা চালের উপর উঠে কান্না করছে। কান্না করতে করতে একবার চালের ঐ প্রান্তে যায়, আবার এই প্রান্তে আসে। বাবুটার ঐ কান্না আর চালের উপরে হাঁটার শব্দ একদমই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।
এতক্ষণে এবার একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করল। বিছানার উপরে উঠে বসলাম। কিন্তু হোস্টেলে বাকি যে ২/৩জন ছিল ওরা সবাই নাক টেনে ঘুমাচ্ছে। বড় ছেলে একটাও নেই, ওরা সব আমার চেয়ে অনেক ছোট্ট। তাই ওদের কাউকে আর ডাকিনি, কারণ ওরা এসবে আরও বেশি ভয় পাবে। তাই আমি আবার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে এক কান বালিশের সাথে আর একটা কান কম্বল দিয়ে চেপে ধরে খিস্তি মেরে শুয়ে রইলাম, যেন ঐ কান্নার শব্দট না শুনতে পারি।
হ্যাঁ এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর হঠাত্ শুনলাম দরজা খুলার শব্দ। কে যেন দরজাটা খুলে ফেলেছে। তারাতারি সিথানের কাছে থারা টর্চ লাইটটা দরজায় মারতেই দেখি হোস্টেলেরই একটা ছেলে দরজা খুলে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি তারাতারি বিছানা থেকে এক লাফ মেরে উঠেই ওর কাছে গেলাম। ও দরজা খুলে সবেমাত্র বারান্দায় নেমেছে আর আমিও ওকে পিছন থেকে একটা ডাক দিয়েই সাথে সাথে খপ করে ওর একটা হাত ধরে ফেলি। হঠাৎ বাজ পাখির মতো ওকে ছোঁ মেরে ধরে ফেলাতে ছেলেটা আমার দিকে ঘুরে তাকালো, কিন্তু আমার চোখ জোড়া ওর দিকে না পড়ে বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে চলে গেল। অতঃপর যা দেখলাম তাতে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অঘটনটা তখনই ঘটলো।
ঐ মুহূর্তে এমন একটা দৃশ্য দেখে আমি যেন ভয়ে দিকদক্ষিণা হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা। যে ছেলেটার হাত ধরছি ও মূলত টয়লেটে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এসেছে বলে চোখ ডলতে ডলতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে ভাই? আর ততক্ষণে আমি জোড়ে একটা চিত্কার দিয়ে ওকে নিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। ছেলেটা বলল, আমি প্রস্রাব করতে বের হইছি ভাইয়া, আমাকে যেতে দিলেন না কেন? কী হইছে? আমি বললাম, তুই কি বারান্দার বাইরে কিছু দেখেছিস? ও বলল, না ভাই। আমি তো আপনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।
আপনারা যদি কেউ ‘কবরের আযাব’ মুভিটা দেখে থাকেন তাহলে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন যে, ঐ মুভিটায় আজরাঈলের চরিত্রে যাকে দেখা যায় ঠিক তার চেয়েও ভয়ংকর আর বিভৎস দেখতে একটা শ্যাডো দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে। বেশ লম্বা আর কালো একটা শ্যাডোর মতো কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল ঐ বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে। কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম ওর চোখ জোড়া দেখে। একদম অগ্নিকুণ্ডের মতো দুইটা বড় বড় লাল চোখ। যদিও দূর থেকে এক পলক দেখেই ওটার দেহের আকৃতিটা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি, কিন্তু এমন লম্বা একটা কালো দেহ থেকে ওরকম দুইটা রক্তলাল চোখ দূর থেকেই যেন একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
আমি ছেলেটার সাথে আর কথা না বারিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। দেখি ঘড়িটা রাত ৩টার কাঁটায় এসে দাঁড়ানো। আমার গা থরথর করে কাঁপছিল। ছেলেটাকে রুম থেকে একটা খালি বোতল দিয়ে বললাম, এটাতে প্রস্রাব করে সকালে বোতলটা ফেলে দিস। অতঃপর ছেলেটা আমার কাঁপুনি দেখে একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞাস করল, আচ্ছা ভাইয়া। তারপর আমরা দুজন এক সাথে জড়াজড়ি দিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঠিক তখন থেকেই বারান্দায় কেমন যেন গোঙ্গানির আওয়াজ আসতে লাগল আর দরজা-জানালা ধাক্কানোর শব্দ। ভয়ংকর শব্দ করে জোরে জোরে গোঙ্গাচ্ছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে। প্রচুর ভয় পেলাম তখন। আর ঠিক এই সময়য়েই মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে যত্ত ধরনের বাজে ঘটনা ছিল তা সবই এক এক করে মাথায় এসে ঘুরপাক থেকে লাগল।
কবে বড় ডাব গাছটায় কী দেখেছিলাম, কবে মাদ্রাসার এক হুজুরকে তিন লাফে তুলা গাছে তুলেছিল, কবে এলাকার এক বুড়িকে রাতের বেলা ঝোপের ধারে আগুনের কুণ্ডলী হতে দেখা গিয়েছিল। কবে হেফজখানার একটা ছেলেকে থাপ্পড় মেরে বেহুস করে দিয়েছিল। কবে ঐ ঘন কবরের সামনে গভীর রাতে ৭জন হুজুরকে খাটিয়া নিয়ে জানাযা নামাযের স্টাইলে দাঁড়ানো দেখা গিয়েছিল, কবে গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদের ভেতর হাফেজি জ্বিন দেখা গিয়েছিল, ইত্যাদি আরও যত্ত ধরনের বাজে ঘটনা ছিল তা সবই মনের মধ্য উঁকি দিতে লাগলো।
যদিও এটা দেখে প্রচুর ভয় পেয়ে গেছিলাম, কিন্তু এর আগেও এমন বহু ঘটনার সাথে পরিচিত ছিলাম বলে নিজেকে একটু সামলে নিতে পেরেছি। ভাগ্যটা অনেক ভালো। নয়তো যেই ছেলেটা ওই টাইমে বাইরে নেমেছিল ও আর বেঁচে ফিরতো না। কারণ, পরদিন জানতে পারলাম সেই রাতটা নাকি অমাবশ্যার রাত ছিল। চারিদিক একদম কালো আর ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আর সেদিন রাতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো এরকম দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছিল। আমরা দুজন প্রচণ্ড ভয়ে দোয়া-কালাম যা যা জানতাম তা সবই পড়তে শুরু করেছি। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কারোই হিতাহিত থাকে না, কিন্তু আমি এর আগেও এসব ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতাম।
এসব ব্যাপারে আগেও অনেক এক্সপেরিয়েন্স ছিল বলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পেরেছি। আমি এটা ঠিকই জানতাম যে, পৃথিবীতে ভুত বলতে কিছুই নেই। যেসব জিনিসকে আমরা ভুত বলে জানি ওসব আসলে কোনো বাজে আত্মা, বদ জ্বিন-পরী, পেত্নী। আর কোনো বাজে জিনিস কখরোই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে গৃহের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। যা পারে সব ঘরের বাইরে, কিন্তু ভেতরে নয়। তবুও ভয়ের কারণে পরদিন প্রচণ্ড জ্বর আসে। একটানা তিন দিন শুধু গা-পোড়া জ্বর ছিল আমার। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর হুজুর পানিপরা আর কী কী ঝারফুঁক যেন করল। তারপর তিনদিন পর আবারও আগের মতো সুস্থ হয়ে গেলাম।
এই ছিল আমার মাদ্রাসা জীবনে হোস্টেলে থাকাকালীন একটি ছোট্ট ঘটনা। এরকম আরও বেশ কয়েকটা বাস্তব এক্সপেরিয়েন্স আছে আমার লাইফে। এর চেয়ে আরও ভয়ংকর একটা ঘটনা আছে আমার লাইফে, যেটা কারণে আমি এখনো মাঝে মাঝে রাতে একা ঘুমাতে পারি না। সেটা নাহয় অন্য একদিন বলব। আজ এ পর্যন্তই বি: দ্র: এটা বানিয়ে লেখা কোনো গল্প নয়। এটা আমার লাইফের একটা ভুতুরে ঘটনার অংশবিশেষ।
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত