কিছুদিন আগে একরাতে হঠাৎ ইচ্ছা করছিল কাউকে ভয় দেখাতে। পড়ার টেবিলে বসে মশা মারলেই আমার অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছারা জেগে উঠে। সেদিন মোটামুটি চাঁদের আলো ছিলো। কাউকে ভয় দেখানোর জন্য পারফ্যাক্ট মুহুর্ত। কি করে ভয় দেখাবো? শার্ট-প্যান্ট পরে হিহি হাহা করে বা আমি ভূত বললে মানুষ ভয় পাবে? উল্টো মাথায় দুইটা থাপ্পড় দিয়ে যাবে। ভয় দেখানোর কোনো থিওরি জানা নেই। তবে এটা জানি,মানুষ আচমকা ভয় পায়। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। প্রথমে এক ভাগিনার ভাষায় গেলাম। বছরদুয়েক আগে সে ‘ক্রিশ মাস্ক’ কিনেছিল। তার কাছে গিয়ে চাইতেই দিয়ে দিলো।
বাসায় এলাম। আব্বুর সাদা পাঞ্জাবী আছে আর তিন-চার বছর আগে কেনা একটা জ্যাকেট। এই জ্যাকেটের বিশেষত্ব হচ্ছে,এটা বিশাল লম্বা। আমি পরলে আমার পা ছুঁয়ে যায়। হাতমোজা সংগ্রহ করলাম পারভেজ নামের এক ছোটোভাই থেকে। প্রথমে পাঞ্জাবী পরলাম। তার উপর জ্যাকেট। লুঙ্গী পরলাম,লুঙ্গীর উপরেই সাদা প্যান্ট। তারপর মাস্ক লাগালাম,এরপর হাতমোজা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাকাতেই আমি আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। কবরস্থান পর্যন্ত যাওয়ার পর দেখি,কে যেন আসছে,তার পরনেও সাদা পাঞ্জাবী। দ্রুত হেটে আসছে দেখে আমি ঝোপের মাঝে লুকালাম। অস্পষ্ট হলেও বুঝেছি,ইনি মোশতাক ভাই। এইটে থাকতে উনি আমাকে বাঁশতলায় ভয় দেখিয়েছিলেন। প্রতিশোধ নেবার মোক্ষম সুযোগ। একটু সামনে এগুতেই ইটের টুকরা অনবরত ছুঁড়লাম আর সাথে হিহি হাহা করছিলাম মেয়েলি কন্ঠে। মোশতাক ভাই,লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন পড়ে এমন জোরে দৌড় দিলেন,তাতে আমিই ভয় পেয়ে গেলাম।
এরপরে গেলাম এক বুড়ির বাড়ী। সবাই বলে তার সাথে নাকি জ্বীন থাকে আর উনিও সেটা সবাইকে বলে বেড়ান। এমন কোনো মুহুর্ত দেখিনি উনি গালিগালাজ বন্ধ করে বসে আছেন।
তার বাড়ীতে ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠলো।বিশাল এক বাড়ী। সুপারি বাগান দুইপাশে। ছোটো একটা ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে থাকেন। আমি যখন গেছি,তখন তিনি কিছু একটা রান্না করছিলেন। পাকঘরে বাইরে থেকে ভেতরের সব দেখা যায়,আমি গিয়ে হিহিহি হাহাহা বলে হেসে উঠলাম,তা অবশ্যই মেয়েলি কন্ঠে। বুড়ি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিলোনা,যেন এসবে সে অভ্যস্ত!
‘কি রান্না করিস? আমাকে দিবি? হিহিহি’
এই বুড়ি যেই কাজ করলো,সে কাজের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। চুলা থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ বের করে আমাকে ধাওয়া দিলো। আমি কোনোরকম প্রাণ বাঁচিয়ে আসলাম। পেছনে শুনছিলাম অশ্রাব্য গালাগাল।
আবার কবরস্থানের পাশে এলাম। কেউ একজন আসছে দেখে কবরস্থানেই ঢুকে গেলাম। পাশের বাড়ীর রনি আসছিল। সে মাঝপথে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সাধন করছিল। আমি একলাফে কবরস্থানের ওয়ালে দাঁড়িয়ে গেলাম মূর্তির মতো। কোনোরকম,হিহিহি করতেই সে পেছনে ফিরলো এবং আমাকে দেখে ওমাগো! ও বাবা গো! বলে জোরসে দৌড় দিলো। আমি খুবই মজা পেলাম।
এবার স্কুলের দিকে গেলাম,এই জায়গাটাও নির্জন। স্কুলের গেইটের উপর দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গা আছে,সেখানে উঠে দাঁড়ালাম। কেউ একজন মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো আর ফোনে কথা বলছিলো।
-ওই শোন!
-কে কে কেএএ?
-উপরে তাকা।
বেচারা আমার দিকে তাকিয়েই রইলো। হাত-পা কাঁপছে সেটা বোঝাই যাচ্ছিলো। আমি বলে উঠলাম,’তুই আমার বিরক্ত করছোস। আমার নিজ দিয়ে যা,মাফ করে দেবো।’ কথা শেষ না করতেই সে প্রাণপ্রণে ভূউউউউত,ভূউউউত বলে দৌড় দিলো। আইডিয়া কাজে লাগছে! আমিও তাড়াতাড়ি কবরস্থানের দিকে গিয়ে গা ঢাকা দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম,আর একজনকে ভয় দেখিয়ে বাসায় চলে যাবো। রাত দশটার মতো বেজে গেছে।
হঠাৎ,দেখলাম একজন আসছে। কে হতে পারে? চিনতে পারছিনা। কুয়াশার কারণেই বোধহয়। তবুও প্রস্তুত হলাম। কাছাকাছি আসতেই কবরস্থানের ভেতরে বসে ‘তোর ঘাড় মটকে দেবো হেহেহে,পাঞ্জাবী পরে হুজুর সাজছোস?’ এটা বলেই আবার খিক খিক খিক করে হাসছিলাম। লোকটা মোটেও ভয় পেলো বলে মনে হলোনা। উল্টো থেমে গেলো। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার গায়ে টর্চ লাইটের আলো পড়লো। কেউ বলে উঠলো,রোবন নাকি রে? কন্ঠ পরিচিত হওয়া স্বত্বেও বললাম,তোর জম,হিহিহি।
ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে জামা টেনে উপরে তুলে দাঁড় করালো। মুখোমুখি হতেই আমার বুক ধ্বক করে উঠলো,বাবা! বাবা ঠাস করে গালে থাপ্পড় দিলো। ব্যাথা পেলামনা তেমন। লজ্জা পেলাম। বাবা বলে উঠলো,ভয় দেখাবি ভালো কথা,কবরস্থানে ঢুকছিস ক্যান? জানিসনা কবরস্থানে জ্বীন-পরী থাকেনা?
আমি ঢোক গিললাম,কিছু বলার সাহস নেই। ইচ্ছে করছিলো আবার হিহি করে উঠি। সেদিন রাতে আমাকে আধঘন্টা এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি,আর কাউকে ভুলেও ভয় দেখাবোনা।