..(প্রথম পর্ব)
পেটটা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠেছে। দেহের ভেতরে ধীরে ধীরে আরেকটি দেহ বেড়ে উঠছে।
সাঞ্জে ব্যাপারটা অনুভব করে কিন্তু উপভোগ করতে পারে না। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে গর্ভবতী হয়েছে।
আসলে ওর স্বামীটা যেভাবে বাচ্চাকাচ্চার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল, ও কিছুতেই তাকে মানা করতে পারে নি।
কিন্তু ঝড়টা তো আর ছেলেদের উপর দিয়ে যায় না। তাই বাচ্চা নিতে ওরা এতটা আগ্রহী।
সাঞ্জে ভাবে কেবল দুদিনের জন্যে যদি বাচ্চাটা অভির পেটে প্রতিস্থাপন করে ওকে গর্ভাবস্থার স্বাদটা বুঝিয়ে দেয়া যেত,
তাহলে ও হয়তো আর কখনো রাতে বিছানায় দাপাদাপি করার সাহস দেখাতো না।
শয্যাসুখ স্বামী স্ত্রী দুজনই উপভোগ করে, কিন্তু এর শাস্তিটা কেবল স্ত্রীদের কপালেই জুটে। দশ মাস দশ দিন একটা বিশাল বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়।
আর স্বামীটা তখন একের পর এক সদুপদেশ দিয়েই যেতে থাকে।
এই কাজ করবে না, ওই কাজ করবে না, বিছানা ছেড়ে উঠবে না, আরেকটু খেয়ে নাও,,,,,,,,,, যত্তসব ন্যাকামো।
প্লেনে জানালার পাশের হেলানো সিটে আধশোয়া হয়ে এসব ছাইপাঁশ ভাবছিলো সাঞ্জে।
হঠাৎ ওর অনাগত বাচ্চাটা ডি-বক্সের ভেতর থেকে একটা পেনাল্টি শট নিলো।
উৎসুক দর্শকরা যেভাবে “গোওওওওল” বলে চেঁচিয়ে উঠে সাঞ্জেও তেমনি “আআআআউউউচচচ” করে ককিয়ে উঠলো।
প্লেনের একটানা জার্নিতে অভির খানিকটা তন্দ্রা চলে এসেছিলো। সাঞ্জের মৃদু আর্তনাদে ও তাৎক্ষণাত সজাগ হয়ে গেল।
তারপর উৎকন্ঠিত চিত্তে ভয়ার্তস্বরে বলে অভি: “কি ব্যাপার মাজেস্টি। কোন সমস্যা হল না কি? ”
সাঞ্জে মনে মনে বলে, এই তো শুরু হয়েছে ন্যাকামি। এবার না জানি আরো কত কি উপদেশ দিবে।
তাড়াতাড়ি ওকে বুঝিয়ে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে সাঞ্জে।
সাঞ্জে: “আরে! ও কিছু না। বাচ্চাটা একটা মিসকল দিয়েছে আর কি।” তবুও ওর পেটে হাত বুলিয়ে একবার চেক করে নেয় অভি। বলাতো যায় না।
কখন কি সমস্যা হয়ে যায়। তারপর ওর সিটের বাটন টিপে আরেকটু পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলে, অভি: “এই নাও, আরাম করে শুয়ে থাক।”
অভি ভাবে এই অবস্থায় ওকে নিয়ে জার্নি করা একদমই উচিৎ হয় নি। বিয়ে করে পোল্যান্ডে সংসার পেতেছিলো ওরা দুজন।
ওখানে সবকিছু নিরাপদেই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে ফোন যায়, ওর নানি বুড়িটা আর নেই। খবর শুনেই অভি গোছগাছ শুরু করে।
বুড়িকে শেষ দেখা দেখতে বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ও। সেটা টের পেয়ে সাঞ্জেও গো ধরে। সেও যাবে ওর সাথে।
পারিবারিক সম্পর্কে ওরা দুজন কাজিন হওয়ায় অভির নানিটাই যে সম্পর্কে সাঞ্জের দাদি হয়।
দাদির মৃত্যুতে ব্যাথিত সাঞ্জে কিছুতেই পোল্যান্ডে পড়ে থাকতে পারে না। ছোটবেলা ওদের এক সাথে বসিয়ে কত্ত মজার মজার গল্প বলতো বুড়িটা।
আজ থেকে সেই গল্পের আসরটা চিরতরে ভেঙে গেল। ভাবতেই চোখটা ভিজে উঠে ওদের। সাঞ্জের পীড়াপীড়িতে অবশেষে অভি হার মানে।
ওকে সাথে নিয়েই যাত্রা শুরু করতে হয়। লম্বা জার্নি। বাল্টিস থেকে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো, তারপর ওয়ারশো থেকে বিমানে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট।
সেখান থেকে সরাসরি সিলেটের ওসমানী বিমান বন্দর। স্বদেশের পথটা খানিকটা বন্ধুর। কিন্তু নাড়ির টানে ওদের ফিরতেই হয়।
রাত দশটার দিকে প্লেনটা ওসমানী এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করে। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে অভি আর সাঞ্জেও একে একে বেরিয়ে আসে।
স্বদেশের সুবাতাস ওদের মনটাকে ভরিয়ে দেয়। আহ! বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।
ভাগ্যগুণে কাস্টমসের কোন ঝামেলা ছাড়াই ওদের লাগেজ দুটো কনভেয়ার বেল্ট হয়ে বেরিয়ে আসলো। সবার ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হয় না।
ঘুষখোর কাস্টমস কর্মকর্তারা একটা না একটা ছুতোয় লাগেজ আটকে অবৈধভাবে টাকা দাবী করে। এটা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।
দুর্নীতিতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বলে কথা। এয়ারপোর্ট থেকে অভি একটা ট্যাক্সি ধরে। গন্তব্য গোয়ালাবাজার ব্রাম্মণগ্রাম।।
ওর নানাবাড়ি, আর সাঞ্জের দাদাবাড়ি। রাস্তায় জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে অভি ড্রাইভার কে যেভাবে ঝাড়ি দিচ্ছিলো তাতে সাঞ্জের বিরক্তি ধরে গেল।
ও যেন একটা পানপাত্র, কানায় কানায় অমূল্য পানীয়জলে ভর্তি। গাড়িটা একটু জোরে চালালেই ঝাঁকি খেয়ে উপচে পড়বে।
গর্ভবতী হয়েছে বলে এতটা যত্ন আত্তি নিতে হবে? ব্যাপারটা খানিকটা বাড়াবাড়িই মনে হয় ওর। ভালয় ভালয় বাড়ি পৌছে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অভি।
ব্যাপারটা ওর কাছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের মতো মনে হয়। ৭ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া কি চাট্টেখানি কথা।
তবুও সবকিছু নিশ্চিত হতে কাল একবার সাঞ্জেকে নিয়ে গিয়ে আল্ট্রা সাউন্ড টেস্ট করিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
অনাগত সন্তানের ব্যাপারে কোন ঝুকি নিতে রাজি নয় ও। সাঞ্জের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
ও কখনো দাদির লাশের পাশে বসে কোরআন পড়ছে, আবার কখনো বা চাঁচি কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কান্নাকাটি ভাল লাগে না অভির।
সে ক্রন্দনরূত মহিলাদের ভিড়টা একটু এড়িয়ে চলে। তাই বলে যে ও কষ্ট পায়নি তেমনটা নয়। কেবল সবার সামনে চোখের জল খসাতে চায় না।
তবে আজ সে ও কাঁদবে! রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, বিছানায় শুয়ে মুখের উপর চাদর টেনে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে।
পরদিন সকালেই জানাজা পড়িয়ে কবর দেওয়া হল বুড়িকে। দাফন শেষ হতেই অভি সাঞ্জেকে নিয়ে সিলেট টাউনে গিয়ে টেস্ট করিয়ে আনলো।
সবকিছুই নরমাল। ও খামাখাই টেনশন করছিলো। কিন্তু ফেরার পথেই গন্ডগোলটা বাঁধলো।
সিলেটের চৌহদ্দিটা পেরুতেই গাড়ির ইঞ্জিনে গোলমাল দেখা দিল। কিছুক্ষণ ভটভট করে গাড়িটা থেমে গেল!
খুব সম্ভবত ফুয়েল পাইপে কিছু একটা আটকে গেছে। তেল ফুয়েল ট্যাংক থেকে ইগনিশন চেম্বারে আসছে না।
পুরো ফুয়েল ট্যাংক খুলে পরিষ্কার করতে হবে। হঠাৎ এই অনাকাঙ্খিত যাত্রা বিরতিতে অভি প্রচন্ড বিরক্ত হয়।
এত্ত গরমে এভাবে রাস্তায় আটকে সিদ্ধ হতে হচ্ছে দেখে ওর মেজাজটা বিগড়ে যায়।
খেকিয়ে উঠে ও ড্রাইভারের দিকে, অভি: “কি মিয়া? রাস্তায় বেরুনোর আগে গাড়ি চেক করে বেরুতে পারো না?
আর এ কি গাড়ি এনেছো যে মাঝপথে হঠাৎ ঠেলাগাড়ি হয়ে যায়?”
ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল, “আৎকা কি হইয়া গেল কইবার পারি না সাহিব।” বৃদ্ধ ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি দিতে গিয়েও থেমে গেল অভি।
তার বদলে নরম স্বরে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে, আমাদের আরেকটা গাড়ি খোজে দেন।
আমরা তো আর আপনার গাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এত লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে পারি না।”
অভি গাড়ির ভেতরে সাঞ্জের কাছে ফিরে আসে। মুখে আশ্বাসের হাসি টেনে উৎকন্ঠিত মেয়েটাকে যথা সম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করে।
অভি: “ক্ষমা চাচ্ছি মাজেস্টি, আসলে আমাদের গাড়িতে একটা সমস্যা হয়েছে। ঠিক হতে অনেক লম্বা সময় লাগবে।
তাই ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি আরেকটি গাড়ি খুঁজে দিতে। গাড়ি পেয়ে গেলেই আমরা ফের যাত্রা শুরু করব।
” ওর কথা শুনে বিরক্তিতে মুষড়ে পড়ে সাঞ্জে। ধ্যাত।
বাংলাদেশের এই রিকন্ডিশন্ড সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড, গাড়ি গুলার জালায় আর পারা গেল না।
উফ! সাঞ্জে কেবল ঠোট বাঁকিয়ে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল, “ওহ হোনার। আমাদের কপালই খারাপ।”
গরমে গাড়ির ভেতরে ঠিকতে না পেরে নেমে পড়ে ওরা। তারপর কেবলই অপেক্ষার পালা! কখন আরেকটি নতুন গাড়ি আসবে।
হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে একটা নিশান জীপ আসতে লাগলো। ড্রাইভার হাত তুলে থামতে ইশারা করলো।
অভিও হতদন্ত হয়ে জীপের দিকে হাত তুলে চেঁচাতে লাগলো। অভি: “আরে ভাই থামুন, থামুন। একটা লিফট চাই। জরুরি।”
জীপটা ড্রাইভারকে পেরিয়ে এসে অভির সামনে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে থামলো।
..(দ্বিতীয় পর্ব)
জীপের জানালা গলে একটা টেকো মাথা বেরিয়ে এসে চিৎকার ছাড়লো, “আরে দোস্ত রে! কবে দেশে এসেছিস?
টেকো মাথার লোকটা ছিলো ঢাবি’র আর্কাইকোলজির আসিস্টেন্ট প্রফেসর শরিফুল হক। অভির স্কুলের প্রাক্তন ক্লাসমেট।
স্কুল পাশ করার পর দুজনের মধ্যে আর কখনো দেখা হয় নি। প্রায় ১৫ বছর পরে আবার দেখা।
জীপ থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে প্রফেসর অভিকে জড়িয়ে ধরলো। শরীফ: “আরে দোস্ত! তুই তো দেখি এখনো টম ক্রুজের মতোই আছস।
আমি তো বুড়িয়ে গেলাম রে।” অভি প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তারপর স্মৃতি হাতড়ে শরীফকে বের করে আনে।
অভি: “এইডা তুই কি কস দোস্ত? এতো সহজে বুড়িয়ে গেলে কি চলে? মাত্র বিয়া শাদী করলাম।”
শরীফ কপট অভিমান করে বলে, “আব্বে তুই আমার দোস্ত না। তুই হইলি আমার শালা।
দোস্ত হইলে কি আর বিয়েতে দাওয়াত না দিয়ে থাকতে পারতি?”
অভি জিভে কামড় কেটে বলে, “সরি দোস্ত। সাংঘাতিক ভুল হইয়া গেছে। মাফ চাইতাছি। তয় তুই ও তো বিয়াতে দাওয়াত দিস নাই?”
শরীফ: “আমার নিজের বিয়া তো আমি নিজেই খাই নাই এখনো। ব্যাচেলরই আছি। তোরে কেমনে দাওয়াত দেই? হা হা হা ”
দুই বন্ধুর পুনর্মিলনীর তালে সাঞ্জে এতক্ষণ অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল। তারপর হঠাৎ শরীফের চোখ পড়ে তার উপর।
আহা বেচারি! অসুস্থ শরীর নিয়ে নষ্ট গাড়িটার ছায়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে। শরীফের সাথে চোখাচোখি হতেই ও একটা সৌজন্যমূলক হাসি দেয়।
শরীফ গলা নামিয়ে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “দোস্ত, মাইন্ড খাইস না। ওই হুরপরীটা কি তোর বউ?” এক গাল হেসে অভি মাথা নাড়ায়।
বন্ধুকে ছেড়ে শরীফ এবার ভাবির সাথে পরিচিত হতে সচেষ্ট হয়,
শরীফ: “সেলাম ভাবি জান। কেমন আছেন?” সাঞ্জে হেসে জবাব দেয় “ভালই তো।
আপনি কেমন? ” প্রাথমিক পরিচয় পর্বটা সেরে ওরা সবাই শরীফের জীপে উঠে বসে। যাক। একটা ব্যবস্থা হল শেষ পর্যন্ত।
ঢাকা সিলেট হাইওয়ে ধরে শরীফ গাড়িটা ছুটিয়ে দেয়। পথে কথা বলতে বলতেই সাঞ্জে জানতে পারে শরীফ অভির অনেক পুরাতন বন্ধু।
অবশ্য ব্যাপারটা ও অনেক আগেই আঁচ করে ফেলেছিলো। সে ও ওদের মতো গোয়ালাবাজার যাচ্ছে।
গোয়ালাবাজারের ইউসুফপুরে কি যেন এক পুরাতাত্ত্বিক মন্দিরের খনন চলছে,
সেটা তদারকি করতে। ইউসুফপুরের পথে ব্রাম্মণগ্রামের সামনে ওদের নামিয়ে দিতে তার কোন বিশেষ অসুবিধা নেই।
সবটুকু শোনে খানিকটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও। শরীফ খানিকটা বাচাল টাইপের লোক। সারাটি পথ বকবক করেই চল।
প্রায় সব কথাই সদ্য খোজ পাওয়া মন্দিরটার ব্যাপারে। ওটার নাম ছিলো তামিখাসু মন্দির। যার মানে দাঁড়ায় বহুরূপীর মন্দির।
শরীফের ধারনা আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগে ভারতের মেঘালয় থেকে আগত জৈনিক তান্ত্রিক সাধু মন্দিরটা প্রতিষ্টা করেন।
এখানকার সন্যাসীদের ব্যাপারে খুব বেশী কিছু জানা যায় নি। কারণ প্রতিষ্টার ১০ বছরের মধ্যেই মন্দিরটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো।
শরীফের টিম খনন করে কেবল ধ্বংস প্রাপ্ত মুর্তি আর ভাঙ্গা দেয়ালের ইট খুঁজে পাচ্ছে। আস্তো ইটের সংখ্যা খুবই কম।
যা প্রমাণ করে মন্দিরটা প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং মানুষের দ্বারাই ধংস্বপ্রাপ্ত। মন্দিরের ফটকের সামনে কতগুলি ভাঙা ত্রিশূল পাওয়া গেছে।
এগুলি মন্দিরের নিজস্ব সম্পদ নয়। মন্দির আক্রমণকারীদের হাতিয়ার। ত্রিশূল উপমহাদেশীয় ব্রাম্মণদের ট্রেডমার্ক।
খুব সম্ভব স্থানীয় ব্রাম্মণদের নেতৃত্বেই বহুরূপীর মন্দিরটা ধংস্ব করে দেয়া হয়। শেষ কথাটা সাঞ্জের কাছে খানিকটা অবাস্তব লাগলো।
কৌতুহলটা চাপতে না পেরে সে শরীফকে প্রশ্ন করেই বসলো।
সাঞ্জে: “আপনি কি করে এতটা নিশ্চিত হলেন যে ব্রাম্মণরাই ওই মন্দিরটা ধংস্ব করেছে?
আপনাদের গবেষণায় কোথাও কোন ভুল নেই তো? ব্রাম্মণরা কেন মন্দির ধংস্ব করতে যাবে?”
শরীফ ওকে ব্যাপারটা যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে। “এটা তৎকালীন হিন্দু মন্দির গুলি থেকে আলাদা ছিলো।
চিরায়ত হিন্দু দেবতাদের বদলে এখানে অর্হ্নিশ নামক একজন অপদেবতার পূজা করা হত। মন্দিরে অর্হ্নিশ এর অনেকগুলি মুর্তি পাওয়া গেছে।
কিন্তু ওই দেবতাটা যে দেখতে কেমন তা কখনো জানা যায় নি।
ওর মুর্তিগুলি বানানোর সময় কর্মকার এর মুখে নাক মুখ চোখ, ঠোট, কান এসব কিছুই দেয় নি।
তাই বলে এমনটা নয় যে ওরা ভাল মূর্তি বানাতে জানতো না। এর কারণ হল ওরা বিশ্বাস করতো অর্হ্নিশের নিজস্ব কোন চেহারা নেই।
ও একজন বহুরূপী অপদেবতা। সে যেকোন সময় যে কারো রূপ ধারণ করতে পারে। তাই মুর্তিগুলির চেহারা খালিই রাখা হয়েছে।
ব্রাম্মণরা ঠিক কি কারণে মন্দিরে হানা দেয় তা আজো জানা যায় নি।
হয়তো বহুরূপীর মন্দিরের জনপ্রিয়তা সমসাময়িক হিন্দু মন্দিরগুলির চেয়ে বেশী হয়ে যাওয়ায় ওরা ঈর্ষান্বিত হয়ে কাজটা করে।
কিংবা ওই আক্রমণের পেছনে আরো যুক্তিযুক্ত কোন কারণ ছিলো যা এখনো জানা যায় নি। তবে এটা নিশ্চিত যে ব্রাম্মণরাই আক্রমণ করেছিলো।
আক্রমণের শুরুতে ওরা সকল সন্যাসীদের হত্যা করে দেহ পুড়িয়ে দেয়।
তারপর একে একে সবগুলি মূর্তিকে ভেঙে ফেলে, তারপর মন্দিরের দেয়ালগুলি ধসিয়ে দেয়।
ওদের সৌজন্যতায় আমরা এখনো একটা আস্ত মূর্তি জোগাড় করতে পারি নি। অর্হ্নিশের প্রায় সকল মূর্তিরই একই দশা।
ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। ” গাড়ি চালানোর সময় এতগুলি কথা বলতে একটু ও অসুবিধা হয় না শরীফের।
ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস লেকচার দিয়ে অভ্যস্ত সে। চাইলে সারাটা দিন এভাবে একটানা বকবক করে যেতে পারবে ও।
কিন্তু এইটুকু বলার পরেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও থামতে হল। আসলে ওই মন্দিরটা নিয়ে বলার মতো বেশী কিছু নেই।
সমগ্র মন্দিরটাই যেন এক ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা। মাস চারেক ধরে এখানে একটানা খেটে যাচ্ছে ও। কিন্তু সর্বসাকুল্যে এইটুকু জানতে পেরেছে।
মন্দিরের ভেতরকার সন্যাসীদের ধর্মীয় আচার ব্যবহার, তাদের জীবনধারার গতি প্রকৃতি, তাপস্য- সাধনা সবই এখনো অজ্ঞাত।
খুব দ্রুত উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি দেখাতে না পারলে অর্থলগ্নিকারি এনজিও টা অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
তখন খননকার্য বন্ধ ঘোষনা করা ছাড়া তখন আর কোন পথ খোলা থাকবে না।
কিন্তু শরীফ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এখানে আরো কিছু বিষ্ময়কর পুরাকৃর্তি লুকিয়ে রয়েছে, মাটির গহীনে।
সেগুলির সন্ধান পেতে খুঁড়াখুঁড়ি চালিয়েই যেতে হবে। এতটা জটিলতায় মাথা পেঁচিয়ে যায় শরীফের।
রাস্তা থেকে নজর না ফিরিয়েই, গাড়ি চালাতে চালাতে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই মন্দিরটার ব্যাপারে যতই জানছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সাঞ্জে।
এসব ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব বিষয় গুলিতে প্রচন্ড আগ্রহ ওর। এসব দেখতেই বিয়ের পর হানিমুনে প্যারিস গিয়েছিলো ওরা।
কিন্তু দুঃখের বিষয়টা হল ঘরের পাশেই এত্ত ভাল একটা পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ব্যাপারে ও কিছুই জানতো না!
“দেখিতে গিয়েয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,,,,,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে কেবল দু পা ফেলিয়া,
একটি ঘাসের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু।” আবোল তাবোল ভুল শুদ্ধ মিলিয়ে, মনে মনে কবিতাটা আবৃতি করে সাঞ্জে।
গাড়ির ভেতরটা হঠাৎ করে নিস্তব্দ হয়ে যায়। কথা ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রফেসর চুপ হয়ে আছেন।
সাঞ্জে গাড়ির জানালার দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আপন মনে ভেবে চলছে। আর অভি তো স্বভাবতই গুম মেরে আছে।
গোমট ভাবটা কাটাতেই হঠাৎ করে শরীফ ওর সাইটে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়।
শরীফ: “ওই দোস্ত। ভাবির তো দেখি আমার সাবজেক্টে হেভী ইন্টারেস্ট আছে! উনাকে নিয়ে চল না, আজ মন্দিরটা দেখিয়ে নিয়ে আসবি।”
সাঞ্জে প্রস্তাবটা লুফে নেয়, সাঞ্জে: “দেশে এসে এত কাছের একটা প্রত্নতাত্ত্বিক স্পট না দেখে যাই কি করে? আপনাকে আর বলতে হবে না।
আপনি না চাইলেও ওখানটা একবার দেখতে যাবই।” শরীফ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে বলে, “তাহলে চলুন, আজই যাওয়া যাক। এক্ষুনি। ”
এতক্ষণ অভি নিশ্চুপ থাকলেও এবার ও বাধ সাধলো, অভি: “আজ থাক, এমনিতেই আজ অনেকটা টায়ার্ড। তাছাড়া সন্ধা ঘনিয়ে আসছে।”
কিন্তু শরীফ ও নাছোড়বান্দা। শরীফ: “এমন সুন্দরী বউ থাকতে মানুষ টায়ার্ড হয় কেমনে? আর সন্ধা হতে এখনো তো দু ঘন্টা বাকি।
এ দু ঘন্টায় ব্রাম্মণগ্রাম থেকে ইউসুফপুরে পাঁচবার যাওয়া আসা করা যাবে। তাছাড়া সারাটি পথ আমার গাড়িতে করেই যাবি।
এত টেনশন নিস কেন?” এবার সাঞ্জেও শরীফের সাথে সুর মেলায়: “আজই চল না। পরে হয়তো আর আসাই হবে না।
পরশুদিনই তো পোল্যান্ড চলে যাচ্ছি।” গাড়িতে দুজনের বিপরীতে অভি একা হয়ে গেল।
তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী ও সায় না দিয়ে পারলো না।
..(তৃতীয় পর্ব)
গোয়ালাবাজার পৌছে জীপটা ব্রাম্মণগ্রাম অতিক্রম করে ছুটলো ইউসুফপুরের পথে।
গন্তব্যের কাছাকাছি আসতেই শরীফের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো।
ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করেই প্রফেসর চলন্ত গাড়িতেই ফোনটা ধরে কানে লাগালেন। ওপাশ থেকে কি যেন একটা বার্তা ভেসে এলো।
সেটা শুনেই শরীফের মুখে আকন্ঠ বিস্তৃত হাসি ফুটলো। ফোনটা রেখেই ও চুটকি বাজিয়ে বলল, “আমার ভাবিটা তো বড্ড লক্ষী রে অভি।
উনি সাইটের দিকে রওনা হতেই আমার ছেলেরা একটা অসাধারণ আবিষ্কার করে ফেলেছে। অর্হ্নিশের একটা আস্ত মূর্তি।
আমি ওদের বলে দিয়েছি যেন ওটা অভাবেই থাকে। আমরা যেয়েই ওটাকে উদ্ধার করব।” অভির এসবে খুব একটা আগ্রহ নেই।
ডাক্তার হয়েছে বলে পুরাতত্ত্বকে ও গুরুত্বই দেয় না। অকাজে পণ্ডশ্রম।
৬০০ বছর আগে কোথাকার কোন মন্দিরে কি সব হয়েছে, সেটা নিয়ে এত লাফালাফি করার কি হল? তাই ও শরীফের কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে।
ওদিকে সাঞ্জে মনে মনে এক তীব্র উত্তেজনা অনুভব করে। জীবনের প্রথম কোন পুরাতাত্ত্বিক উদ্ধারকার্য দেখার জন্যে আর তর সইছে না ওর।
সাইটে পৌছে চোখে রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে ও দেখে মাটিতে মাটিতে বিশাল বিশাল গর্ত। তার মাঝ থেকে মন্দিরের কতগুলি ভিত্তিপ্রস্তর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
ওরা গাড়ি থেকে নামতেই একটা ছেলে দৌড়ে এসে শরীফকে বলল, “স্যার, ওই দিকে চলুন। ওখানেই মূর্তিটা পাওয়া গেছে।” শরীফ দ্রুতপায়ে সেদিকেই ছুটলো।
সাঞ্জে ও অভি ওর পেছন পেছন চলতে লাগলো। একটা বিশাল গর্তে কাঁদার মধ্যে পোঁতা লালচে ইটের খুপরি থেকে একটা মূর্তির মাথা উঁকি দিচ্ছে।
ওটা দেখেই প্রফেসার হাতে গ্লাভস, মাথায় হেলমেট, হলুদ আপ্রণ, পায়ে গামবুট পড়ে নেমে পড়লেন।
তার দেখাদেখি আরো কয়েকজন লোক ও একইভাবে নেমে পড়লো। এত্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থার কি প্রয়োজন সেটা সাঞ্জের মাথায় ঢুকলো না।
ও কেবল গর্তের ধারে বোকার মতো দাঁড়িয়ে সবকিছু নিরবে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে দক্ষ হাতে শরীফ মুর্তিটাকে আস্ত তুলে আনলো।
ওটার গায়ে একটা আচঁড় ও লাগতে দেয়নি ও। হালকা জলস্রোতে ওটা ধোয়ে নিতেই একটা ঝকঝকে তকতকে আর্হ্নিশের মুর্তি বেরিয়ে পড়লো।
গ্লাভস পরা হাতে অতি সতর্কতার সাথে প্রফেসর মূর্তিটাকে সাইটের পাশে একটা তাবুতে নিয়ে গেলেন।
প্রফেসরের বিশেষ মেহমান হিসেবে সাঞ্জেকেই প্রথম মূর্তিটা খুটিয়ে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হল।
ওর খুশিটা আর দেখে কে? প্রথমেই মোবাইলটা বের করে মুর্তিটার দশ বারোটা ক্লোজআপ ফটো তুলল। তারপর মুর্তিটাকে আলতো করে ছোয়ে দেখলো।
ও প্রথমে মুর্তিটার হাত ধরেছিলো। তারপর ওর হাতটা নিজের অজান্তেই মূর্তির মুখটা ছোয়ে দিল।
আসলে ও ভাবছিলো এই অর্হ্নিশটা দেখতে কি এই রকমই ছিলো? নাক মুখ বিহীন বোঁচকা পেঁচা? সেই ভাবনাটাই ওকে মূর্তির মুখে হাত দিতে উদ্ভূদ্ধ করে।
কিন্তু ওটার মুখে হাত দিতেই ও বজ্রপৃষ্ঠের মতো ঝাঁকি দিয়ে দু পা পিছিয়ে আসে।মূর্তির মুখটা অসম্ভব গরম।
ওটার স্পর্ষ যেহ ওর আঙুলের ডগা গুলিকে চকিতে পুড়িয়ে দিয়েছে। ওর এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াটা অভির চোখ এড়ালো না।
ও এগিয়ে এসে সাঞ্জের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কি ব্যাপার মাজেস্টি? কোন সমস্যা?” সাঞ্জে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেয়ে বলল, “নাহ, কিছু না তো।”
অভিকে ওসব বললে তাৎক্ষণাত গাড়িতে উঠিয়ে ওকে নিয়ে আসতো সেখান থেকে।
কি দরকার পাগলকে নৌকা ডুবানোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে? অভিকে কোনমতে বুঝ দিয়ে সাঞ্জে ফের মুর্তিটার দিকে ফিরলো।
মুর্তিটা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সাঞ্জে কাঁপাকাঁপা হাতে ফের ওটার মুখে হাত দিলো। নাহ, এবার আর এত উষ্ম মনে হচ্ছে না।
একদম কক্ষ তাপমাত্রায়ই আছে। সাঞ্জে ব্যাপারটাকে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিতে চাইলো।
কিন্তু ওর বা হাতের আঙুলের ডগায় পুড়ে লালচে হয়ে যাওয়া চামড়াটুকু তাতে বাঁধ সাধলো।
ঠিক তখনই শরীফ ও তাবুর ভেতরে ঢুকলো, শরীফ: “দুঃখিত দোস্ত এন্ড ভাবিজান। তোমাদের খুব একটা সময় দিতে পারছি না বলে।
আজকের সুখবরটা ঢাকায় ফোন করে জানিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। আশা করি এখানে একা থাকতে মোটেও বিরক্ত লাগে নি তোমাদের।
আমি ফিরতে ফিরতেই তাবুর ভেতরে এক দফা রোমান্স হয়ে গেছে হয়তো।” ওর কথা শুনে অভি হো হো করে হেসে উঠে।
সাঞ্জে চোখ মুখ পাকিয়ে শরীফকে ঘুসি দেওয়ার ভান করে। তাবুর ভেতরে হাসির বন্যা বয়ে যায়।
শেষ বিকালে শরীফ ওদের জীপে করে ব্রাম্মণগ্রামে পৌছে দিয়ে গেল। ওরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন দূর মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে।
সাঞ্জেকে বাড়িতে রেখেই অভি নামাজ পড়তে চলে গেল। বাড়ি ফিরেই সাঞ্জে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলো। সারাদিনের ধকলে সে অনেকটা ক্লান্ত।
চোখ দুটো বুজে আসছিলো তার। হঠাৎ কিসব হাঁক ডাকে শুনে ওর ঘুম ভেঙে যায়।
রুম থেকে বেড়িয়ে গ্রামের এক চাচির সাথে কথা বলে জানতে পারলো অভির এক সেট কাপড় চুরি হয়ে গেছে।
গতিকাল জার্নি করার সময় অভি যে কাপড়টা পড়ে ছিলো সেটা আজ সকালে কাজের বুয়াটা ধুয়ে দেয়।
তারপর ওটাকে উঠোনে মেলে দিয়েছিলো শুকানোর জন্যে। কিন্তু বিকালে ওটা ঘরে তুলতে মনে ছিলো না।
গোধূলির আধারে গাঁ ঢাকা দিয়ে চোর সেই কাপড়টা নিয়ে গেছে। সাঞ্জে ব্যাপারটা নিয়ে হৈ হোল্লড় না করতে সবাইকে নিষেধ করে দিলো।
তারপর ঘুমঘুম চোখে কলপাড়ে গেল, হাত মুখ ধোয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। কলপাড়ে যেয়ে দেখে অভি সেখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
পড়নে সেই চুরি যাওয়া পোশাক। তাই দেখে সাঞ্জে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ওহ হোনার, তুমি এই কাপড় পড়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো!
আর ওরা সবাই ভাবছে কাপড়টা বুঝি চুরি গেছে। হিহিহিহিহি।” অভি কথার উত্তর না দিয়ে ধিরে ধিরে ওর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
কাছে এসেই খপ করে সাঞ্জের হাতের কব্জিটা আকড়ে ধরে। ওর মুখে সেই হাসিটা আর নেই। তার বদলে ভয়ঙ্কর খুনিবৃত্তি খেলা করছে ওই চেহারায়!
সাঞ্জে অনুভব করলো ওর হাতটা প্রচন্ড গরম। তার কব্জি পুড়ে ওই হাতের ছাপটা বসে যাচ্ছে!
ও হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিতে সর্বউচ্চ চেষ্টা করে, “আহ! কি করছো! ছাড়ো, ছেড়ে দাও আমায়। ব্যাথা লাগছে তো।”
কিন্তু অভি ওর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে কলপাড়ের কাছের ওই বাঁশ ঝাড়ের দিকে নিয়ে যায়।
তারপর বাঁশঝাড়ের নিচে নিয়ে গিয়ে ও সাঞ্জের হাতটা ছেড়ে দিল।
ছাড়া পেয়ে আহত হাতটা কোলে নিয়ে সাঞ্জে কঁকিয়ে উঠে, “উহ মা গো! এসব হচ্ছেটা কি হোনার? মাথা খারাপ হয়ে গেছে না কি তোমার?”
হঠাৎ ওর চোখ গেল অভির অতি-উষ্ম হাতের দিকে। চাঁদের আবছা আলোয় সাঞ্জে দেখলো ওই হাত দুটো জোড়া বেধেঁ ওর গলার দিকে এগিয়ে আসছে।
তাই দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ও। এ
কটু আগেও যে ছেলেটা সারাক্ষণ ওর জন্যে উৎকন্ঠিত থাকতো সেই কি না এখন ওর অনাগত সন্তানসমেত তাকে খুন করতে চলেছে!
বিষ্ময়ের ধাক্কায় মেয়েটা চিৎকার করতেও ভুলে যায়। পৃথিবীটা ওর কাছে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হয়। আহ বেচারি।
ওতো আর জানতো না যে আসল অভিটা তখন মসজিদে মিলাদ পড়ানোয় ব্যাস্ত। সে এখনো বাড়িই ফিরে নি।
উত্তপ্ত হাত দুটো গলা স্পর্ষ করতেই স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠে সাঞ্জে, “বাঁচাওওওওও, কে আছো, বাঁচাওওও।”,,,,,
..(চতুর্থ পর্ব)
আজ জমির শেখের মনটা খুব ভাল। গাছের লাউ দুটো আজ বিকালের হাটে আশাতীত দামে বিক্রি করেছে ও।
দুই লন্ডনীর দামাদামিতে ৩০ টাকার লাউ এর মূল্য ৫০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছিলো।
লাউ দুটো বিক্রি করে নিজের একটা লুঙ্গি, বউয়ের জন্যে কাঁচের চুড়ি আর ছেলে দুটোর জন্যে একটা ফুটবল নিয়েই বাড়ি ফিরছে।
এইটুকুতেই গরীবের ঘরে আজ খুশির বন্যা বয়ে যাবে। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ও বাড়ির পথে হাঠছিলো।
পথে ধারের বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসা একটা মেয়েলি চিৎকার শুনে ও থমকে দাঁড়ায়। কে যেন বাঁচাও বাঁচাও বলে সাহায্যের উদাত্ত আহব্বান জানাচ্ছে।
প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় ও। বাঁশঝাড়ের নীচে কত ধরনের ভুত প্রেতের বসবাস।
হয়তো ওরা এভাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাঁশঝাড়ের আগায় চড়িয়ে মেরে ফেলবে ওকে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হয় হয়তো কোন মহিলা সত্যিই বিপদে পড়েছে।
গ্রামে তো চোর বদমাইশের অভাব নেই। বাঁশঝাড়ের দিকে লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে ও হাঁক ছাড়ে, “কিডা রে? ওইহানে চিল্লায় কিডা।” কোন সাড়া শব্দ নেই।
ও গুটিগুটি পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায়। বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি আসতেই একটা দমকা বাতাস বাঁশঝাড়টাকে প্রবল ভাবে ঝাঁকিয়ে দেয়।
ঠিক তখনই একটা ছায়ামূর্তি বাঁশঝাড় থেকে ছুটে বেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখের কোন দিয়ে ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করে জমির শেখ।
অন্ধকারে দেখার ভুল ভেবে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যায় ও। আরো কয়েক পা এগুতেই ও বাঁশঝাড়ের নিচে এক যুবতি মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখলো।
লন্ঠনের আলোয় ওকে ভালমানুষের মেয়ে বলেই মনে হয়। লণ্ঠনটা ওর পাশে নামিয়ে রাখতেই ওর বেঢপ আকৃতির পেটের দিকে নজর পড়ে জমিরের।
আরে! এইটা তো দেখি পোয়াতি মাইয়া। হায় হায়! এই কোন ফ্যাসাদে পড়লো ও! ভেবে কুল কিনারা পায় না জমির শেখ। সামনের বাড়িটায় মৃদু জ্বলছে।
জমির ভাবে ওই বাড়িতে গিয়ে একবার সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু ওরা যদি তার সাথে মেয়েটাকে জড়িয়ে কেলেঙ্কারি রটায় তখন কি হবে? মনে মনে ভয় পায় জমির।
কিন্তু মেয়েটার কচি মুখের দিকে তাকিয়ে ওর খুব মায়া হয়। ভয়কে জয় করে সে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটাকে সাহায্য করবে।
জমির: “বাড়িত কেউ আছোইন নি? কুইইইইই? বাইরে আহেন তো দেহি।”
জমিরের ডাক শুনে ঘরের কাজের বুয়া, মরিয়ম বিবি বেরিয়ে আসে,
মরিয়ম: “কিতা হইছে? রাইত বিরাইতে আইসা ভেড়ার লাহান চিল্লাইতাছো কেন?” মরিয়মের কথা শুনে জমির শেখ খানিকটা দমে যায়।
কিন্তু বুকের সকল সাহসটুকু মিলিয়ে ও ফের বলে উঠে,
” না আফা, আফনা গো বাড়ির পিছের ওই বাঁশঝাড়ের তলে একডা পোয়াতি মাইয়া মরার লাহান শুইয়া আছে। একডু সাহায্য করবা নি? ”
জমিরের কথা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে মরিয়মের। সাঞ্জেকে ও বাড়ির পেছনে কলপাড়ে যেতে দেখেছিলো।
কিন্তু ও তো এখনো ফিরে নি? আল্লাহ না করুক মেয়ে যদি সাঞ্জে হয়ে থাকে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
উৎকন্ঠিত কণ্ঠে মরিয়ম বলে, “চলেন ভাই, চলেন। গিয়া দেহি তো।” বাঁশঝাড়ের নিচে যেয়ে সাঞ্জেকে পড়ে থাকতে দেখেই মরিয়ম আর্তচিৎকার ছাড়ে।
মরিয়ম: “আল্লা রে! এইডা তো দেহি আমাগো সাঞ্জে আফা। কে কনে আছো রে, জলদি আহ।
দেইখা যাও, আমাগো আফামনিডার কি হইলো,,,,,,,” মরিয়মের হাঁক ডাকে বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে যায়।
ছেলে বুড়ো সবাই এসে বাঁশঝাড়ের নিচে জড়ো হয়। মহিলারা ধরা ধরি করে সাবধানে অজ্ঞান সাঞ্জেকে ঘরের ভেতরে বয়ে নিয়ে যায়।
মসজিদে মিলাদ শেষ হতেই অভির কাছে দুঃসংবাদটা পোছে। মসজিদ থেকে এক ছুটে ও বাড়িতে ফেরে। এটারই ভয় পাচ্ছিলো ও এতক্ষণ।
ও বাড়ি ফিরতে ফিরতেই সাঞ্জের জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই ও একদম চুপ হয়ে আছে। কারো সাথে কোন কথা বলছে না।
তাই কেউ জানতেও পারলো না কলপাড়ে ঠিক কি ঘটেছে। অভি বাড়িতে ঢুকতেই সাঞ্জে আঁতকে উঠে চাচির আচলে মুখ লুকালো।
অভি এর আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে এগিয়ে যায় সাঞ্জের পালস চেক করতে। হাতটা ধরতেই ও চমকে উঠে।
মেয়েটার বা হাতে একটা কালসেটে পোড়া হাতের ছাপ। মাপটা একদম ওর হাতের মাপের।
ক্ষতটা আলতো করে স্পর্ষ করতেই সাঞ্জে ঝাঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়, তারপর ওটাকে সাঁ করে নামিয়ে আনে অভির গালের উপর।
চপাট,,,,, তারপর ও উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে থাকে, “আমাকে মারতে চেয়েছিলি কেন?
আমি আর আমার বাচ্চাটা মিলে তোর কি এমন ক্ষতি করেছিলাম? বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে। চাচি, ওকে চলে যেতে বল।”
সবার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে অভির আঁতে প্রচন্ড ঘাঁ লাগে। ও বুঝতে পারে সাঞ্জের কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
কিন্তু ও ঠিক বুঝতে পারছে না সমস্যাটা কোথায়। ও সিদ্ধান্ত নেয় সমস্যাটা ও পরে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবে।
আপাতত ওর এই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ। ওর উপস্থিতি সাঞ্জে সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না।
ও একটু ধাতস্থ হয়ে যাক, তারপর সে রুমে ফিরে আসবে।
..(পঞ্চম পর্ব)
জমির শেখ সেদিনকার মতো বাড়িতে ফেরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। অসাধারণ এক সন্ধা কেটেছে ওর পরিবারের সাথে।
বাচ্চা দুটো ফুটবল পেয়ে তক্ষুনি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো, “বাজান, আমাগো লক্ষী বাজান।”
তারপর রাতেই উঠোনে বল নিয়ে কিছুক্ষণ লোফালুফি খেলে। বউটাও চুড়ি পেয়ে মুচকি হাসি হাসে। চুড়ি পরা হাতে ওর পাতিলে ভাত বেড়ে দেয়।
টুংটাং শব্দে মন মাতিয়ে যায় জমিরের। রাত বাড়লে ওরা তাদের ছোট্ট কুঠিরে শুয়ে পড়ে।
জমির শেখ ও তার বউ হাসনা বেগম ঘুমায় একটা ছোট্ট খড়ের ঘিঞ্চি ঘরে। কিন্তু ছেলেদের জন্যে পাশেই নতুন টিনের ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
মাঝরাতে একটা ছায়ামূর্তি চুপিচুপি, ভাঙা খড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদের ঘরে ঢুকে।
গভীর ঘুমে বিভোর জমির শেখ বা হাসনা বানু কেউই ব্যাপারটা টের পায় না।
ছায়ামূর্তিটা হাসনা বানুর একটা শাড়ি চুরি করে খাটের নীচে বসে বসে ওটা পড়ে নেয়।
শেষরাতে হাসনা বানু প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ঘর ছেড়ে টয়লেটে যায়।
গ্রামের টয়লেট গুলি সঙ্গত কারণেই বসত ভিটা থেকে অনেকটা দুরে বানানো হয়। শেষরাতে ঘুটঘাট শব্দ শুনে জমিরের ঘুম ভেঙে যায়।
চোখ মেলে লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ও দেখে, হাসনা বাণু তার বিছানার পাশেই হাসি হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর প্রথমেই খেয়াল যায় বউয়ের হাতের দিকে। ওর হাতে তার দেওয়া চুড়িগুলি পড়া নেই কেন? জমির: “বউ, ও বউ।
চুড়ি গুলান খুইলা ফেইল্লা কেরে? পছন হয় নাই বুজি?” হাসনা বাণু জবাব দেয় না।
কেবল বিছানার নীচে পাওয়া ছেদি দাও টা আঁচলের নীচে শক্ত করে ধরে রাখে। বউ কথা বলছে না দেখে জমির বিছানায় উঠে বসে।
ওর বউ তো কখনো এমন ছিলো না। বউয়ের কথার চোটে কত রাতে ওকে বালিশের নীচে মাথা ঢুকিয়ে ঘুমাতে হয়েছে।
জমির উঠে বসতেই হাসনা বাণু আঁচলের নীচে লুকানো দা টা বের করে ওর গলায় ধাঁ করে একটা কোপ বসিয়ে দেয়।
ফিংকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে জমিরের কাটা গলাটা দিয়ে। নিঃশব্দে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে ও। হাসনাবাণুও তেমনি নিঃশব্দে হাসে।
ও প্রতিশোধ নিয়েছে। চরম প্রতিশোধ। আজ সন্ধায় পোয়াতি সাঞ্জে কে বাঁচানোর প্রতিশোধ।
কাজ শেষে হাসনা বাণু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। ভোরের আলো ফোটার তখনো ঘন্টা দুয়েক দেরি।
ও দিকে আসল হাসনা বাণু টয়লেট থেকে ঘরে ফিরেই হতভম্ব হয়ে যায়। চোখে মুখে অবিশ্বাস নিয়ে ও ভাবে এটা বুঝি কোন ভয়াল দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু পরক্ষণেই বাস্তবটা উপলব্দি করতে পেরে ও আর্তনাদ করে উঠে,
“আল্লা রে,,,, কিডায় আমার মন্টুর বাপ রে মাইরা ফালাইছে রে,,,,,,,,,,! ”
..(ষষ্ঠ পর্ব)
সেরাতে সাঞ্জে এতটাই ভয় পেয়েছিলো যে ও আর অভির পাশে ঘুমায় নি। রাতটা সে চাচির রুমেই কাটিয়ে দিয়েছে।
ওর এসব উদ্ভট আচরণ দেখে গ্রামের বিজ্ঞ মহিলারা বলতে শুরু করে ওকে না কি বাঁশঝাড়ের জংলি ভুতে ধরেছে।
তাকে একবার কেরামত উঝার কাছে নিয়ে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু অভি ওসব বিশ্বাস করে না।
ওর পাঁচ বছরের ডাক্তারিবিদ্যা সেসব গ্রাম্য কুসংস্কারকে হেলায় উড়িয়ে দেয়।
ও জানে গর্ভাবস্থায় মেয়েদের দেহে প্রাণরসের অসামঞ্জস্য (হরমোনাল ইমব্যালেন্স) দেখা দেয়।
এই অসামঞ্জস্যের কারণে গর্ভবতী মায়েরা অনেক অবাস্তব জিনিস অতিকল্পনা (হ্যালুসিনেট) করে। কিন্তু অভি কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না।
সাঞ্জে হঠাৎ ভাবতে শুরু করেছে যে ও তাকে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু কেন এমনটা হল?
ব্যাপারটা কি কেবলই কল্পনা না কি সত্যিই সাঞ্জেকে ভুতে ধরেছে? নাহ, তা হতে যাবে কেন? ভুত বলে কিছু থাকলে তো ধরবে।
এসব ভাবতে ভাবতে অভি পাশের রুমে একা একাই ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে ধর্মপ্রাণ চাচি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠে পড়েন।
সাঞ্জেকে একা ফেলে কলপাড়ে যেয়ে অজু করতে শুরু করেন। উনি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই কাজের বুয়া মরিয়ম সাঞ্জের রুমে ঢুকে।
কিন্তু ওর পরণে হাসনাবাণুর সেই বেগুনি শাড়িটা আর হাতে একটা রক্তাক্ত ছেদি দাও। ঘুমন্ত সাঞ্জে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না।
মরিয়ম বিবি চুপিসারে সাঞ্জের বিছানার কাছে এগিয়ে আসে।
তারপর হাতের দা টা আকাশের দিকে উঁচু করে ধরে, পরক্ষণেই নামিয়ে আনবে সাঞ্জের ঘুমন্ত গলায়। ঠিক তখনই রুমের দরজাটা খুলে যায়।
দরজা খুলার শব্দে মরিয়ম চকিতে দা টা আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলে। শেষ রাতে অজু করতে এসে চাচির কেমন জানি ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো।
এমনিতেই উনি হাপানির রোগি। যদি ভুল করে একটু ঠান্ডা লেগে যায় তাহলে তো সর্বনাশ। তাই উনি অজু না করেই ঘরে ফিরে আসেন।
সিদ্ধান্ত নেন মরিয়মকে দিয়ে একটু গরম পানি করিয়ে সেটা দিয়েই আজ অজু সারবেন।
ঘরে ফিরতেই দেখেন মরিয়ম গুটিগুটি পায়ে সাঞ্জের রুমের দিকে যাচ্ছে। ব্যাপার কি?
বুয়াটা কিছু চুরি করার মতলব এঁটেছে না তো? উনিও নিঃশব্দে ওর পিছু নেন। কিন্তু সাঞ্জের রুমে ঢুকেই সতর্ক মরিয়ম দরজাটা ভেজিয়ে দেয়।
ফলে বাহিরে থেকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই চাচিকে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হয়।
ভেতরে ঢুকতেই তিনি মরিয়ম কে ঘুমন্ত সাঞ্জের উপর ঝুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
ওর আঁচলে লুকানো দা টা ডিম-লাইটের আলো আধারীতে উনার চোখ এঁড়িয়ে যায়।
মরিয়মকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি রাগত গলায় যতটা সম্ভব নীচু স্বরে হিসিয়ে উঠেন,
“ওই মরিয়ম, এত রাতে এখানে কি করস? যা, রসুইঘরে গিয়ে আমার জন্য পানি গরম বসা।”
বিনা বাক্যব্যয় এ মরিয়ম ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের দিকে চলে যায়। আসল মরিয়ম তখনো রান্নাঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে বিভোরে ঘুমাচ্ছে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে সাঞ্জে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠে। গতরাতের ব্যাপারটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে থাকতে চায় ও।
ওর এই অভাবনীয় উন্নতিতে অভি বেশ খুশি। আজ বাংলাদেশে ওদের শেষ দিন। কালই ওরা ওয়ারশোর উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করবে।
অভি ভাবে আজকের দিনটা কোনভাবে পার হয়ে যাক,
কাল ওয়ারশোয় নেমেই সাঞ্জেকে ভাল স্ত্রি ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞের (গাইনোকলজিস্টের ) কাছে নিয়ে যাবে।
দিনটা ভালভাবেই কাটছিলো ওদের। কিন্তু দুপুর নাগাদ খবর আসে গ্রামে একটা মার্ডার হয়েছে। জমির শেখ আর নেই।
পুলিশ এসে ওর গলাকাটা লাশটা বাড়ি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। গ্রামে এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এক অদৃশ্য খুনি গ্রামে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেউকেউ রটায় জমিরের সাথে সখিনার পরকিয়া সইতে না পেরে সখিনার জামাই তফাদার এই খুনটা করে।
আবার কেউ বলে জমিরের কাছে আজিমউদ্দিন অনেক টাকা পায়। পাওনা টাকা না পেয়েই আজিমউদ্দিন এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
কিন্তু বেশীর ভাগ কুসংকারাচ্ছন্ন গ্রামবাসী বিশ্বাস করতে শুরু করে যে গ্রামে জীন ভুতের আছর পড়েছে।
এটা অশরীরী কোন ধারাবাহিক খুনির কাজ। জমিরকে দিয়ে কেবল শুরু। এরপর একে একে আরো অনেকেই এরূপ হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে।
সন্ধার পরেই সবাই ঘরে খিল এঁটে বসে থাকে। বিকাল থাকতে থাকতেই জমজমাট গ্রাম্য বাজার ফাঁকা হয়ে যায়।
অভিও সাঞ্জেকে একা ফেলে বাহিরে কোথাও যায় না। সন্ধার পর মরিয়ম কাপড় কাঁচতে কলপাড়ে গিয়েছিলো।
কলপাড়ে বসে কাপড় কাচতে কাচতে ওর চোখ গেল বাঁশঝাড়ের দিকে। অভি ওখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ওকে হাতের ইশারায় ডাকছে।
দৃশ্যটা মরিয়মের কাছে এতই স্বাভাবিক লাগলো যে ওর খেয়ালই হল না অভির পরনে সেদিন সেই চুরি যাওয়া কাপড় গুলিই।
কোন সন্দেহ ছাড়াই ও পান চিবাতে চিবাতে সেদিকে এগিয়ে গেল।
..(সপ্তম পর্ব)
মরিয়ম: “কি খবর ভাইজান? এইহানে কি করেন? মোরে ডাকছেন কিয়ের লাইগা? ”
মরিয়ম নাগালের মধ্যে আসতেই অভির হাতের দা টা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। মরিয়মের ফাঁক হয়ে যাওয়া গলা থেকে টুঁ শব্দটাও বেরুলো না।
আধাঘন্টা পর এক বালতি ধোয়া কাপড় নিয়ে এক নতুন মরিয়ম ঘরে ঢুকলো। সেগুলির মধ্যে অভির চুরি যাওয়া কাপড়টাও ছিলো।
এদিকে তার নিজের পড়নের কাপড়ে তখনো রক্তের লাল লাল ছোপ লেগে আছে।
সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ও তার পোটলা থেকে নতুন একটা শাড়ী বের করে পরে নিলো। আর রক্তমাখা শাড়িটা উনুনে পুড়িয়ে ফেলল।
সাঞ্জের হাতটা ধরে বিছানায় বসে আছে অভি। সারাটি সন্ধা ওরা এক সাথেই ছিলো। অভিকে কাছে পেয়ে গতরাতের সব কথা ওকে খুলে বলে সাঞ্জে।
অভি প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না। কিন্তু মেয়েটার হাতের পোড়া দাগটাও অস্বীকার করতে পারছে না।
কোন সমাধান ছাড়াই ওরা কথা বলার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। ওদের অনাগত সন্তানের নাম ঠিক করা নিয়ে কিছুক্ষণ ঝগড়া ঝাটি হয়।
খানিক পরে তা আবার মিটেও যায়। এভাবেই সেদিনের সন্ধাটা কেটে যায় ওদের। রাতের খাবার শেষে সাঞ্জে ফের অভির সাথেই ঘুমায়।
গতরাতের ঘটনাটা শুনার পর থেকে প্রতিটা মুহুর্তেই অভি ওকে চোখে চোখে রেখেছে।
রাত সাড়ে চারটার দিকে মশার অবিরাম গুন গুনানিতে অভির ঘুম ভেঙে যায়। খাটের নীচের মশার কয়েকটা নিভে গেছে।
গরমের ঠেলায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো দায়। তাই কয়েল জ্বালিয়েই শুয়ে পড়েছিলো ওরা। সাঞ্জের দিকে চোখ গেল ওর।
মেয়েটার সারা মুখে কালো মশাগুলি জটলা পাঁকিয়ে বসেছে। হাত নাড়িয়ে মশাগুলিকে তাড়ানোর চেষ্টা করলো ও।
কিন্তু চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ওরা ফের বসে পড়লো। নিরুপায় হয়ে অভি রান্নাঘরে গেল মশার কয়েল জ্বালিয়ে আনতে।
ও বেরিয়ে যেতেই একটা ছায়ামূর্তি অবিকল ওর মতোই দেখতে, খোলা দরজা গলে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
সারাটা রাত ধরে ছায়ামূর্তিটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো, কখন সাঞ্জেকে একা পাবে, আর পরপারে পাঠিয়ে দেবে।
এতক্ষণ পর ও সেই সুযোগটা পেয়েছে। তড়িঘড়ি করে ছায়ামূর্তিটা দা হাতে ঘুমন্ত সাঞ্জের দিকে এগিয়ে গেল।
ওদিকে রান্নাঘরে গিয়ে অভি মরিয়মকে ডাক দিলো, “বুবু, একটা কয়েল জ্বালিয়ে দাও। মশায় কাঁচা খাইয়া ফেললো।”
মরিয়মের কোন সাড়াশব্দ নেই। ডায়ানিং রুমে জ্বলতে থাকা বাল্বের মৃদু আভায় অভি আবিষ্কার করলো, রান্নাঘরে পাতা মরিয়মের বিছানাটা সম্পূর্ণ খালি।
বুয়া নেই ওখানে। ও ভাবলো হয়তো বাথরুমে গিয়েছে। হঠাৎ ওর মনে পড়লো ওর বেডরুমের ছোট্ট টেবিলের উপরেই তো একটা লাইটার আছে।
হঠাৎ ক্যারেন্ট চলে গেলে কুপি জ্বালানোর জন্যে। রান্নাঘরে এভাবে না হাতড়ে বেডরুমে বসেই তো ও সহজে কয়েলটা জ্বালিয়ে নিয়ে পারে।
নিজের নির্বোদ্ধতায় বিরক্ত হয়ে ও বেডরুমে ফিরে চলল। বেডরুমে ফিরেই ও দেখলো ওরই উচ্চতার একজন মানুষ ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
হাতে উদ্ধত ছেদি দা, ঘুমন্ত সাঞ্জের গলায় নেমে আসার প্রতিক্ষায়। অভি চিৎকার করে উঠলো, “না, না খবরদার। আর এক পাও এগুবি না।”
ওর হাঁক শুনে মুর্তিটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
চোখের ভুল কি না সন্দেহ, অভির কেন জানি মনে হলো লোকটা ওর চোখের সামনেই ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেল।
তার হাতের দা টা আস্তে করে নিচে নামিয়ে লোকটা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো।
ও ঘুরে দাঁড়াতেই ডিম লাইটের মৃদু আলোয় মাথার চকচকে টাক টা ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
আরে! এতো দেখি শরীফ! ওর এত্ত বড় সাহস সে সাঞ্জের গায়ে হাত তুলতে চায়!
ভালবাসার অন্ধমোহ আর প্রতিশোধের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় মত্ত হয়ে অভি খালি হাতেই ধেয়ে গেল, সসস্ত্র শরীফের দিকে।
অভির হাঁক শুনে সাঞ্জে ঘুম ভেঙে চোখ মেলল। ও চোখ খুলতেই দেখলো একটা অভি ওর সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে উদ্ধত ধারালো ছেদি দা।
অরেকটা অভি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছে। তারপরই বিছানার পাশের অভিটার চেহারা বদলে যেতে শুরু করলো।
চেহারা থেকে একে একে নাক, মুখ, চোখ, কান হারিয়ে গেল। ঠিক অর্হ্নশের মুর্তিটার মতো।
তারপর যখন নাক মুখ ফের গজালো, তখন চেহারাটা দেখতে ঠিক প্রফেসার শরীফের মতো ঠেকলো।
ধীর লয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে, শরীফ দা বাগিয়ে অভির দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কাছে আসলেই এক ঘা বসিয়ে দেবে।
ওদিকে বোকা ছেলেটাও ওসবের তোয়াক্কা না করেই বহুরূপী শরীফের দিকে দুড়ধাড় করে ছুটে আসছে।
দুজনের সংঘর্ষের ঠিক পুর্ব মুহুর্তে সাঞ্জে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাকিয়ে তাকিয়ে অভির নিশ্চিত মৃত্যুটা দেখার সাহস হল না ওর।
চোখ বন্ধ করে সে চিৎকার করে উঠলো, “না আ আ আ আ আ,,,,,”
হাতের দা টা বাগয়ে ধরে বহুরূপী শরীফ অবস্থান নেয়, ছুটন্ত অভিকে নাগালে পাওয়া মাত্র কোপ বসাবে। ওর মনের কথাটা পড়ে ফেলে অভি।
মাথা নীচু করে ছুটতে ছুটতে শরীফের কাছাকাছি আসতেই ওর বাম হাতটা মাথার উপর বাড়িয়ে ধরে।
দা এর প্রথম কোপটা বাম হাতের এক খাবলা মাংস তুলে পিছলে যায়। কিন্তু এতে ওর গলাটা রেহাই পায়।
পরক্ষণেই ছুটন্ত কাঁধ দিয়ে শরীফের বুকে এক প্রচন্ড আঘাত হানে ও। তাল সামলাতে না পেরে শরীফ দুহাত পেছনে ছিটকে পড়ে।
..(অষ্টম পর্ব)
খানিকের জন্যে অভির মনে হল ওর কাঁধে কেউ যেন লোহিত-তপ্ত লোহার পাত ঘষে দিয়েছে। কিন্তু ও সেটা পরোয়াই করলো না।
যখন ওর স্ত্রী কিংবা অনাগত সন্তানের প্রতি কোন হুমকি আসে তখন সে প্রচন্ড রক্ষণাত্মক।
মাটিতে পড়ে থাকা শরীফের উপর থেকে নজর সরিয়ে ও এবার সাঞ্জের দিকে তাকালো। ভয়ার্ত মেয়েটা দুহাতে চোখ মুখ ঢেকে চিৎকার করেই চলেছে।
অভি ওর মুখের উপর থেকে হাত দুটো সরালো। সাঞ্জে ভেবেছিলো চোখ খুললেই হয়তো ওর প্রিয়তমের কাটা মাথাটাই দেখবে।
তাই প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। হঠাৎ ও অনুভব করলো কে যেন ওর চোখের উপর চেপে থাকা হাত দুটো টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।
চোখ মেলতেই সে অভিকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। কিন্তু ও তখনো সন্ধিহান এটা কি খুনি বহুরূপী অভি না কি ওর প্রিয়তম?
সাঞ্জের চিৎকারে ঘর সুদ্ধ সবাই জেগে গেছে। তারা সবাই ওদের রুমের সামনে জড়ো হল।
ওরা সবাই ভেবেছে বাড়িতে বুঝি কোন চোর ডাকাত পড়েছে।
শক্তিশালী বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ক্ষেতের কামলা মঈনউদ্দি একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে সবার আগে ওদের ঘরে ঢুকে পড়লো।
মঈনউদ্দি: “কি হইছে ভাইজান? আপামনি চিল্লাইতাছে কেন?”
ভয়ার্ত সাঞ্জেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, অভি হাতের আঙুল দিয়ে ইশারা করে ঘরের কোণে পড়ে থাকা শরীফকে দেখিয়ে দেয়।
কিন্তু কোথায় শরীফ? শরীফের বদলে মৃত জমির শেখ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মঈনউদ্দি, জমিরের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানতো।
ওর লাশটা নিজের হাতে পুলিশ ভ্যানে তুলে দিয়েছিলো সে।
আচানক একজন মৃত মানুষকে উঠে বসতে দেখে ওর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে! মঈনউদ্দি: “উহ! মাগোওওও। ভুতে মাইরা ফাইল্লো রেএএএএএ।”
এক রাম চিৎকার দিয়ে মঈনউদ্দি পেছন ফিরে দৌড় লাগালো। কিন্তু দু পা ফেলতেই ও জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।
ওর চিৎকার শুনে বাড়ির মহিলারা আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। সবাই যে যার মতো পড়িমরি করে সটকে পড়ে।
কিন্তু ধার্মিক, খোদাভীরু চাচি মা দোয়া দুরুদ পড়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
ভেতরে ঢুকে আলো আধারীতে তিনি দেখলেন, একটা লোক দরজার সামনেই উপুর হয়ে শুয়ে আছে। তার পাশেই মঈনউদ্দিনের বাঁশের লাঠি।
তারপর চোখ গেল অভি আর সাঞ্জের দিকে। ওরা একে অপরকে জড়িয়ে বিছানায় জবুথুবু হয়ে বসে আসে।
সবার শেষে চোখ পড়লো, ঘরের কোণে থাকা মঈনউদ্দির উপর।
বিরাট বপুর লোকটা মুখে স্বভাবসুলভ বোকাবোকা হাসি নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।
উনি মঈনউদ্দির দিকে এগিয়ে যেয়ে বললেন, “কি রে মইন্না, চোর ঢুকছিলো না কি ঘরে? ” মঈনউদ্দি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতেই থাকে।
ওদিকে চাচিও প্রায় ওর কাছাকাছি পৌছে গেছেন। ওদের দুজনের অলক্ষেই অভি মাটিতে পড়ে থাকা লাঠিটা কুড়িয়ে নেয়।
চাচি আরেকটু কাছে আসতেই মঈনউদ্দি আগুয়ান চাচির টুটি চেপে ধরতে যাচ্ছিলো।
তখনই অভি চাচিকে অতিক্রম করে মঈনউদ্দির মাথায় একটা লাঠির বাড়ি বসিয়ে দেয়।
তা দেখে চাচি কঁকিয়ে উঠেন, “এইটা তুমি কি করছো বাজান? আমাদের মইন্নারে মাইরা ফেলবা না কি?”
ছোটবেলা থেকেই নিঃসন্তান চাচি মঈন্না কে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।
স্বভাবতই ওর উপর এমন নির্মম আঘাত তিনি সহ্য করতে পারলেন না। কিন্তু অভি উনার কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না।
সে একটা বাড়ি মেরেই ক্ষান্ত হয় নি। বরং নির্দয়ের মতো মইন্নাকে একের পর এক বাড়ি মেরেই চলল।
চাচি মাঝখানে পড়ে ওকে থামানোর সর্বউচ্চ চেষ্টা চালালেন। কিন্তু অভি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
এই বুড়ো বয়সে অভির ধাক্কা খেয়ে অসহায় চাচি ছিটকে পড়লেন , দরজার সামনের অজ্ঞান দেহটার ঠিক পাশেই ।
উনি হাচড়ে পাচড়ে উঠে ফের অভিকে থামাতে যাচ্ছিলেন,
ঠিক তখনই পড়ে থাকা দেহটা মৃদু গুঙ্গিয়ে উঠলো, “খালাম্মাগো, এইডা মুই কি দেহলাম গো! সাক্ষাইত ভুইঁত।”
স্বরটা চাচির কাছে বড্ড চেনা চেনা লাগলো। আরে! ওটা মইন্নার কণ্ঠ না?
দেহটাকে উপুর থেকে চিৎ করে শুয়াতেই মইন্নার চেহারাটা বেরিয়ে পড়লো।
চাচি অবাক হয়ে ভাবলেন এটা যদি মইন্না হয় তো ঘরের কোণে দাঁড়ানো ঐটা কে? ভাবতেই উনার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের এক হিমেল স্রোত বয়ে যায়।
জোরে জোরে দোয়া কালাম পড়তে পড়তে উনি ফের তাকালেন ঘরের কোণে পড়ে থাকা ওই বহুরূপীর দিকে। অভি তখনো ওটাকে পিটিয়েই চলেছে।
বারোয়াঁ বাঁশের শক্ত লাঠিটা অভির দৈহিক জোরকে যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। ওটার প্রথম আঘাত মাথায় পড়তেই বহুরূপীটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
কিন্তু তাতেও অভি থামে না। সে এক নাগাড়ে পিটিয়েই চলে। লাঠিপেটা করার ম্যারাথন এ নেমেছে যেন।
দশ পনেরো ঘাঁ পড়তেই ওটা নিথর হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অভি পেটানো চালিয়ে যায় যতক্ষণ পর্যন্ত বাঁশের মজবুত লাঠিটা না ভাঙে।
অবশেষে যখন লাঠিটা ভাঙলো ততক্ষণে ওর প্রায় শ খানেক ঘাঁ বসানো হয়ে গেছে। বহুরূপীর থেঁতলানো দেহটা উপুর হয়ে পড়ে আছে।
একটু নড়াচড়া করছে না। অভি ভয়ে ভয়ে ওটাকে পা দিয়ে চিৎ করিয়ে দিল, যেন চেহারাটা দেখা যায়।
কিন্তু ওটার চেহারাটা দেখার পর আর স্থির থাকতে পারলো না, সভয়ে দু পা পিছিয়ে এলো। এমন একটা চেহারা সে আগেও দেখেছিলো।
অর্হ্নিশের মুর্তির মুখে। নাক, মুখ, চোখ, কান বিহীন এক বিভৎস চেহারা। অভি আর ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না।
ওটার বিভৎস মুখের দিকে পিছন ফিরে সাঞ্জের মায়াবী বদনে চক্ষু স্থির করে। টলতেটলতে কোনমতে বিছানায় ফিরেই জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে পড়ে।
সাঞ্জে ওর মাথাটা কোলে তোলে নেয়। ঠিক তখনি অভির বা হাতের জখমটা সাঞ্জের নজরে পড়ে। ওটা থেকে তখনো রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে।
ওটা দেখেই সে আৎকে উঠে! ও মা! কত্ত রক্ত বেরুচ্ছে! এভাবে রক্ত বেরুতে থাকলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সাঞ্জে তার ওড়না দিয়ে ক্ষতটা আপাতত বেধেঁ দেয়।
..(নবম পর্ব)
কিন্তু অবাধ্য রক্তধারা ওড়নাকে ভিজিয়ে সেখান থেকে টপটপ করে চুইয়ে পড়তেই থাকে। ওদিকে চাচি ততক্ষণে নিজেনে সামলে নিয়ে উঠে বসেছেন।
সাঞ্জে তার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে সাহায্য চায়, “চাচি, তাড়াতাড়ি কিছু একটা করেন। ওর সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে।”
অভির হাতের ক্ষতটা চাচির ও চোখে পড়ে। তিনি বলেন, “আচ্ছা মা, একটু সবুর কর, আমি এক্ষুনি ব্যান্ডেজ নিয়ে আসছি।”
উনি তো আর ক্ষতটা কাছ থেকে দেখেনি। ভেবেছিলেন সামান্য কাটা ছেড়া, সামান্য ব্যান্ডেজ করে দিলেই সেরে যাবে।
কিন্তু সেলাই ছাড়া ওই ক্ষত শুকানোর নয়। তবুও তিনি একবার ভয়েভয়ে নিথর বহুরূপীর দিকে তাকান, তারপর বেরিয়ে যান ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে।
ও দিকে মঈনউদ্দি একটু আগে বাবাগো মাগো বলে ফের জ্ঞান হারিয়েছে। ঘরের মধ্যে একমাত্র সাঞ্জেই সজাগ ছিলো।
ও হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে খেয়াল করলো বহুরূপীটা নড়ছে।
প্রথমে মনের ভুল ভেবেছিলো কিন্তু পরক্ষণেই দেখলো ওটা হামাগুড়ি দিয়ে অনেক কষ্টে ওর দিকে এগুচ্ছে।
এত্তগুলি লাঠির বাড়ি খাওয়ার পর ওর আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই।
প্রথম কয়েক হাত ওটা ধীর গতিতে হামাগুড়ি দিয়ে, নিজেকে টেনে টেনে এগুচ্ছিলো ওটা।
তারপর হঠাৎ সাপের মতো একেঁবেকেঁ দ্রুত সাঞ্জের কাছে চলে আসলো। মেয়েটা ভয় পেয়ে ফের চেঁচালো, “না আ আ আ ,,,, সরে যাওওও।”
কিন্তু ততক্ষণে ওটা সাঞ্জের নাগাল পেয়ে গেছে। চিৎকারের সময় হাঁ করা মুখে ভেতর দিয়ে বহুরূপীটা ওর একটা হাত ঢুকিয়ে দিল।
সাঞ্জের মনে হল এক বিস্বাদ তরল ওর গলা বেয়ে নীচে নামছে। পর মুহুর্তেই দপ করে একটা শব্দ হল, আর অমনি ঘরটা মৃদু কুয়াশায় ঢেকে গেল।
কুয়াশা কাটতেই বহুরূপীটাকে আর কোথাও দেখা গেল না। খানিক পরেই চাচি রুমে ঢুকলেন। হাতে এক দলা পেঁজা তুলো আর ব্যান্ডেজের কাপড়।
কিছুক্ষণ সেগুলি দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেও তিনি ব্যার্থ হলেন। তবে সুখবর হল অভির ইতিমধ্যেই জ্ঞান ফিরেছে।
সে চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো। জ্ঞান ফিরতেই বা হাতে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছিলো ও।
হাতের ক্ষতের দিকে চোখ পড়তেই ওর একটু আগের ঘটনাগুলি মনে পড়ে যায়।
ঘাড় ঘুরিয়ে ওর চোখ দুটো দিয়ে সারারুমে তল্লাসি চালায়, তারপর চাচি ও সাঞ্জের মুখের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।
ও বুঝার চেষ্টা করে এ ঘরের কোথায় বহুরুপীটা লুকিয়ে আছে। ভাবে চাচি আর সাঞ্জের মধ্যে যেকোন একজনই হয়তো সেই বহুরূপী।
ওর চোখের ভাষা পড়তে পেরে সাঞ্জে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “শান্ত হও হোনার। ওটা চলে গেছে।”
একথা শোনার পর ও উৎকন্ঠিত চিত্তে পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে, “তোমার কিছু হয় নি তো মাজেস্টি? ” সাঞ্জে না সূচক মাথা নাড়ে।
এবার অভির মুখে স্মিত হাসি ফোটে। অভি বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ল্যাগেজটা খুলল ।
ওর ল্যাগেজে সবসময়ই একটা মাঝারী আকৃতির ফার্স্টএইড কিট থাকে।
ডাক্তার হয়েছে বলে একটা ভাব নেওয়া লাগবে না? কিন্তু আজ ওর সেই ভাব নেওয়াটা সার্থক হল।
ফার্স্টএইড কিট খুলে কিছু বন্ধাকৃত (স্টেরিলাইজড) ভেড়ার নাড়ীভুঁড়ির তন্তু দিয়ে বানানো সুতা বের করলো।
তারপর তরল কার্বানাইলের ঠান্ডা স্প্রে দিয়ে ওর ক্ষত স্থানটা অচেতন করে নিয়ে, নিজেই সেলাই করলো।
গ্রামের সবচেয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালটাও প্রায় ২০ কি,মি দুরে। এই কিট টা না থাকলে সত্যিই অনেক সমস্যায় পড়তে হত।
ওদিকে মঈনউদ্দি ও জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। তবে এখনো কাথাঁ মুড়ি দিয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপছে ও।
অভি যখন নিজের ক্ষতটার শুশ্রূষা করছিলো তখনই সাঞ্জে তার তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে।
সেটা বাড়তে বাড়তে সারা পেটেই ছড়িয়ে। তারপর এক সময় সহ্যের বাহিরে চলে যায়।
সাঞ্জে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “অভি, আমার সময় হয়ে এসেছে।” ওর কথা শুনে অভি হতবাক হয়ে যায়।
ডায়াগনোসিস অনুসারে ওর প্রত্যাশিত ভুমিষ্টের দিন (EDD=expected date of delivery) এখনো তিনমাস বাকি।
তবে কি ওই বহুরূপীটা দেখে ভয় পেয়ে ওর গর্ভপাত (abortion) হতে যাচ্ছে?
যদি তাই হয় তো ওকে এই অবস্থায় বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্যে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না অভি।
দ্রুত ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে গাড়ি ভাড়া করতে। সাঞ্জেকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে।
এরই মধ্যে ভয় পেয়ে সটকে পড়া মহিলাদের মুখ হয়ে, ওদের বাড়িতে ভুত হানা দেওয়ার ঘটনাটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো।
গ্রামবাসী মোল্লা-কবিরাজ, তাবিজ কবজ, পানি পড়া নিয়ে ওদের বাড়ির চারপাশে ভিড় জমিয়েছে।
এদের মধ্যে কয়েকজন যুবকের হাতে লাঠি, দা, শাবল ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। আজ ওই ভুতের বাঁচার কোন আশা নাই।
গ্রামবাসীর গনধোলাই খেয়েই ওটাকে অক্কা পেতে হবে। দরজা খুলে বেরুতেই অভি অবাক হয়ে যায়! বাড়ির সামনে এত মানুষের জটলা কেন?
ও বেরুতেই সবাই এক সাথে ওকে ছেঁকে ধরে ….
গ্রামবাসী ১: “ভাই, ওই ভুতটা কি এহনো বাড়ির অন্দরেই আছে?”
গ্রামবাসী২: “ভাইজান, ওইডা দেইখতে কিয়ের লাহান? ”
গ্রামবাসী৩: “এই পানি পড়া ডা নেন। ওইডার গায়ে ছিটাইয়া দিলে পিচাশটা মইরা ভুত হইয়া যাইবো। ”
সবার সম্মেলিত শোরগোলে অভি কারো কথাই ভাল মতো শুনতে পায় না।
এক সময় ও বিরক্ত হয়েই হাত উঁচু করে সবাইকে থামতে ঈঙ্গিত করে। শোরগোল একটু কমে এলে ও গলা উঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করে।
জড়ো হওয়া সবকটা চোখই ওর উপর আটকে যায়। অভি: “দেখুন ভাই। এসব ভুত টুত কিছু না।
আমাদের বাড়িতে একটা চোর ঢুকেছিলো। ওই বেটাকে দেখে আমার বউ ভয় পেয়ে চিৎকার দেয়। সে চিৎকার শুনে মঈনউদ্দিও আসে।
সে ও চোর কে দেখে ভুত ভেবে ভয়ে চিৎকার জুরে দেয়। এসব চিৎকার চেঁচামেচিতে চোর বেটা পগারপার হয়ে যায়। এই কাহিনী।”
গ্রামবাসী এই কাহিনীটা মেনে নিতে চায় না। ওদের কেমন জানি খটকা লাগে। মঈনউদ্দি তো সামান্য চোর দেখে ভয় পাওয়ার মতো লোক না।
ও রাত বিরাতে শশ্মান ঘাটের খালে দিব্যি মাছ ধরতে যায়। ভয় ডরের কোন বালাই নেই ওর মাঝে।
একজন গ্রামবাসী তো প্রায় প্রতিবাদ করে উঠে, “মইন্না রে ডাক দেন। ওই বেডারে জিগাইয়া দেহি, হালায় চিক্কুর পাড়ছে কে রে।”
অভি ব্যাস্ত কণ্ঠে বলে, “দেখুন এসব পরে দেখা যাবে। আমার স্ত্রীর ব্যাথা উঠছে। ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
প্লীজ আপনারা এখানে ঝামেলা বা পাকিয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যান।”
..(দশম পর্ব)
আনিছুলের ছেলে রহিম পেশায় একজন ড্রাইভার। গতরাতে ও এক লম্বা ট্রিপে গিয়েছিলো। রাতে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।
তাই গাড়িটা মালিকের গ্যারেজে ফেরৎ না দিয়ে ওর বাড়ির উঠোনেই পার্ক করে রেখেছিলো।
অভির কথা শুনে ও বলে, “হাসপাতালে নিবেন কেমনে ভাইজান? হেইডা তো মেলা দুর।
কোন গাড়ির খোজ পাইছেন? না পাইলে মোর গাড়ি খান লইয়া আহি? ” অভির কাছে মনে হয় এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
ও ভাবছিলো ঢাকা সিলেট হাইওয়েতে যেয়ে একটা খালি গাড়িকে খুজে বের করে নিয়ে আসবে। এ কাজে নুন্যতম আধা ঘন্টা সময় লাগতো ওর।
ও এগিয়ে এসে রহিমকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাই, তাড়াতাড়ি তোর গাড়িটা নিয়ে আয়। ওর অবস্থা খুব একটা ভাল না।”
রহিম কেবল “যাইতাছি ভাইজান” বলেই এক দৌড়ে চলে যায়। দু মিনিটের মধ্যেই একটা ভাঙাচোরা নোহা এস,ইউ,ভি নিয়ে আসে।
সাঞ্জেকে কোলে করে নিয়ে অভি তাতে উঠে বসে। চাচি ও সাথে চলেন। গাড়িটা দ্রুত সদর হাসপাতালের দিকে চলতে শুরু করে।
গোয়ালাবাজার শহরটা অতিক্রম করতেই সাঞ্জের চিৎকার চরমে উঠে। অভি একদম ঘাবড়ে গেছে।
পশুরডাক্তার হওয়ায় জীবনে প্রায় হাজার খানেক ডেলিভারি দেখেছে ও। গরু, ভেড়া, কুকুর, বেড়াল, এমন কি বাঘের ও।
কিন্তু মানুষের ডেলিভারি ওর জন্যে এটাই প্রথম। তা ও আবার ওর প্রিয়তমার ডেলিভারি।
ও ভেতরটা হাতড়াতে যেয়ে তার সন্তানের মাথাটা অনুভব করে! আরে! ওটাতো বেরিয়ে আসছে!
পশুদের ডেলিভারির জ্ঞানটা ও সাঞ্জের উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করলো।
তলপেটে আলতো করে মেসেজ করতে করতে চেঁচিয়ে বলে, “পুশ সাঞ্জে, পুশ। আরো জোরে। আরেকটু।”
কিছুক্ষণ পরেই নবাগতের ওয়াও ওয়াও কান্নার ধ্বনিতে গাড়ির ভেতরটা মুখরিত হয়।
প্রচন্ড কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেয়ে সাঞ্জে গাড়িতেই নেতিয়ে পড়ে।
ওদিকে রক্ত আর ভ্রূণীয় তরলে (আমনিওটিক ফ্লুইড) এ মাখামাখি বাচ্চাটাকে কুলে নিয়ে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে অভি।
ওর হাতে প্রথম মানুষের ডেলিভারি সফল হয়েছে। সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে মোটেও কম আনন্দের নয় ব্যাপারটা।
সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতেই ও অনুভব করে বাচ্চাটা অত্যন্ত দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস ফেলছে।
ও সদ্যজাত শ্বাসকষ্টতে (নিওন্যাটাল নিউমোনিয়া) আক্রান্ত। তাছাড়া ওর শরীর দ্রুত ঠান্ডা হয়ে আসছে।
ওর দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা (হমোথার্মিক সিস্টেম) এখনো পুর্ণতা পায় নি। একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় গাড়িতে উঠেছিলো ওরা।
বাচ্চার জন্যে একটা তোয়ালেও আনে নি।
ওর হঠাৎ মনে পড়লো ডাক্তারিবিদ্যায় ও পিড়েছিলো,
প্রসবকালীন আম্লজান উত্তেজক প্রাণরস (অক্সিটোসিন হরমোন) এর প্রভাবে প্রসূতি মায়েদের দেহজ শক্তিউৎপাদী বিক্রিয়া (ক্যাটাবলিজম) বেশী পরিমানে হয়।
ফলে তাদের দেহের তাপমাত্রা অন্য যে কারো দেহের থেকে অনেক বেশী হয়। বাচ্চাটাকে সাঞ্জের কোলে দিলেই ও সবচেয়ে বেশী উষ্মতা পাবে।
বাচ্চাটাকে সাঞ্জের কোলে রাখার সময় মেয়েটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
অভি প্রথমে ভেবেছিলো ওর বুঝি প্রসবজনিত সাময়িক নিসাড়তা (পোস্ট পারটাম ট্রানজিয়েন্ট কনকাশন) হয়েছে। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ও খেয়াল করলো সাঞ্জের বুকটা আর শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে উঠা নামা করছে না।
তাড়াতাড়ি নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে সে বুঝলো যে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।
দ্রুত মেয়েটার বুকে পাম্প করতে করতে ওর রেডিয়াল ধমনী পরীক্ষা করলো অভি। সব শেষ। ওর ধমনী একটু ও নড়ছে না।
শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে এক্ষুনি একটা পেইস মেকার (সরাসরি হৃদপিণ্ডে তড়িৎ প্রবাহকারী যন্ত্র, যা কার্ডিয়াক এরেস্ট এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।) দরকার।
ওটা দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু গাড়িতে কোন পেইসমেকার নেই। আর হাসপাতালটাও এখনো নুন্যতম আধাঘন্টার দুরত্বে।
খানিকের জন্যে ও ভাবলো গাড়ির ব্যাটারির তড়িৎ দিয়ে হয়তো পেইসমেকারের কাজ চালানো যেতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দিলো।
গাড়ির ব্যাটারির শক্তি মাত্র ১২ ভোল্ট, যা দিয়ে ইগনিশন চ্যাম্বারে একটা স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করা যায় মাত্র।
পেইসমেকারের জন্যে নুন্যতম ২৫০-৫০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এ কাজের জন্যে প্রায় একশোটা গাড়ির ব্যাটারি লাগবে।
নিরুপায় হয়ে ও বাচ্চাটা কে সাঞ্জেত কোল থেকে নিয়ে নিলো। ও যখন ছেলেটাকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো সাঞ্জে তখন ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে ওপারে।
সাঞ্জের ঠোটে একটা বিদায় চুম্বন খেয়ে ও ঢুকরে কেঁদে উঠলো। বুঝ হওয়ার পর থেকেই অভি কখনো কারো সামনে কাঁদেনি।
কিন্তু আজ ওকে কাঁদতেই হবে। না কাঁদলে ব্যাথায় বুক ফেঁটে সেও মরে যাবে। বাচ্চাটা তখন একদম এতিম হয়ে যাবে যে।
অবশেষে গাড়িটা হাসপাতালে পৌছলো। ইম্মেচুর বাচ্চাটাকে তাৎক্ষণাত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তী করা হল।
সাঞ্জের লাশটা আর গাড়ি থেকে নামানো হয় নি। ফিরতি পথে ওকে গোয়ালাবাজারে ফেরৎ পাঠানো হল।
আজ বিকালেই আসরের নামাজের পর ওর জানাজা। জানাজা শেষে ওকে তার দাদির কবরের পাশেই দাফন করা হবে।
আশাকরি দাদি-নাতনি একত্রে থাকতে কোন অসুবিধা হবে না। বুড়িটা ওকে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
ইনটেনসিভ কেয়ারে সম্পূর্ণ ডায়াগনোসিসের পর বাচ্চাটার একগাদা রোগ ধরা পড়লো।
সল্প ওজন (ক্যাকেকশিয়া), হৃদপিণ্ডের অলিন্দদ্বয়ের বিচ্ছেদক পর্দার অসম্পূর্ণতা (Atrip Septal defect),
জন্মগত ডানপন্থী হৃদপিণ্ড (কনজেনিটাল ডেক্সট্রোকার্ডিয়া), অনুন্নত রেচনাঙ্গ (মনো-রেনাল হাইপোপ্লাসিয়া),
ফুসফুসের শ্বাসপ্রকোষ্টে পিচ্ছিলকারকের অভাবজনিত শ্বাসকষ্ট (নিওন্যাটাল নিউমোনিয়া),
অন্ডকোষের অন্ডথলিতে নিম্নগমণে অক্ষমতা (ক্রিপ্টো-অর্কিডিজম) মলদ্বারের অনুপস্থিতি। বাচ্চাটার জীবন একটা সুতোর উপর ঝুলছিলো।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ডাক্তারদের উপর অভি আস্থা রাখতে পারে না।
সিঙ্গাপুর থেকে জুরুরী ভিত্তিতে, কোটি টাকা খরচে এয়ার এম্বুলেন্স নিয়ে আসে ও।
তারপর দুপুরের মধ্যেই বাচ্চাটাকে নিয়ে ওয়ারশোর উদ্দেশ্যে উড়ে যায়। সাঞ্জের জানাজায় অংশ নেওয়ার সুযোগটা আর মেলে না।
ওয়ারশোয় এসে ইউরোপের সেরা ডাক্তারদের দিয়ে বাচ্চার চিকিৎসা করায় অভি।
টানা পাঁচমাস হসপিট্যালে কাটানোর পর আল্লাহর রহমতে সুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে ও ঘরে ফেরে।
বড্ড শখ করে ওর নাম রাখে জুবায়ের।
..(একাদশ পর্ব)
সাঞ্জের অবর্তমানে জুবায়েরই ওর একমাত্র সম্বল। অভি আগে তিন তিনটা ফার্মে পার্ট টাইম চাকুরী করতো।
আর সন্ধায় পোষ্য প্রাণীদের নিয়ে প্রাইভেট প্রাক্টিস। সাঞ্জে বেঁচে থাকতে প্রচুর রোজগার করেছে সে।
তখন তো আর গৃহস্থালি কাজকর্ম নিয়ে ভাবতে হত না, সাঞ্জেই সব সামাল দিতো।
দিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে রাতে বাড়ি ফিরেই দেখতো টেবিলে ভাত তরকারি সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। হাত ধুয়েই ও বসে পড়তো।
খাবার শেষ মেয়েটাই থালাবাসন ধুয়ে পরিষ্কার করতো। অভিকে কক্ষনো কিচেনে ঢুকতেই হয় নি।
কিন্তু সাঞ্জের অনুপস্থিতিতে কাপড় কাচা থেকে শুরু করে ঘর মোছা, বিছানা গোছানো থেকে নিয়ে রান্না করা, সকল কাজই ওকে একা করতে হয়।
তার উপর যোগ হয়েছে যুবায়েরের দেখা শোনা। ওর কাপড় বদলানো, দুধ গরম করা, কোলে নিয়ে কান্না থামানো আরো কত্ত কি।
ঘর সামালাতে যেয়ে একে একে তিনটি ফার্মের চাকুরিতেই ও ইস্তেফা দিয়ে দেয়।
কেবল জীবিকা নির্বাহের জন্যে কেবল দৈনিক দু ঘন্টা প্রাইভেট প্রাক্টিস করতো। এতে ওর সপ্তাহিক আয় কমে দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে যায়।
কিন্তু ওইটুকু দিয়েই বাপ বেটার সংসার স্বাচ্ছন্দে চলতে থাকে। এত কিছুর পরেও অভি দ্বিতীয় বিয়ের পথে পা বাড়ায় না।
কি দরকার? বাকি জীবনটা নাহয় যুবায়েরকে নিয়েই কাটিয়ে দেবে। দেখতে দেখতে যুবায়ের বেড়ে উঠে। কিন্তু ও আর সব ছেলে মেয়েদের মতো নয়।
ও কথা বলতে পারতো না। অভি ওর সাথে ঈশারায় কথা বলতো। স্কুলে বাচ্চাদের সাথে ও মোটেও মিশতো না। ওর কোন মেয়েবন্ধু ছিলো না।
ও জন্মদিনে কোন বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে বাড়ি আনতো না, আবার কারো দাওয়াতে যেত না।
ওকে বেশ কয়েকবার সাইকোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো অভি। কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু লেখাপড়ায় ও সব সময়ই ভাল করতো।
ক্লাসে সবসময় ওর রোল ১-৩ এর ভেতরেই থাকতো। পড়ালেখায় ভাল হওয়ায় অভি ওর মানসিকতা নিয়ে আর বেশী ঘাটাঘাটি করে নি।
এভাবে চলতে চলতে যুবায়ের একদিন শৈশব ছেড়ে কৈশরে পা দেয়। আজ ওর ১৩ তম জন্ম দিন।
জন্মদিন উপলক্ষে আত্মীয়, বন্ধু ও শোভাকাঙ্খিদের পক্ষ থেকে অভির কাছে প্রচুর ইমেইল আসে।
উল্লেখ্য যে যুবায়েরের নিজস্ব কোন ইমেইল আক্যাউন্ট ছিলো না। ও কম্পিউটারের সামনে খুব একটা বসতে চাইতো না।
তাই অভি তার কাছে আসা ইমেল গুলি ওকে দেখাচ্ছিলো। ছেলেটার সাথে মেতে থেকে সাঞ্জের মৃত্যুবার্ষিকীর বেদনা ভুলে থাকতে চায় সে।
অভি: “এই যে দেখ, শোরেন্সা তোমায় উইশ করেছে। দেখ, দেখ। ও একটা কেকের ফটো দিয়ে নিচে লেখেছে হ্যাপি বার্থডে।”
ওটা দেখে যুবায়ের হেসে হাততালি দিয়ে উঠে। তাই দেখে অভি টিম্পনি কাটে, “বাহ! তোমাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।
আর মেয়েটাও ইমেইলের শিরনামে লিখেছে লাভ ইউ যুবায়ের।
তোমাদের দুজনের প্রেম চলছে বুঝি?” ছেলেটা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে, উঠে তার রুমে চলে গেল।
অভি ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমের কাউচে একা পড়ে রইলো। ওর একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে স্মৃতি তার নিষ্ঠুর অত্যাচার শুরু করে।
সাঞ্জে হঠাৎ করেই স্মৃতির পাতা থেকে চোখের সামনে চলে এল। সেই মায়াবী লাল গাল, আর কামুক গোলাপি ঠোট।
মনকাড়া সেই মিষ্টি চাউনি যা অভিকে একদিন পাগল করে তুলতো। কেন জানি নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে অভির।
সে ই তো সাঞ্জেকে বাচ্চা নিতে উদভুদ্ধ করেছিলো।
তারপর গর্ভাবস্থার ৭ম মাসের সংকটময় মুহুর্তে তাকে এতটা পথ জার্নি করিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন গাড়িতে বসে মেয়েটা যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দোলছিলো, ও তখন বাবা হওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে নবাগত সন্তানকে নিয়ে ব্যাস্ত।
ওর উপর অভিমান করেই সাঞ্জে চলে গেছে না ফেরার দেশে। সবকিছুর জন্যে সে ই দায়ি। আর ভাবতে পারে না অভি।
এবার ভাবনার রাশ টেনে ধরা উচিৎ। নইলে ও পাগল হয়ে যাবে। মনটাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে এনে ল্যাপটপের মনিটরে স্থির করলো।
প্রাপ্ত ইমেইলগুলি একে একে পড়তে শুরু করলো ও। বেশীরভাগ ইমেইল ই যুবায়েরের জন্মদিনের উইশ সম্বলিত।
কিছু কিছু ইমেইলে ওর কয়েকজন গ্রাহক তাদের পোষা প্রাণীর রোগের বর্ণনা দিয়ে প্রতিকার জানতে চেয়েছেন, আবার কিছু হাবিজাবি ইমেইল ও রয়েছে।
এসবের মাঝে একটা ইমেইলে ওর চোখ আটকে গেল। ওটার প্রেরক জৈনিক শরীফুল হক নামক এক ভদ্র লোক।
নামটা চেনা চেনা লাগলো ওর। এটা কি ওর সেই বন্ধুটা যার সাথে বাংলাদেশে দেখা হয়েছিলো? ইমেইলটা খেলেই নিশ্চিত হল যে ওটা শরীফই।
তারপর ওদের মধ্যে শুরু হল বার্তা বিনিময় যা একসময় লাইভ চ্যাটে গড়ায়।।
চ্যাট করতে করতে অভি জানতে পারলো সেদিনের আসিস্টেন্ট প্রফেসর শরীফ আজ ঢাবি’র পুরাতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ শরীফুল হক।
সেই বহুরূপীর মন্দিরের উপর থিসিস লিখেই ও পি,এইচ,ডি পাশ করেছে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত বহুরূপীর মন্দিরের রহস্য এর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দুরে অবস্থিত একটা শীব মন্দিরে লুকায়িত ছিলো।
মাটি খুড়ে সেই শীব মন্দিরের অস্তিত্ব আবিষ্কারের পরপরই বহুরূপীর মন্দিরের সকল রহস্য সমাধান হয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে ওই শীব মন্দিরের উপাসকেরাই বহুরূপীর মন্দিরকে ধ্বংস করেছিলো।
আক্রমণের আগে ব্রাম্মণরা বহুরূপীর মন্দিরের উদ্ভট আচার প্রথা একটা প্রস্তর ফলকে খুদাই করে ,
শীব মন্দিরে সংরক্ষিত করে রেখেছিলো যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঐ মন্দির আক্রমণের সঠিক কারণগুলি জানতে পারে।
ওই ফলকের সাহায্যেই শরীফ বহুরূপীর মন্দিরের রহস্য সমাধান করে তারপর সেটাকে থিসিস আকারে লিখে জমা দেয়। ব্যাস।
এমন এক অসাধারণ আবিষ্কারের জন্যে সাথে সাথেই ওকে পিএইচডি দিয়ে দেওয়া হয়।
পি,এইচ,ডি কমপ্লিট করতেই ও প্রমোশন পেয়ে আসোসিয়েট প্রফেসর, তারপর প্রফেসর, সবশেষে ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান হয়ে যায়।
তারপর ওর ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন করা এক লেকচারারকে বিয়ে করে সংসার পাতে ও। বছর ঘুরতেই ওদের একটা কন্যা সন্তান জন্ম হয়।
এখন ওই মেয়েটা প্রায় ৮ বছরের হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ভালই চলছে ওদের জীবন।
তারপর শরীফ ওকে তার সংসারের ব্যাপারে জিজ্ঞাস করলো। অভি তাকে সবকিছু খুলে বলল না।
কেবল সংক্ষেপে বলল, প্রসবজনিত জটিলতায় সাঞ্জে মারা গেছে। শুনে শরীফ অনেক দুঃখ প্রকাশ করলো।
এভাবে ওদের কথা চলতেই থাকলো। প্রায় ঘন্টা দুইয়েক ধরে। কথা বলার এক পর্যায়ে অভি, শরীফের থিসিস পেপার গুলি দেখতে চাইলো।
শরীফ ও খুশি মনে সেগুলি স্কান করে পিডিএফ আকারে পাঠিয়ে দিলো। তারপর আরো কতক্ষণ চ্যাট করার পর শরীফ ঘুমাতে চলে গেল।
অভি ফের একা হয়ে গেল। একাকী সময় কাটানোর জন্যে সে তখন থিসিসের পেপার গুলি পড়তে শুরু করলো।
..(দ্বাদশ পর্ব)
সেদিনের সন্ধাটা ওই থিসিস পড়েই কাটালো ও। রান্না বান্না কিচ্ছু করলো না। পাশের রেস্টোরেন্ট থেকে কিছু খাবার অর্ডার করে আনিয়ে নিলো।
ছেলেকে নিয়ে সেগুলি খেয়েই শুয়ে পড়লো ও। ছেলেটাও নিজের রুমে যেয়ে শুয়ে পড়েছে। অভি ফের থিসিসটা সময় নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লো।
তারপর ওটার একটা সারসংক্ষেপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। বহুরূপীর মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এর স্থাপনের কাল এবং ধ্বংসের কারণ নির্দেশ করে।
কিন্তু এর ভেতরের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সন্যাসব্রত লিপিবদ্ধ আছে শীব মন্সিরের ওই প্রস্থর ফলকে।
ওটা থেকে জানা যায় বহুরূপী অর্হ্নিশ একজন মানুষ। ও স্বর্গালোকের কোন দেবতা নয়।
ও কোনভাবে তন্ত্রমন্ত্র খাটিয়ে রূপ বদলানোর প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে ফেলেছিলো।
শীব মন্দিরের প্রস্থরলিপি অনুসারে ও অসুর-রাজ পিকাংসুর বর লাভ করেছিলো।
কিন্তু পরবর্তীতে অর্হ্নিশ পিকাংসুর চেহারা নকল করে তার সৈন্য সামন্ত পরিচালনা শুরু করে ও তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়।
পিকাংসু ক্রোদ্ধ হয়ে তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্হ্নিশ বারবার রূপ বদলে পিকাংসুকে ফাঁকি দিতেই থাকে।
কিন্তু সে জানতো একদিন না একদিন পিকাংসু তাকে মেরে ফেলবেই। কারণ পিকাংসু নিজেই একজন বহুরূপী ছিলো।
ও একটা জজ্ঞ আবিষ্কার করে যাতে ওর নিজের আত্মাকে ভেঙে অন্যের দেহে সহজীবী আকারে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
এতে পোষক পাবে রূপ বদলানোর অপার্থিব ক্ষমতা, আর সহজীবী আত্মা খন্ড পাবে বেঁচে থাকার অপার আনন্দ।
সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ও এক তান্ত্রিকের সাহায্য প্রার্থী হয়। ওই তান্ত্রিক কে নিজের আত্মা উপহার দেয়।
তান্ত্রিক ওই আত্মাকে ভেঙে কতগুলি মুর্তির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। তারপর মুর্তিগুলি কে পিকাংসুর অগোচরে মেঘালয় থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশে এসে ওই তান্ত্রিক তামিখাসুর মন্দির স্থাপন করে আর মূর্তিগুলিকে সে মন্দিরে স্থাপন করে।
দেখতে দেখতে তামিখাসুর মন্দিরে কতগুলি ভক্তের আবির্ভাব হয়। তান্ত্রিক তাদের দেহে একে একে অর্হ্নিশের আত্মা ঢুকিয়ে দিতে থাকে।
এই ভক্তরা সংগোপনে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে মানুষের ক্ষতি করতে থাকে।
এভাবে চলতে চলতে গ্রামে এমন অবস্থা হয় যে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সবাই একে অন্যকে বহুরূপী ভাবতে থাকে।
তখন ব্রাম্মণরা এটা থামাতে এগিয়ে আসে। ওরা সবাই মিলে বহুরূপীর মন্দিরটাকে ধ্বংস করে দেয়।
সেখানে থাকা সকল বহুরূপীকে খুঁজে বের করে পুড়িয়ে মারে।
মন্দির স্থাপনকারী সেই তান্ত্রিকটা শীবমন্দিরে থাকা ছদ্দবেশী এক বহুরূপী চরের মাধ্যমে আক্রমণের ব্যাপারে আগেই সতর্ক হয়ে যায়।
সে তাৎক্ষণাত তার শিষ্যদের নির্দেশ দেয় যেন ওর দেহকে চুনের সুরকি আর চিনা মাটির মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে ফেলে আরেকটি অর্হ্নিশের মুর্তি বানানো হয়।
ও জানতো এতে তার মৃত্যু হবে, কিন্তু ও বেপরোয়া ছিলো। ওর দেহ দিয়ে মুর্তিবানানো হয়ে গেলে শিষ্যরা তাদের নতুন যজ্ঞ শুরু করে।
অর্হ্নিশের সবচেয়ে বড় মুর্তি থেকে সবচেয়ে বড় আত্মাখন্ডকে এনে নতুন মুর্তিটায় ঢুকিয়ে দেয়।
তারপর মুর্তিটাকে ব্রাম্মণদের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে একটা রক্ষাকারী মন্ত্র পড়ে বন্ধ করে দেয়।
ওই মন্ত্রের বলে এই মুর্তি ধ্বংসকারীর পরিণতি এই মূর্তির মতোই হবে।
তারমানে কেউ যদি এই মূর্তির হাত কেটে ফেলে তো ওর নিজের হাত কাটা পড়বে, কেউ যদি গলা কেটে ফেলে তো ওর নিজের গলাটাও যাবে।
তাই ব্রাম্মণরা একে ধ্বংস করতে পারে নি। তারা সেটাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ভিটার নিচে গহীন গর্ত করে পুঁতে রাখে।
এটাই সেই মুর্তি যেটা সাঞ্জের উপস্থিতিতে সেদিন খুজে পাওয়া গিয়েছিলো। এত্ত কিছুর পেছনে তান্ত্রিকের একটাই আশা ছিলো।
এই মুর্তি থেকেই একদিন ও আবার ফিরে আসবে।
জাদুবলে মুর্তিটা এমনভাবে বানানো হয়েছিলো যেন কেউ ওর মুখটা স্পর্ষ করা মাত্র এর মেকানিজম শুরু হয়ে যায়।
ফলে মুর্তির ভেতরে তান্ত্রিকের দেহ গলে তরলে পরিণত হবে। তারপর মুর্তিটার গোপনাঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে আসবে।
নির্গত তরলটা রাতের আধারে জমাট বেঁধে তান্ত্রিকের দেহে পরিণত হবে। তারপর ওতে আর্হ্নিশের বহুরূপী আত্মা ঢুকবে।
কিন্তু দিনের আলোয় ওটা ফের তরলে পরিণত হবে।
দিনে রাতে সার্বক্ষণিকভাবে দেহটাকে কার্যক্ষম রাখতে বহুরূপীকে সেই লোকটাকে খুন করতে হবে যার স্পর্ষে মুর্তির ভেতরের মেকানিজম চালু হয়েছিলো।
কারণ বহুরূপী হতে হলে পৃথিবীর সকল জীবিত মানুষের রূপ ধারণের ক্ষমতা থাকতে হবে।
কিন্তু পুনরাবির্ভুত এই বহুরূপী তার স্পর্ষকারীর রূপ ধারণে অক্ষম।
স্পর্ষকারী কে হত্যার পর ওর রক্তটুকু মুখে মেখে নিলেই বহুরূপীর দেহটা সার্বক্ষণিক স্থায়িত্ব লাভ করবে।
কিন্তু ওই স্পর্ষকারী যদি কোন গর্ভবতী মহিলা হয় এবং তাকে হত্যা করা দুষ্কর হয় তবে দ্বিতীয় একটা পন্থানুসরণ করা যাবে।
দিনের বেলায় মহিলার পানীয়জলের সাথে বহুরূপীর তরলীকৃত দেহ খাইয়ে দেওয়া।
এতে অর্হ্নিশ তার অনাগত সন্তানের দেহে আশ্রয় লাভ করবে আর প্রসবের সময় মহিলাটাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এ পদ্ধতিতে সন্তানের বয়স ১৩ বছর না হওয়া পর্যন্ত ওর দেহে অর্হ্নিশের বিকাশ ঘটে না।
অর্হ্নিশের বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত সন্তানটা কথা বলতে এবং রূপ বদলাতে পারে না।
এতটাই ভয়ঙ্কর ঐ অক্ষত মুর্তিটা! তাই ওই প্রস্থরলিপিতে বারংবার ওটার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
সেদিনকার ব্রাম্মণরা মন্দিরটা ধ্বংস করার পর ওর ত্রিসীমানায় লোক সমাগম কে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো।
যেন কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও মুর্তিটার খোজ না পায়। কিন্তু কালের আবর্তে একদিন সেসব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে শরীফ মুর্তিটাকে উদ্ধার করে বসে।
হাতে গ্লাভস পরা থাকায় সেদিন সেসব উদ্ধারকারীরা বেঁচে যায়। ওরা মুর্তির ম্যাকানিজম চালু করে নি।
কিন্তু অবুঝ সাঞ্জে বোকার মতো ওটার মুখে স্পর্ষ করে বসে। অভির মনে পড়ে ওটার চেহারা স্পর্ষ করার পর সাঞ্জে ছিটকে দু পা পিছিয়ে এসেছিলো।
তারপর থেকেই বহুরূপীটা ওর পেছনে লেগে গিয়েছিলো। পরদিন শেষরাতে বহুরূপীটার সাথে এক ভয়াবহ লড়াই বাঁধে অভির।
সেরাতে ওটাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছিলো সে। কিন্তু এক পর্যায়ে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ওর অজ্ঞান দেহটাকে বিছানায় শুইয়ে, মাথাটা কোলে নিয়ে সাঞ্জে বসে ছিলো। আহা! ওর নরম হাতের কোমল স্পর্ষটা যেন এখনো গালে লেগে আছে।
একটু একটু জ্ঞান আসতেই ও সাঞ্জেকে চিৎকার করতে শুনেছিলো,” না না, সরে যাও।”
তারপর আলো আধাঁরিতে একটা হাতকে ওর মুখের ভেতর ঢুকে যেতে দেখেছিলো। তারপর কি যেন হল আর মনে নেই।
সম্পূর্ণভাবে জ্ঞান ফিরতেই সাঞ্জে ওকে বলেছিলো বহুরূপীটা চলে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওটা যায় নি।
ওটা সাঞ্জের ভেতরই ঢুকে পড়েছিলো। বাচ্চাটার দেহে। তারপর ওটাই প্রসবের সময় সাঞ্জেকে মেরে ফেলে।
যে সন্তানটাকে এত কষ্ট করে ও লালন পালন করছে সেটাই কি ওই বহুরূপী? নাহ।
তা হয়ে যাবে কেন? এইসব পুরাতত্বের বিজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই। অভির ডাক্তারিবিদ্যা ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়।
কিন্তু অবচেতন মনের একটা অংশ বলে, সব কিছুই যখন খাপে খাপে মিলে গেছে তখন ওটা বহুরূপী না হয়ে যায় না।
আজ ওর ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। আজই অর্হ্নিশ ওর দেহে বিকশিত হবে।
দুদুল্যমান অভিকে চমকে দিয়ে বাড়ির কলিংবেলটা বেঁজে উঠলো। এত রাতে আবার কে এল?
..(শেষ পর্ব)
দরজা খুলতেই ও একজন ডাকপিয়নকে হাতে জন্মদিনের উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।
কাগজে মোড়ানো উপহারের গায়ে প্রাপকের স্থানে জুবায়েরের নাম লেখা রয়েছে।
তাই দেখে অভি হাঁক ছাড়লো, “জুবায়ের, তোমার জন্যে উপহার এসেছে। বেরিয়ে এসে সাইন করে নিয়ে যাও।”
ছেলেটা রুম থেকে বেরিয়ে, উপহারটা গ্রহণ করে, ফের রুমেই চলে গেল। অভির সাথে একটা কথাও বলল না।
ছেলেটার এই চাঁপা স্বভাবটা অভিকে আবারো সন্দেহে ফেলে দিলো।
নিজের বেডরুমে ফিরে ও অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে ভাবছিলো, পাশের রুমে ওটা কে শুয়ে আছে? ও
টা কি সত্যিই ওর ছেলে না কি অন্যকিছু? অবান্তর চিন্তা হলেও একবার দেখে আসতে ক্ষতি কি?
অভি পা টিপেটিপে জুবায়েরের রুমের দরজার সামনে চলে এলো। তারপর চাবির ফোকর দিয়ে চোখ।
ভেতরে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য! মেঝেতে একটা ষড়ভুজাকৃতির চক্র একে, খানিক আগে আসা ডাকপিয়নটা চোখ বন্ধ করে যোগাসনে বসে আছে।
ওর পরনে যুবায়েরের নাইটড্রেস। অভি দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলেছে। আজ ও বহুরূপীটাকে শেষ করে দেবে।
এই শয়তানটার জন্যেই সাঞ্জে মারা গিয়েছিলো। আজ ও সাঞ্জে হত্যার প্রতিশোধ নিবে। চরম প্রতিশোধ।
অভি দ্রুত নিজের বেডরুমে ফিরে আসে। তারপর ওয়ার্ডোবের গুপ্ত ড্রয়ার খুলে ওর পিস্তলটা বের করে।
দু মাস আগেই ওটাকে লাইসেন্স করিয়ে এনেছিলো । আজ রাতে এই বৈধ অস্ত্র দিয়ে একটা অবৈধ কাজ করতে যাচ্ছে ও। খুন।
কাল পত্রিকায় হেডলাইন হবে পিশাচ বাবার হাতে সন্তানের খুন। কিন্তু আজ অভি জানে সত্যিকারের পিশাচটা কে।
ওটাকে খুন করার জন্যে ওর এতটুকু অনুশোচনা থাকবে না। পিস্তলটায় একে একে সাতটা গুলি ভরলো অভি।
তারপর সন্তর্পণে জুবায়েরের দরজার সামনে চলে গেল। হঠাৎ এক লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে, পিস্তল তাক করে ও ভেতরে ঢুকলো।
কিন্তু একি! জুবায়ের তো রুমে নেই। তবুও রুমটা ভাল করে তল্লাসি করলো ও।
হতাশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো অভি। ঠিক তখনি বাথরুমের দরজা খুলে রুমে ঢুকলো জুবায়ের।
অভি পিস্তলের নলটা ওর বুক বরাবর স্থির করলো। কিন্তু জুবায়েরকে দেখে মোটেও চিন্তিত মনে হল না।
ও হাসিমুখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার দিকে হেটে আসতে লাগলো। ওর মায়াবী হাসিটা দেখে অভির হৃদয় কেঁপে উঠলো।
নাহ, ও পারবে না। ও কিছুতেই নিজের সন্তানের বুকে গুলি চালাতে পারবে না। ও
র পিতৃস্নেহ, পিস্তলের ট্রিগার ছুঁয়ে থাকা আঙুলটাকে অসার করে দিলো। ওদিকে জুবায়ের এগিয়ে আসছে। কাছে, আরো কাছে।
অভির নাগাল পেতেই ওর আস্তিনে লুকিয়ে রাখা পেপার কাটিং নাইফটা একবার ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
…সেদিনের পর থেকে বাপ বেটাকে আর কখনো এক সাথে দেখা যায় নি।
বেড়াতে এসে প্রতিবেশীরা কলিংবেল টিপলে ওদের যেকোন একজন এসে দরজা খুলে দিত, অভি অথবা জুবায়ের।
যে ই খুলুক না কেন, অপরজনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে একটাই উত্তর আসতো: “ও তো বাড়ি নেই। বাহিরে গেছে।”……!!