( পর্ব- ৫ / শেষ পর্ব )
*** এবং কোব্বালা ***
রিমির রুমের দরজা ভেজানো।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঘরের বাতি জ্বালেনি রিমি। আসলে বাতি জ্বালানোর মতো এক ফোটা শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।
কোনো এক অদৃশ্য শক্তি রিমির ভেতরের প্রাণ শক্তির শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিয়েছে। তাই নিথর হয়ে বিছানায় পড়ে আছে রিমি।
বাড়িতে কেউ না থাকলেও ভেতরে ঢুকতে তন্ময়ের কোনো সমস্যাই হয়নি। এখানে সে অনাহুত নয়, বরং রীতিমতো ভিআইপি।
কদিন পরই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রিমিকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
তাই তন্ময়ের ভেতরে ঢোকার ব্যাপারে কাজের লোকেরা কোনো আপত্তিই করেনি।
ধীরে ধীরে রিমির বিছানার দিকে এগিয়ে যায় তন্ময়। ভাবলেশহীন চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে রিমি।
হাতের একটা আঙ্গুল নাড়ানোর মতো শক্তিও তার নেই। তার নিয়তির মতো এগিয়ে আসতে থাকে তন্ময়…
না না তন্ময়ে ভর করে অন্য কিছু, যার চোখে হিংস্র পশুর নিষ্ঠুরতা। মুখের দু পাশের চোয়ালের হাড় ঠেলে উচু হয়ে আছে।
এই তন্ময়কে তো রিমি চেনে না। এ কে! গলা দিয়ে একটু শব্দও বের করতে পারে না রিমি।
দুটো অদৃশ্য হাত যেন তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। একটা জান্তব বোটকা গন্ধে পুরো কামড়ার বাতাস ভারি হয়ে আসে।
অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে তন্ময়, না তন্ময় নয়, তার ভেতরের অশুভ স্বত্ত্বাটি,
–‘রিমি, তুমি হবে এ পৃথিবীর প্রথম সৌভাগ্যবান নারী। কোব্বালার বংশধর আসবে তোমার ঔরষে।
–তুমি হবে এ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তির জন্মদাত্রী।
–সারা পৃথিবীর শয়তানের উপাসকরা তোমাকে পূজা করবে।’
তন্ময়ের প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে ভেসে আসে গা গুলানো দুর্গন্ধ।
দু’ঠোট ঠেলে বেরিয়ে থাকা জিব বেয়ে নেমে আসছে চটচটে অস্বস্তিকরা আঠালো পদার্থ।
দু’হাতের নখের ভেতর জমাট বেধে আছে কালচে ময়লা।
রিমির চোখের সামনে একটি ভারি কালো পর্দা নেমে আসে।
তন্ময় যখন ধীরে ধীরে রিমির উপর ঝুঁকে আসছে, তখনই বিদ্যুত গতিতে সেখানে প্রবেশ করেন হায়দার মবিন।
প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তন্ময়। শ্বাপদের হলদে দৃষ্টি নিয়ে মবিনের চোখে চোখ রাখে।
রাগ আর ঘৃণায় মুখের চামড়া কুঁচকে আসে। জিবটাকে এক বিঘা পরিমাণ বের করে মুখের চারপাশটা চেটে নেয়।
দৃশ্যটি দেখে ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠে হায়দার মবিনের।
চাপা হুঙ্কার ছেড়ে এক পা এক পা করে মবিনের দিকে এগুতে থাকে তন্ময়।
তার চোখে চোখ রেখে নিজেরে জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন হায়দার মবিন।
ঠিক এক হাত সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে দুজন। সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে যায়।
তন্ময়ের শরীরের আশ্রয় ছেড়ে কোব্বালার অস্তিত্ব গ্রাস করে নিতে চায় হায়দার মবিনকে।
মুহুর্তের ভগ্নাংশের অন্যমনষ্কতা, কিংবা চুল পরিমাণ সুযোগ খুঁজতে থাকে অন্য ভূবণ থেকে আসা এই অনাহুত শক্তি।
তীব্র মানষিক শক্তি আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে হায়দার মাবিন বুঝতে পারেন, কোব্বালাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না।
মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করতে থাকেন তিনি।
আর সতর্ক সাবধানতায় সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন কোব্বালার রণকৌশল।
স্নায়ুর লড়াই চলে শুভ আর অশুভের। হায়দার মবিনের সারা শরীর দিয়ে ফোয়ারার মতো ঘাম ঝড়তে থাকে।
টকটকে লাল মুখমন্ডল দেখে মনে হয় শরীরের সব রক্ত এসে মুখে জমা হয়েছে।
তন্ময়ের চোখে উঁকি দেওয়া কোব্বালার সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান।
শরীরের প্রতিটি কোষ বিদ্রোহ শুরু করে। খুলি ফেটে যেন মস্তিষ্ক বেড়িয়ে আসবে।
এভাবে কতোক্ষণ কেটেছে জানা নেই।
সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে পরাজয়ের কাছে আত্মসমর্পণের মুহুর্তে হায়দার মবিন অনুভব করেন, কোব্বালা পিছু হটছে।
আসন্ন বিজয়ের আশায় একটু হয়তো অসতর্ক হয়েছিলেন, মুহুর্তের জন্য হয়তো একবার চোখের পলক পড়েছিলো,
এ সুযোগে হায়দার মবিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তন্ময়। হিংস্র শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে টুটি কামড়ে ধরতে চায়।
হায়দার মবিনের গলায় ঝুলানো প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান সাধকের আঙ্গুলের হাড় দিয়ে তৈরি মালাটির সংস্পর্শে আসামাত্রই….
বিকট জোরে জান্তব চিৎকার দিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে তন্ময়।
অমানুষিক এই চিৎকারে হায়দার মবিন দুচোখে অন্ধকার দেখেন। কিন্তু মুহুর্তের জন্যও কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননা।
অশুভশক্তির দুর্বলতার সুযোগে নিজের গলা থেকে হাড়ের মালাটা বের করে পরিয়ে দেন তন্ময়ের গলায়।
হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে যায় তন্ময়।
তার চোখ থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে অমানুষিক অশুভ ছায়া।
একটু একটু করে মনুষত্ব উঁকি দেয়। এক সময় দুচোখ বুজে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে।
তন্ময়ের গলায় ঝোলানো মালাটির দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন হায়দার মবিন।
নিউইয়র্কে এক ম্যাক্সিকান বুড়ির গ্যারেজ সেল থেকে এটি কিনেছিলেন।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বুড়ি এ মালাটির বিশেষ আধ্যাতিক গুনাগুনের বর্ননা করেছিলো।
বুড়ির কথাগুলো তখন এতোটুকু বিশ্বাস করেননি মবিন। মালাটির রহস্যময় সৌন্দর্য টেনেছিলো।
হাতে নিতেই এক ধরণের বিচিত্র অনুভুতি হয়েছিলো। সেজন্যই এটা কিনে নেন।
আর তখন থেকেই এটা মবিনের গলায় শোভা পাচ্ছে।
কিন্তু আজকে এই চরম বিপদের মুহুর্তে ম্যাক্সিকান বুড়ির সেই কথাগুলো….
..এভাবে জ্বলজ্বলে সত্যি হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।
বিছানায় ধীরে ধীরে উঠে বসে রিমি। মেঝেতে পড়ে থাকা তন্ময়কে দেখে একটু আগের স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
চিৎকার দিয়ে হায়দার মবিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। তার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে মবিন বলেন,
–‘চিন্তার কিছু নেই রিমি, সব ঠিক হয়ে যাবে। তন্ময় আবার আগের মতো হয়ে উঠবে।
–শুধু লক্ষ্য রাখবে আগামী সাত দিন যেন সে ঘর থেকে না বের হয়। এ সময় যেন সে এক মুহুর্তেও জন্যও একা না থাকে।
–আমি প্রতিদিনই সকাল-বিকেল এসে তন্ময়কে কাউন্সেলিং করে যাবো।
মেঝেতে পড়ে থাকা তন্ময়ের রুক্ষ চুলগুলোতে এবার পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় রিমি।
মনে মনে হাসেন গোলাম হায়দার। তন্ময় অবশ্যই ভালো হয়ে উঠবে।
ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর কী আছে।
………..
এই গল্পের সব পর্বের জন্য নীচের লিঙ্ক গুলোতে ক্লিক করুন —
কোব্বালা ( পর্ব- ৫ / শেষ পর্ব )