( পর্ব- ৪)
*** ড. হায়দার মবিন ***
মবিন সাহেব অতি সজ্জন ব্যক্তি। নিখুঁত ভদ্রলোক।
গল্প-উপন্যাসের অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড প্রফেসরদের মতো উদ্ভট পোশাক পড়া কিংবা,…
উল্টাপাল্টা হাস্যকর কান্ডকারখানাও করে বেড়ান না তিনি।
কিন্তু পাড়ার লোকজন তাকে একটু সন্দেহের চোখেই দেখে। কারণ আর কিছুই না, তার গবেষণার বিষয়বন্তু।
সারা দুনিয়ার মেধাবীরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করছে,…
..তখন ড. হায়দার মবিন গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রেততত্ত্ব।
যুক্তরাষ্ট্রেও ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়তে গিয়ে সাত বছর মার্কিন মুল্লুকে কাটিয়ে আসেন তিনি।
এ সময়টির বেশিরভাগই তিনি ব্যয় করেছেন প্রেততত্ত্বর গবেষণায়।
ইউনিভার্সিটির ডর্মের রুমমেট জেসনের পাল্লায় পড়ে প্রথম এ বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়।
জেসন ছিল প্রেত সাধকদের একটি চক্রের সদস্য। হায়দার মবিন অবশ্য জেনসের পথে হাঁটেননি।
প্রেত বা অশুভ আত্মার স্বরূপ সন্ধানে গবেষণা করেছেন তিনি।
কিভাবে এসব অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করা যায় সে বিষয়টিই ছিল তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
অশুভ শক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য কোথায় কোথায় না গিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের তাবৎ শহর থেকে শুরু করে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল কিছুই বাদ রাখেন নি।
অবশ্য যে বিষয়ে পড়তে গিয়েছিলেন তাতেও একটা ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছিলেন।
ভাগ্যিস এ কাজটা করেছিলেন, নয়তো দেশে ফিরে গ্রাসাচ্ছাদনই মুশ্কিল কয়ে পড়তো।
এখানেতো আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভুততত্ব’ পড়ানো হয় না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ান।
সেটা নিছক পেট চালানোর জন্য। নেশা বলতে ওই অতীন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা।
অকৃতদার মবিন সাহেবের কাজে বাধা দেওয়ার মতোও কেউ নেই।
তাই মহানন্দে পুরো সময়টাই তিনি প্রেত বিষয়ে চর্চা করে কাটান।
দীর্ঘ বার বছরের পারবাস্তব বিষয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম হোঁচট খেয়েছেন হায়দার মবিন।
গত কয়েক দিন ধরে যতোবারই ধ্যানে বসে মনোসংযোগের চেষ্টা করেছেন,
ততোবারই একটি চরম অস্বস্তিকর অনুভুতি তার একাগ্রতায় বাগড়া দিয়েছে।
যেন একটা তাগিদ তাকে তাড়া করে ফিরছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসেতে এক সাধু বলেছিলেন,
–সাধনার একটি স্তরে পৌছালে অনেক দূর থেকেই অশুভ কোনো কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
তাহলে কী হায়দার মবিন সেই স্তরে পৌছে গেছেন?
–‘স্যার, আসতে পারি?’
কপাল কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করেন। ও হ্যা মনে পড়েছে; এমবিএ থার্ড সেমিস্টারের ছাত্রী।
মেয়েটির হাতে একটা কার্ড। তার লাজুক হাসি দেখে মনে হচ্ছে এটি সম্ভবত তার বিয়ের কার্ড।
কিন্তু আজকালতো মেয়েরা পড়া শেষ না করে বিয়েই করতে চায় না।
–‘রিমি, কি ব্যপার বলো তো? তোমার বিয়ে নাকি?’
এ প্রশ্নে লজ্জাল লাল হয়ে যায় রিমি। এগিয়ে এসে কার্ডটি হায়দার মবিনের হাতে তুলে দেয়।
তার আঙ্গুল মবিন সাহেবের আঙ্গুল স্পর্শ করে। বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকে উঠেন মবিন।
তার গা থর থর করে কাঁপতে থাকে। হিস্টিরিয়া গ্রস্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েন তিনি।
আকষ্মিক এ ঘটনায় হতচকিত হয়ে যায় রিমি।
–‘স্যার, স্যার আপনি ঠিক আছেন?’
কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ারে বসেন হায়দার মবিন।
লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আরেকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকান তিনি। অশুভ আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অশুভ শক্তি নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকেও যথেষ্ট মনে হয়না মবিনের।
নিজেকে দারুন অসহায় মনে হয়।
এ মেয়েটির উপর যে অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে, কিভাবে এর মোকাবেলা করবেন তিনি?
এতো শক্তি কী তার আছে?
কিন্তু যুগে যুগে শুভ শক্তির কাছে অশুভ আত্মার যে পরাজয়ের ইতিহাস, হায়দার মবিন সে পরম্পরাকে নষ্ট হতে দিতে পারেন না।
ঘটনাচক্রে এই গুরু দায়িত্ব এখন হায়দার মবিনের কাঁধে এসে পড়েছে। পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক এই শক্তির মোকাবেলা তাকে করতেই হবে।
কাঁপা হাতে টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক নিশ্বাসে শেষ করেন হায়দার মবিন।
রিমির কাছ থেকে চেয়ে তার বাড়ির ঠিকানাটি লিখে নেন। আরেকটু পড়াশোনা করতে হবে, আরেকটু জানতে হবে।
হোমওয়ার্ক করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তবেই এই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হবেন হায়দার মবিন।
কদিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে বইপত্র ঘাটছেন মবিন সাহেব। আর নিয়মিত ধ্যানে বসছেন।
মনের একাগ্রতা খুবই জরুরি। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানষিক শক্তিই হচ্ছে প্রধান অস্ত্র।
সেদিনও বিকেলে লাইব্রেরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় নিজের ভেতর একটা তীব্র তাগিদ টের পান।
ভুতগ্রস্তের মতো ছুটে গিয়ে গাড়ির চাবিটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে পড়েন। গাড়িটারও যেন প্রাণ আছে।
স্টিয়ারিং হুইলটা নিজেই তাকে কোনো একটা লক্ষ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
নিয়তির হাতে নিজেকে সপে দিয়ে কাঠ হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকেন।
ঢাকার ব্যস্ত ট্রাফিক উপেক্ষা করে আশি মাইল গতিতে ছুটতে থাকে তার সাদা টয়োটা।
সময় নেই, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই পৌছাতে হবে।
মাথার ভেতর কে যেন ক্রমাগত ফিস ফিস করে কথাগুলো আউড়ে যায়।
রিমির দেওয়া ঠিকানাটা বাড়িতেই পড়ে থাকে। হায়দার মবিন বুঝতে পারেন, সেটির আর কোনো দরকার নেই।
প্রয়োজনই তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেবে।
…………
এই গল্পের সব পর্বের জন্য নীচের লিঙ্ক গুলোতে ক্লিক করুন —
কোব্বালা ( পর্ব- ৫ / শেষ পর্ব )