কুয়াশায়

কুয়াশায়

ট্রেণ থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালাম । ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, খানিকটা টিনের শেড দেওয়া, টিকিটঘর, ওয়েটিংরুম-টুম আছে বোধহয় । চারধারে গাছপালা, কেমন একটা বুনো বুনো গন্ধ । শৌভিক বললো, “তুমি একটু মালপত্রগুলোর কাছে দাঁড়াও, আমি দেখি একটা ট্যাক্সি ফ্যাক্সি পাওয়া যায় কিনা”। বলে ওদিকে গেটের দিকে চলে গেলো । ট্রেণটা মন্থর গতিতে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেলো, যে দুচারজন স্হানীয় লোক নেমেছিলো তারা টুকটাক এদিক ওদিক কেটে পড়লো ।

ঘন দুপুর ঝিম ঝিম করছে, একটা নিরুৎসাহ গোছের হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে । কেউ কোত্থাও নেই । এই মফস্বল শহরটাতে আমাদের মাস দুয়েক থাকতে হবে । শৌভিকদের কম্পানি একটা নতুন ফ্যাক্টরি তৈরি করেছে কাছাকাছি, সেখানে কিছু নতুন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ওকে । কলেজে আমার নতুন পদে যোগ দিতে মাস তিনেক দেরী, তাই আমারও আসতে অসুবিধে হয় নি । বেশ আবার মধুচন্দ্রিমা হবে বিয়ের তিন বছর পরে ভেবে দিব্যি লাগছিলো, কিন্তু চারপাশটা দেখে একটু দমে গেলাম । বড্ড নিঃঝুম যেন ।

পাশের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে এইসব ভাবছিলাম । ওদিকের একটা ঝুপসি মতো গাছের ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি রোদ পড়েছে, সরু পাতাগুলোর মধ্যে সর সর শব্দ হচ্ছে ।শৌভিকটাও এতো দেরী করছে সত্যি ! অন্যমনস্কভাবে পাশের দিকে তাকিয়েই ভীষণ চমকে গেলাম । একটা বড় সড় পাটকিলে রঙের কালো কালো ডোরাঅলা বেড়াল শুয়ে আছে । কখন এলো ? না কি আগে থেকেই ছিলো, লক্ষ্য করিনি ? বেড়ালটা চোখ খুলে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো ।

অবাক হয়ে দেখলাম ওর একটা চোখ নীলসবুজ আর অন্যটা হলদে মতো । কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো । খামচে টামচে দেবে না তো ? দেখলাম ওর ডান কানটা অর্ধেকটা কাটা । “নাও, চট করে ওঠো, একটা ট্যাক্সি পেয়েছি, পথে বাড়িঅলার বাড়ি থেকে চাবিটা নিতে হবে” শৌভিক এসে স্যুটকেসদুটোর হ্যান্ডল ধরলো । “ওই ব্যাগগুলো নাও । এই শ্রী, ওদিকে কি দেখছো ?” “এই বেড়ালটা ওমা কোথায় গেলো ? এই তো এক্ষুণি ছিলো ।” “যাক গে ।” শৌভিক পাত্তা দিলো না । “চলো, ট্যাক্সিটা ওইদিকে ।” ট্যাক্সিতে যেতে যেতে দেখছিলাম শহরটাতে বেশ একটা গ্রাম গ্রাম ভাব । গাছপালা ঝোপঝাড়, বাড়িগুলো সেকেলে আর পুরোনো । রাস্তায় বেশি লোকজন গাড়ি নেই, মাঝে মাঝে দোকানপাট ।

মিনিটদশেক পরে একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামলাম । শৌভিকের সঙ্গে আমিও নামলাম, সদর দরজার দিকে এগোবো, দেখি সেই বেড়ালটা, ঘাসজমিটায় বসে আমার দিকে নীল আর হলদে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে । কি আশ্চর্য, এতটা পথ এলো কি করে । ভেতর দিয়ে শর্টকাট আছে নাকি ? থাকলেও এইটুকু সময়ে…বেড়ালটা আমার দিকে তাকিয়েই কাটা ডান কানটা একটু নাড়লো ।শৌভিক বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে অধৈর্য গলায় ডাকলো, “শ্রী, এসো ।” আমি পা চালিয়ে গিয়ে দেখি এক মোটাসোটা গিন্নীবান্নি মহিলা দরজা খুলে বলছেন, “এসো বাছারা, ভেতরে এসো । বোসো একটু, চাবি দিচ্চি। ওমা তোমরা তো নেহাত ছেলেমানুষ গো, এই বুঝি বৌমা। অ ইন্দু, শরবত মিষ্টি নিয়ে আয়, সেই কোলকাতা থে’ তেতেপুড়ে এয়েচে।” আমি অভিভূত হয়ে ঢিপ করে একটা পেন্নাম ঠুকে দিলাম ।

উনি বলছিলেন, “কত্তার হাঁপানীটা বেড়েচে, তাই আমিই কতা কইচি । ও বাড়িতে তোমাদের অসুবিদে হবে না কো, আসবাব পত্তোর বাসন টাসন সব আচে । তোষক চাদর পর্দা সব পোস্কার করে কাচিয়ে রাকা আচে ।” একটি অল্পবয়সী মেয়ে ঘোলের শরবত আর সন্দেশ নিয়ে এলো, শৌভিক “আহা মাসীমা এসব আবার কেন” বলে টপ করে মুখে সন্দেশ পুরে দিলো । মাসীমা বললেন, “এত বেলায় আর কখন রান্নাবান্না করবে, আমি টিপিনকারিতে এবেলার খাবার গুচিয়ে দিচ্চি । তবে একটা কতা, ও বাড়িতে একটা অসুবিদে আচে বটে, বলে রাকচি…”। ভেতর থেকে কে ওঁকে ডাকলো, উনি ভেতরে গেলেন । আমি ঘোলের গ্লাস নামিয়ে শৌভিককে বললাম, “ব্যস হয়ে গেলো ।” “মানে ?” “মানে নির্ঘাত ভূত আছে । এক্ষুণি বলবেন, দক্ষিণপশ্চিমের শেষের ঘরটা তালা দেওয়া, ওটা খুলতে যেও না, রাতবিরেতে ওঘরে চলাফেরার শব্দ হয়, তা সে কিছু না । কিংবা পেছনের আমগাছের ডালে কে বৌ গলায় দড়ি দিয়েছিলো, পূর্ণিমা রাতে তার কান্না শোনা যায় । ওদিকে তাকাতে যেও না ।”

শৌভিক হাত নেড়ে কি বলতে যাচ্ছিলো, মাসীমা ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে হাতে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে একটি মাঝবয়সী কেজো মতো বৌ । “এই হচ্চে শান্তি, তোমাদের সব কাজকম্মো করে দেবে, ওপাড়াতেই বাড়ি । আর এই যে চাবি ।”
আমি করুণ গলায় বললাম, “মাসীমা, ওবাড়িতে মানে ইয়ে ভূতটুত নেই তো, আমি বড্ডো ভয় পাই । আপনি যে বলছিলেন কি একটা অসুবিধে আছে, তাই বলছিলাম মাসীমা চোখ কপালে তুলে বললেন, “অ মা ! ভূত আবার কোতা ! ওসব কিচু নেই কো । ওবাড়ি আমার মামাশ্বশুরের ছিলো, আমাদের দিয়ে গেচেন । নিষ্ঠেবান বাম্ভোন ছিলেন । বলচি জলের অসুবিধের কথা । জলের পাইপ নিয়ে ওপাড়ায় কি সব হয়েছে, মুখপোড়ারা অ্যাদ্দিনেও সারাতে পারলো না । তা শঙ্করকে বলা আচে, পেছনের কুয়ো থেকে তোমাদের জল টল তুলে দেবে, ট্যাঙ্ক ভরে দেবে ।” অনেক ধন্যবাদ দিয়ে টিয়ে বেরোবার সময় বললাম, “আপনাদের বেড়াল আছে বুঝি, মাসীমা ? বাইরে দেখলাম যেন।”

“না না বেড়াল টেড়াল কিচু নেই মা, কত্তার হাঁপানী আচে, লোম টোমে অ্যালার্জি হয়ে বাড়ে ।” ট্যাক্সিতে ওঠার সময় বেড়ালটাকে দেখলাম না । শান্তিদি আমাদের সঙ্গেই এলো । বেশ মিশুকে মনে হলো, বলছিলো, গিন্নী মায়েরা এ শহরের অনেক পুরোনো বাসিন্দা । জায়গাটা আগে অনেক জমজমাট ছিলো । তারপর কিছু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকজন কমে গেলো, তেমন ভালো স্কুলকলেজ কাছে নেই, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা থাকতে চায় না, তবে আবার নতুন ফ্যাক্টরি খুলছে, তাতে হয়তো মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম, একতলা বেশ ছড়ানো বাড়ি । শান্তিদি আমাদের জিনিষপত্র ভেতরে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো, তার পর বললো, “তোমরা আগে খেয়ে নাও বৌদিমণি । তার পর বিশ্রাম কোরো, আমায় বাজারের টাকা দিয়ে রেখো, যা যা দরকার নিয়ে আসবো ।”

বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘরদোর, সামনে একটু বাগান, পেছনে খানিকটা জমি, তাতে কিছু গাছপালা, তারপর জঙ্গলমতো । জঙ্গলের ভিতরটা কেমন আবছামতো দেখাচ্ছে, যেন কুয়াশা জমে আছে । সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এদিকে দেখতেই চমকে গেলাম, একটা বড়ো গাছের ছায়ায় শিকড়ের ওপর একটা আট ন বছরের মেয়ে চুপ করে বসে আছে । গ্রাম্য চেহারা, একটা ডুরে শাড়ি গাছকোমর করে পরা । মাথায় বেড়াবিনুনী, নাকে নোলক…এরকম কেউ পরে নাকি, যতোই গ্রাম্য হোক? কে জানে ! .মাটির মতো গায়ের রং, খালি পা । স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম, ওর কোলে সেই বেড়ালটা । সেটাই । সেই অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে ।আর, আর চোখ তুলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই দেখি, সে-ও আমার দিকে স্হির চোখে চেয়ে আছে, আর তারও একটা চোখ নীলচে সবুজ আর অন্য চোখটা হলদে বাদামী । এসব কি হচ্ছে ! কিছু একটা বলতে যাবো, এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে শান্তিদি আমায় ডাকলো । সেদিকে দুপা এগিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে দেখি, গাছতলায় কেউ নেই । কিরকম হলো ব্যাপারটা ! ভুল দেখলাম নাকি ।

খাবার টেবিলে বসে বললাম, “জানো, মনে হলো সেই বেড়ালটাকে আবার দেখলাম…”। শৌভিক বললো, “ধুৎ কি হলো তোমার, ঝোপে ঝোপে বেড়াল দেখছো । ওটা সেই ওখান থেকে আসবে কি করে, উড়ে নাকি ?” তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে গেলো, কি সব ফাইল পত্র দেখার আছে ।আমি বললাম, “শান্তিদি, তুমিও খেয়ে নাও, আচ্ছা, একটা ছোট শাড়ি পরা মেয়েকে দেখলাম গাছতলায় বসে ছিল, কে জানো তুমি ?”

“ওমা, ওরকম ছোট মেয়ে আবার কে গো এখানে..” শান্তিদি একটু ভাবলো, তার পর বললো, “ তবে ওই বিলের ওধারে যে নতুন পাড়া হয়েছে, সেখানকার কেউ হতেও পারে, ওদের কাউকে আশকারা দিও নি বৌদিমণি, যা হুজ্জোত হলো ওদের নিয়ে “কি হয়েছিল গো ?” বাসন তুলতে তুলতে শান্তিদি বললো, “ওরা সব এখানকার লোক না । ওদিকে অনেকটা ভেতর দিকে, অনেক দূরে জঙ্গলের ভেতরে ওদের গাঁ ছিলো নাকি, অত জানি না । একবার বছর দুতিন আগে কোথায় যেন বাঁধ ভেঙে নদীতে ভীষণ বন্যে হয়ে ওদের ঘরদোর ভেসে গেছলো, মড়ক লেগেছিল । তা গভমেন্ট ওদের বিলের ওদিকে জমি টমি দিয়ে ঘর তুলে দিয়েছিলো, চাষের সাহায্য করেছিলো । সেই থেকে আছে ।” “তা বেশ তো ।” আমি কৌটো থেকে মৌরি মুখে দিলাম ।

“না গো বৌদি, ওরা যেন কেমনতরো । ওই একটু আধটু চাষ করে, বিলে জলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, মাছ ধরে, পাখি মারে, ছেলেপুলেদের ইস্কুল টিস্কুলে পাঠায় না, ইস্কুল বোর্ডের দিদিমণিরা কত্তো চেষ্টা করেন । ওদের কেউ কাজে রাখতে চায়না । ঠিক ঠাক কাজ করে না, আবার হাতটান আছে । জড়িবুটি ওষুধ বিষুধ তুকতাক জানে না কি । কি সব মন্তোর তন্তোর কালোজাদু করে । কে রাখবে ওদের, বাব্বা, বলো ।” “কি যে বলো শান্তিদি, তুক তাক মন্তোর আবার কি ! তা হুজ্জোতটা কি হলো ।” “আগের ভাড়াটেরা চলে যাবার পর এবাড়ি খালি পড়ে ছিলো কিছুদিন । তা ওই হতচ্ছাড়াগুলো করলো কি, পেছনেই জঙ্গল তো, ওদিক দিয়ে এসে এবাড়ির পেছনের জমিতে উঠোনে বারান্দায় উঠে এসে শোওয়া বসা রান্না বান্না করতে লাগলো । কুয়ো থেকে জল নিতো । কি সব লতাপাতা লাগাতো, শেরড়বাকড় শুকোতো । গিন্নীমারা কত বললেন ভালোয় ভালোয় চলে যেতে, শুনলো না, ওনারা চটে কাঁই, তখন পুলিশ ডেকে লোকজন দিয়ে ওদের তাড়ানো হলো, চ্যাঁচামেচি, হই চই সে এক কাণ্ড ।”

শান্তিদি রান্নাঘরে চলে গেলো । আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম । আমরা সংসার গুছিয়ে নিলাম । শৌভিক কিছুদিন ফ্যাক্টরির কাজে খুব ব্যস্ত রইলো । আমি শান্তিদির সঙ্গে দোকানবাজার ঘুরে আসতাম, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপও হলো, সকলে আমাকে নতুনপাড়ার বাসিন্দাদের সম্বন্ধে একবার করে সতর্ক করে দিলেন । সামনের বাড়ির সরকার কাকীমা গলা নামিয়ে অনেক কিছু বললেন ওদের ব্যাপারে । ওরা নাকি অনেক রকম ইয়ে টিয়ে জানে, কতো কি করতে পারে । না ঘাঁটানোই ভালো ।

“তোমাদের বাড়িউলী রায় গিন্নী তো ওদের মেরে ধরে তাড়ালেন, তা কাজটা উচিত হয় নি কো । ওরা সহজ মানুষ না । সাবধানে থেকো বাছা ।” সেদিন দুপুরে পেছনের জমিটায় দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে এই সব ভাবছিলাম, কতো রকম যে সংস্কার মানুষের মনে । দূরে গাছপালার মধ্যে একটু একটু কুয়াশা, যেন মেঘ জমে আছে । শৌভিক বলছিলো ও শুনেছে না কি বেশী বৃষ্টি হলে বিল উপচে জল ঢুকে যায় জঙ্গলে, আর এই শহরটা ঠাণ্ডা মতো, তাই ভেতরটা সবসময় ভিজে ভিজে, ঘন গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশা দেখা যায় । এমনিতে লোকজন বেশী ঢোকে না।

সামনের ঘাস জমিটুকুর ঝোপে ঝাড়ে নানা রকম অচেনা ফুল ফুটেছে । গাছের নিচে রোদে ছায়ায় ডোরা ডোরা…হঠাৎ একটা অংশ কেমন দুলে উঠলো, দেখি একজোড়া আলাদা রঙের চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে । ধীরে ধীরে এগোলাম…চোখদুটোর মধ্যে কিসের যেন ঝিলিক খেলে গেলো । বেড়ালটা রেশমের মতো মসৃণ ভঙ্গীতে উঠে জঙ্গলের দিকে চললো । দেখি একটা সরু পথ রয়েছে, ওইদিকেই বোধহয় কুয়োটা যেখান থেকে জল আনা হয় । দেখা আসা যাক…আমি বেড়ালটার পেছন পেছন চললাম, কিন্তু একটু পরেই সেটা আলোছায়ায় মিলিয়ে গেলো । যখন তখন এমন অদৃশ্য হয়ে যায় কেমন করে কে জানে ।

আমি একটু থেমে আবার এগোতে লাগলাম । ঘন গাছপালা, গুঁড়িগুলোর গায়ে লম্বা লম্বা শিকড়ের মতো কি ঝুলছে, বুনো ভারী একটা গন্ধ, ঝিঁঝিঁ ডাকছে, কেমন যেন ঘুমঘুম দেখি পথটার পাশে গাছপালার আড়ালে একটা আদ্যিকালের মরচেধরা ভাঙাচোরা গাড়ি, কি করে এলো এখানে ? কিছুটা গিয়ে দেখি একটা নালার ওপর একটা চওড়া বড়ো পাথর, জলের মধ্যে একটা কালো লম্বা মূর্তি ভেঙে পড়ে আছে । পেরিয়ে গেলাম, আরেকটু এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম । সামনেই একটা ঝুপসিমতো গাছের নিচে দুটো মেয়ে বসে আছে । একটা সেই সেদিনের দেখা মেয়েটা, অন্যটা ঠিক অবিকল ওর মতো দেখতে আরেকটা মেয়ে । সেইরকম সাজপোশাক, শুধু একজনের নীল ডুরে শাড়ি আর অন্যজনের লালচে । একজনের ডানচোখটা নীলচে সবুজ, বাঁচোখটা হলদে বাদামী, যেমন আগে দেখেছিলাম আগে, আর অন্যজনের ঠিক উলটো । বেড়ালটা একজনের কোলে শুয়ে আছে । তিনজোড়া চোখ আমার দিকে চেয়ে রইলো । বাঁদিকের মেয়েটা কেমন ধাতব গলায় বললো, “দেখ, নতুন বৌদিমণি ।” ডানদিকের মেয়েটা বললো, “হ্যাঁ, ওবাড়ির বৌদিমণি ।”

“কি সোন্দর না ।”
“খুব সোন্দর ।” কেমন একটা অদ্ভুত টান ওদের কথায় । আমি বললাম, “তোমরা বুঝি ওদিকের নতুন পাড়ায় থাকো ।” ওরা কিছু বললো না ।
“তোমাদের নাম কি ?”
“ওর নাম পদ্ম গো ।”
“আর ওর নাম সল্লা গো ।” পরস্পরকে দেখিয়ে দিলো । বললাম, “ওটা তোমাদের বেড়াল বুঝি ? কি নাম ওর ?” কেমন একটা অদ্ভুত খিলখিল করে হাসতে লাগলো ওরা ।

“ওর নাম নেই গো ।”
“ওর নাম হয় না ।” আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল । ফেরার জন্য পেছন ফিরলাম ।
“বৌদিমণি কুয়ো দেখবে না ?”
“হ্যাঁ, কুয়ো দেখতে এসেছে, না ?”
“কুয়ো দেখবে এসো, কি মিষ্টি জল ।”
“কুয়োর জল, কি মিষ্টি গো ।”
“ওই দিকে ।”
“আমাদের সঙ্গে এসো, ওওইই দিকে ।”

এমন অদ্ভুতভাবে কথা বলে কেন ওরা, কেমন সুর করে, এ ওর কথাটা ধরে নেয়, কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে আওয়াজটা । ওরা কি করে জানলো আমি কুয়োটা দেখতে এসেছিলাম ! বনের ভেতরটা কুয়াশায় ঢেকে আসছে, আমি দ্রুত পা চালালাম, তাকাবো না ভেবেও একবার ফিরে দেখি, গাছের নিচে কেউ নেই, মেয়েদুটো নেই, বেড়ালটাও নেই । জানতাম…আমি প্রায় ছুটে ফিরে এলাম, নালা পেরিয়ে, ভাঙা গাড়িটা পাশে রেখে । শান্তিদিকে তেমন কিছু বলি নি, এই নিয়ে আবার নানা কথা হবে । রাত্রে শৌভিককে বললাম । ও বললো, “তুমি কেবলই ওই বেড়ালটাকে দেখছো, তোমার একটা অবসেসান হয়ে যাচ্ছে । মানে বেড়াল থাকতেই পারে, আছেও, কিন্তু তুমি ভাবছো ওই বেড়ালটাই ।”

“আর মেয়েদুটো ? শান্তিদিকে কায়দা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললো ওসব যমজ মেয়ে টেয়ে কক্ষণো দেখেনি ।”
“দেখো শ্রী, ওই যে নতুন পাড়া না কি, ওখানে যমজ দুটো মেয়ে থাকতেই পারে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর সকলেই তো বলছে ওদের হাবভাব কথাবার্তা একটু অন্যরকম । আরে কয়েক বছরেই মূলস্রোতে মিশে যাবে একদম দেখো ।”
ল্যাপটপে মন দিলো, আমি রাগ করে শুয়ে পড়লাম । শরীরটা ভালো লাগছিলো না । খেতেও পারি নি ভালো করে ।
রাত্রে ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম । আমি যেন ওই বনটায় ছুটে বেড়াচ্ছি, গাছে ধাক্কা লাগছে, চারদিকে কুয়াশা । কি যেন একটা খুঁজছি আমি, খুব দরকার সেটা, হঠাৎ বুঝলাম সেটা হচ্ছে কুয়োটা । দূর থেকে পদ্ম আর সরলা কেমন সুর করে আমায় ডাকছে ।

কিসে যেন পা জড়িয়ে গেলো, আমি পড়ে যাচ্ছিলাম, চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম । পাশে শৌভিক গভীর ঘুমে । একটু বসে থেকে আমি পাশের টেবিলের গ্লাস থেকে জল খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখি, খোলা জানলায় বেড়ালটা । একদম অবাক হলাম না কোনো কারণে । আস্তে আস্তে জানলার দিকে এগোলাম, বেড়ালটা লাফিয়ে মাটিতে পড়ে দ্রুত জঙ্গলের দিকে মিলিয়ে গেলো । আমার হঠাৎ মনে হলো, শোবার আগে আমি ওই জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম । শৌভিক বলেছিলো ওই জঙ্গলের দিকে আর না যেতে । আমার কদিন কাটলো কেমন একটা অস্হির ভাবে । অবসন্ন লাগছিলো, খেতে ঘুমোতে পারতাম না ঠিক করে । কলেজে ক্লাস নেওয়া শুরু করার আগে একটু পড়াশোনা করা উচিত, তাতেও মন লাগতো না । একদিন শান্তিদি মাছ ভাজছিলো, আমি তরকারি কুটে দিচ্ছিলাম, জিজ্ঞেস করলাম ,

“আচ্ছা শান্তিদি, ওই যে কুয়োটা থেকে তোমরা জল আনো সেটা কোন দিকে গো ?”
“ওই তো, ডান পাশের মিনিপিসীদের বাড়ির পিছন দিয়ে একটু গিয়েই, কেন গা, হঠাৎ কুয়োর খোঁজ ?”
“এমনি, দেখতে ইচ্ছে করছিলো ।”

শান্তিদি পরে আমায় নিয়ে গেলো, জঙ্গলের দিকে নয়, পাশের দিকে খানিকটা গিয়ে বেশ পরিষ্কার খোলা জায়গায় একটা কুয়ো, কিছু লোক জল তুলছে, কথাবার্তা বলছে । বাঁধানো পাড়ে বালতি কলসী নামানো, শান্তিদি একজনকে বললো, “কি রে মিঠু, তোর রান্নার কাজ সারা ?”

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, “না না এটা নয়, অন্য কুয়ো..” কেন বললাম জানি না । শান্তিদি অবাক হয়ে বললো, “অন্য কুয়ো আবার কোথায়, এটা থেকেই তো জল নিই ।” আমি অপ্রতিভ হয়ে বললাম, “না না, এমনি বলছিলাম…”। শান্তিদি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকালো ।

সে রাত্রে আবার স্বপ্নটা দেখলাম । ঘুম ভেঙে কেবলই মনে হতে লাগলো কি যেন আমায় খুঁজতেই হবে, ওই জঙ্গলে । কুয়ো ? এই অবধি ভেবে আমার মাথার ভেতরটা কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগলো । বেচারা শৌভিক ওর ট্রেণিদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, ওকে কিছু বলি নি । অশান্ত মনে এদিক ওদিক করলাম, শান্তিদির সঙ্গে বাজারে গিয়ে কেনা কাটা করলাম ।আর দুপুর বেলা, শান্তিদি বাড়ি চলে গেলে, সব চুপ চাপ, আমি বেরিয়ে এলাম ।

জঙ্গলের ঠিক সামনে বসে বেড়ালটা যেন আমারই অপেক্ষা করছিলো । উঠে বনের ভিতর ঢুকলো, আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই সরু পথটা দিয়ে চললাম, আজ যেন বনটা আরো ঘন, কুয়াশা আরো বেশী, ঝিঁঝিঁর শব্দটা কেমন নেশাধরানো, কি একটা ফুলের মিষ্টি ভারী গন্ধ, দমচাপা…ভাঙা গাড়িটা পাশে পড়লো, নালায় আজ জলটা বেশী…কোথায় যাচ্ছি, কেন ? দুপাশে বনের মধ্যে ভাঙাচোরা দেয়াল থাম, আগের বার লক্ষ্য করিনি । বেড়ালটাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে, প্রথম দিন থেকেই যেমন করে, কি ভাবে করে ? হাঁপ ধরে গলাটা শুকিয়ে গেছে । উপর দিকে চেয়ে দেখি আকাশ দেখা যাচ্ছে না, শুধু কুয়াশা । আর সামনে চেয়ে দেখি, একটা বিরাট কুয়ো, পাথরে বাঁধানো । কি সব খোদাই করা । আর ওদিকের পাড়টায়, কুয়োর ভেতর পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসে আছে পদ্ম আর সরলা । বেড়ালটা একজনের কোলে ।

“ওই দেখ, বৌদিমণি এসেছে ।”
“কুয়ো দেখতে এসেছে বৌদিমণি ।”
“কাছে এসো গো বৌদিমণি ।”
“এসো, এসো ।”

হঠাৎ দেখি ওরা আর কুয়াটার ও পাড়ে নেই, এ পাড়ে ঠিক অমনিভাবে বসে আছে, পা ঝুলিয়ে, আমার দিকে ফিরে । আমার গা ছমছম করতে লাগলো, ভীষণ ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো । আমি বললাম, “না, না, যাবো না…”। পিছন ফিরে ছুটলাম, ওরা সেই অদ্ভুত ধাতব গলায় হাসতে লাগলো ।

“যেও না গো, শোনো ।”
“কথা শোনো ।”

অন্ধভাবে ছুটলাম, আঁচল কাঁটাঝোপে আটকে যেতে লাগলো । দুপাশে ভাঙাচোরা থাম আর দেয়ালের মাঝে ছায়া ছায়া কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে । সেই নালাটায় জল উপছে যাচ্ছে, জলের মধ্যে একটা কালো লম্বা পাথরের মূতি উঠে দাঁড়িয়েছে, মরচেধরা গাড়িটার মধ্যে এক এলোচুল মহিলা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে, তার কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে…আর সামনেই আবার সেই কুয়োটা, পদ্ম আর সরলা খিল খিল করে হাসছে ।

“ঐ দেখ, বৌদিমণি, পথ হারিয়েছে ।”
“আহা গো, পথ হারিয়েছে ।”

আমি আবার পিছন ফিরে ছুটি । একটা সরু চৌরাস্তা, কোত্থেকে এলো, বাঁদিকের পথটা ধরি, কালো মূর্তিটা এখানেও, আর সামনেই আবার কুয়োটা, পদ্ম আর সরলা দুলে দুলে হাসে । আবার ডানদিকে যাই, সেখানেই তাই, মাগো, কোথায় যাবো, ভীষণ চেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে, আর পারি না…

“বৌদিমণির তেষ্টা পেয়েছে ।”
“আহা গো, তেষ্টার বড় কষ্ট ।”
“জল খাবে গো ?”
“খুব মিষ্টি জল, খাবে ?”

না, না, আমি খাবো না । কিন্তু কোথায় যাবো, কুয়াশা ঘিরে ধরেছে, কোন দিকে পথ । আমার শরীর যেন হিম হয়ে জমে যাচ্ছে । ওদের মধ্যে একজন পিছন না ফিরেই কুয়োতে ঝাঁপ দিলো । নিমেষে উঠে এলো, হাত একটা পাথরের পুরোনো ঘটি ।

“এই নাও, জল ।”
“জল খাও গো বৌদিমণি ।” আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম । ওরা হাসলো । কি সেই হাসিতে – কৌতুক, ব্যঙ্গ, আক্রোশ, না অন্য কিছু ?
“ভয় নেই গো ।”
“ভয় কোরো না ।”
“বৌদিমণির খোকা হবে ।”
“রাঙা খোকা ।”
“কিন্তু দাম দিতে হবে ।”
“নইলে হবে না ।”

আমি স্হাণুর মত দাঁড়িয়ে গেলাম । আমার কদিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু এরা, কে এরা, কি…ডাক্তার বলেছিলো সন্তান হতে গিয়ে আমার কিছু জটিলতা হতে পারে, সন্তান না-ও বাঁচতে পারে, শৌভিক ঝুঁকি নিতে চায় নি, কিন্তু, আমি, আমি চেয়েছিলাম, তাই…

“কি গো বৌদিমণি, দাম দেবে তো ?”
“দেবে কিনা বলো, সময় নেই বেশি ।” চারপাশের দৃশ্যটা একটু একটু কাঁপছে । সবটাই যেন…অবাস্তব । আমি তখন যুক্তির বাইরে । বললাম, “কি দাম দেবো, বলো ।”
“সে আমরা নিয়ে নেবো ।”
“পরে নিয়ে নেবো ।”
“তুমি বুঝতেও পারবে না ।”
“বুঝবেও না গো ।” আমি বললাম, “বেশ, দেবো…নিয়ে নিও ।”
“এসো, জল খাও ।”
“এসো গো । রাঙা খোকা আসুক ।”

আমি অঞ্জলি পেতে দাঁড়ালাম, ওরা জল ঢেলে দিলো, মিষ্টি জল সত্যি, আকন্ঠ পান করে আমার তেষ্টা জুড়িয়ে গেলো, চারপাশের দৃশ্য কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে গেলো, শুধু স্বাভাবিক বন, গাছপালা, কুয়াশাও নেই তেমন । সরু পথটায় বেড়ালটা আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো, তারপরে মিলিয়ে গেলো । আর কখনো দেখিনি ওদের । ক’মাস পরে কলকাতায় আমার ছেলে জন্মালো কোনো সমস্যা বা জটিলতা ছাড়াই, ডাক্তাররা অবাক হয়েছিলেন ।

সুস্হ ছেলের চোখের রং গাঢ় বাদামী, আমার শ্বশুরেরও অমনি ছিলো, আমার শাশুড়িমা বললেন । শুধু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় ওর ডান চোখে একটা সবুজ আভা আছে । ডাক্তার বললো, হেটারোক্রোমিয়া, অমন হয় কারো কারো, ওতে কোনো সমস্যা হয় না । বড় হয়ে উঠছে ও, স্বাভাবিক জীবন আমাদের । শুধু আমি মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবি সেই দামটা কি আমার দেওয়া হয়েছে, না এখনো বাকি আছে ? আর, কি করে বুঝবো, কি মূল্য দিলাম আমি !

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত