একাউন্টিং ভুত

একাউন্টিং ভুত

আমি ভুত হয়ে যাওয়ার পর কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। অথচ এই লোক আমাকে কীভাবে দেখছে।আমি বেশ ভালো ভাবেই অপ্রস্তুত হলাম। আমি বললাম -“সরি ভাই, আমি ভেবেছি আপনি আমাকে দেখতে পাননি। দেখার কথাও না। আমিতো আসলে মানুষ না। আমি ভুত ”

উনি বললেন -“তুমি ভুত তো কী হয়েছে? তোমার কী ধারণা তুমি একাই ভুত? পৃথিবীতে আর কোন ভুত নেই? যাইহোক শোন, আমিও ভুত। তোমার চেয়ে সিনিয়র ভুত আমি। বেয়াদবি করবা না আমার সাথে। ” আমি বেশ খুশি হলাম। একা একা খারাপ লাগছিল। কথা বলার মত কেউ ছিল না। যাক অবশেষে একজন ভুত তো পাওয়া গেল। কিন্তু মনে হচ্ছে এই ভুত অনেক রাগী । আমি বললাম -“ভাইয়া, এক্সট্রিমলি সরি। আপনি যে ভুত এটা বুঝতে পারিনি, তাহলে ভেংচি দিতাম না। ” ভুত ভাইয়া ধমকের স্বরে বললেন –“আমাকে ভাইয়া বলবা না। আমাকে ডাকবা ‘বস’। আমি অনেক সিনিয়র এবং অনেক কিছু জানি, অন্যান্য ভুতেরা আমাকে বস ডাকে। কেন বস ডাকে শুনতে চাও? ”

– “ জি বস, শুনতে চাই। ”

“ আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। সেটা হচ্ছে আমি চাইলে জীবিত মানুষের সাথেও যোগাযোগ করতে পারি, কথা বলতে পারি। ” আমি বললাম -“ বাহ্। অসাধারণ! বস, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে চাই।” বস বললেন -“ এখন ঠিক আছে। সম্মান দিয়ে কথা বলবা। বলো কী জানতে চাও?” “ আমি একাউন্টিং পরীক্ষার ভয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মারা গেছি। তারপর ভুত হয়ে গেলাম। আপনি কীভাবে ভুত হলেন? আপনিও কি একাউন্টিং ভুত? ”

বস আমাকে আবারও ধমক দিলেন। বললেন -“ একাউন্টিং কোন সাব্জেক্ট হলো। একটু পড়াশোনা করলেই পাশ করা যায়। আমি কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছিলাম। হঠাৎ একদিন মনে হল আমার মাথার ভেতরে কয়েক জায়গায় গিট্টু লেগে গেছে। গিট্টু ছোটানোর জন্য একটা সহজ বুদ্ধি বের করলাম। বড় একটা হাতুড়ি দিয়ে নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি দিয়ে ।এখন ভালো আছি। ভুতের জীবন খারাপ না। তুমি নতুন ভুত হয়েছো, আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবা।”
আমি বললাম -“ বস, আপনি তাহলে কেমিস্ট ভুত? ” বস চুপ করে রইলেন। আমি ফাজলামো করছি কিনা বুঝতে পারছেন না উনি। আমি বললাম -“ বস, আপনি আসলেই অনেক প্রতিভাবান। আপনি কী খাবেন? বলেন বস, আমি এনে দিচ্ছি। ”

– “তোমাকে আনতে হবে না। আমি আনিয়ে নিচ্ছি। ”

উনি হাতের ইশারায় ডাকতেই দোকানের একটা বাচ্চা ছেলে এলো অর্ডার নিতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই ছেলেটাকে আমি মানুষ ভেবেছিলাম। এই ছেলেটা তাহলে বাচ্চা ভুত। আমি বললাম -“ বস, সব হোটেলেই কী এমন ভুত ওয়েটার থাকে? ” বস বললেন -“ হ্যাঁ। না থাকলে চলবে কেমন করে? আমরা ভুতেরা খাবো কীভাবে? যত নামি দামি রেস্টুরেন্ট আছে সব জায়গাতেই ভুত ওয়েটার আছে। শুধু হোটেল-রেস্টুরেন্টই না, সব জায়গাতেই ভুত আছে কম বেশি। ” উনার কথা শুনে আমি শুধু অবাক হচ্ছি। আমি বললাম -“ মেয়েরা মরে গেলে কী হয়? মেয়ে ভুত? ” বস বললেন -“ তুমি তো দেখছি ব্যাকরণ ও ভালো জানো না।‘মেয়ে ভুত’ বলে কোন শব্দ নেই। মেয়েরা মারা গেলে পেত্নী হয়ে যায়। ”

আমি বললাম-“বস, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি, মানুষ হিসেবে এত বছর পার করলাম, ভালো করে একটা প্রেম ও করতে পারিনি। আপনি যদি একটা পেত্নী খোঁজ করে দিতেন, বিয়ে সাদীর চিন্তা করা যেত। আমি তো ভুত সমাজে কাউকে চিনি না। আপনিই আমার মুরুব্বি বস।” বস বললেন -“ হবে হবে। সব হবে মেয়ে মানুষ থেকে পেত্নী পটানো সহজ। এটা নিয়া টেনশন করার দরকার নেই। ” বসকে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। উনি ভুত সমাজের নানা দিক আমাকে বোঝাতে লাগলেন। দেশি-বিদেশি ভুতের পার্থক্য আছে উনার কাছেই জানলাম।

বস বললেন-“ ভুত সম্পর্কে মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুল ধারণা করে আসছে। যেমন সবাই ভাবে তেতুল গাছে ভুত থাকে। আরে মূর্খের দল, তেতুল গাছে কি লেপ-তোশোক আছে নাকি যে ওখানে আমরা থাকবো। তোরা মানুষড়া থাকবি এসি ওয়ালা রুমে, আমরা কেন গাছে থাকবো। ” আমি বললাম “ বস, তাহলে আপনি কোথায় থাকেন? ” “ ওই যে সামনের বাড়িটা দেখছো, ওটার একটা ফ্ল্যাটে থাকি আমি। অবশ্য ছেড়ে দিবো এই বাসাটা। ভাড়া বেশি পরে যাচ্ছে।” আমি যতই শুনছি ততই অবাক হচ্ছি। ভুত সম্পর্কে মানুষ এত ভুল জানে! এতটা কম জানে! আমি বললাম “ বস ভুত হয়ে যাওয়ার পর আপনার সময় কীভাবে কাটে? ”

বস বললেন -“গল্পের বই পড়ি। এবার বইমেলা থেকে বেশ কয়েকটা বই কিনেছি। রোজ রাতে গল্পের বই পড়ি। তোমার লেখা ‘ রুপালি সমুদ্র ’ বইটাও কিনেছি। কয়েকটা গল্প পড়ে দেখলাম ” আমি বললাম – “ বই মেলা থেকে কীভাবে কিনলেন? ভুতেরা বইয়ের স্টল নেয় বই মেলাতে?” “নিবে না কেন?ভুতরা মানুষের মতো কিপ্টা না। ওরা শুধু ফেইসবুকে গল্প খোঁজে না। ওরা বই কিনে পড়ে। তোমার বইটা ভালোই হয়েছে। তবে হুমায়ুন স্যারের বলয় থেকে বের হয়ে আসো। নিজে কিছু করার চেষ্টা করো।” “আর বই লেখালেখি। একাউন্টিং আবার জীবনটাই কেড়ে নিল বস।” গরম গরম পরোটা খেতে খেতে বস বললেন -“ তারপর বলো ,মরে যেতে কেমন লাগলো তোমার? ” আমি বললাম -“ বস, কষ্ট কেমন হয়েছে সেটা নাই-বা বললাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি মরে গিয়ে বেঁচে গেছি। ”

বস বললেন -“ বেঁচে গেছ কীভাবে? কি লাভ হয়েছে মরে গিয়ে? ” -“ বস, একাউন্টিং থেকে তো বেঁচে গেছি। এখন আর আমাকে একাউন্টিং পরীক্ষা দিতে হবে না। এখন পড়াশোনা ও নেই, টুক্কু স্যার ও নেই ” আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম। বস বললেন -“ তোমাকে কে বলেছে এসব কথা, ভুতদের ও পড়াশোনা আছে।” আমি আবারও টেনশনে পরে গেলাম। বলে কী এই লোক। ভুতের আবার পড়াশোনা কিসের! আমার জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বস বললেন -“ আমি চাই তুমি একজন গ্র‍্যাজুয়েট ভুত হও। তোমাকে আবারও একাউন্টিং পরীক্ষা দিতে হবে এবং টুক্কু স্যারই তোমার পরীক্ষা নেবেন। ”

আমি বললাম -“ এসব কী বলেন? একাউন্টিং পরীক্ষা দিতেই হবে? আর টুক্কু স্যারই বা কেমন করে আমার পরীক্ষা নেবেন। আমি তো ভুত হয়ে গেছি। তিনি তো প্রফেসর, একজন মানুষ। ” বস শব্দ করে জোরে জোরে হাসতে লাগলেন। হাসির বেগ কমার পর বললেন -“ তুমি কি টুক্কু স্যার কে বোকা ভেবেছো? যে তুমি মরে গিয়ে বেঁচে যাবা, আর উনি কিছুই করবেন না?? তোমার চালাকি সে ধরে ফেলেছে। তুমি ছাদ থেকে লাফ দেয়ার পর পরই সে ও লাফ দিয়েছে। এবং সাথে সাথেই স্পট ডেড। সে ও ভুত হয়ে গেছে শুধুমাত্র তোমার পরীক্ষা নেয়ার জন্য  আমি কোন কথা বলতে পারলাম না।

চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। আমি মরে গিয়েও একাউন্টিং থেকে রেহাই পাবো না ,এমনটা জানলে জীবনেও কমার্স নিয়ে পড়তাম না। আবারও ওমর সানির মতো বলতে ইচ্ছে করছে – কী আর পেলাম জীবনে।কিই বা পেলাম মরণে। যেই একাউন্টিং এর জন্য জীবন দিয়ে দিলাম, সেই একাউন্টিং আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই চৌধুরী ( সরি বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছি) আমি আর বস হোটেল থেকে বের হলাম । বাইরে টুক্কু স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে তিনি একগাল হেসে বললেন -“ আগেই বলেছিলাম ভালো করে পড়াশোনা করো। তাহলে এত সমস্যা হতো না। নিজে মারা গেলে, সাথে সাথে আমাকেও মরতে হলো। তোমাকে একাউন্টিং পরীক্ষা দিতেই হবে।তুমি একাউন্টিং পরীক্ষা দিতে পারবে না এটা আমি মেনে নিতে পারিনি।আমি আসাতে তুমি খুশি হয়েছো? ”

আমি বললাম -“ স্যার, আমার প্রতি আপনি যে ভালবাসা দেখিয়েছেন, তা যে কোন ভালবাসার গল্পকে হার মানাবে। একাউন্টিং পরীক্ষার জয় হোক। পৃথিবীটা একাউন্টিংময় হোক ” তখনও আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। বসকে বিদায় দিয়ে আমি আর টুক্কু স্যার, ভার্সিটির দিকে রওনা হলাম। আমাদেরকে বাসে যেতে হল। ছেলেবেলায় গল্পের বইয়ে পড়তাম যে ভুতের অনেক ক্ষমতা থাকে। তারা আকাশে উড়তে পারে। আসলেই কিছুই না। বাস, রিকশায় করে ডিপার্টমেন্টে পৌছে গেলাম। সকাল ৯.৪৫। আমি এক্সাম হলে বসে অপেক্ষা করছি। একটু পরই আমার একাউন্টিং পরীক্ষা শুরু হবে।

শেষমেষ আমাকে ওইদিন একাউন্টিং পরীক্ষা দিতে হয়নি। কোথাও ছোট্ট একটা গোলমাল হয়েছে। ছয় তলা থেকে পরে গিয়েও কীভাবে যেন আমি বেঁচে গেছি। আইসিইউ থেকে বের হয়ে এখন জেনারেল ওয়ার্ডে আছি। প্রতিদিন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আমাকে দেখতে আসে। আমাকে খুশি করার জন্য আমার সামনে একাউন্টিং বই পোড়ায় ওরা। আমি টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি। একটা নিউজ সব চ্যানেলে বার বার দেখায় -“ ছাত্রকে ভালবেসে ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের আত্মহত্যা। ” এদিকে প্রথম আলোতে ছাপা হয় – ছাত্র বেঁচে গেলেও বেঁচে নেই শিক্ষক”

অনেক দিন পর আমার সাথে বসের দেখা হল।সেই কেমিস্ট ভুত। তিনি মানুষের সাথেও কথা বলতে পারেন। তিনি আমাকে বললেন -“ তোমার সাথে অল্প সময় কাটিয়েছিলাম। তুমি ছেলে হিসেবে ভালো। ভেবেছিলাম ভালো একজন ভুত পাওয়া গেল। বাট তুমি বেঁচে গেলে।তোমাকে আমরা ভুত সমাজ খুব মিস করি।”দেখলাম উনার চোখে জল। কেউ মারা গেলে আমরা কান্না করি ।আমি মারা যাইনি এই দুঃখে তিনি কান্না করছেন। আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি ।ভুতের চোখে জল অথচ ঠিক মানুষের চোখের জলের মতোই সুন্দর । তার কাছ থেকে জানলাম – টুক্কু স্যার পুরোদমে ভুতদের একাউন্টিং শেখাচ্ছেন এখন। স্যারের ভয়ে ভূতেরাও নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করছে আজকাল। ( দৌড়ুবে ) নেক্সট আসছে মেডিকেল ভুত

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত