অচেনা “সে”

অচেনা “সে”

আমি একা থাকলে কে যেন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। আমি তাকে দেখতে পাই না। আমার কেমন শিরশিরে অনুভূতি হয়।

ট্রেকিং করার সময় বান্দরবানের পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে মারা গেছে আদিত্য। খবরটা পেয়ে আমি শোকে স্তব্দ হয়ে যাই।

আদিত্য মারা যাওয়ার পর থেকে আমার এরকম ছমছমে অনুভূতি হচ্ছে।
আদিত্য ছাড়াও পর পর ক’জন ঘনিষ্ট বন্ধুর অপমৃত্যু আমাকে স্তব্দ, নির্বাক আর শোকগ্রস্থ করে তুলেছে।

আমার জীবন শূন্যতায় ভরে উঠেছে। আমার বুক সারাক্ষণ খাঁ খাঁ করে। পড়ালেখায় মন বসে না। আমার কেবল ফাঁকা লাগে।

কারও সঙ্গে আর আগের মত আড্ডা জমে না। একা একা রাস্তায় হাঁটি। ছাদে বসে থাকি। তখন সে আমার কাছে আসে।

আমার কাছে যে আসে সে আদিত্য না। সে অন্য কেউ।

আমি একা থাকলে আমার কাছে যে আসে তাকে আমি মাস ছয়েক আগে এক বৃষ্টির দিনে সাভারের রাস্তায় এক পলক দেখেছি …
একা থাকলে আমার মনের মধ্যে আমার মৃত বন্ধুদের কত স্মৃতি এসে ভিড় করে।

ক্লাসের পর আমরা এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। আরমান ছিল গাড়ি পাগল। ওর অনেক গুলো গাড়ি ছিল।

তার মধ্যে কি কারণে যেন ২০০৮ সালের ছাই রঙের টয়োটা ফরচুনা ছিল ওর ফেবারিট। গাড়িটা ওরাই ইম্পোর্ট করত।

ঢাকা আর চট্টগ্রামে গাড়ির শোরুম ছিল আরমানদের। আরও ব্যবসা ছিল ওদের । আরমানদের বাড়ি চট্টগ্রাম।

ঢাকায় নিকেতনে ফ্ল্যাট ছিল । ওই ফ্ল্যাটেই থাকত আরমান। আরমানের বাবা চিটাগাং চেম্বার অভ কমার্সের মেম্বার।

অঢেল টাকা পয়সার মালিক। ঘন ঘন আমেরিকা যায় আরমানরা। আমেরিকার মিনোসোটার মিনিয়াপোলিস শহরে বাড়ি আছে আরমানদের।

আরমানের স্বাস্থ ভালো। টল। ফরসা। ইদানীং প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে ইয়াবা খাওয়া এক ধরণের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরমানও ওই লাল-নীল বড়ি গুলো খেত। নেশা করলেও ড্রাইভিং করার সময় আরমানের হাত কাঁপত না।

যাত্রাবাড়ির জ্যামটা কোনও মতে কাটিয়ে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে একটানে শীতলক্ষার পাড়ে পৌঁছে যেতাম। কখনও রাজেন্দ্রপুর রাশিদা খালার বাড়ি।

রাশিদা খালা আমার মায়ের খালাতো বোন। বিধবা। নিঃসন্তান। একাই থাকেন। রেবু নামে একটি ছাব্বিস-সাতাশ বছর বয়সি মেয়ে দেখাশোনা করে।

রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বাড়ি। বাড়িটা নির্জন। দোতলা। দেয়াল ঘেরা গাছগাছালিময় । পিছনে একটা কালো জলের টলটলে পুকুর।

তারপর দেয়াল। তারপর রেললাইন। রাশিদা খালার বাড়িতে আমার বন্ধুরা খুব ইনজয় করত। পুকুরে দাপাদাপি করে গোছল।

রেবুর হাতের রান্না চমৎকার।তাছাড়া আমরা গেলে রাশিদা খালাও রান্না করতেন।
আমার বন্ধুদের মধ্যে আদিত্যরই ঘোরাঘুরি করে বেড়ানোর শখটা বেশি । এই বয়েসেই বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছে।

ওর বাবার ছিল বদলির চাকরি । এটাও এক কারণ। বান্দরবানে ট্রেকিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল । ভালো ফটো তুলত আদিত্য।

ওর সুন্দরবন সিরিজি-এর ‘একজন বৃদ্ধ মৌয়ালের মুখ’ ছবিটি জার্মানিতে অনুষ্টিত একটি আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছিল।
আমাদের মধ্যে জিন্নাতই ছিল সবচে শান্ত আর চুপচাপ। কালো মতন ছোটখাটো গড়নের শুকনো করে দেখতে ছিল জিন্নাত।

জিন্নাতের বাড়ি ছিল হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায়। কথাবার্তায় সেই অঞ্চলের টান আছে। কথা বলার সময় খানিকটা তোতলাত জিন্নাত।

ঢাকায় প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়ে ঝিকাতলার কাছে একটা মেসে উঠেছিল জিন্নাত ।

আরমানই প্রায় জোর করে ওকে নিকেতনে ওদের ফ্ল্যাটে নিয়ে তুলেছিল ।
অনেকটা ভ্রমন পাগল আদিত্যর ঠেলাঠেলিতেই গত জানুয়ারিতে আমরা জিন্নাতদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

লাখাই জায়গাট বেশ সুন্দর। জিন্নাতদের গাছগাছালিতে ঘেরা টিন সেডের বাড়িটাও সুন্দর।

বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে ঘেরা বেশ বড় সরো একটি পুকুর। পুকুরঘাটে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আমরা অনেক রাত অবধি আড্ডা মারতাম।

জিন্নাত-এর বসির কাকা চমৎকার লোক গান গাইতেন। বসির কাকার বয়স পঞ্চাশের মতো বয়স।

শীর্ণ। লম্বা। মাথায় টাক। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। বিয়েটিয়ে করেননি বসির কাকা। স্বভাবটি খানিক পাগলাটে ধরনের।

তিনিও আমাদের সঙ্গে এসে বসতেন পুকুর ঘাটে। ক্কারী আমির উদ্দীন -এর গান গাইতেন :

..জায়নামাজে বন্ধু সেজে
ধ্যানে পাবে খোদা
হুজুরী কলবে কর সজিদা।..

একরাতে। পুকুর ঘাটে বসে আড্ডা মারছি। আমার বাথরুম চাপল।জিন্নাতকে ইশারা করলাম। ও উঠে দাঁড়াল। হাতে টর্চ।

বাথরুম সেরে ফেরার পথে জিন্নাত আমাকে ফিসফিস করে বলল, প্রায়ই আমি অদ্ভুত একখান স স স স্বপন দেখি সাজিদ।
কি স্বপ্ন? আমি কৌতূহল বোধ করি। চাপা স্বভাবের জিন্নাতকে আমার কেমন মিস্টিক মনে হত।ওর চোখ দুটি সরল আর নিষ্পাপ।
জিন্নাত বলল, সে সে সে আমারে পুকুরে টাইন্না নিতে চায়।
কে?
সে।

আমি অবাক হলাম। তারপর জিন্নাতকে ‘ধুরও স্বপ্ন’ বলে সান্ত্বনা দিলাম।
জিন্নাত বলল, স্বপন পর পর অঅ অ অনেক বার দেখছি।
আমি বললাম, ওরকম হয়। বলে আমি একটা ইংরেজি সিনেমার নাম বললাম।
স্বপনত আমি তো-তোরেও দেখছি। জিন্নাত বলল।
কি! আমি থমকে গেলাম। আমারে দেখছিস? কোথায়?
হ। পুকুরের তলায়। কাদার ওপর পইড়া আছোস।
জিন্নাত এর কথা শুনে আমার গা শিরশির করে উঠেছিল।

লাখাই থেকে আমরা লাউয়া ছড়া রির্জাভ ফরেস্ট রওনা হলাম । জার্নি খুব একটা ইনজয় করিনি।

জিন্নাতের স্বপ্নটা বারবার হানা দিচ্ছিল। মাথা থেকে কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। সারাটা পথ আরমান ড্রাইভ করল।

গাড়ি চালাতে চালাতে ফারিয়ার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলল। ফারিয়া আরমানের গার্ল ফ্রেন্ড । আমেরিকায় পড়াশোনা করছে।

ইয়াবার নেশা সত্ত্বেও একবারও হাত কাঁপল না আরমানের । অথচ সেদিন বৃষ্টির দিনে সাভারের রাস্তায় যে কী হল …

এক বৃহস্পতিবার বিকেলে ইউনিভারসিটি থেকে বাসায় ফিরেছি।
মা কে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাল। কি হয়েছে জিগ্যেস করলাম। মা বলল, রেবু ফোন করেছিল।

তোর রাশিদা খালা খুব অসুস্থ । আজই একবার শ্রীপুর যাওয়া দরকার।
মায়ের সঙ্গে বাসে উঠলাম।
রাশিদা খালা দীর্ঘদিন ধরে স্নায়ূবিক অসুখে ভুগছেন। মাঝে মাঝে অসুখটা তীব্র আকার ধারণ করে।

তখন ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেন। মাকে দেখলেই কেবল খানিকটা সুস্থ হন। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়।

মা অনেকবারই রাশিদা খালাকে শ্রীপুরের ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে ঢাকায় আমাদের সঙ্গে এসে থাকতে বলেছেন।

কি কারণে রাশিদা খালা রাজি হননি।
মাকে দেখে রাশিদা খালাকে নর্মাল মনে হল।
রাতে খেয়ে এসে দোতলার বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম।আজ রাতটা ভরা পূর্ণিমার। পুকুর। গাছ। সব আলো হয়ে আছে।

চারধার নির্জন হয়ে আছে। শীত প্রায় শেষ। তবে বাতাসে শীতের তীব্রতা আছে।
বারান্দায় অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঘুমএল না। আজকাল আমার রাতগুলি নির্ঘুম কাটে। সেই দিনটার কথা ঘুরেফিরে মনে হয়। তখন আমি স্তব্দ হয়ে যাই।

… সেদিনও আরমানই ড্রাইভ করছিল । ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। ক্লাসের পর সে দিনটায় আমরা সাভার চলে গিয়েছিলাম।

আশুলিয়া বাজার ছেড়ে আরও উত্তরে।
এই জায়গাটার নাম গণক বাড়ি। আদিত্য বলল।
গণক বাড়ি, গণক বাড়ি।বলে উৎকট ভঙ্গিতে হেসে উঠল আরমান । তারপর গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল।
জিন্নাত চিৎকার করে বলে, এই আরমান! আস্তে!
জিন্নাতের কথায় আরমান হাসে। তারপর স্পীড আরও বাড়িয়ে দেয়। টাল ছিল। দিনদিন ওর ইয়াবা খাওয়ার মাত্রা বাড়ছিল।

যদিও ড্রাইভিং সিটে বসে ওর হাত কাঁপে না।
আমি সিগারেট ধরিয়ে টানছি। হঠাৎ বিকট শব্দ হল। ওহ্ মাইগড! আদিত্য চিৎকার করে ওঠে। জিন্নাত চিৎকার করে ওঠে।
আরমান ব্রেক কষে।
আমি মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই আমার শরীর জমে গেল … চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা ছেলে রাস্তার পাশে পড়ে আছে।

গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়েছে। বেঁচে আছে কি না বোঝা গেলনা। ছেলেটার খালি গা লুঙ্গি পরা।
জিন্নাত কাঁপা-কাঁপা বলল, ওরে হাসপাতালে নেওন দরকার।
তার বদলে আরমান গাড়ি স্টার্ট নেয়।
তারপর একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি।
একটি দৈনিক পত্রিকায় দূর্ঘটনার সংবাদটি ছোট করে ছাপা হয়েছিল । সাভারের গণক বাড়ি সড়কে অজ্ঞাতনামা কিশোরের লাশ।
সাতদিন পর সপরিবারে আমেরিকার মিনোসোটায় চলে যায় আরমান। ওরা মিনিয়াপোলিসের বাড়িতে উঠেছিল।

সেন্ট পল শহরের সেন্ট ক্যাথেরিন ইউনিভার্সিটিতে ফারিয়া পড়ত। মিনিয়াপোলিস থেকে সেন্ট পল শহরে যাচ্ছিল আরমান।

একা। নিজেই ড্রাইভ করছিল। নাঃ, ফারিয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি আরমানের ।

দানবীয় লরি সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরমানের কনভার্টিবলটা দুমড়ে মুচরে গিয়েছিল …

জিন্নাত দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিল।ও মারা গেল পুকুরে ডুবে। তার পর থেকেই আমি সব সময় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে থাকি।

জিন্নাত বলেছিল, তোরে দেখছি পুকুরের তলায় কাদার ওপর পইড়া আছোস।
আর আদিত্য … পরে মারমা গ্রামের লোকজন ওর লাশ উদ্ধার করেছিল। ওর ক্যামেরাটা পাওয়া যায়নি।

সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিলাম। আজ কিছু ঘটতে যাচ্ছে মনে হল । জিন্নাত মুখটা মনে পড়ে গেল।

ওকে কে যেন পুকুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জিন্নাত এর কথা মনে পড়তে আমার গা শিরশির করে উঠেছিল।

ঠিক তখনই মনে হল কে যেন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আদিত্য কিংবা আরমান কিংবা জিন্নাত না। অন্য কেউ।

আমার মাথার ভিতরটা হিম হিম ঠেকল । মাথার ভিতরে কেমন ধূসর কুয়াশা ছড়িয়ে যায়।

হঠাৎ আমার মনে হল আমার এক্ষুণি নীচে যাওয়া দরকার। চাঁদের আলোয় পুকুর ঘাটে বসা দরকার।

আমি নীচে নেমে এলাম।
নীচে নামতেই দেয়ালের ওপাশ দিয়ে গুমগুম শব্দে একটা ট্রেন চলে গেল। তারপর চারপাশ গভীর নির্জনতায় ডুবে গেল।

কেবল গাছের পাতায় শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দ শোনা যায়।

পুকুর ঘাটটি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। সিঁড়ির ওপর বসলাম। বাতাসে বেশ শীত আছে। তেমন তীব্রতা টের পেলাম না।

পুকুরে চাঁদের ছায়া। পুকুরে টুপ করে একটা শব্দ হল। আমি চমকে ফিরে তাকাই। পুকুরের রুপালি পানিতে গোল তরঙ্গ ছড়াল।

ঢেউয়ে চাঁদের ছায়া কাঁপছে। আমি জানি এখন সে পুকুরের পানি থেকে উঠে আসবে …

আমাকে স্পর্শ করার আগে সিমেন্টের ঘাটে তার ভেজা পায়ের ছাপ পড়বে …
আমি শ্বাস টানি ।
তার অপেক্ষা করি ……

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক · রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত