আমি তোমাদের আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ভূত আর ভগবান নিয়ে তর্কের আজও শেষ হয়নি। যতদিন মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা থাকবে ততদিন শেষও হবে না।
এ বিষয়ে পৃথিবীর বিদ্বান এবং সাধারণ লোক দুটো মত পোষণ করেন। কেউ বলেন, বিজ্ঞান ভূতের অস্তিত্ব মানে না। কিন্তু বিজ্ঞানই কি শেষ কথা? আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে? আবার কেউ বলেন, ভূত নিশ্চয়ই আছে।
এমন ঘটনা তোমাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছ কিংবা শুনেছ, খ্যাতনামা ডাক্তাররা যে রোগীকে দিনের পর দিন চিকিৎসা করেও সুস্থ করতে পারছে না, এক সামান্য ফকির তার মাথায় হাত বুলিয়ে কিংবা একটা সামান্য রুদ্রাক্ষ ছুঁইয়ে তাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করে তুলেছে।
এতে বোঝা যায় আমাদের জানা জগতের বাইরে একটা জগৎ আছে যেটা ঠিক বিজ্ঞানের নিয়মে চলে না।
তোমরা পরজন্ম সন্মন্ধে অনেক কিছু শুনেছ।
সংবাদপত্রেও নিশ্চয়ই শুনেছ জাতিস্মর নিয়ে কত আলোচনা হচ্ছে।
সুদূর রাজস্থানে মরুর মধ্যে দিয়ে উটের পিঠে চেপে বাপের সাথে ছোট সাত বছরের ছেলে চলেছে।
হঠাৎ একটা গ্রামের কাছে এসে একটা কূটীরের দিকে আঙুল দেখিয়ে ছেলে বাপকে বলল, ” ঐ দেখো ঐ আমার বাড়ি। ওখানে আমার আত্মীয় স্বজন সবাই আছে।”
বাপ প্রথমে কড়া ধমক দিল ছেলেকে কিন্তু তাকে নিরস্ত করা গেল না। তার মুখে সেই এক কথা। সে বলতে লাগল, ” ওখানে আমার বুড়ো বাপ রয়েছে, বউ চন্দ্রা রয়েছে, ছোট ভাই এক ভোর বেলা ধাক্কা দিয়ে আমায় কূয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। তুমি চলই না ওখানে।”
কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বাপ সেই কূটিরের দিকে গেল।
দাওয়ার ওপর এক বৃদ্ধ বসে হাঁফাচ্ছে, একটি বউ জল তুলছে কূয়ো থেকে।
ছেলেটি ঊট থেকে নেমে হনহন করে হেঁটে বৃদ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
” বাবা, আমি কেশোপ্রসাদ, তোমার বড় ছেলে।”
দু চোখের ওপর কোঁচকানো মাংসের স্তর নেমেছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। বৃদ্ধ ঝুঁকে পড়ে দেখে বলল, ” দিল্লাগি করতে এসেছ? আমার বড় ছেলে আজ আট বছর মারা গেছে। ভোর বেলা জল তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল কূয়ার মধ্যে। ”
ছেলেটি বলল, ” পা পিছলে পড়ে যায় নি, মাধোপ্রসাদ তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তার মতলব ছিল, আমি না থাকলে বাজরার ক্ষেত, বাড়িঘর সব সে পাবে। ”
ইতিমধ্যে যে বৌটি জল তুলছিল সে ছেলেটির কথায় আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে এসে দাঁড়াল। তার দিকে চোখ পড়তেই ছেলেটি চেঁচিয়ে বলল, ” আরে চন্দ্রা, আমি কেশোপ্রসাদ, তোমার মরদ।”
চন্দ্রার বয়স বছর ত্রিশের কম নয়। সে সাত বছরের স্বামীকে দেখে হেসে ফেলল। চোখের কোনে একটু জলও এসে গেল। বলল, ” পাগল কোথাকার।”
ছেলেটির বর্তমান বাপ একটু পেছনে দাঁড়িয়েছিল সে এবার এগিয়ে এসে বলল, ” কি ঝামেলা করছিস! দেরী হয়ে যাচ্ছে, চল।”
ছেলেটি যাবার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। দাওয়ার ওপর বসে পড়ে সে বলতে লাগল, কোন ঘরে সে শুত, সে ঘরে কি আসবাব আছে। বাজরার ক্ষেতের পরিমাপ কত, বাপের দুবার সাঙ্ঘাতিক অসুখ করেছিল, বিকানীর থেকে সেই-ই হাকিম নিয়ে এসেছিল….আরও অনেক কথা সে বলল। সে কোন গাঁয়ে বিয়ে করেছিল, চন্দ্রার বাপের নাম কি, এমনকি বিয়ে করে বৌকে নিয়ে যখন ফিরছিল তখন মাঝপথে তুমুল বালির ঝড় উঠেছিল, সে আর চন্দ্রা সারা দেহ আবৃত করে উটের পেটের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল।
চন্দ্রা আর চন্দ্রার শ্বশুর তো অবাক। সাত বছরের ছেলে এসব কথা জানল কি করে!
এবার ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ” মাধোপ্রসাদ নেই?”
বৃদ্ধ বলল, ” তাকে ক্ষেতের মধ্যে সাপে কামড়েছিল। তুই যাবার এক বছরের মধ্যেই।”
ছেলেটির যাবার মুখেই বাধা। চন্দ্রার তাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কান্না। সে তাকে ছাড়বে না।
ছেলেটি বলল, ” আমার নবজন্ম হয়েছে। নতুন আমার ওপর তোমাদের কোনও দাবি নেই। আমার নতুন সংসার আছে, সেখানে আমার মা আছে, বাবা আছে, দাদারা আছে। সে সংসারে আমায় ফিরে যেতেই হবে। এই নিয়ম।”
ছেলেটি আবার বাপের সাথে উটের পিঠে চাপল।
তবে মাঝে মাঝে সে পুরনো সংসারেও আসত।
এই ছেলেটি জাতিস্বর।
আগের জন্মের সব কথা তার মনে আছে।
খবর পেয়ে বিখ্যাত এক গবেষক ছেলেটির সাথে দেখা করেছিলেন, তার সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। শেষে পরীক্ষা করে বলেছিলেন, ” সত্যিই এর মধ্যে কোনও কারচুপি নেই। ছেলেটির সত্যিই আগের জন্মের সব কথা মনে আছে। ”
এইরকম জাতিস্মরের কাহিনী ইদানীং অনেক শোনা যায়। শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও।
ঠিক এইরকম ভূতের কাহিনীও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।
আজ আমি এমনই এক ভূতের কাহিনী তোমাদের শোনাচ্ছি।
এ কাহিনীর সাথে আমি নিজে কিছুটা জড়িত, কাজেই এটা যে নির্ভেজাল সত্যি তা আমি তোমাদের কাছে হলফ করে বলতে পারি।
আমার একজন খুব নিকট আত্মীয়া, নাম আরতি বন্দোপাধ্যায়, এম এ, এল এল বি, কিন্তু ওকালতি করে না। একটা বেসরকারি অফিসের আইন বিভাগের উচ্চ পদস্থ অফিসার।
থাকত পাইকপাড়ায়। এক বান্ধবীর সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে।
বান্ধবীটি এক স্কুলের শিক্ষিকা। জীবন দুজনের বেশ ভালোই কাটছিল। ছুটির দিন সিনেমা দেখতে যাওয়া, অথবা আরও অনেক বান্ধবী মিলে বনভোজন কিংবা গড়ের মাঠে প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া, কত কি।
হঠাৎ আরতির বিয়ে ঠিক হলো।
পাত্রও উচ্চশিক্ষিত। এক যন্ত্রপাতির কারখানার আধা মালিক।
আরতি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ” আপনি তো অনেক কিছুর সন্ধান রাখেন। আমায় একটা বাড়ি খুঁজে দিন না।”
জিজ্ঞাসা করলাম, ” কিনবে?”
” না, না, ভাড়া নেব। খুব বড়ো নয়, দুজনের থাকবার মতো ঘর হলেই চলবে। আর একটু যেন ভালো এলাকায় হয়, আর দক্ষিন কলকাতায় দেখবেন কারন ওর কারখানাটা কালীঘাটে।”
আমি নিজে থাকি বালিগঞ্জে। একেবারে লেকের কাছে।
পরদিন থেকেই বাড়ি খোঁজা শুরু করে দিলাম। গোটা দুয়েক দালালকেও লাগিয়ে দিলাম।
অনেক বাড়ির সন্ধান এল। কিছু নিজে, কিছু আরতিকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে গেলাম।
আরতি ভারী খুঁতখুঁতে স্বভাবের মেয়ে। কোনও বাড়িই তার পছন্দ হলো না। কোন না কোন কারনে সব নাকচ করে দিল।
তিন মাস ঘোরাঘুরির পর কালীঘাট অঞ্চলে এক বাড়ির সন্ধান এল।
পার্কের সামনে প্রায় নতুন বাড়ি। সদ্য রঙ করা হয়েছে। খান তিনেক কামরা, বারান্দা, বাথরুম আবার ওরই মধ্যে একফালি উঠোনও আছে।
সেই অনুপাতে ভাড়াও খুব বেশী নয়। দুশো কুড়ি।
এ বাড়ি আরতির পছন্দ হয়ে গেল।
শুধু আরতির নয়, আরতির স্বামী আশীষেরও।
আর দেরী না করে সেদিনই দুমাসের ভাড়া আগাম দেওয়া হলো।
মাসখানেক পর আরতির বাসায় বেড়াতে গিয়ে খুব ভালো লাগল।
নতুন আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে। উঠোনের পাশে সারি সারি ফুলের টব। দেশী ফুল বেল, জুঁই যেমন আছে, তেমনি বিদেশী ডালিয়া, পাপি, হলিককও রয়েছে।
এমন বাসা খুঁজে দেবার জন্য আরতি আর আশীষ বারবার আমায় ধন্যবাদ দিল।
এরপর অনেকদিন আর আরতির সাথে দেখা হয় নি। অফিসের কাজে দিল্লী যেতে হয়েছিল। সেখানে তিনমাস কাটিয়ে এবার কানপুর যেতে হল। সেখানেও একমাসের ওপর লেগে গেল।
কলকাতা ফিরলাম প্রায় পাঁচমাস পর।
এক ছুটির দিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে গল্প করছি। আরতি এসে ঢুকল।
প্রথম নজরেই মনে হলো চেহারা একটু ম্লান।
আরতি ভেতরে চলে গেল।
বন্ধুরা একসময় বিদায় হতে আমিও ভেতরে গেলাম। দেখলাম আরতি চুপচাপ সোফার ওপর বসে আছে। আমায় দেখে বলল, ” আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
আমি বললাম, ” কি বল? শরীর খারাপ নাকি? চেহারাটা কেমন দেখাচ্ছে।”
আরতি মুখ তুলে বলল, ” রাত্রে একেবারে ঘুম হচ্ছে না।”
বললাম, ” সেকি! ডাক্তার দেখাও, নইলে শক্ত অসুখে পড়ে যাবে।”
” ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।”
” মানে?”
” মানে বাড়িটা ভালো নয়।”
” কেন? অন্ধকার বা স্যাঁতসেঁতে এমন তো নয়। রোদ বাতাস প্রচুর। ”
” সে সব কিছু নয়। অন্য ভয় আছে।”
” আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
আরতি এবার আস্তে আস্তে বলল, ” ও বাড়িতে আমরা দুজন ছাড়াও অন্য একজন আছে।”
” অন্য একজন আছে?”
” হ্যাঁ, মাঝে মাঝে তাকে গভীর রাতে দেখা যায়।”
অন্য লোক হলে আরতির এই কথাটা হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু আমি মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমার স্থির ধারণা যারা অতৃপ্ত কামনা বাসনা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, তারা ফিরে আসে। কখনো বায়বীয় মূর্তি, কখনো মানুষের রূপ ধরে ফেলে যাওয়া সংসারের মাঝখানে ঘুরে বেড়ায়।
বললাম, ” কি ব্যাপার খুলে বলো তো।”
” বলছি।”
আরতি কোলের ওপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রাখল। সহজ হয়ে বসে বলতে লাগল:-
” মাস দুয়েক আগে মাঝরাত্রে হঠাৎ খুটখাট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো যেম বাইরের ঘরে কার পায়ের আওয়াজ।
আশীষ পাশেই শুয়েছিল। তার ঘুমের বহর তো জানেনই। বুকের ওপর দিয়ে এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য চলে গেলেও ঘুম ভাঙবে না।
কাজেই তাকে ডাকার চেষ্টা না করে নিজেই উঠে পড়লাম।
ভীতু এ বদনাম কেউ দিতে পারবে না। বরং সবাই জানে আমি রীতিমত সাহসী।
প্রথমে জানলা দিয়ে দেখলাম। কিছু দেখা গেল না।
কিন্তু খুটখাট শব্দ ঠিক চলতে লাগল। মনে হলো খড়ম পায়ে দিয়ে কে যেন পায়চারি করছে।
অথচ কোনও লোককে দেখা গেল না।
রাতে মাংস রান্না হয়েছিল। হাড়ের টুকরো রান্নাঘরে প্লেটের ওপর পড়েছিল। খুব সম্ভবত ইঁদুর সেই হাড়ের টুকরো বাইরের ঘরে নিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বিছানায় এসে শুলাম।
তখনি ঘুম এল না। একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে চট করে আমার ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম।
পাশের লোকটি অকাতরে নিদ্রা যাচ্ছে। নাক দিয়ে বিচিত্র ধ্বনি বের হচ্ছে।
ঘরে হালকা সবুজ রঙের একটা বাতি জ্বলছিল। অন্ধকারে আমার ঘুম আসে না। এ আমার ছেলেবেলার অভ্যাস।
হঠাৎ দেখলাম দীর্ঘ একটা ছায়া আলোকে আড়াল করে এ ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেল।
চমকে উঠে বসলাম।
আশীষকে ডেকে তুললাম।
” এই ওঠো, ওঠো, ঘরে কে ঢুকেছে।”
আশ্চর্য মানুষ। চোখ খুলল না! পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ” ফ্লিট দিয়ে দাও।”
ওদিকে ছায়াটা সরে সরে বাইরের দেওয়ালের সাথে মিশে গেল। আর দেখা গেল না।
আমি তখন বিছানার ওপর উঠে বসেছি। মনকে বোঝালাম এ শুধু আমার চোখের ভুল। নইলে ছায়াটাকে দেখা গেল, অথচ মানুষটাকে দেখা গেল না। তা কি করে হয়!
ভূতের কথা ভাবতেও পারিনি, কারণ ভূত আছে, এমন অদ্ভুত কথা আমি কোনওদিনই বিশ্বাস করি না।”
আমি মনোযোগ দিয়ে আরতির কথা শুনছিলাম। বললাম, ” তারপর? ”
আরতি বলতে লাগল, ” তারপর দিন কুড়ি সব স্বাভাবিক। কোনও গোলমাল নেই। সে রাতে ভয় পেয়েছিলাম ভেবেই হাসি পেত। একেবারে ছেলেমানুষি কান্ড।
আশীষ অফিসের কাজে দিন চারেকের জন্য জামশেদপুর গিয়েছিল। বাড়িতে আমি একা।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
এবার একেবারে স্পষ্ট দেখলাম।
দীর্ঘ একহারা চেহারা। খালি গা। কাঁধের ওপর ধবধবে সাদা উপবীত। কোঁচাটা ভাঁজ করে সামনে গোঁজা। মাথাভর্তি পাকা চুল। দুটি চোখ জবাফুলের মতো লাল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মধ্য দিয়ে উঁচু চোয়াল দেখা যাচ্ছে।
লোকটির ঊর্ধ্বদৃষ্টি। হাতে একটা শক্ত দড়ি। ওপর দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে।
সেই মূহুর্তে আমার শরীরের সব রক্ত জমে হিমশীতল হয়ে গেল। দু হাতে বুকটা চেপে ধরেও দ্রুত স্পন্দন কমাতে পারলাম না। মনে হলো তখনি হার্টফেল করব।
বিকৃতকন্ঠে বললাম, ” কে, কে ওখানে?”
লোকটি ওপর থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আমার দিকে দেখল।
জ্বলন্ত দৃষ্টি। পলকহীন।
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
তখনি মনে হলো লোকটা এ জগতের কেউ নয়। অশরীরী আত্মা।
লোকটা ধীরে ধীরে পাশের ঘরে ঢুকে গেল।
আমিও খাট থেকে নামলাম বটে, কিন্তু তার পিছু পিছু যাবার সাহস হলো না।”
এসব কথা বলবার সময় দেখলাম আরতির চোখমুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
আমি বললাম, ” এরকম যখন ব্যাপার, তখন না হয় এ বাড়ি ছেড়ে দাও, অন্য কোথাও বাড়ি খুঁজি।”
আরতি বলল, ” তাতেও তো মুশকিল। আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেন নি, আমি বাড়ির দেওয়াল ভেঙেচুরে দুটো ঘর বাড়িয়েছি। বাইরেটা চুনকাম করেছি, ভেতরে রঙ দিয়েছি। গ্যাস বসাবার জন্য রান্নাঘরেরও অনেক অদল বদল করেছি। এসব অবশ্য বাড়িওয়ালার মত নিয়েই করেছি। ভাড়া থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা কেটে রাখছি। সে টাকা শোধ হতে বছর দুয়েক লেগে যাবে। তার আগে বাড়ি ছাড়লে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।”
একটু ভেবে বললাম, ” ঠিক আছে, আমি একবার তোমার বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করব। তিনি কি বলেন শুনি।”
দিন দুয়েকের মধ্যেই আমি আরতির বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলাম। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, বিপুলাকায়। কলকাতায় বেশ কিছু বাড়ি আছে, কাঠের ব্যবসা।
আমায় দেখে ওঠবার চেষ্টা করল, পারল না।
বলল, ” কি ব্যাপার? আমার কাছে হঠাৎ?”
আমি তখন আরতির কাছে শোনা সবকিছু বললাম, তারপর বললাম, ” ঠিক করে বলুন তো মশাই, ও বাড়ির কি কোনও দোষ টোষ আছে? মানে কেউ কি ও বাড়িতে অপঘাতে মারা গিয়েছিল? আগের কোনও ভাড়াটে?”
বাড়িওয়ালা বলল, ” অপঘাত কি বলছেন মশাই? এমনি মৃত্যুই কারো হয়নি। তাছাড়া আজকের যুগে মানুষ যখন পায়চারী করার জন্য চাঁদে যাচ্ছে, তখন কিসব ভূতপ্রেতের কাহিনী আমদানি করছেন?”
আমি আর তর্কে গেলাম না। চলে এলাম। অনেক কিছু আছে, যা তর্ক করে বোঝান যায় না। স্থুল উদাহরণ দেওয়া যেখানে সম্ভব নয়।
তারপর মাস দুয়েক আরতির কোনও খবর নেই।
আমিও নিশ্চিন্ত, যাক অপদেবতার উপদ্রব আর নেই।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে একদিন সকালে আশীষ এল।
কোটরগত চোখ, বিবর্ণ মুখ, ঘোলাটে দৃষ্টি।
বললাম, ” কি হে, শরীর খারাপ নাকি?”
আশীষ উত্তর দিল না। অস্পষ্ট গলায় বলল, ” এক গ্লাস জল দিন।”
শুধু জল খেল না, মুখে চোখেও ঝাপটা দিল। তারপর বলল, ” আরতিকে টালিগঞ্জে তার দিদির বাড়িতে দিয়ে এসেছি। কালীঘাটের বাড়িতে আর আমাদের থাকা চলবে না।”
” কেন কি হলো?”
” আরতির কাছে আপনি তো কিছু কিছু শুনেছেন। আমি এতদিন কিছু দেখিনি কিংবা কোনও শব্দও শুনিনি। তাই এতদিন আমি আরতির সাথে হাসি ঠাট্টা করতাম। তাছাড়া ভূতপ্রেতে আমার কোনওদিনই বিশ্বাস নেই। কিন্তু গতরাতে যা হলো…..
আশীষ বলতে লাগল:
” কাল রাতে একটা বিশেষ কাজে হাওড়ায় আটকে পড়েছিলাম। বাস বন্ধ। ট্যাক্সিও পাই না। কিছুটা হেঁটে তারপর ট্রামে চড়ে বাড়ি পৌঁছতে রাত বারোটা বেজে গেল।
আরতি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।
যাক, আরতিকে খাবার সাজাতে বলে আমি বাথরুমে গেলাম হাত মুখ ধুতে।
নীচু হয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথায় ঠক করে কি একটা ঠেকল।
বাথরুমে আবার কে কি রাখল!
একটু কমজোর বাতি। কিন্তু সেই আলোতেই দেখতে কোনও অসুবিধা হলো না।
ঠান্ডা একটা বরফের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল।
বাথরুমটায় এসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া। আগে টালির ছাদ ছিল। আমরাই খরচ করে এসবেস্টস দিয়ে নিয়েছিলাম। ওপরে দুটো কাঠের কড়ি।
একটা কড়িতে দেহটা ঝুলছে।
গলায় দড়ির ফাঁস। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়েছে। পরনে আধময়লা ধুতি, কাঁধে পৈতে। দুটো চোখ আধবোজা। জিভটা অনেকখানি বের হয়ে এসেছে। বোধহয় জিভের ওপর দাঁতের চাপ পড়েছিল, জিভ কেটে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়েছে। কিছুটা দেহের ওপর, কিছুটা মেঝেতে।
মাথা উঁচু করবার সময় ঝুলন্ত দেহের একটা পা আমার মাথায় ঠেকে গিয়েছিল।
আমি সবকিছু ভুলে ‘ আরতি’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
আরতি আমার অপেক্ষায় খাবার টেবিলে বসে ছিল।
আমার চিৎকারে ছুটে এসে বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়াল।
প্রথমে সে সঠিক কিছু বুঝতে পারেনি।
তারপর ওপর দিকে চোখ যেতেই ‘ও মাগো’ বলে মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান।
আরতির মুখে চোখে জলের ছিটে দিয়ে কোনওরকমে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলাম।
তারপর বাকি রাতটা দুজনে বাইরের ঘরে বসে কাটালাম।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম ট্রামে চেপে যখন আরতিকে ওর দিদির বাড়িতে দিয়ে এলাম, জ্বরে আরতির গা পুড়ে যাচ্ছে। দুটো চোখ করমচার মতো লাল।”
আমি এতক্ষণ সব শুনে গেলাম। আশীষের কথা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করলাম, ” আরতি এখন কেমন আছে?”
আশীষ বলল, ” খুব ভালো নেই। বিকারের ঘোরে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে, ওই লোকটা, ওই লোকটাই তো ঘুরে বেড়াচ্ছিল দড়ি হাতে নিয়ে। আমি এখানে থাকব না। আমায় অন্য কোথাও নিয়ে চলো।
অবশ্য আরতির জন্য খুব চিন্তা নেই। ভয়টা কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু নিজের চোখে দেখবার দারুণ ইচ্ছে হলো।
এমন তো নয়, কোনওসময় বাড়ি খোলা পেয়ে বাইরের কোনও লোক ঢুকে পড়ে আত্মহত্যা করেছে? সে হয়ত আত্মহত্যা করার জন্য একটা নির্জন জায়গা খুঁজছিল।
তাই আশীষকে বললাম, ” চলো, তোমার সঙ্গে একবার ও বাড়িতে যাই। তাছাড়া তোমরা ব্যাপারটাকে ভৌতিক ভাবছ, সেরকম তো নাও হতে পারে। পুলিশে খবর দেওয়াও তোমাদের একটা কর্তব্য। তারা এসে মৃতদেহের ভার নিক।”
আশীষ আমার সঙ্গে চলল।
তালা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম।
বাথরুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। কোথাও কিছু নেই, সব পরিষ্কার। আশীষকে বললাম,” কই হে, কোথায় তোমার ঝুলন্ত দেহ? রক্তের একটি ফোঁটাও তো কোথাও দেখছি না।”
আশীষ রীতিমতো অপ্রস্তুত।
” সব চোখের ভুল বুঝলে?”
আশীষ মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ” কিন্তু দুজনেই ভুল দেখলাম?”
” ওরকম হয়। একজনের ভয় অন্যজনের ভেতর সঞ্চারিত হয়ে তাকেও এক ধরনের কাল্পনিক দৃশ্য দেখায়। নইলে তুমিই বলো না, কাল রাতে সত্যিই যদি তুমি ওরকম একটা দৃশ্য দেখে থাকো, আজ সকালে কোথাও কিছু নেই, এটা কি হতে পারে? এইখানটাতেই তো দেখেছিলে?”….বলে ওপর দিকে তাকাতেই আমার মুখের কথা আটকে গেল।
আশ্চর্য! এটা তো আগে দেখিনি!
বাথরুমের ছাদের কড়ির সাথে একটা মোটা দড়ি বাঁধা। দড়িটা ফাঁসের আকারে ঝুলছে।
অস্বীকার করব না, আমার হাত পা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। বুকের দাপাদাপি এত জোরে হলো, ভয় হলো, স্পন্দন থেমে না যায়।
এই দড়ির ফাঁস তো প্রথমবার দেখিনি। আরও আশ্চর্য, দড়ির ফাঁসটা আবার অল্প অল্প দুলছে। অথচ আশেপাশে কোথাও বাতাস নেই। বাইরে বাতাস থাকলেও বাথরুমে বাতাস ঢোকবার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
আশীষের সঙ্গে চলে এলাম। এটা যে ভৌতিক ঘটনা নয়, কোনও মানুষের কারসাজি হওয়াও অসম্ভব নয়। হাজার যুক্তিতক্কো বিস্তার করেও সমাধান করতে পারলাম না।
আরতিরা আর ও বাড়িতে ফিরে যায়নি। ভবানীপুরে একটা বাড়ি ঠিক করে উঠে গিয়েছিল। আর্থিক লোকসান স্বত্ত্বেও।
এই ঘটনার প্রায় মাস তিনেক পর এক বিকেলে কালীঘাট পার্ক দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ আরতির বাড়িওয়ালার সাথে দেখা। একটা বেঞ্চে বসে আছে।
আমি তার পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ” মশাই, সত্যি বলুন তো, বাড়িটার কি রহস্য? আমার আত্মীয়াটি তো থাকতেই পারল না, পালাল……”
প্রথমে কিছুতেই বলবে না। অনেক পীড়াপীড়ির পর শেষে বলল, ” এক বুড়ো ভদ্রলোক ঐ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিল। তা প্রায় বছর দশেক আগে। পেটে শূলবেদনা ছিল। বাড়ির সবাই নেমন্তন্ন খেতে বাইরে গিয়েছিল। সেইসময় বুড়ো বাথরুমে ঢুকে গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকে যে ভাড়াটে আসে, তারাই ভয় পায়, বেশীদিন থাকতে পারে না। ”
বললাম, ” গয়ায় পিন্ডদানের ব্যবস্থা করেন নি কেন?”
” করেছি মশাই অনেকবার করেছি। প্রত্যেকবারই এক একটা বিপদ। বুড়োর আত্মীয়রা গয়া গিয়েছিল পিন্ড দিতে, তিনদিন ধরে দারুণ ঝড়বৃষ্টি, ধরমশালা থেকে বের হতেই পারল না। আমি নিজেও একবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ট্রেন থেকে স্টেশনে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে একমাস হাসপাতালে শয্যাগত।
পুরোহিত দিয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়নের আয়োজন করেছিলাম, সেখানেও বিপত্তি। পুরোহিত আসনে বসবার সাথে সাথে ছাদ ভেঙে একটা চাঙড় তার মাথায় পড়ল। পুরোহিত জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
তারপর থেকে আর কোনও পুরোহিতই আসতে রাজি হলো না। কি করি বলুন তো?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। তাই সেদিন বাড়িওয়ালার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারিনি।
একটা কথা শুধু মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব অবিশ্বাসী মানুষদের জড় করে চিৎকার করে বলি, ” যারা মনে করেন মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু শেষ হয়ে যায়, প্রেতযোনি বলে কিছু নেই, তারা কালীঘাট অঞ্চলের এই বাড়িটায় রাত কাটিয়ে যান। বাড়িটা এখনো খালি।
অবশ্য আমি ভালো মন্দ কোনকিছুর জন্য দায়ী থাকব না। এই মর্মে আমায় একটা লিখিত চুক্তিপত্র দিতে হবে।”