খাটের তল থেকে চাপা একটা গোঙ্গানির মতো আওয়াজ আসছে। ভাবলাম মনের ভুল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বালালাম। ঘরের এদিক-সেদিক টর্চের আলো ফেললাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। গোঙ্গানির শব্দটাও আর পাচ্ছি না। টর্চটা অফ করে মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে মাথা পর্যন্ত কম্বলটা টেনে দিলাম। গোঙ্গানির শব্দটা আবার শুরু হলো। এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম টিভির রিমোটটা খোঁজার জন্য বিছানা হাতরাতে লাগলাম। কিন্তু পাচ্ছি না। উঠে বসলাম।
শব্দটার রিয়েকশান অথবা অন্য যেকোনো কারনেই নিজের অজান্তে আমার চোখদুটো যেনো অন্ধকারে কিছু খুঁজতে শুরু করতে থাকে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে টর্চটা আবার জ্বালিয়ে টিভির রিমোটটা খুঁজতে থাকি। টিভিটা ছাড়ার পর ঘর আলো হয়ে যায় বেশ অনেকটা। বিছানা থেকে নেমে লাইটটা অন করে খাটের নিচে তাকানোর জন্য হাতে ভর দিলাম। হঠাৎ হাতের নিচে পানির স্পর্শ অনুভব করি। খাটের নিচে পানি কোথাথেকে আসবে বুঝতে পারছি না। জয়নাল কাকাকে বলা দরকার। পুরানো বাসা। ভালো করে পরিষ্কার করা হয়নি হয়তো।
মুরাদকে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইলটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে ওই কল দিয়ে বসলো।
– হেপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে মাই ডিয়ার অন্তরা।
– আরেহ ওহহ শিট। হেপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে।
– ঘুমিয়ে পরেছিলে?
– নাহ্। ঘুম আসছে না। তোমার এই ভূতুরে বাসায় কিছুক্ষণ পরপর কুটকুট শব্দ হচ্ছে।
– ইঁদুর-টিদুর হবে। আমার দাদার-দাদার বাগানবাড়ি। অনেক বছরের পুরোনো। তবে আরামভোগ করার মতো যথেষ্ট সুবিধা আছে।
– কচু আছে। আমারই ভুল। কেন যে আসতে চাইলাম এখানে। শহর ছেড়ে এতদূর। নিজে তো এলে না। আমাকে পাঠিয়ে দিলে অফিসের কথা বলে সটকে পড়লে…
– সটকে পড়লাম কোথায়। কালকে তো আসছি আমি নাকি?? আজকে রাতটার ব্যাপার।
– আজকে রাতটা কিভাবে কাটাবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কি ভয়ানক জায়গা। কেমন যেনো একটা ছমছমে পরিবেশ।
– এজন্যই বলি এতো হরর মুভি-টুভি দেখো না।সবকিছু এইসব মুভি দেখার কুফল।
– একটা কথা বলি?
– বলুন …
– আমি না কিছুক্ষণ আগে খাটের নিচ থেকে একটা চাপা গোঙানির মতো আওয়াজ পেয়েছি। লাইট জ্বালানোর পর…
– শব্দটা বন্ধ হয়ে গেছে তাই তো?
– তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না।
– এগুলো তোমার কল্পনা অন্তরা। নতুন জায়গায় গিয়ে একা একা আছো। তাই এমন হচ্ছে।
– এতোটা ভুল শুনলাম?
– মনে হয় বিয়ের আগে রাত জেগে বেশি কথা বলে ফেলেছিলাম। ওইটারই সাইড-এফেক্ট। বাই দা ওয়ে – ইউ নিড রেস্ট।
– তুমি কালকে কখন আসছো? মানে আসতে আসতে কতক্ষণ লাগবে?
– আসতে আসতে দুপুর হয়ে যাবে। লাঞ্চ একসাথে করবো।
– হুমম।
– হুমম না। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। আমি এসে যেন দেখি তুমি খুব সুন্দর করে সেজে আছো।শাড়ি-টারি পড়বে না। আর তুমি যেনো হাতে ওই কিসের কাঁচের চুড়ি-টুরি পরো,একদম না।এগুলোর শব্দে আমার মাথা ধরে যায়।
– হুমম।
– গুড নাইট ডার্লিং।
– কি করবে এখন?
– রাতের বেলা মানুষ তো ঘুমায়…তাইনা?
– ও আচ্ছা।
– রাখি বাই….
চাচ্ছিলাম ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে।কিন্তু দরজায় কেমন একটা খটখট শব্দ হচ্ছে। অন্তরা ঘরের সবগুলো কোণায় আবার চোখ বোলায়। খাটের নিচটা আরেকবার দেখে নিয়ে কম্বলের ভিতর গিয়ে বসে। দরজার নিচে তাকিয়ে থাকে সে। খাটের নিচের শব্দটা আবার শুরু হয়। আচমকা কিছু একটা দেখতে পাওয়ার ভয় যেন গ্রাস করতে থাকে ওকে। জয়নাল কাকাকে নিয়ে পুরো বাগানবাড়িটা ঘুরে দেখলাম। বাঁধানো পুকুর ঘাট, সামনের খোলা জায়গা,শিউলি বাগান সবকিছুতেই একটা জমিদারী জমিদারী ব্যাপার আছে।পুকুরঘাটে বসে আছি। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কে-যেনো খুব জোরে চোখদুটো চেপে ধরলো।
– তুমি?
– হ্যাঁ। আমি।
-তোমার তো দুপুরে আসার কথা ছিলো।
-“তোমার জন্য এসেছি সখী,দেখো-হে দুয়ারো খুলে, তোমারো নিঠুরও নয়নো জলে ডুবিবো অতল তলে”।
– তুমি মানে মুরাদ তুমি মানে….
– কি তুমি তুমি করছো?
– না না কিছু না।
– তোমাকে না বলেছিলাম যে সুন্দর হয়ে রেডি হয়ে থাকতে? এসব কি?
– কি আর?তোমার পছন্দমতো পোশাকই তো পরলাম।
– এসব সালোয়ার-কামিজ আজকের দিনে যায় বলো? তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তোমার ঘরে যাও।
– তুমি কোথায় যাবে?
– এখানেই ছিলাম। এখানেই থাকব।
ঘরে এসে দেখলাম দুটো সুন্দর রেপিং কাগজে মোড়ানো প্যাকেট। প্যাকেটদুটো খুলে দেখলাম একটা লাল রঙের টকটকে শাড়ি আর লাল চুড়ি।আমি স্বপ্ন দেখছি না সত্যি বুঝতে পারছি না। এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী মনে হলো।শাড়িটা পড়ে নিচে এসে দেখি মুরাদ ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই আমায় জাপটে ধরলো। একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় আমার চোখ থেকে পানি পরতে লাগলো।
– তুমি কাঁদছ?
– না।
– চলো..
– কোথায়?
– তোমাকে বাগানবাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। বাগানবাড়ির দক্ষিণে একটা টিনশেডের চালা আছে। ওখানে তোমার জন্য পৃথিবীর সবথেকে বড় চমক অপেক্ষা করছে।
– আমি তো জয়নাল চাচার সাথে গিয়ে দেখে এসেছি সবটা। আবার কেনো?আর ওদিকে তো কোনো টিনশেড দেখলাম না..!
– তুমি অনেক কিছু দেখনি বাগানবাড়ির পাশে একটা গেরস্তের বাড়ি আছে। ওখানে একজন বয়স্ক মহিলা থাকেন।এনার হাতের মোয়া এ এলাকার বিখ্যাত।ওনার একটা মেয়ে ছিল। বিয়ের দিন ওনার মেয়েকে কে বা কারা ধর্ষন করেছিল। মেয়েটা গলায় কলসি বেঁধে আমাদেরই এই বড়পুকুরে আত্মহত্যা করেছিল।
– কি?? তারপর?
ওরা হাঁটতে থাকে। একজন আরেকজনের হাত ধরে।এই ভ্যালেন্টাইন’স ডের কথা সবসময় মনে থাকবে অন্তরার। কারন এই মুরাদকেও যে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না ।
– মুরাদ… তুমি উপরে!
– আমি তো মাত্র আসলাম। আর বলো না। অফিসের কাজ শেষ করে আসতে আসতে এতো দেরী হয়ে যাবে বুঝি নি।
– মানে? তুমি তো বললে তুমি জয়নাল কাকার সাথে দেখা করবে…তাই আমি তোমায় নিচে রেখে একা একা উপরে চলে এলাম। আর কিসের অফিস? তুমি তো সকালেই এসে পরলে!
– কি বলো এগুলা!!! আমি আবার সকালে কখন আসলাম? আমি মাত্র আসলাম। জয়নাল কাকা আমাকে স্টেশনে আনতে গেলো আমি জিজ্ঞেস করলাম তুমি ওনার সাথে গেলে না কেনো..উত্তরে উনি বললো তোমাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! আমি সারা রাস্তা চিন্তা করতে করতে এলাম।পাগলের মতো সব জায়গায় খুঁজলাম। কোথায় ছিলে বলোতো?আর এসব কি??তোমাকে না বলেছি এসব শাড়ি-চুড়ি পরবে না?
ওয়েস্টার্ন কিছু পরতে বলেছিলাম তো কি আশ্চর্য এসব সাহিত্যসম্পর্কিত রোমান্টিকতা কোথা থেকে আসে বলোতো তোমার? ডিজগাস্টিং পুরো পৃথিবীটা এক মুহুর্তে ওলট-পালট হয়ে যায় অন্তরার মুরাদ যদি মাত্রই আসে তাহলে ওই লোকটি কে ছিল যে কিনা হুবুহু মুরাদের মতো? কার সাথে ঘুরেছে সে এতক্ষণ? সবকিছু তো এভাবে মিথ্যা হতে পারে না। আর এই শাড়ি-চুড়িগুলোই বা আসলো কোথা থেকে? কে দিলো এগুলো তাকে? কে ছিল সে?যার সাথে বিয়ের পর প্রথম ভ্যালেন্টাইন পালন করল সে!