পূর্ণিমার সেই রাত

পূর্ণিমার সেই রাত

আবির ও নাফিজ একই হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে।তারা ঘণিষ্ঠ বন্ধু হলেও দুজনের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণই আলাদা। আবির একদিকে ধর্মপরায়ন, নামাযী ও একজন কোরান পড়ুয়া ছেলে। অন্যদিকে নাফিজের “সারাদিন কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনা, রোমান্টিক গান বা কবিতা লিখা, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিয়ে টাইমপাস করা, সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যাওয়া কিংবা পূর্ণিমার রাতে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে জোছনা দেখা” এ সবই আছে তার লিস্টিতে। তাদের হোস্টেল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে সেই তেপান্তরের মাঠটি। যেখানে গেলে মনে হবে পায়ের নিচে কেউ যেন সবুজ ঘাসের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। মাঠের একপাশে অশ্বত্ত, বট, হিজলগাছে ভর্তি ঘন জঙ্গল- এর নাম “ভূষন্ডীর জঙ্গল”। অপরপাশে কলকল রবে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা “নীলাঞ্জনা” নদী। সেদিন ছুটির দিন। নাফিজ প্রস্তাব করলো-

: চল আবির আজকে আমরা সেই তেপান্তরের মাঠে জোছনা দেখতে যাবো। আজ পূর্ণিমার রাত। ভরা জোছনায় মুখরিত থাকবে সেই নির্জন সবুজ প্রান্তর।
: ঠিক আছে আজ যখন ছুটির দিন তখন নাহয় যাবো। রাত্রে এশার নামায ও ডিনার সেরেই আমরা জোছনা দেখতে বেরুবো। কেমন?
: ইয়ে মানে আবির, আজ সন্ধ্যায় না আমার একটা পার্টিতে এটেন্ড করতে হবে। তুই নামায ও ডিনার সেরে তৈরি থাকিস আমিই সময়মতো এসে তোকে নিয়ে যাবো।

: সেকি রে, সন্ধ্যায় পার্টিতে গেলে তুইতো মাগরিব ও এশার নামায মিস করবি?
: ভাবিস না সে আমি ঠিকই পড়ে নেবো। এখন আসি বান্ধবীরা নিচে অপেক্ষা করছে। আজ তাদেরকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চায়নিজ খাওয়াবার কথা। বিকেলে সবাই নাইটক্লাবে যাবো, সেখানেই পার্টি হবে। পার্টিতে নাচ গান-বাজনা আরো অনেক কিছু হবে, আসি এখন- এই বলে নাফিজ চলে গেলো। এদিকে আবিরও গোসল সেরে যোহরের নামায পড়তে মসজিদের দিকে রওনা হলো।

রাত প্রায় সাড়ে এগার টা বাজে। আবির অনেক আগেই এশার নামায ও নৈশভোজ সেরে একরকম তৈরি হয়েই বসে আছে তেপান্তরে যাবার জন্য, কিন্তু নাফিজের কোন খোঁজ নেই। সেই যে দুপুরে বান্ধবীদের নিয়ে চলে গেলো এখনো ওর কোন পাত্তাই নেই। এদিকে সারাদিন টুকটাক কাজ শেষে নৈশভোজের পর আবিরের অনেকটা ঘুমও পাচ্ছে। নিজে এসে নিয়ে যাবে বলে কোথায় যে গায়েব হলো নাফিজটা, কে জানে বাবা। আনমনে এসব কথা ভাবতেই হঠাৎ দরজায় ঠকঠক করে কে বা কারা যেন কড়া নাড়লো। আর এমনভাবে দরজায় নক করছিলো যে মনে হচ্ছিলো দরজায় বুঝি কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। আবির দরজা খুলে দেখতে পেলো লাল টি-শার্ট ও নীল জিন্সের প্যান্ট পরে নাফিজ দাড়িয়ে আছে। সে কি! ওতো যাবার সময় পর পরনে সাদা শার্ট ও সাদা ফুল প্যান্ট ছিলো! আর এইমাত্র যে এসেছে তা ওর ক্লান্ত ভাবভঙ্গি আর হাতে নিয়ে যাওয়া ক্যামেরাটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রাতে তো আর এটার প্রয়োজন নেই, তাও আবার নিরিবিলি তেপান্তরের মাঠে!

তাকে সাতপাঁচ ভাবতে দেখে নাফিজ হুংকার ছাড়লো- কি রে যাবি না জোছনা দেখতে? চল্ তারাতারি চল্।
বাহ্ রে, নিজে দেরী করে এসেছে। কোথায় সেজন্য আমি ওকে রাগ দেখাবো উল্টো সে-ই দেখি আমাকে ঝাড়ি মারছে! নাফিজের আবারো হুংকার- কি রে যাবিনা? চল্ , দেরী হয়ে যাচ্ছে । আবির আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে।নাফিজকে দেখার পর থেকে তার আবার কেন যেন মনে হচ্ছে নাফিজের চোখ দুটোও তার টি-শার্টের মতোই লাল হয়ে আছে! অবশেষে এক কিলোমিটার হেঁটে তারা পৌঁছে গেলো জঙ্গল ও নদীর তীরবর্তী সেই নির্জন তেপান্তরের মাঠে। আবির হঠাৎ লক্ষ্য করলো তার মোবাইলে কল এসেছে নাফিজের নাম্বার থেকেই!

: কি রে নাফিজ তুই আবার আমাকে কল দিচ্ছিস কেন? (কথাটা শুনার সাথে সাথেই নাফিজ চমকে উঠলো।)
: না মানে আমি দেখছিলাম আমার মোবাইলে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স আছে কিনা। এই আর কি-
: ও আচ্ছা, এই বলে আবির কলটা কেটে দিলো। কিছুক্ষণ পর দেখে আবার ওর নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে।

আরে! ব্যাটাতো আচ্ছা ফাজিল দেখছি। এইমাত্র দেখলো সবকিছুই ঠিকঠাক আছে তারপরো এখন আবার এসএমএস দেয়ার মানেটা কি? নিজে দেরী করে এসে আবার আমাকে ধমক দিয়ে আসার কথা বলে! যাবার সময় পরনে একরকম কাপর থাকলেও ফেরার আগেই কাপর পাল্টে ফেলে ! চোখ দুটো আবার এমন রক্তের মতো লাল হলো কিভাবে ! নেশা করলেও তো এমনটা হবার কথা নয়!! আবির এসব ভেবেই আনমনে সামনে এগুচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদের ফুটফুটে রোশনাই আবিরের দেহ ও মনে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দেয়। কেমন যেন কবি কবি ভাব আসে তার মধ্যে। কিছুক্ষণ সে ঘাসের গালিচায় শুয়ে পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা শিরশিরে শীতল-স্নিগ্ধ বাতাস আবিরের গাঁ ছুয়ে যায়। কতক্ষণ এভাবে ছিল খেয়াল নেই। তার নিরবতা ভাঙলো নাফিজের হাঁক শুনে। কি রে আবির চলনা কতক্ষণ এখানে শুয়ে থাকবি আর??

: সে কিরে, এইমাত্র তো এলাম। আর কিছুক্ষণ পরেই না হয় মেসে ফেরা যাবে। এতো তাড়া কীসের?
: আরে ভাই, মেসে যাবার কথা তোকে কে বললো? চল্ আমরা নীলাঞ্জনা নদীর তীরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। চাঁদনীরাতে নদীতীরের দৃশ্য দেখতে সত্যিই মোহনীয় লাগে। চল্ উঠে আয়।
: না রে নাফিজ, আমি ওখানে যেতে পারবোনা। একে তো রাতদুপুর তার ওপর নদীর পাশেই সেই ভয়ংকর ভূষন্ডীর জঙ্গল! না না বাবা; আমি ওদিকে যাবোনা।

: আরে আবির তুই না দিনদিন একটা ভীতুর ডিম হয়ে যাচ্ছিস। আমি সাথে থাকতে আবার ভয় কীসের?
:কি যে বলিস না নাফিজ; তুই ওতো মানুষ নাকি? তোরই বা যদি কিছু হয়ে যায় তখন?
:আমি যে মানুষ- একথা তোকে কে বললো ?
:তাহলে তুইকি ভূত নাকি?
: না মানে মানুষ হলেও আমি ওসব ভূত-টুত এ একদম বিশ্বাস করিনা। আর আমি থাকতে তোকে কিছু করবে কার সাধ্যি?
:আবারো বোকার মতো কথা? তুইকি সুপারম্যান হয়ে গেছিস যে এমন সাহস আর বীরত্ব দেখাচ্ছিস?আরে তোর সাহসের দৌড় আমি জানি না ভেবেছিস? রাতে তো ওয়াসরুমে যেতেও আমাকে ডেকে তুলিস? আর বাঁচানো বা মারা এই দুটিরই ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র আল্লাহ পাকের হাতে।

: হয়েছে মুফতী সাহেব। এবার উঠুন তো। অনেকক্ষণ জোছনা দেখেছেন;
:আচ্ছা উঠলাম এবার বল্ কি?
:চল্ ঐ নীলাঞ্জনার তীরে বসে জোছনা আলোয় নদীর ঢেউ দেখবো। জঙ্গল থেকে লাল লাল হিজলফুল নদীর পানিতে পড়ে দূর-দূরান্তে ভেসে যায়, সে দৃশ্য দেখতে কি যে অপরূপ লাগে! মনে হয় হিজলফুলেরা আজ নদীর জলে
মনে হয় নদীই বুঝি আজ ফুলের মালা দিয়ে সেজেছে।

: কীরে নাফিজ, তুই কি আজ পাগল হলে নাকি! একে তো পাশেই ঘন ভয়ংকর ভূষন্ডীর জঙ্গল আর তার মধ্যে এই গভীর রাতে ঐ ভুতুরে নদীর তীরে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। খাল কেটে কি আবার কুমির আনবো নাকি? পরে যদি কোন অশরীরি এসে আমার ঘাড়টা মটকে দেয়! বাপরে…;

:আরে আবির, একবার বললাম না তোকে যে আমি থাকতে তোর কোন ভয় নেই? আর ওসব ভূত-অশরীরি এগুলো শুধু গল্পেই মানায়। বুঝলে? এসব মানুষের বানানো কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।

:আচ্ছা দাড়া, আমি “আয়াতুল কুরসী”টা পড়ে নিই। জ্বীন ও মানুষের মধ্যে অন্তরাল হলো এই “আয়াতুল কুরসী”।

:না না, আরে কীসব বলছিস? ওসব গোড়ামী এখন বাদ দেতো। আমি বলছি কিছু হবেনা ব্যস?এইসব কুরছি ফুরছিগুলো শুধুই কুসংস্কার মাত্র।

: মহান আল্লাহ পাকের কালাম কখনো কুসংস্কার হতে পারে না নাফিজ, এই বলে আবির চোখ বন্ধ করেই “আয়াতুল কুরসী” পড়া শুরু করলো। “আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল হাইয়্যুল ক্কাইয়্যুম ওহুয়াল আলিয়্যুল আজিম।
দোয়া পড়া শেষ করে আবির বললো

:চল্ এবার যাই। আর কোন ভয় নেই।

কিন্তু একি! নাফিজ হঠাৎ কোথায় গেলো! আবির চারপাশে চেয়ে দেখে তার আশেপাশে অন্য কেউই নেই। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি নাফিজ এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়াটাতো অসম্ভব! এতোবড় বিশাল তেপান্তরের মাঠে আবির দেখে সে একাই দাড়িয়ে আছে, আর উপরে মধুপূর্ণিমার চাঁদ থেকে শুধু খসে পড়ছে রূপালী জোছনা। আবির জোরে জোরে কয়েকবার নাফিজের নাম ধরে ডাক দেয়। কিন্তু তার সেই ডাক ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে। আবিরের গাঁ শিঁরশির করে উঠে! এতক্ষণ তাহলে কার সঙ্গে আমি এখানে কথা বলছিলাম! কে আমাকে মধ্যরাতে এই নির্জন তেপান্তরের মাঠে নিয়ে আসলো! আর ওর চোখদুটোই বা কেন এমন রক্তের মতো জ্বলজ্বল করছিলো!!! তাহলে কি নাফিজের বেশ ধরে যে বহুরূপীটা আমাকে এই জনশূন্য প্রান্তরে নিয়ে এসেছে সে আর কেউই নয়। ওটাই ছিল আসলে একটা – “অশরীরি” !!!

আবির আর কিছু ভাবতে পারেনা। সে মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে দ্রুতপায়ে হেঁটে মেসে ফিরে আসে। তার রুমে যাবার সময় নাফিজের রুমের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নাফিজ তার বিছানায় মোষের মতো প ড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। তার হাতে মুঠোর মধ্যে তার মোবাইল ও পরনে সেই সাদা শার্ট ও সাদা ফুলপ্যান্ট।।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত