লিলি

লিলি

আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা আপনাদের এবার বলি। গতকাল আমার সাইক্রাটিস্ট বন্ধু সৌভিক আমায় তার এক নতুন খুদে পেশেন্টের ব্যাপারে জানায়। মেয়েটার নাম লিলি, বয়স পাঁচ বছর। তার বাবা মা অনিরুদ্ধ ও হিয়া সেন গতমাসে তাকে কৃষ্ণনগরের হলি চাইল্ড অরফানেজ থেকে দত্তক নিয়েছেন। গত কয়েকদিন থেকে মেয়েটির মারাত্মক জ্বর ও সাথে সে কিছু প্রচণ্ড অদ্ভুত ব্যবহার করছে। কাল যখন আমার বন্ধুর কাছে ওকে ওনারা আনেন তখনও সেরমই কিছু ঘটে যেটা আজ আমার বন্ধু আমাকে জানাবে আর সেই ঘটনা দেখেই ও আমাকে একবার ওর সাথে যেতে বলেছে আজ। এখন আমি তাই চলেছি বালিগঞ্জে প্রথমে আমার বন্ধুকে নেব তারপর যাবো অনিরুদ্ধ সেন এর বাড়ী গড়িয়া।” কৌস্তভ ক্যামেরা বন্ধ করলো। পাশেই দিশা আর শাহীন বসেছিল। সামনে ওদের ড্রাইভার দিলীপ।

“ভাই একটা জিনিস কিন্তু বেশ প্রব্লেম লাগছে।” শাহীন বলল।

“কিরে?” কৌস্তভ গাড়ির জানলা নামিয়ে সিগারেট ধরালো।

” দেখ আমরা এর আগে যেখানেই গেছি ওখানে আমাদের ভিক্টিম নিজে ডেকেছে তো শুট করা কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এখানে সৌভিক আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির বাবা মা জানেনও না ওনারা কিন্তু আমাদের এলাও না করতেই পারেন।”

“ব্যাপারটা আমিও ভেবেছি। একটা বাচ্চা মেয়ে আর বড় কথা ওনারা দুজনেই ডাক্তার শুনলাম। এসব ভূত তুতের থিওরি ওনারা পাত্তা দেবেন বলে আমার লাগছে না।”

“আরে সেরম হলে ক্যামেরা অফ থাকবে। আমরা তো আর জোর করে করতে পারিনা। পুরোটাই ওদের ওপর। একবার দেখি তো গিয়ে কি ব্যাপার।”

“ভিডিও না দিলে পাব্লিক গালি দেবে!”

“দিক । এটাতো আর প্র্যাংক ভিডিও না এটা অত্যন্ত সিরিয়াস ইস্যু।”

“সে ঠিক। দিলীপদা আর কতটা?”

“এই তো ঢুকছি। ওনাকে ফোন করো। নামতে বলো।”

” আলাপ করিয়ে দি , আমার বন্ধু ডাক্তার সৌভিক বেরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ , গতকাল ওই আমায় লিলির ব্যাপারে জানায়। তো সৌভিক তুই একটু আমাদের বল কাল ঠিক কি হয়েছিল তোর চেম্বারে।” “দেখ আমার প্র্যাকটিসের সূত্রে রোজ বিভিন্ন রকম মানুষের সাথে আলাপ হয়, আজকাল মানুষের মনের জটিলতা বা কোনো অদ্ভুত আচরণ আমায় আর আগের মতো অবাক করেনা। কিছুক্ষণ কথা বললেই ব্যাপারটা ধরেনি। কিন্তু কাল যেটা হলো সত্যি আমায় নাড়িয়ে দিয়েছে। ওই টুকু ফুটফুটে একটা মেয়ে যে আমায় ওই রকম আতঙ্কিত করবে কোনোদিনও ভাবিনি..”

“বলিস কি? তোকে তো সাহসী বলেই চিনি..”
“দেখ ভূতে বিশ্বাস আমার কোনোদিন ছিল না, এখনও করি সেটাও বলছি না, কিন্তু তোর অভিজ্ঞতা গুলো আমায় এটা ভাবতে বাধ্য করেছে যে কিছু একটা আছে। আর তাই কালকের ঘটনার পর প্রথমেই তোর কথা মনে পড়লো।”
শাহীন হাতের ইশারাতে একবার ক্যামেরা অফ করতে বলল। কৌস্তভ অফ করে ইশারাতেই জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার।

“সৌভিকদা আমি তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস না করে পারছি না ওরা আমাদের দেখে বিরক্ত হবেননা তো? আর এলাও না করতেই পারেন..”

“দেখো ক্যামেরার ব্যাপারে বলতে পারছিনা কিন্তু লিলির সাথে সেশনে কৌস্তভ যাতে অন্তত থাকে সেটা আমি দেখবই।”

“বুঝলি শাহীন আর চাপ নিসনা। সৌভিক ভাই তুই বল কি হলো কাল।”
“তো ওরা আগেই এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল। বিকেল পাঁচটায় ডাকি ওনাদের। তো ওনারা সময়ে পৌঁছে যান। ওনারা জানান যে দত্তক নেওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন সব ঠিক ছিল। নতুন বাড়িতে ও সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল খেলছিল। খাওয়াদাওয়া ঘুম সব সময় মতোই চলছিল। কিন্তু ছয় সাতদিন পর থেকে ও খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেয় সারাদিন ঘরের কোনো একটা কোণে একা বসে থাকতো।

জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেও ওরা খাওয়াতে পারছিলেন না। তারপর ও ওনাদের সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ওনারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরপর গত শুক্রবার অর্থাৎ আজ থেকে চারদিন আগে, সকালে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়ে ওর মা দেখেন ওর প্রচন্ড জ্বর। উনি নিজেই ডাক্তার, কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারেন না। সেইদিনই রাতের বেলায় হঠাৎ ও ঘরের সব জিনিস তুলে তুলে ফেলে দিতে শুরু করে। অনিরুদ্ধ ওকে বাঁধা দিতে গেলে ও নাকি চিল্লাচিল্লি শুরু করে, ওনাকে কামড়েও দেয়। তারপর কিছুক্ষণ সারা বাড়ি লন্ডভন্ড করে ও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপরের দিন ও সারাদিন বিছানা থেকে নামেনি, জ্বর মাঝে মাঝে এসেছিল আর কথা একেবারেই বন্ধ। সেদিন রাতে যখন ওনারা ঘুমাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ ওনারা খেয়াল করেন লিলি ওদের খাটে ওদের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

ওনারা দুজনেই চমকে যান , অনিরুদ্ধ ওর নাম ধরে ডাকতেই ও ওনার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভাবে হাসে আর খাট থেকে লাফিয়ে নেমে অন্য ঘরে চলে যায়। অনিরুদ্ধ উঠে ওর পিছনে যান তখন হঠাৎ একটা ফুলদানি তুলে ও ওনার দিকে ছুঁড়ে মারে। অনিরুদ্ধ কোনো ভাবে নিজেকে বাঁচান। তারপর ওর ঘরে গিয়ে দেখেন ও ওর বিছনায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এরপর ওনারা কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না।পরের দিন ওনারা অরফানেজে ফোন করেন , ওনারা জানান এরকম কোনো রেকর্ড ওর নেই। এমনকি ওরা ঘুরিয়ে কথাও শুনিয়েছেন বলে জানালেন অনিরুদ্ধ। ওনারা বলেছেন অসুবিধা হলে যেন তারা লিলিকে ফেরত দিয়ে আসেন। এই প্রস্তাবটা মেনে নেওয়া ওনাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল তাই ওনারা আমার কাছে আসেন। আচ্ছা ওই বাঁদিকের রাস্তাটা নিতে হবে রে..”কৌস্তভ ইশারায় ঠিক আছে বলে ওকে বলে যেতে বললো।

” আমার চেম্বারে আসার পর থেকে লিলি মাথা নিচু করেই বসে ছিল। অনিরুদ্ধ অনেকবার বলার পর ও আমার দিকে তাকালো। একটা নিষ্পাপ শিশুর মুখ, কিন্তু শরীরটা যে ভালো নেই সেটা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু জানিস হঠাৎ মুখের অভিব্যক্তি কেমন বদলে যেতে লাগলো, ওই নিষ্পাপ ভাবটা হারিয়ে গিয়ে কেমন নৃশংস হয়ে উঠলো ওই ছোট্ট মুখটা। চোখগুলো লাল হয়ে গেল দেখতে দেখতে আর অদ্ভুত ঘৃণার দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে লাগলো মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। হঠাৎ ওর ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠলো যেটা বর্ণনা করা খুব মুশকিল কিন্তু ওটা ভয়াবহ। ও হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আর তারপর একলাফে ঘরের কোণে রাখা টেবিলের উপর উঠলো। ওর মা হিয়া আর্তনাদ করে ওঠে ওই দৃশ্য দেখে।

আর ও ওনাকে দেখে এবার বেশ জোরে জোরেই হাসতে থাকে। ও টেবিল থেকে নেমে আমার দিকেই আসছিল, এই সময় কেমন একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল ও , কিন্তু লিলি যখন প্রথমে এসে চেয়ারে বসে ওর হাঁটায় কোনো সমস্যা ছিলনা। লিলি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি ঠিক কি করা উচিত বুঝে ওঠার আগেই ও অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অনিরুদ্ধ এসে ওকে কোলে তুলে নেন। ওনারা অত্যন্ত হতাশ হয়েই ফিরে যান, আমি চেষ্টা করেও কোন সদুত্তর দিতে পারিনি রে। কেন জানিনা ব্যাপারটা তখনই আমার তোকে জানাতে আর তোকে দেখাতে ইচ্ছে করে। হয়তো কোথাও একটা গিয়ে তোর তত্ত্ব গুলো বিশ্বাস করে ফেলছি।” কৌস্তভ আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, “দেখ আপাত দৃষ্টিতে ভৌতিক লাগলেও এটা ওর মেন্টাল কন্ডিশনও হতে পারে, হয়তো আগে থেকেই ছিল যেটা অরফানেজ চেপে গেছে।”

“দেখ সেটা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না কারণ আমি সেটার সুরাহা করতে পারবো। স্প্লিট পারসোনালিটি হতেই পারে কিন্তু তাও কেমন একটা খটকা লাগছে।”
“চল গিয়েই দেখি, তুই একটু ওনাদের ম্যানেজ করিস।”
“নিশ্চই নাহলে তো সবটাই বেকার হয়ে যাবে। কিন্তু ক্যামেরাটা জানিনা রে।”
“চাপ নিস না সেরম হলে মোবাইলে ভয়েস রেকর্ড করবো।”

আরও মিনিট পাঁচেক পর ওরা পৌঁছালো অনিরুদ্ধ সেনের বাড়ির সামনে। একটা নতুন খুব সুন্দর দুইতলা বাংলো। বাড়ি দেখেই বোঝা যায় স্বচ্ছল অবস্থা ওদের। গেটের পাশের শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা , “ডঃ অনিরুদ্ধ সেন ও ডঃ হিয়া সেন।”

প্রথমেই বিপত্তি, যা ভয় তাই হলো কৌস্তভ নিজের পরিচয় দিতেই ওরা প্রচন্ড রেগে গেল এমনকি সৌভিককেও বলল এরকম হলে তারা অন্য কোনো ডাক্তার দেখবে। হিয়া তো কেঁদেই ফেলল। শাহীন আর দিশা বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো। কিন্তু অনেক কষ্টে ওদের বোঝানো গেল। যখন সৌভিক লিলির সাথে দেখা করবে তখন কৌস্তভের ওই ঘরে থাকার অনুমতি দিলো ওরা। ওদের ওখানে পৌঁছানোর আগে, সৌভিক জানায় যে ও যখন সকালে ঠিকানা জানতে ফোন করে তখন ওরা ওকে বলেছিল যে কাল ওর ওখান থেকে আসার পর থেকে লিলি ঘুমিয়েই চলেছে। সৌভিক, কৌস্তভ আর লিলির মা বাবা ঢুকলো লিলির ঘরে। কৌস্তভ দেখলো সৌভিক ঠিকই বলেছিল একটা ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু, ও ভাবতেই পারছেনা এই বাচ্চাটা ওই রকম ঘটনা ঘটাতে পারে।

সৌভিক ওর মাথার এক দিকে বসলো আর অনিরুদ্ধ আর হিয়া আরেক দিকে। ওরা বসতেই লিলি একেবারে উঠে বসলো। ঘটনাটা এমনভাবে হল যে ওরা সবাই চমকে উঠলো। ও উঠে বসলেও ওর চোখগুলো তখনও বন্ধ ছিল। এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটলো যার জন্য কেউ তৈরি ছিল না। লিলি মুখটা অস্বাভাবিক বড় করে খুললো আর ওর মুখ থেকে রাশি রাশি মাটি পড়তে লাগলো। সবাই ওইদিকে তাকিয়ে থাকলো আর মাটি পড়েই যেতে থাকলো। প্রায় দশ মিনিট ওইভাবে মাটি পড়ার পর লিলি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। প্রায় আধঘন্টা সবাই লিলির চারদিকে বসে থাকল, কারো গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোলো না। শাহীন আর দিশাও ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

“কিছু বুঝলি কৌস্তভ?” নিস্তব্ধতা ভাঙলো সৌভিক।
“মাটিটা কিন্তু এখানকার না।”
“কি বলছো কৌস্তভ?” দিশা জিজ্ঞেস করলো।
“দেখছিস না লাল মাটি? এখানে লাল মাটি হয় নাকি?”
“বাঁকুড়াতে হয়!” শাহীন বললো।
“আমি ওকে কৃষ্ণনগরে দিয়ে আসবো। এসব ঠিক না।” হঠাৎ অনিরুদ্ধ বলল। হিয়া তখনও নির্বাক।
“আপনারা কি লাল মাটি আনিয়েছিলেন কোনো কারণে?”
“পাগল হয়ে গেছেন কি যাতা বলছেন?!” অনিরুদ্ধ চিৎকার করে উঠল আর ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“লিলি!” ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল হিয়া। দিশা গিয়ে ওর পাশে বসলো।

কৌস্তভ এগিয়ে গেলো মাটিটার দিকে। ততক্ষনে আরেকটা জিনিস হয়েছে ওই মাটির ওপর এসে বসতে শুরু করেছে হাজার হাজার মাছি। আর ওই মাটি থেকে একটা দুর্গন্ধ হঠাৎ সারা ঘরে ছড়াতে শুরু করে।

“তুই ওনাকে নিয়ে বাইরে যা আর তোরাও বাইরে যা।” কৌস্তভ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
“আর লিলি?” সৌভিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোরা বের হ আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

আর ঠিক সেই সময় লিলি আবার উঠে বসে। এবার সে তার চোখ খোলে। তার চোখ তখন গাঢ় লাল। ও এবার আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে আসে। ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। লিলি খুঁড়িয়ে হাটছিল। আর ঐভাবেই ও গিয়ে পৌঁছায় পাশের ঘরে। পিছন পিছন কৌস্তভরাও যায়। অনিরুদ্ধ মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। লিলি ঘরে ঢুকতেই ও টের পায়। কারণ লিলির সাথে ওই দুর্গন্ধটাও ঢোকে ঘরের মধ্যে।

“কি চাই তোর? আমার সামনে আসিস না আমি কিন্তু মেরে দেব। এই ঘর থেকে চলে যা এক্ষুনি। আমি কালই তোকে ফেরত দিয়ে আসবো। এসব ঝামেলার দরকার নেই। কি কথা কানে যাচ্ছে না বের হ এখন থেকে। মেরে দেব কিন্তু।”
“জানি তো তুমি মারবে!” গত কয়েকদিনে প্রথম লিলি কথা বললো, কিন্তু অনিরুদ্ধ বুঝলো এটা লিলির গলার আওয়াজ না এটা তো এক অন্য গলার আওয়াজ। কিন্তু এই গলার আওয়াজ খুব চেনা ওর। ভয়টা এবার চেপে ধরলো অনিরুদ্ধকে। “কি মারবে না? মারবে না আমায়? মেরে ফেলবে না? মাটিতে পুঁতে দেবে না? খাইয়ে দেবে না আমায় ওই মাটির পোকা গুলোকে?”

অনিরুদ্ধ কেঁদে ফেলল। বাকিরা সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বেশ অনেক্ষন আগেই শাহীন ক্যামেরাটা অন করেছে। কৌস্তভ এগিয়ে গেলো লিলির দিকে। “লিলি আমার কথা শোন লিলি… কি হয়েছিল বল আমায়?” কৌস্তভ ওকে বলল। লিলি প্রচন্ড রাগ আর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে তাকালো, তারপর আবার অনিরুদ্ধর দিকে ফিরলো।”মারো আমায় ড্যাড মারো আমায় আবার!” “আমার ভুল হয়ে গেছেরে আমায় ক্ষমা করে দে আমার ভুল হয়ে গেছে।” লিলি এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল,আর একবারে এক মুঠি চুল চামড়া শুদ্ধু ছিড়ে নিলো ওর মাথার থেকে। অনিরুদ্ধের গোটা মুখ রক্তে ভরে যেতে লাগলো। ও চিৎকার করে উঠলো।ঠিক এমন সময় হিয়া ওই ঘরে এলো আর ওই অবস্থা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।

লিলি অন্যদিকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে অনিরুদ্ধকে বারান্দার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। শাহীন কৌস্তভ সৌভিক ওকে আটকাতে চেষ্টা করলে ওদের ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে লাগলো। ওরা বুঝতে পারছিল না এত অমানবিক শক্তি কি করে এলো ওই টুকু বাচ্চার মধ্যে। সবাই কিছু করে ওঠার আগেই লিলি চুলের মুঠি ধরে অনিরুদ্ধকে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিলো আর নিস্তেজ হয়ে বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেলো। সৌভিক আর বাকিরা ওই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো, কৌস্তভ ছুটে এলো বারান্দায় কিন্তু যখন ও নীচে দেখলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, নীচে রাখা ইটের রাশির ওপর অনিরুদ্ধর মাথাটা পড়ে থেতলে গেছে।

এমন সময় দিশা ছুটে এসে কৌস্তভকে বলল, ” দাদা তাড়াতাড়ি এস দেখো হিয়া কি বলছেন।” কৌস্তভ সৌভিককে লিলিকে দেখতে বলে নিজে ভেতরে গেল। সৌভিক লিলিকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে এলো। আর শাহীন সম্বিৎ ফিরে পেতে পুলিশে আর হাসপাতালে ফোন করলো। “আমিও হয়তো আর বাঁচবো না। আমি মা হয়ে যা করেছি আমার বাঁচার অধিকার নেই আর। কিন্তু আমি চাই নিজের পাপটা স্বীকার করে যেতে, তাই ওই ঘরে বইয়ের আলমারিতে একটা কালো ডাইরি আছে… ওটাতে সব লিখেছি আমি… সব বুঝতে পারবে।” হিয়া আবার জ্ঞান হারালো।

“গত কয়েকবছর ধরে আমার এই কাজের সূত্রে বেশ কিছু অদ্ভুত অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী আমি হয়েছি। অনেকেই বিশ্বাস করবেন না এমন অনেক জিনিস এখন আমি হয়তো বিশ্বাস করে নেব, অত্যন্ত একেবারে উড়িয়ে দিতে পারব না। কিন্তু গতকাল সেনবাড়িতে যা হলো তা আগের সব কিছুকেই ছাপিয়ে যায়। এতটা সংবেদনশীল এই পুরো ঘটনা যে আমিও নিজের আবেগকে বেঁধে রাখতে পারিনি।” কৌস্তভের গলা ভারী হয়ে এলো। কালকের ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে আপনাদের সামনে ইতিমধ্যে তুলে ধরেছি। আজ আপনাদের জানাবো হিয়ার ওই ডায়েরি থেকে আমরা কি কি জানতে পারলাম।”

“অনিরুদ্ধ আর হিয়ার বিয়ে হয় ২০১৩ সালে। বিয়ের পর পরই ওনারা চলে যান শিলং। ওনারা দুজনেই ওখানের একটা বেসরকারি নার্সিংহোমে কাজ শুরু করেন। সবকিছুই ভালো চলছিল কিন্তু বিয়ের দুইবছরের মাথায় ওনারা জানতে পারেন যে ওদের নিজেদের সন্তান হওয়া সম্ভব না। দুজনেই ভেঙে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ তে ওনারা ঠিক করেন দত্তক নেওয়ার। শিলং এর একটা হোম থেকে ওনারা আট বছরের একটা মেয়েকে দত্তক নেন। অদ্ভুতভাবে এই মেয়েটির নামও লিলি।ওই মেয়েটির পায়ে একটু অসুবিধা থাকায় ও খুঁড়িয়ে হাঁটত। কিন্তু ওই হোমে ওই মেয়েটিই একমাত্র বাঙালি হওয়ায় আর খুব সুন্দর গান গাওয়ায় ওকেই ওদের পছন্দ হয়। বয়েসে একটু বড় হওয়া সত্ত্বেও। লিলির আসার পর ওনাদের জীবন আনন্দে ভরে ওঠে।

সন্তান পেয়ে দুজনের জীবন সুখে কাটতে থাকে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়না। লিলি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অদ্ভুতভাবে পাল্টে যায়। চঞ্চল ও প্রথম থেকেই ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে প্রচন্ড অবাধ্য। ঘরের জিনিস পত্র ভাঙা শুরু করে। তারপর শুরু করে চুরি করা। না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও যেতে লাগলো। যখন এসব প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি পর্যায় পৌঁছে গেল ওনারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরপর হিয়া একদিন ওকে হাতে নাতে চুরি করার সময় ধরে ফেলেন। অনিরুদ্ধ তখন ঘরেই ছিলেন, উনিও ওখানে আসেন। ধরা পড়ে যাওয়ায় ও বেশ ঘাবড়ে যায় আর হঠাৎ একটা ফুলদানি তুলে ও হিয়ার মাথায় জোরে মারে। হিয়ার মাথা ফেটে যায়, ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এসব দেখে অনিরুদ্ধ নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি।উনি লিলির গালে একটা জোরে চর মারেন।

লিলির মাথা গিয়ে পাশের দেওয়ালে লাগে আর ও মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। এটা দেখে হিয়া রক্তাক্ত অবস্থাতেও উঠে বসেন আর লিলিকে নিজের দিকে টেনে নেন। কিন্তু ওর মাথাটা যখন উনি কোলে নিলেন, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছিলো। লিলির নিষ্প্রাণ শরীর নিয়ে দুজনে অনেক রাত অব্দি বসেছিলেন সেদিন ওনারা। যখন অনিরুদ্ধ নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলেন, তখন উনি হিয়াকে বললেন এই ঘটনা কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। তাহলে সারাজীবন তাদের নিঃসন্তান থাকতে হবে।হিয়া কিছু বলার অবস্থাতেই ছিলেন না । অনিরুদ্ধ ওর কোল থেকে লিলিকে তুলে নেন । সেদিন ওই গভীর রাতে অনিরুদ্ধ লিলিকে ওদেরই বাগানে মিশিয়ে দেন। হিয়া পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা শুধু দেখতে থাকেন।

ঘটনার পর রাতারাতি ওনারা শিলং ছেড়ে প্রথমে মুম্বাই যান আর পরে কলকাতাতে ফিরে আসেন। সব ভুলিয়ে তারা নতুন করে জীবন শুরু করেন। কিন্তু একটা শুন্যতা থেকেই গেছিলো। তাই তারা ঠিক করেন আবার দত্তক নেবেন। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার হওয়ায় দত্তক পেতে অসুবিধা হয়নি। ওনারা আবার একটা মেয়েকেই দত্তক নেন। আমরা যে মেয়েটিকে লিলি বলে চিনি আসলে তার নাম দিয়া। কিন্তু দত্তক নেওয়ার পর ওনারা ওর নাম লিলি রাখেন। আর তারপর যা যা হয়েছে তা তো আপনাদের জানা।” “ঘটনাটা বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করবেন না, আমিও হয়তো করতাম না একযুগে। আর যারা বিশ্বাস করবেন তারা ভাববেন দোষটা আসলে কার। হয়তো কোনো ভাবে পুরো ব্যাপারটা আটকানো যেত। কিন্তু নিয়তিকে আটকাবে কে? যাইহোক পুলিশ এসেছিল।

পুরো ঘটনা তাদের বলা হয়েছে স্বাভাবিক ভাবে তারা বিশ্বাস করেননি। হিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, লিলিকে অর্থাৎ দিয়াকে রাখা হয়েছে এখানেই একটা হোমে। এই বিকেলেই দেখে আসলাম ও সুন্দর হাসছে খেলছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও হ্যাঁ শাহীন যে ভিডিও করেছিল সেটা এতক্ষণ ভয়ে আমায় জানায়নি। এখনই জানালো। ওটা এখন যাচ্ছি পুলিশের কাছে নিয়ে। তারপর সত্যি কি হবে আমি নিজেও জানিনা। আচ্ছা এবারের মত শেষ করি, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য নমস্কার।” কৌস্তভ রেকর্ডার অফ করলো।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত