আমি ভূতে বিশ্বাসী না৷ তবে পরিবেশটা ভয়ংকর রকমের থমথমে৷ চারপাশের সব কিছু বুকের ভেতর কেমন এক চাপা ভূতের ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে৷ আকাশে পূর্ন জ্যােৎস্না৷ এর মাঝেও স্টেশনটি ডুবে আছে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে৷ আমি ট্রেনের বগিতে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি৷ ছোট স্টেশন৷ তবে বেশ গুছানো৷ স্টেশনে বৈদ্যুতিক বাতির সংখ্যা, হাতে গুনে মোটে পাঁচটা৷ তার মধ্যে দুটি জ্বলছে আর নিভছে৷ বাতি জ্বলা নিভা দেখলে প্রথমে মনে পড়ে ভৌতিক সিনেমার কথা৷ সেখানে ভূত আসার আগে, এমন করে বাতি জ্বলে আর নিভে৷
প্লাটফর্মে প্রানীর হিসেব করলে দাঁড়াবে চার সংখ্যায়৷
বৃদ্ধ করে এক লোক৷ যে কিনা ব্যাঞ্চে বসে খাতায় কি যেন লিখছে৷ পোশাকে মনে হয় স্টেশন মাস্টার৷ খানিকটা বা পাশে একটি চায়ের দোকান৷ দোকানী বসে বসে ঘুমোচ্ছে৷ সেই দোকানের সামনে পাগল ধরনের এক লোক লাঠি হাতে বসে আছে৷ এই গরমেও সে কানটুপি, গলায় মাফলার, আর ছিড়া ফ্যাড়া কোর্ট গায়ে জড়িয়ে আছে৷ তার পাশেই একটা কুকুর শুয়ে লেজ নাড়াচ্ছে৷
আমার দৃষ্টি যতদূর যায়, এই চারটি প্রানী বাদে আর কোন প্রানীকে আবিষ্কার করতে পারে না৷
কোন এক পত্রিকায় রাশির কলামে পড়েছিলাম, বৃশ্চিক রাশিদের জন্য “নয়”সংখ্যা অশুভ৷ ঘোর অশুভ৷ আমি এসব গণকেও বিশ্বাসী না৷ তবে আমার মস্তিষ্কে এখন নয়ের হিসেব ঘুড়ছে৷ পাঁচটি বাতি৷ চারটি প্রাণী৷
হিসেব নিকেশ বাদ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে এসে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি তিনটে নয় বাজে৷ ঘড়িতেও নয়!
দরজায় দাঁড়িয়ে ডান পাশে তাকিয়ে দেখি, মরিচা পড়া স্টিলের বোর্ডে লেখা নয়ণমনি স্টেশন৷ ঐ নামের প্রথম দুই অক্ষরের নয় নিয়ে ভাবতেই, স্টেশন মাষ্টার আমার দিকে এগিয়ে এলেন৷ বললেন,
‘আপনি কি একাই এসেছেন?’
বোর্ডের থেকে চোখ সরিয়ে ভদ্রোলকটির ওপর রাখতেই দেখলাম হাসিমাখা মুখ৷ দেখে একটু স্বস্তি পেলাম৷ চারদিক যেমন থমথমে পরিবেশ, তার ওপর মাথায় গাজাখুরি নয় ছয় ঘুড়ছিলো৷ লোকটির হাসি দেখে এখন সব কিছু ঠিক ঠাক মনে হচ্ছে৷
আমি স্টেশনে পা রাখতেই আমার ব্যাগের বেল্টটি ট্রেনের দরজায় বেঁধে গেল৷
ছোট বেলায় যখন স্কুলে যেতাম৷ যাওয়ার আগে তারাহুরা করে বেরুবার সময় কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খেলে, মা বলতেন একটু থেমে দাঁড়িয়ে যেতে৷ তানা হলে যাত্রায় কোন বিপদ ঘটে৷
এসব কুসংস্কারে আমি মাথা ঘামাতাম না কখনই৷ ব্যাগের বেল্ট ছাড়িয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে বললাম, ‘জ্বি একাই এসেছি৷’ ভদ্রলোকটির শার্টে নাম প্লেটে মতিন লিখা৷ সে পতাকা নাড়াতেই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি ছেড়ে দিল৷
আমি বললাম, ‘মানবশূন্য স্টেশন৷ কোন লোকজন দেখছি না৷ ট্রেন থেকে আমি বাদে আর অন্য কেউতো নামলো না!’
মতিন সাহেব পূনরায় হাসলেন৷ তবে এই হাসিটা দেখে আমার মনে তখনকার মত স্বস্তি এলো না৷ এবার হাসির মাঝে এক চাপা রহস্য দেখতে পেলাম৷
উনি বললেন—‘এখানে কেউতো নামে না৷ তাই আশে পাশেও মানুষ নাই৷ আপনাকে নামতে দেখে বেশ অবাক হয়েছি!’
‘অবাক হওয়ার কি আছে! এটা স্টেশন৷ যে কোন যাত্রী চাইলেই নামতে পারে৷ আর এইদিকের মানুষ বোধ হয় এই স্টেশন দিয়েই যাতায়ত করে’৷
ভদ্রোলক রহস্যের হাসিটা এবার একটু চওড়া করলেন৷ বললেন, ‘এদিকের মানুষ সামনের ময়নামতী স্টেশনে নামে৷ আর বহু বছর পর আপনি নামলেন এখানে৷’
লোকটির রহস্যের হাসির সাথে কথা বার্তাও রহস্যময় হয়ে দাঁড়াল৷ আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, ‘বহু বছর পর মানে৷ এদিকের মানুষ এই স্টেশনে না নেমে সেই দশ কিলোমিটার দূরের স্টেশনে কেন নামতে যাবে?’
লোকটি আমার এ কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে আগ্রহ দেখালো না৷ অন্য প্রসঙ্গে বলল, ‘আপনি কি ঢাকা থেকে এসেছেন?’
‘জ্বি৷ আমার এক বন্ধুর কাছে এসেছি৷’
‘ভালো৷ একাই যাবেন বন্ধুর বাড়ি? পথ ঘাট কিছু চেনেন? আর চিনে থাকলেও লাভ নেই৷ এদিকে গাড়ির কোন ব্যবস্থা নাই৷’
‘আমি ময়নামতী স্টেশনেই নামতে চেয়েছিলাম৷ হটাৎ-ই আমার কেমন মাথা ধরে যাওয়ায় বাথরুমে যাই৷ কিছুখন পর ট্রেন ছেড়ে দেয়৷ বন্ধুকে ফোন করে বলেছি৷ ও বলেছে এখানে নেমে দাঁড়াতে৷ ও বাইক নিয়ে আসবে৷ ঘন্টা দুয়েক লাগবে আসতে৷’
‘যাক, এটা ভালো৷ বন্ধু আসার আগ পর্যন্তু আপনি বরং আমার রুমেই বিশ্রাম করুন৷’
—‘আপনি এখানেই থাকেন?’
—‘জ্বি’
—‘পরিবারের বাকি সদস্য?’
—‘আমার বিয়ে করা হয়ে উঠে নাই’৷
—‘ওহ! কত বছর ধরে এই চাকরি করছেন?’
—‘তা প্রায় পনের বছর হবে’৷
—‘পনের বছর কি এখানেই?’
—‘জ্বি, মাঝে অবশ্য অন্য একটি স্টেশনে গিয়েছিলাম৷ কিছু দিনের জন্য৷ এই স্টেশনে যাকে অানা হয়েছিলো৷ সে তিন দিন থেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে৷ তাই স্টেশনে আবার এসেছি৷ লোক জন নেই৷ ট্রেনের সিডিউল নেই৷ ঝামেলাও নেই৷ তাই বেশ আছি৷’
—‘সেই লোকটি চাকরি কেন ছেড়েছিলো?’
লোকটি এবার হাসল কপালের ভ্রুঁ কুচকিয়ে৷ আমার এই প্রশ্নটি উনার পছন্দ হয়নি তা হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম৷ কিন্তু স্পষ্ট হলাম উনার সরাসরি কথায়৷
‘সব কিছুর প্রতি বেশি আগ্রহ ভালো না৷ উৎসাহ, আগ্রহ যত হাতের মুঠোয় রাখা যায়৷ মানুষের জন্য ততই ভালো৷ আর এই স্টেশনে যতখন সময় কাটাবেন৷ নিজের আগ্রহটাকে বিসর্জন দিতে পারলেই মঙ্গল৷’
—‘কেন! কোন কিছুর হুমকি আছে?’
—‘হা হা হা! হুমকি বলতে কিছু নেই এই পৃথিবীতে৷ মানুষের অতিরিক্ত আগ্রহের পরিনাম হিসেবে একটি খারাপ প্রভাব ফেলে৷ আর তা ছাড়া আমরা তো বেঁচে আছি৷ সুতরাং কোন হুমকি নেই৷’
আমরা শব্দটা শুনে আমি তাকালাম ঐ পাগল লোকটির দিকে৷ লোকটি আড় চোখে আমাকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে৷ আর মুদি দোকানী এখনো ঘুমাচ্ছে৷ কুকুরটি সাপের ফোনা তোলার মত মাথা জাগিয়ে আমাকে দেখছে৷
মতিন সাহেব রুমের সামনে এসে বলল, ‘আপনি ভেতরে বসেন৷ আপনার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি৷ চা খাবেন তো?’ আমি মাথা ঝাকিয়ে সাই দিয়ে বললাম, ‘আপনার যদি কষ্ট না হয়’৷
ভদ্রলোক পাশের আরেকটি ঘরে ঢুকে পড়লেন৷ সম্ভবত ঐটা রান্না ঘর৷ আমি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম৷
আমি ভূতে বিশ্বাসী না৷ ভূতের ভয়ও নেই৷ শুনেছি অশ্বরীরী বলে কিছু থাকে আমাদের আশ পাশে৷ সেসবেও আমার মাথা ব্যাথা নেই৷ কিন্তু চারপাশের পরিবেশটা কেমন ঝিম মেরে আছে৷ অন্ধকার যেন আরো ঘনিয়ে আসছে৷ আকাশের এত সুন্দর চাদের কি এক ফোঁটা আলোও পড়ছেনা এই স্টেশনে!
সব কিছু মিলিয়ে বুকের মধ্যে কেমন এক চাপা ভয় কাজ করছে৷ ভয়টা ভূতের বা আধ্যাত্মিক কিছুর কিনা তা এড়ানোর জন্য নিজের মনকে বলার চেষ্টা করছিযে, এই পরিবেশে আমি অভ্যস্ত না বলে এমন লাগছে৷ কিন্তু যতই নিজেকে বুঝাই, তবুও একটা চাপা ভৌতিক ভয় ঠিকই কাজ করছে৷
বন্ধু রাতুলকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করেছি৷ নেটওয়ার্কের এক ছিটেফোঁটাও নেই৷
হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে৷ সেটি দিয়েই আরেকটি ধরালাম৷ বড় বড় লেখক, মনীষীরা ঠিকই বলতেন৷ সিগারেট কিংবা তামাক নার্ভ শক্ত রাখে৷
দুই আঙ্গুলের মাঝের সিগারেটটা এখন আমার কাছে বেশ আপন মনে হচ্ছে৷
নিঃশব্দে মিনিট দুয়েক সিগারেট ফুঁকার মাঝেই, স্টেশনের অন্ধকারের ঘনত্ব যেন খানিকটা বেড়ে গেল৷ পাঁচটি বাতির মধ্যে যে দুটি টিপ টিপ করে জ্বলছিলো৷ ধাপ করে সে দুটি বন্ধ হয়ে গেল৷ পূর্ন জ্যােস্নার নিচে স্টেশনটি এক অদ্ভুত অন্ধকারে ঢাকা পড়লো, এর মাঝেই আমার দৃষ্টি গেলো এক যুবতী মেয়ের ওপর৷ চায়ের কাপ হাতে করে আমার দিকেই আসছে সে৷ স্টেশনের অদ্ভুত চারটি প্রানের বাইরেও যে আরেকটি কোমল প্রান আছে৷ তাই দেখে স্বস্তি বোধ হলো৷
মেয়েটির দিকে দৃষ্টি স্থির রাখতেই সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ মেয়েটির মুখশ্রী মায়াবী৷ লম্বা চুল ছেড়ে রেখেছে পীঠের ওপর৷ দৈহিক গঠনো বেশ আকর্ষণীয়৷ সব মিলিয়ে রূপবতী একটা মেয়ে৷ চোখে এক প্রকার রহস্য খেলা করছে৷
আমার মুখের কাছে চায়ের কাপ উচিয়ে ধরল সে৷ বলল, ‘আপনার চা’৷
—‘মতিন সাহেব আমার জন্য চা আনতে গিয়েছেন৷’
—‘উনিই আমাকে পাঠিয়েছে৷ বলেছে আপনাকে যেন চা দিয়ে আসি৷ হটাৎ উনার মাথা ব্যাথা উঠেছে৷ তাই গিয়ে শুয়ে পড়েছে৷
মেয়েটি কথার ভঙ্গি, কথার বলার মাঝে ঠোঁটে মুচকি হাসি৷ গায়ের থেকে হালকা সুগন্ধি৷ সব কিছু মিলিয়ে কেমন আমাকে হিপনোটাইজ করে দিচ্ছে৷ এমন অদ্ভুত পারফিউমের ঘ্রাণ, এর আগে কখনো পাইনি৷ কয়েক মুহূর্ত আমি সব ভৌতিক ব্যাপার ভুলে, মতিন সাহেবের রহস্যময় কথা ভুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি৷ সাধারন একটা মেয়ে৷ তবুও এক অসাধারন ঘোরের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি৷ স্টেশনের অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে৷ আমি তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি৷
এমন সময় আঙ্গুলের মাঝে সিগারেটের আগুনের ছ্যাক লাগতেই আমার হুশ ফিরে এলো৷ ততক্ষনাৎ মনে হলো মতিন সাহেবের কথা৷ আমি সিগারেটের শেষটুকু ফেলে দিয়ে মেয়েটির হাত থেকে চায়ের কাপটি গ্রহন করে বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না৷ আপনার পরিচয়টা?’ প্রশ্ন শুনে মেয়েটি হাসলো৷ সরল হাসি৷ হেসে বলল, ‘আমার পরিচয় দিয়ে কি হবে?’
‘অচেনা এক জায়গায়, অচেনা এক মেয়ে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল৷ আর আমি তার পরচিয়টা জানতে চাইবো না?’
মেয়েটি ঠোঁটের হাসি কমাল৷ তবে বিন্দু বিন্দু হাসি ঠোঁটে লেগে আছে৷ বলল, ‘আমার নাম রুনা৷’
—‘ওহ আচ্ছা, মতিন সাহেবের কাছে থেকে যতদূর শুনেছি৷ এখানে উনি ছাড়া আর কেউ থাকেন না৷ তবে আপনি?’
—‘উনি আমার চাচা হোন৷ আমার বাবা মা নেই৷ উনার কাছেই বড় হয়েছি৷ রাত বিরাতে কত জায়গা থেকে কত রকমের মানুষ আসে৷ তাই কোন ট্রেন আসলে, আমাকে ঘর থেকে বেরুতে নিষেধ করেন৷ যেন কারো কুনজরে না পড়ি৷ আপনাকে ভালো মানুষ মনে হয়েছে৷ তাই আমাকে বলেছে ঘন্টা দুয়েক যেন আপনার সঙ্গেই থাকি৷ আপনার বন্ধু আসবে তাই না?’
—‘হ্যা, তবে উনি যে বললেন, এ স্টেশনে কেউ আসে না৷’
—‘চাচা আপনাকে ভয় দেখিয়েছে, যেন আপনি ভয়ের মধ্যে থাকেন৷ এবং এ স্টেশনের রূপবতী মেয়েটির দিকে কুনজর দেয়ার মানষিকতা না আসে৷’
কথাটি বলেই মেয়েটি ঠোঁটের বিন্দু বিন্দু জমা হাসি ছড়িয়ে দিল সারা গায়ে৷ মেয়েটির হাসির সাথে শরীর দুলছে৷ রুনার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকতেই, আমি যেন হিপনোটাইজ হয়ে যাচ্ছি৷ মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলাম মেয়েটির কাছে থেকে৷
রুনা বলল, ‘দুঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবেন৷ চলুন সামনের দিকে একটু হাটা যাক’৷
পৃথিবীতে এক প্রকৃতির মেয়ে আছে৷ যারা এক বিশেষ ক্ষমতার বলে ওপর একজন মানুষকে খুব সহজেই বশে আনতে পারে৷ খুব রূপবতী মেয়েরা তা পারে না৷ মাঝারি ধাচের কিছু মেয়েদের মাঝে এই বিশেষ গুনটি থাকে৷
আমি হ্যা বা না কিছু বলার আগেই বুঝলাম আমি পা বাড়িয়েছি হাটার জন্য৷ রুনা পাশ থেকে বলল, ‘চা খাচ্ছেন না কেন? ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷’
আমি চায়ের কাপ মুখের কাছে নিতেই, কুকুরের ঘেউ শব্দে হাত থেকে কাপটি নিচে পড়ে গেল৷ এবং মুহূর্তে আমার আবার হুশ ফিরে এলো৷ বললাম, ‘এই অন্ধকারে কোথাও হেঁটে কি হবে৷ তার চেয়ে ভালো বেঞ্চিতে বসে কিছুটা সময় কাটানো যাক’৷
রুনা কিছু বলল না৷ এক পলক কুকুরটির দিকে তাকাল৷ তারপর বলল, ‘আচ্ছা৷’
বেঞ্চিতে বসে এক হাতের নখ দিয়ে আরেক হাতের নখ কুটছে রুনা৷ মনে হবে যেন প্রেমিকের কাছে সামান্য একটি আবদার চেয়ে তা পায়নি প্রেমিকা৷ তাই এক বুক অভিমান নিয়ে বসে আছে৷ আমি একবার কুকুরটির দিকে তাকালাম৷ কুকুরটি এবার চার পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷
নখ কুটা শেষ করে, এক বিন্দু হাসি ঠোঁটে জমিয়ে রুনা বলল, ‘আপনি এখানে বন্ধুর কাছে কেন এসেছেন?’
— ‘বেড়াতে এসেছি৷ সেমিস্টার শেষ হয়েছে৷ তাই ভাবলাম এদিকটা দেখে যাই৷’
—‘বিয়ে করেছেন?’
আমি এক পাশে হেসে অবাকের স্বরে বললাম, ‘আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে! ভার্সিটি শেষ হতে আরো কয়েক সেমিস্টার বাকি৷ এরপর চাকরি, তারপর বিয়ের চিন্তে ভাবনা৷’
—‘প্রেমিকা আছে?’
— ‘উহু, নাহ! ছিলো৷’
—‘এখন নেই কেন?’
— ‘আমাদের মেন্টালিটি মিলছিলো না৷ কোন এক ভালো লাগা থেকে রিলেশনে যাই আমরা৷ কিন্তু কোন কমিটমেন্টে থাকতে হলে, মেন্টালিটি মিলাটা খুব জরুরি৷ ওর যেটা ভালো লাগতো, সেটা আমার অপছন্দ ছিলো৷ আবার আমার পছন্দটাকে ও নিজের পছন্দ করতে পারেনি৷ এসব মিলিয়েই আমরা এক সময় ব্রেকাপ করি৷ অহেতুক নিজেদের কষ্ট দিয়ে কমিটমেন্টে থাকার মানে হয় না৷’
—‘এখন কাউকে ভালোবাসেন?’
—‘নাহ, তবে পছন্দের একজন মানুষ আছে৷ যাকে দেখে, কথা বলে, কিছু সময় কাটিয়ে মনে হয়েছে বাকি জীবনটা তার সাথে কাটাতে পারবো৷’
—‘ওহ আচ্ছা’৷
আমি বললাম, ‘অাপনি খুব সহজেই একজনকে নিজের বশে করার ক্ষমতা রাখেন৷ আপনার পছন্দের কেউ নেই?’
—‘মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি৷ পছন্দ অবশ্যই থাকবে৷ প্রানীদের মধ্যে এক মাত্র মানুষেরই পছন্দ অপছন্দ আছে৷’
—‘সেই পছন্দ কি ভালোবাসা পর্যায়ের’?
—‘তাই বলা যেতে পারে৷ কয়েক বছর আগের কথা৷ আপনার মতনই একজন ভুলক্রমে ট্রেন থেকে নামলো৷ কিন্তু এখানে যাওয়ার কোন জায়গা ছিলো না৷ তাই অন্য ট্রেন আসা অবধি সেই মানুষটা এখানেই সময় কাটায়৷ এবং আমার সাথে পরিচয় হয়৷ মানুষটাকে দেখে এবং তার সাথে কথা বলে কি মনে হয়েছে জানেন? মনে হয়েছে আমি এরই জন্য সৃষ্টি৷ সৃষ্টির সেরা মানুষ এলেও, সেই মানুষটার প্রতি ভালো লাগা অন্য কোথাও জাগবে না বলে বিশ্বাস৷ একটা পর্যায়ে সেই মানুষটি, আচমকা আমাকে বলে বসলো, রুনা তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই৷
বিশ্বাস করবেন না৷ সেই কথাটি শুনে মনে হয়েছিলো আমার জীবনের সব কিছু পাওয়া হয়ে গেছে৷ আনন্দে আমার চোখের পানি চলে এসেছিলো৷ সেই মানুষটির কথার পরিবর্তে আনন্দ অশ্রু ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি৷’
কথাটা বলে কিছুখন চুপ করে রইলেন৷ হয়তো পরিবর্তী কথাটা বলার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলে বলল, ‘উনি ঢাকা গেছেন আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে৷ বলে গেছেন আমি যেন অপেক্ষা করি৷’ কথাটি শেষ করে রুনা আবার তাকালো সেই কুকুরটির দিকে৷
আমি রুনার কথার ঘোরের মধ্যে ডুবে আছি৷ স্টেশনের পেছনে বাঁশঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার শব্দ আসছে৷ মনে হচ্ছে আমাকে ঘোরের মধ্যে স্থির রাখতেই কোন সুরেলি বাঁশিওয়ালা ক্রমাগত মন ভুলানোর মধুর শব্দ করে যাচ্ছে৷
আমি কিছু বলতে যাব, এমন সময় রুনা আমার হাতের ওপর হাত রাখল৷ বলল, ‘কয়েক বছর ধরে তার প্রতীক্ষায় আছি৷ আমাকে নিয়ে চলুন উনার কাছে’—বলেই আমার কাঁধে মাথা রাখলো৷ মেয়েটির চুলের থেকে আসা এক অদ্ভুত সুগন্ধি আমার চোখে বন্ধ করে দিচ্ছে৷ শরীর দুর্বল করে তুলছে৷ রুনার কোমল হাতখানা খুব শক্ত এবং ভারি মনে হচ্ছে৷ আমি কানের কাছে এক চাপা গর্জন শুনতে পাচ্ছি৷ মনে হচ্ছে সেই কুকুরটি আমার কানের কাছে এসে গর্জন করছে৷ এখনই আমার ঘাড়ে কামড় বসাবে৷ ছিড়ে খেয়ে ফেলে বিধ্বস্ত শরীরটি ফেলে রাখবে রেল লাইনের মাঝে৷
কয়েক মুহূর্ত অবচেতন অবস্থায় সব শুনতে পাচ্ছি, এক তরুণীর বীভৎস হাসি৷ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ৷ ঝিঝি পোকার শব্দ৷ কিন্তু আমি চোখ মিলতে পারছি না৷ শরীরের কোন প্রকার শক্তি অনুভব করতে পারছি না৷
তারপর কিছুখন নিরবতা৷ আমার কানে এখন শব্দ আসাও বন্ধ হয়েছে৷ কিছুখন পর বুঝতে পারলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে, ‘মুহিত! এই মুহিত! তুই ঠিক আছোছ? মুহিত৷’
এবার আমি নির্ধিদায় চোখ খুলতে পারলাম৷ শরীরে শক্তিও পাচ্ছি বটে৷ চোখ খুলে দেখি আমি স্টেশনের মেঝেতে শুয়ে আছি৷ সেখান থেকে উঠে বসে দেখি সামনে রাতুল হাটু গেরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আর বলছে, ‘কিরে তুই ঠিক আছোছ!’
আমি ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যা, ঠিক আছি৷ কিন্তু…..’
চারপাশে চোখ ঘুড়িয়ে দেখি রুনা মেয়েটি নেই৷ সেই পাগলটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ কুকুরটি ঘেউ ঘেউ শব্দে উতলা হয়ে আছে৷ চায়ের দোকানটিও বন্ধ৷
রাতুল বলল, ‘কিরে কিছু খুঁজতেছোছ?’
—‘হ্যা, আমার সাথে একটি মেয়ে বসে ছিল৷ ও কোথায় গেল!’
—‘কোন মেয়ে বসে ছিলো? তুইতো একাই এখানে পড়েছিলি৷ ঢাকা থেকে বান্ধবি নিয়ে আসছিলি?’
—‘না, এখানকার মেয়ে৷ স্টেশন মাষ্টারের ভাগ্নি৷’
—‘কিসব বলছিস! বাইরে চল, বাইক রেখে এসেছি৷ বাইকে যেতে যেতে বলিস ঘটনা৷
—‘কিন্তু রুনা!’
—‘আরেহ কিসের রুনা,মুনা,কুনা চল তুই হারমজাদা৷’
রাতুল আমার হাত চেপে ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ স্টেশনের ভাঙা মরিচা পড়া গেইটটা পার হতেই, রুনার গায়ের সেই অদ্ভুত সুগন্ধিটা আমার নাকে তিরের মত এসে বাঁধল৷ আমি পেছনে ফিরতেই এক খিল খিল শব্দের হাসি শুনতে পেলাম৷ রাতুলের হাতে চাপ দিয়ে বললাম, ‘তুই শুনলি হাসিটা?’
—‘তোর মরা নানী কবর থেকে হাসছে, চল তুই’৷
বাইকে বসিয়ে রাতুল রওনা দিলো ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে৷ বাইকের মিররে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘটনা কি এখন বলতো আমারে৷ তোরে আগেই বলেছি ময়নামতী স্টেশনে নামবি৷ এই স্টেশনে কেউ নামেনা৷ পরিত্যক্ত এটি৷ তারপর তোর ট্রেন যখন এলো, আমি ঐ স্টেশনেই বসেছিলাম৷ তোকে নামতে দেখলাম না৷ ফোন দিয়েছি সেটিও বন্ধ৷ তারপর তুই নিজেই ফোন দিয়ে বললি এখানে নামবি! আর কে এই রুনা! গলাটা পরিষ্কার করে বলতো ঘটনা৷’
আমি স্বাভাবিক হয়ে রাতুলকে বলতে লাগলাম, ‘ ঐ স্টেশনেই নামবো বলে ঠিক করেছি৷ কিন্তু হাটৎ আমার মাথা এত ব্যাথা উঠলো যে, আমি ওয়াশরুমে গেলাম মাথায় মুখে পানি দিতে৷ কখনো এমনটি হয়নি৷ আজই প্রথমবারের মত এমনটা হলো৷ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি ময়নামতী স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে৷ পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি সেটি বন্ধ হয়ে আছে৷ ভাবলাম হয়তো ভুলে টিপ লেগে বন্ধ হয়ে গেছে৷’
—‘সেটা বুঝলাম৷ কিন্তু এই স্টেশনে এসে তোর কি হলো সেটা বল৷ তার আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার ঠোঁটে দে৷
আমি ওকে সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে, সব ঘটনা খুলে বললাম৷
ঘটনা শুনে ও রাস্তার পাশে বাইকটি থামালেন৷ থামিয়ে আমার দিকে কিছুখন বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলিস কিরে ভাউ! ওপর ওয়ালা আমার উসিলায় তোরে আজ রক্ষা করলরে!’
ওর মতই বিষ্ময় নিয়ে ওকে বললাম, ‘মানে! কি হয়েছে?’
সিগারেটে এক লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘তবে শোন ঘটনা৷ দশ বারো বছর আগে এই স্টেশনে তিনজন এসেছিলেন৷ বাবা মেয়ে, এবং মেয়ের জামাই৷ তারা ঢাকা থেকে এসেছিলো এ গ্রামে বেড়াতে৷ মেয়ের জামায়ের বাড়ি এ গ্রামেই৷ তাই শশুর আর বউকে নিয়ে এসেছিল নিজ বাড়িতে৷ কিন্তু জামাই-এর ছিল অর্থ লোভ৷ মেয়ে ঢাকার স্থানীয় দেখে প্রেম টেম করে বিয়ে করে৷ প্রেম না বলে অভিনয় করে বিয়ে করেছেও বলতে পারিস৷ কেউ প্রেম করে অর্থ লোভে, কেউ করে যৌন লোভে, কেউবা সুন্দর্যের লোভে৷ প্রেম ভালোবাসায় লোভ জিনিসটা থাকেই৷ তো মেয়ে মারা গেলে কয়েক কাঠা সম্পত্তি আর আরমবাগে পাঁচ তালা বাড়ি পাবে ছেলে৷ উইলটা ছিল এরকমের৷
ছেলে তখন ঠিক করলো, মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসে মেরে ফেলবে৷ যেই ভাবা , সেই কাজ৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শশুরও আসলেন ওদের সাথে৷ তারপর এমনই কোন এক রাতে শশুর আর বউকে মেরে ফেলে রাখে রেল লাইনে৷ এবং লাশ ছিন্ন বিন্ন করার কাজটা সমাপ্ত করে ট্রেনের চাকা৷’
— ‘কিন্তু এসব ঘটনা দেখল কে যে এত প্রুভ সহ সব বললি৷’
—‘ঐযে দেখলি না পাগল বসেছিলো? পুলিশের সন্দেহ হয় জামাই এর ওপর৷ তাই ইনভেস্টিগেশনে ঐ পাগলকে ইচ্ছে মত জেরা করে এসব তথ্য বের করে৷ এই স্টেশনতো বলতে গেলে পাগলটার প্রাসাদ৷ বারো বছর আগেও পাগলটা এখানেই ছিলো৷’
আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘ঐ ঘটনার পর কি এখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছিল?’
—‘হ্যা, বছর তিনেক আগে ঐ স্টেশনে রেল লাইনে এক লাশ পাওয়া যায়৷ স্থানীয় এক যুবকের৷ স্টেশনে চায়ের দোকান খুলে বসেছিল৷ দেখলি না বন্ধ চায়ের দোকানটা?
সেই দুর্ঘটনার পর, কেউ বলে ভূতের ব্যাপার৷ শিক্ষিত লোকেরা বলে সাধারন খুনের মত৷ আমি অবশ্য সাধারন খুনই ভেবেছিলাম৷ তবে এখন তোর অবস্থা দেখে এবং শুনে অশিক্ষিতের মত বিশ্বাসটাই আসছেরে৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ সব যেন কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে৷ রাতুল আবার বাইক চালু করলো৷ আমি পেছনে বসে সেই স্টেশনের দিকে তাকালাম৷
এক দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনটি৷ আকাশের জ্যােৎস্নার আলোয়, বাইকের লুকিং গ্লাসে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি৷ কিন্তু সেই স্টেশনে ঘোর অমাবস্যা চলছে৷ মানুষের জীবনের রহস্যের মত, চাঁদের আলোতেও এক অদ্ভুত রহস্য আছে৷ এ আলো সব জায়গায় পৌঁছায় না…৷